বাংলা কিচ্ছা (বাংলা কিসসা বা কেচ্ছা নামেও পরিচিত) বাংলা কবিতা এবং গদ্যের একটি ধারার পাশাপাশি মৌখিক গল্প-বর্ণনার বাংলা ভাষায় একটি ঐতিহ্য। স্থানীয় বাঙালি লোককাহিনী এবং আরব ও পারস্য-তুর্কী অভিবাসীদের গল্পের সংমিশ্রণে এটি বাংলায় সমৃদ্ধি লাভ করে।[১] এই জনপ্রিয় শিল্পটি গ্রামীণ বাংলাদেশের মুসলিম সম্প্রদায়ের মাঝে এখনও অবশিষ্ট রয়েছে।

কিচ্ছার মাধ্যমে মুসলমানদের মধ্যে প্রেম, বীরত্ব, সম্মান এবং নৈতিক অখণ্ডতার জনপ্রিয় কাহিনীর মাধ্যমে ইসলামী এবং/অথবা পারসী ঐতিহ্যের প্রতিফলন ঘটেছিল। এটি বাংলায় পৌঁছে ধর্মের গণ্ডিকে অতিক্রম করে আরও ধর্মনিরপেক্ষ রুপে পরিণত হয়েছিল এবং বিদ্যমান প্রাক ইসলামী সংস্কৃতির সাথে বাংলার সংস্কৃতি এবং এর সত্তার লোককাহিনী যুক্ত করেছিল।

ব্যুৎপত্তি এবং উচ্চারণ সম্পাদনা

কিসসা শব্দের উৎপত্তি আরবি শব্দ ক্বিসসা (قصة) থেকে, যার অর্থ মহাকাব্য কিংবদন্তি বা লোক কাহিনী। এটি ভারতীয় উপমহাদেশের অনেকগুলি ভাষাকে প্রভাবিত করেছে এবং এটি বাংলা, গুজরাটি, উর্দু এবং হিন্দি জাতীয় ইন্দো-আর্য ভাষা সমূহে নিয়মিত বিশেষ্য হিসাবে দেখা যায়। যদি সাধারণভাবে ব্যবহৃত হয় তবে শব্দটির অর্থ একটি আকর্ষণীয় গল্প বা উপকথা

ইতিহাস সম্পাদনা

কথিত আছে যে ১৫শ শতাব্দী থেকে কিচ্ছা বাংলায় প্রচুর জনপ্রিয়তা অর্জন করেছিল। বাঙ্গালী মোসলমান লেখকরা তাদের কিচ্ছায় প্রেম, যুদ্ধ, ধর্ম এবং বীরত্বের আরবী-পারসী বিষয়গুলি মিশ্রিত করতেন। কিচ্ছা লেখার জন্য দোভাষী নামে বাংলার একটি লিখিত রূপ একটি জনপ্রিয় মাধ্যম ছিল। এটি সুবাহ বাংলা এবং শাহী বাংলার (যা ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক বাংলার পূর্বে বিদ্যমান ছিল) সরকারী ফার্সি ভাষার শব্দভাণ্ডার দ্বারা ব্যাপক প্রভাবিত হয়েছিল। ঊনবিংশ শতাব্দীতে নিখিল বাংলা জুড়ে প্রচুর কিচ্ছা প্রকাশনা সংস্থা, বিশেষত বটতলায় ছাপাখানা প্রতিষ্ঠার আয়োজন করা হয়েছিল। হাওড়ায় মোসলমানী কিচ্ছা সাহিত্যের মতো সাহিত্য সমাজ প্রতিষ্ঠা করা হয়েছিল।[২] বিংশ শতাব্দীর শুরুতে অবশ্য কিচ্ছা এর জনপ্রিয়তা হারিয়ে ফেলে। যখন বিশুদ্ধ বাংলার (সাধু ভাষা) প্রাতিষ্ঠানিকীকরণ শুরু হয়, তখন দোভাষীর পাশাপাশি এটিও জনপ্রিয়তা হারিয়ে ফেলে। এর প্রমাণ পরবর্তীকালে মীর মোশাররফ হোসেনের কারবালার যুদ্ধ সম্পর্কে ঐতিহ্যবাহী পদ্ধতিতে লেখা কিচ্ছা বিষাদ সিন্ধু, যা তিনি ঊনিশ শতকের শেষভাগে দোভাষীর পরিবর্তে শুধুমাত্র সংস্কৃত সাধু ভাষায় লিখেছিলেন।[৩]

উল্লেখযোগ্যতা সম্পাদনা

বাঙ্গালী মোসলমান পরিবারে লিখিত বাঙ্গালী কিচ্ছা গৃহস্থালী সরঞ্জাম হয়ে ওঠেছিল। পঞ্চদশ শতাব্দী থেকে শাহ মুহম্মদ সগীরের ইউসুফ-জুলেখা মধ্যযুগীয় বাংলা সাহিত্যের সর্বশ্রেষ্ঠ রচনা হিসাবে বিবেচিত হত।[৪] চট্টগ্রামের বাহরাম খান লায়লা ও মজনুরর নিজস্ব সংস্করণ তৈরি করেছিলেন যাকে তিনি "লাইলী-মজনু" নামে অভিহিত করেন। সাতকানিয়ার নিকটবর্তী মুহাম্মদ ইয়ার খন্দকারের পুত্র কবি নওয়াজীশ খান গুলী বাকাওয়ালি লিখেছিলেন, এটি ছিল প্রেম সম্পর্কে এবং এতে পরীদের মতো প্রাণীদের অন্তর্ভুক্ত করেছিল। বর্ণিত গল্পের বিভিন্ন সংস্করণ বাংলার কবি লিখেছিলেন। অন্যান্য বিখ্যাত কিচ্ছার মধ্যে রয়েছে আমীর হামজা, মধুমালতী, শীরীন-ফরহাদ, তুতিনামা, হাতিম তায়ি, সখী সোনা, জঙ্গনামা, আলিফ-লায়লা ওয়া লায়লা এবং গুলে তরমুজ। উপর্যুক্ত তালিকা ব্যতীত উল্লেখযোগ্য লেখকদের মধ্যে সৈয়দ হামজা, নাসের আলী, রওশন আলী এবং ফকির গরীবুল্লাহ অন্তর্ভুক্ত ছিল।[১]

তথ্যসূত্র সম্পাদনা

  1. সিরাজুল ইসলাম (২০১২)। "কিসসা"ইসলাম, সিরাজুল; মিয়া, সাজাহান; খানম, মাহফুজা; আহমেদ, সাব্বীর। বাংলাপিডিয়া: বাংলাদেশের জাতীয় বিশ্বকোষ (২য় সংস্করণ)। ঢাকা, বাংলাদেশ: বাংলাপিডিয়া ট্রাস্ট, বাংলাদেশ এশিয়াটিক সোসাইটিআইএসবিএন 9843205901ওএল 30677644Mওসিএলসি 883871743 
  2. কুমার ব্যনার্জি, অমিয়া। West Bengal District Gazetteers। পৃষ্ঠা ৪৬২। 
  3. "Bishad Sindhu (Book II Chapter 4)"দ্য ডেইলি স্টার। ২৮ ফেব্রুয়ারি ২০১৫। সংগ্রহের তারিখ ৪ আগস্ট ২০১৬ 
  4. ওয়াকিল আহমদ (২০১২)। "ইউসুফ-জুলেখা"ইসলাম, সিরাজুল; মিয়া, সাজাহান; খানম, মাহফুজা; আহমেদ, সাব্বীর। বাংলাপিডিয়া: বাংলাদেশের জাতীয় বিশ্বকোষ (২য় সংস্করণ)। ঢাকা, বাংলাদেশ: বাংলাপিডিয়া ট্রাস্ট, বাংলাদেশ এশিয়াটিক সোসাইটিআইএসবিএন 9843205901ওএল 30677644Mওসিএলসি 883871743