বাংলা ইনপুট পদ্ধতি
বাংলা ইনপুট পদ্ধতি একটি টাইপরাইটার বা একটি কম্পিউটার কিবোর্ড ব্যবহার করে বাংলা ভাষার অক্ষর লিখার জন্য বিকশিত বিভিন্ন সিস্টেমের পদ্ধতিকে নির্দেশ করে।
ফিক্সড কম্পিউটার লেআউটসম্পাদনা
১৯৮০ সালে গ্রাফিক্যাল ইউজার ইন্টারফেস এবং ওয়ার্ড প্রসেসিংয়ের আবির্ভাব হলে, বাংলার জন্য বেশ কিছু সংখ্যক কম্পিউটার টাইপিং সিস্টেম তৈরি করা হয়েছিল। এর অধিকাংশই মূলত অ্যাপল ম্যাকিন্টোস সিস্টেমের উপর ভিত্তি করে করা হয়।
শহীদলিপিসম্পাদনা
শহীদলিপি কিবোর্ড কম্পিউটারে ব্যবহারের জন্য উন্নয়ন করা প্রথম লেআউট। ১৯৮৪ সালে সাইফুদ্দাহার শহীদ নামে একজন যন্ত্রকৌশলী ম্যাকিনটোশ কম্পিউটারের জন্য এই কিবোর্ড তৈরি করেন।[১] এটি মূলত QWERTY কিবোর্ডের উপর ফোনেটিকভিত্তিক লেআউট ছিল। বিজয় কিবোর্ড আসার পূর্ব পর্যন্ত এটি জনপ্রিয় ছিল। মূল লেআউটে প্রায় ১৮২টি বর্ণ ও যুক্তাক্ষর ছিল।
মুনীর কিবোর্ডসম্পাদনা
মুনীর-অপটিমা টাইপরাইটারে ব্যবহৃত বাংলা লেআউট থেকে মুনীর কিবোর্ডের উৎপত্তি। ১৯৬৫ সালে মুনীর চৌধুরী এই কিবোর্ডটি উন্নয়ন করেন।[১] তার এই কাজে তাকে সহায়তা করে পাকিস্তান কেন্দ্রীয় বাংলা উন্নয়ন বোর্ড। পরে জার্মানির একটি টাইপরাইটার কোম্পানির সাথে যৌথভাবে এই লেআউটটি টাইপরাইটারে ব্যবহৃত হয়, যা মুনীর-অপটিমা নামে পরিচিত ছিল।[২] এই টাইপরাইটার বাংলাদেশে সর্বাধিক প্রচলিত। তাই বিভিন্ন সফটওয়্যার প্রস্তুতকারক তাদের কিবোর্ড সফটওয়্যারে মুনীর-অপটিমার অনুরূপ লেআউট দেয়া শুরু করেন। পরে ইউনিকোডের সাথে সামঞ্জস্য রাখার জন্য একুশে কর্তৃক এই লেআউটের পরিমার্জনা করা হয়।
ইউনিজয় কিবোর্ডসম্পাদনা
একুশে কর্তৃক ইউনিজয় কিবোর্ডের উন্নয়ন করা হয়েছে। এটি m17n ডাটাবেজেও অন্তর্ভুক্ত।[৩]
জাতীয়সম্পাদনা
জাতীয় কিবোর্ড লেআউট বাংলাদেশ কম্পিউটার কাউন্সিল কর্তৃক প্রণীত একটি লেআউট, এটিকে প্রমিত লেআউট হিসেবে ধরা হয়।[১] এই লেআউটটি বাংলাদেশে অফিসিয়াল লেআউট হিসাবে ব্যবহৃত হয়।
বর্ণসম্পাদনা
বর্ণ, জায়েদ আহসান সা'দ কর্তৃক উন্নয়নকৃত একটি বাংলা সফটওয়্যার, যা ০৯ নভেম্বর ২০১৮ সালে মুক্তি পায়। এটা ইউনিকোডের সর্বশেষ ভার্সন সমর্থন করে। এতে ফিক্সড কিবোর্ড লেআউট ছাড়াও ফনেটিক লেআউটের সমর্থন রয়েছে। এর একটি বিশেষ বৈশিষ্ট হলো ফিক্সড লেআউটে বাংলা টাইপ করার সময় স্বয়ংক্রিয়ভাবে শব্দ আন্দাজ করতে পারে।
ইনস্ক্রিপ্টসম্পাদনা
এই কিবোর্ড লেআউট কম্পিউটারে একটি ইউনিফর্ম লেআউটসহ সব ইন্ডিক স্ক্রিপ্টে টাইপ করার জন্য নকশা করা হয়েছে। এই লেআউট অফিসিয়ালভাবে মাইক্রোসফট কর্পোরেশন কর্তৃক গৃহীত হয় এবং তাদের উইন্ডোজ অপারেটিং সিস্টেমে ডিফল্ট রূপে প্রদান করা হয়। এই লেআউটটি প্রধানত ভারতে বেশি জনপ্রিয়।
প্রভাতসম্পাদনা
একটি মুক্ত ইউনিকোড ভিত্তিক বাংলা ফিক্সড লেআউট। প্রভাত প্রায় সব লিনাক্স অপারেটিং সিস্টেম(গুলি) অন্তর্ভুক্ত করা হয়। এর কী ম্যাপিং ফোনেটিক প্যাটার্নের অনুরূপ কিন্তু টাইপিং পদ্ধতি সম্পূর্ণরূপে ফিক্সড বা সংশোধিত।
বিজয়সম্পাদনা
বিজয় কিবোর্ড এর লেআউটসহ মোস্তফা জব্বারের একটি ব্যক্তি মালিকানাধীন সফটওয়্যার। বাংলাদেশ কপিরাইট আইন ২০০৫ এর আওতায় এটি লাইসেন্স করা।[৪] বিজয় সফটওয়্যারটি প্রতি কম্পিউটারে ব্যবহার করার জন্য একটি লাইসেন্স ক্রয় করা আবশ্যক। ১৯৯৮ সালে বিজয় কিবোর্ড প্রথম ম্যাকিনটোশ কম্পিউটারের জন্য প্রয়োজনীয় সফওয়্যার এবং ফন্টসহ প্রকাশ করা হয়। মাইক্রোসফট উইন্ডোজ সংস্করণ প্রকাশ করা হয় ১৯৯৩ সালে। এর প্রথম সংস্করণ সম্ভবত ভারতে কোনো ভারতীয় প্রোগ্রামার দ্বারা উন্নয়ন করা হয়। বিজয় কিবোর্ডের পরবর্তী সংস্করণগুলো বাংলাদেশে আনন্দ কম্পিউটার্সের ডেভেলপার দ্বারা উন্নয়ন করা হয়; তাদের মধ্যে অন্যতম মুনিরুল আবেদিন পাপ্পানা যিনি বিজয় ৫.০ এর জন্য কাজ করেছেন, যা বিজয় ২০০০ নামে বেশি পরিচিত।[৫] বিজয় আসকি-ইউনিকোড ভিত্তিক বাংলা ইনপুট সফটওয়্যার। বিজয় কিবোর্ডের সাথে সরবারহকৃত সফটওয়্যারের মাধ্যমে কিছু স্বরবর্ণ লেখার পদ্ধতি ইউনিকোড থেকে আলাদা। ইউনিকোড ভিত্তিক অভ্র কিবোর্ড আসার আগে পর্যন্ত এটি বাংলাদেশে সবচেয়ে জনপ্রিয় কিবোর্ড ছিল।
বৈশাখীসম্পাদনা
পশ্চিমবঙ্গের (ভারত) ভাষা-প্রযুক্তি গবেষণা পরিষদ কর্তৃক বৈশাখী কিবোর্ডের উন্নয়ন করা হয়।[৬] ইউনিকোড সমর্থিত এই কিবোর্ড মূলত বিভিন্ন সরকারি কাজে ব্যবহৃত হয়। এছাড়া অধিকাংশ লিনাক্স ভিত্তিক অপারেটিং সিস্টেমে বৈশাখী লেআউট অন্তর্ভুক্ত থাকে।
ইউনি গীতাঞ্জলিসম্পাদনা
গীতাঞ্জলি নামের পুরাতন একটি বাংলা লেআউটকে ভাষা-প্রযুক্তি গবেষণা পরিষদ (পশ্চিমবঙ্গ) কর্তৃক ইউনিকোডের জন্য সামঞ্জস্য করে ইউনি গীতাঞ্জলি নামকরণ করা হয়।[৭] ভারতে বিভিন্ন সরকারি দপ্তরে এর ব্যবহার রয়েছে। এছাড়া বিভিন্ন লিনাক্স ভিত্তিক অপারেটিং সিস্টেম ইউনি গীতাঞ্জলি অন্তুর্ভুক্ত থাকে।
দিশাসম্পাদনা
দিশা লেআউট মূলত প্রভাত লেআউটের উপর ভিত্তি করে সায়ক সরকারের উন্নয়নকরা একটি ফোনটিক ধরনের লেআউট।[৮] অঙ্কুর গ্রুপের প্রস্তাবনায় এই লেআউটকে m17n ডাটাবেজে অন্তর্ভুক্ত করা হয়।[৯]
ফোনেটিক কম্পিউটার লেআউটসম্পাদনা
অক্ষর বাংলাসম্পাদনা
অক্ষর বাংলা সফটওয়্যার, খান মোঃ আনোয়ারুস সালাম কর্তৃক উন্নয়নকৃত, যা ১ জানুয়ারি ২০০৩ সালে মুক্তি পায়। অক্ষর প্রথম বাংলার জন্য বাংলা লিপ্যন্তর ব্যবস্থা প্রয়োগ করে। বিনামূল্যের ইউনিকোড/আনসি-ভিত্তিক অক্ষর কীবোর্ডে অক্ষর ফোনেটিক, জাতীয় ফিক্সড কিবোর্ড লেআউটের জন্য সমর্থন আছে। অক্ষরে এছাড়াও নির্দিষ্ট কিবোর্ড লেআউট নকশা জন্য স্বনির্ধারণ করার বৈশিষ্ট্য উপলব্ধ। এটি কিবোর্ড ব্যবস্থাপক প্রদান করে যা সিস্টেম জুড়ে কাজ করে এবং এছাড়াও স্বাধীন অক্ষর ওয়ার্ড প্রসেসর প্রদান করে।
অভ্রসম্পাদনা
অভ্র কী-বোর্ড ২৬ মার্চ ২০০৩ সালে মুক্তি পায়। এটিতে ফোনেটিক ও ফিক্সড উভয় লেআউট সুবিধা রয়েছে। ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজের শিক্ষার্থী ডাঃ মেহদী হাসান খান কর্তৃক অভ্র কীবোর্ডের বিকাশ শুরু হয়েছিল। ২৬ মার্চ ২০০৩ সালে বিনামূল্যে ডাউনলোডের জন্য এটি ওয়েবে প্রথম প্রকাশিত হয়। প্রথমদিকে, এটি ভিজ্যুয়াল বেসিকের মধ্যে বিকশিত হয়। এর লিনাক্স সংস্করণটি সি ++ ব্যবহার করে তৈরি হয়। প্রাথমিক ভাবে অভ্রের উন্নয়নে সরিম খান যুক্ত ছিলেন। বিনামূল্যে ইউনিকোড/আনসি-ভিত্তিক অভ্র কীবোর্ডে বর্ণনা, অভ্র ইজি, জাতীয়, অভ্র ফোনেটিক, মুনির এবং প্রভাত কিক্সড কিবোর্ড বিন্যাসের জন্য সমর্থন রয়েছে। প্লাস ইন হিসাবে ফিক্সড কিবোর্ড যোগ করা যায় এবং তা সরিয়েও ফেলা যায়। এটি সবচেয়ে জনপ্রিয় ও বহুল ব্যবহৃত বাংলা ইনপুট সিস্টেম।
অভ্র মাইক্রোসফট উইন্ডোজ, ম্যাক ওএস এক্স এবং লিনাক্স ডিস্ট্রিবিউশনে একটি স্থানীয় আইএমই হিসাবে উপলব্ধ। এটি ফায়ারফক্স ওএস-এর ডিফল্ট বাংলা ইনপুট পদ্ধতি হিসাবে যুক্ত আছে।
গুগল ইনপুট সরঞ্জামসম্পাদনা
গুগল দ্বারা উন্নত করা ইনপুট সরঞ্জাম, ওয়েব এনড্রয়েড ও মাইক্রোসফট উইন্ডোজ-র জন্য উপলব্ধ।[১০]
অঙ্কুরসম্পাদনা
অঙ্কুর, রাইয়ান কবির দ্বারা উন্নয়নকৃত এবং প্রথম মুক্তি পায় ৩০শে মার্চ ২০১১ সালে। এই ম্যাক ওএসের জন্য উন্নত প্রথম ফনেটিক ইনপুট পদ্ধতি।[১১]
মোবাইলসম্পাদনা
আইওএসসম্পাদনা
আইফোন এবং আইপ্যাড এ আইওএস ৮.০ সংস্করণ থেকে বাংলা ইনপুট পূর্বনির্ধারিতভাবে উপলবদ্ধ রয়েছে।
অ্যান্ড্রয়েডসম্পাদনা
অ্যান্ড্রয়েডে বিভিন্নরকম বাংলা ইনপুট সফ্টওয়্যার রয়েছে।
- গুগল ইন্ডিক কিবোর্ড
- বর্ণ কিবোর্ড
- রিদ্মিক কিবোর্ড
- ওপেনবোর্ড
- অভ্রয়েড কিবোর্ড
- পার্বতী কিবোর্ড
- মায়াবী কিবোর্ড
- আজন্ম কিবোর্ড
- ইন্ডিক কিবোর্ড
তথ্যসূত্রসম্পাদনা
- ↑ ক খ গ "যন্ত্রে যন্ত্রে বাংলা"। প্রথম আলো। ১৮ ফেব্রুয়ারি ২০১৯। সংগ্রহের তারিখ ১৬ জানুয়ারি ২০২২।
- ↑ "What We've Lost"। The Daily Star (ইংরেজি ভাষায়)। ২০১০-০৪-২৮। সংগ্রহের তারিখ ২০২০-০৭-০৭।
- ↑ "The m17n Library: Data provided by the m17n database"। www.nongnu.org। সংগ্রহের তারিখ ২০২০-০৭-০৭।
- ↑ জব্বার, মোস্তফা (নভেম্বর ২০১৫)। বাংলা শব্দ বিন্যাস ও বিজয় নির্দেশিকা। ঢাকা: আনন্দ কম্পিউটার্স। পৃষ্ঠা ২।
- ↑ "An amazing journey from Shahid Lipi to Avro"। The Daily Star। সংগ্রহের তারিখ ২০১৯-১২-২৮।
- ↑ "Baishakhi Bengali Keyboard - Free | Unicode 6.3 Standard"। baishakhi.org। সংগ্রহের তারিখ ২০২০-০৭-০৭।
- ↑ "Development of Technology and Tools"। www.nltr.org। ২০১৮-০৫-০৭ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ২০২০-০৭-০৭।
- ↑ "Disha by sayak-sarkar"। sayak.in। সংগ্রহের তারিখ ২০২০-০৭-০৭।
- ↑ "[m17n-list] m17n Based Visual Input System: bn-disha"। lists.nongnu.org। সংগ্রহের তারিখ ২০২০-০৭-০৭।
- ↑ "ইনপুট সরঞ্জাম"। google.com। সংগ্রহের তারিখ ৯ জুন ২০১০।
- ↑ "বাংলা আমার প্রাণ"। Bangla-অঙ্কুর।