বরুণ বিশ্বাস (১২ সেপ্টেম্বর, ১৯৭২ – ৫ জুলাই, ২০১২) ছিলেন একজন ভারতের পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের উত্তর চব্বিশ পরগণা জেলার সুটিয়া অঞ্চলের অধিবাসী এক বাঙালি স্কুলশিক্ষক ও সমাজকর্মী। ২০০০ সালে সুটিয়া অঞ্চলে অপরাধমূলক কাজকর্ম ও গণধর্ষণের ঘটনার প্রতিবাদে গঠিত সুটিয়া গণধর্ষণ প্রতিবাদ মঞ্চের তিনি ছিলেন সহ-প্রতিষ্ঠাতা।[১] ২০১২ সালের ৫ জুলাই তাকে গুলি করে হত্যা করা হয়। ২০১৩ সালে প্রলয় (চলচ্চিত্র) টি নির্মিত হয় তার জীবন ও কর্মকে ভিত্তি করে।[১][২] এছাড়াও 'প্রলয় আসছে' নামক একটি টেলিসিরিয়াল নির্মিত হয় ২০১১ সালে যার কিছুটা অংশ বরুন বিশ্বাসের জীবনের ছায়ায় নির্মিত।

বরুণ বিশ্বাস
জন্ম(১৯৭২-০৯-১২)১২ সেপ্টেম্বর ১৯৭২
সুটিয়া, পশ্চিমবঙ্গ, ভারত
মৃত্যু৫ জুলাই ২০১২(2012-07-05) (বয়স ৩৯)
সুটিয়া, পশ্চিমবঙ্গ, ভারত
মৃত্যুর কারণগুলিবিদ্ধ হয়ে মৃত্যু
জাতীয়তাভারতীয়
পেশাস্কুলশিক্ষক, সমাজকর্মী
পরিচিতির কারণপশ্চিমবঙ্গের সুটিয়া অঞ্চলে গণধর্ষণের প্রতিবাদ

জীবন ও কর্মজীবন সম্পাদনা

১৯৭২ সালের ১২ সেপ্টেম্বর পশ্চিমবঙ্গের চব্বিশ পরগনা জেলার (অধুনা উত্তর চব্বিশ পরগনা জেলা) সুটিয়ায় বরুণ বিশ্বাসের জন্ম। ১৯৭১ সালে তার বাবা-মা জগদীশ বিশ্বাস ও গীতা বিশ্বাস বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় বাংলাদেশের (তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান) ফরিদপুর থেকে চব্বিশ পরগনা জেলার পাঁচপোতার আচারিপাড়ায় চলে এসেছিলেন।[৩] জগদীশ বিশ্বাস তার সন্তানদের লেখাপড়ার জন্য দিনে মজুরের কাজ করে ও রাতে স্থানীয় যাত্রাদলে গান গেয়ে জীবিকানির্বাহ করতেন।[১]

বরুণ বিশ্বাস পাঁচপোতা ভরাডাঙা হাই স্কুল ও খাতরা বয়েজ হাই স্কুলে পড়াশোনা করেন। তারপর গোবরডাঙ্গা হিন্দু কলেজ থেকে বাংলায় স্নাতক ডিগ্রি অর্জন করেন। তারপর কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি ও নিউ ব্যারাকপুরের বি. টি. কলেজ থেকে বি.এড ডিগ্রি অর্জন করেন।[১][৩][৪]

শিক্ষা শেষ করার পর বরুণ বিশ্বাস পশ্চিমবঙ্গ সিভিল সার্ভিস (WBCS) পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন কিন্তু সমাজসেবা ও শিক্ষকতার জীবন বেছে নেন। ১৯৯৮ সালে তিনি কলকাতার মিত্র ইনস্টিটিউশনে (মেন) স্কুলশিক্ষক হিসেবে কাজে যোগ দেন। মৃত্যুর সময় পর্যন্ত তিনি সেখানেই শিক্ষকতা করেছিলেন।[১][৩][৪]

কাজকর্ম সম্পাদনা

ইছামতী ও জল সম্পাদনা

২০০০ সালে বরুণ বিশ্বাস ইছামতী নদীযমুনা নদীর বন্যা নিবারণের জন্য একটি খাল তৈরির জন্য আন্দোলন শুরু করেন। এই দুই নদী সুটিয়া বনগাঁ, স্বরূপনগরগাইঘাটা অঞ্চলে বন্যার কারণ হত। বরুণ বিশ্বাস খালের একটি নকশাও তৈরি করেন। প্রথম দিকে স্থানীয় রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ তার এই পরিকল্পনা নিয়ে বিশেষ আগ্রহ প্রকাশ না করলেও শেষ পর্যন্ত সরকার প্রস্তাবিত খালটি তৈরি করে।[১] নিজেদের ব্যবসার স্বার্থে ইছামতী নদীর গতি রুদ্ধ করে ও গতিপথ পরিবর্তিত করছিল একটি দল। এর ফলে গ্রামে বন্যা দেখা দিচ্ছিল। এই দলের বিরুদ্ধেও বরুণ বিশ্বাস আন্দোলন শুরু করেন।[১][২][৩]

২০০০–২০১২: ধর্ষণ-বিরোধী কর্মসূচি সম্পাদনা

১৯৯০-এর দশকের শেষ দিকে এবং ২০০০-এর দশকের গোড়ার দিকে সুটিয়া ও পার্শ্ববর্তী গ্রামগুলিকে একদল দুষ্কৃতিদের দৌরাত্ম্য বৃদ্ধি পেয়েছিল। ২০০০–২০০২ সালের মধ্যে ৩৩টি ধর্ষণ ও ১২টি খুনের ঘটনা ঘটেছিল সুটিয়ায়। বরুণ বিশ্বাস একদল গ্রামবাসীদের নিয়ে এই জঘন্য অপরাধের বিরুদ্ধে আন্দোলন শুরু করেন এবং অপরাধীদের গ্রেফতার করার দাবি জানাতে থাকেন। ২০০০ সালে মাত্র ২৮ বছর বয়সে তিনি অন্যান্যদের সঙ্গে "সুটিয়া গণধর্ষণ প্রতিবাদ মঞ্চ" গঠন করেন। এই মঞ্চ ধর্ষণের প্রতিবাদে জনসভার আয়োজন করতে শুরু করে। এমনই একটি সভায় বরুণ বিশ্বাস বলেছিলেন:

আমরা যদি আমাদের মা, বোন, স্ত্রী ও মেয়েদের নিরাপত্তা দিতে না পারি, তবে আমরা সভ্য সমাজে বাস করার যোগ্য নই। আমাদের যদি ধর্ষণকারীদের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোর সাহস না থাকে, তাহলে আমাদের তাদের থেকেও বেশি শাস্তি পাওয়া উচিত... তাই আসুন, আমাদের সঙ্গে যোগ দিয়ে আমাদের মহিলাদের সম্মান রক্ষা করুন।[১]

বরুণ বিশ্বাসের দল ধর্ষিতাদের পুলিশে খবর দিতে সাহায্য করত, যাতে অপরাধীরা ধরা পরে। এর ফলে দলের নেতা সুশান্ত চৌধুরী ধরা পড়ে। বরুণ বিশ্বাস ধর্ষিতা মহিলাদের সঙ্গে কথা বলে তাদের মানসিক শক্তিও যোগাতেন।[১][২][৩]

মৃত্যু সম্পাদনা

আমি ছেলে-হারানো এক গর্বিত মা। আমার ছোটোছেলে বরুণ মৃত্যুভয়ের সামনে দাঁড়িয়েও কখনও পিছু হটেনি। যেদিন পর্যন্ত প্রতিবাদী মঞ্চ সবরকম দুষ্কর্মের বিরুদ্ধে সোচ্চার থাকবে, সেদিন পর্যন্ত আমার ছেলে অমর থাকবে। বরুণ ছিল, বরুণ আছে, বরুণ থাকবে।

—গীতা বিশ্বাস (বরুণ বিশ্বাসের মা) একটি সাক্ষাৎকারে[৪]

২০১২ সালের ৫ জুলাই সন্ধ্যা ৭টা ২০ মিনিটে কলকাতা থেকে ফেরার পথে গোবরডাঙা রেল স্টেশনের বাইরে পার্কিং লটে বরুণ বিশ্বাসকে পিছন থেকে গুলি করে হত্যা করা হয়। এরপরই হাবরা, গাইঘাটা ও গোপালনগর থানার পুলিশ সুটিয়া অপরাধী চক্রের পাঁচ জনকে গ্রেফতার করে। এদের মধ্যে ছিল অভিযুক্ত ভাড়াটে খুনি সুমন্ত দেবনাথ ওরফে ফটকে, দেবাশিষ সরকার, বিশ্বজিৎ বিশ্বাস ও রাজু সরকার। এদের বেশিরভাগই স্থানীয় ছাত্র। এরা পুলিশের কাছে স্বীকার করে যে দমদম কেন্দ্রীয় সংশোধনাগারে যাবজ্জীবন কারাদণ্ডপ্রাপ্ত বন্দী সুশান্ত চৌধুরীর নির্দেশে তারা বরুণ বিশ্বাসকে খুন করেছে।[৩]

উত্তরাধিকার সম্পাদনা

২০১৩ সালের অগস্ট মাসে বরুণ বিশ্বাসের জীবন-ভিত্তিক বাংলা চলচ্চিত্র প্রলয় মুক্তি পায়। এই ছবিতে অভিনেতা পরমব্রত চট্টোপাধ্যায় বরুণ বিশ্বাসের ভূমিকায় অভিনয় করেন।[৪]

২০১৩ সালেই দুর্গাপূজার সময় পাঁচপোতা অভিযান সংঘ দুর্গাপূজা কমিটি বরুণ বিশ্বাসের জীবন ও আন্দোলনকে তাদের পূজার থিম নির্বাচন করে। তারা তাদের পূজার মঞ্চটির নাম রাখে "বরুণ মঞ্চ"। পূজা কমিটির যুগ্মসচিব মানবেন্দ্র বিশ্বাস জানান—[৫]

সুটিয়ার পাঁচপোতা বরুণের মামাবাড়ি। এখানেই সে ছোটোবেলা কাটিয়েছে। ধর্ষণকারী ও অপরাধীরা কার্যত সুটিয়ার শাসক হয়ে উঠেছিল। সুটিয়া প্রতিবাদী মঞ্চের সাহায্যে সে গ্রামবাসীদের তাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে সাহায্য করত... এই দুর্গাপূজা দুর্গার মহিষাসুর বধ এবং অপশাসনের বিরুদ্ধে বরুণের জয়ের প্রতীক হিসেবে পালিত হয়েছে।

পাদটীকা সম্পাদনা

  1. "Barun Biswas: An unsung hero"The Times of India। ১৫ জুলাই ২০১২। ৯ জুলাই ২০১৩ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ৯ আগস্ট ২০১৩ 
  2. "The amazing story of Barun Biswas"The Times of India। ১৫ জুলাই ২০১২। ৭ এপ্রিল ২০১৩ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ৯ আগস্ট ২০১৩ 
  3. "Man who gave the poor a voice now silenced"Indian Express। ১১ জুলাই ২০১২। সংগ্রহের তারিখ ৯ আগস্ট ২০১৩ 
  4. "Mother says Parambrata in Proloy looks exactly like Barun Biswas"The Times of India। ৯ আগস্ট ২০১৩। সংগ্রহের তারিখ ৯ আগস্ট ২০১৩ 
  5. "Theme for Puja dream"। The Times of India। ২২ সেপ্টেম্বর ২০১৩।