বরগুনা গণহত্যা
বরগুনা গণহত্যা হলো ১৯৭১ সালের ২৯ ও ৩০ মে পাকিস্তানি বাহিনী কর্তৃক বরগুনা মহাকুমা জেলে নিরস্ত্র কয়েদিদের উপর চালানো গণহত্যা। এই নৃশংস হত্যাকান্ডে একশ জনের বেশি মানুষ নিহত হয়।[১] তাদের মধ্যে বাহাত্তর জনের পরিচয় জানা যায়নি, নিহতদের বেশিরভাগই ছিল বাঙালি হিন্দু অথবা মুসলিম এবং আওয়ামী লিগের সদস্য বা স্বাধীন বাংলাদেশের সমর্থক। ১৯৯২ সালে একটি মার্বেল ফলক দিয়ে একটি স্মৃতিসৌধ নির্মিত হয়েছিল যেখানে নিহত ৭২ জন এবং অন্যত্র মারা যাওয়া ছয় জনের নাম রয়েছে। [২]
বরগুনা গণহত্যা | |
---|---|
স্থান | বরগুনা, পটুয়াখালী জেলা, বাংলাদেশ |
তারিখ | ২৯-৩০ মে, ১৯৭১ (ইউটিসি+৬.০০) |
লক্ষ্য | বাঙালি (হিন্দু ও মুসলিম) |
ব্যবহৃত অস্ত্র | আগ্নেয়াস্ত্র |
নিহত | ১০০ জনেরও বেশি |
হামলাকারী দল | পাকিস্তান সেনাবাহিনী, শান্তি কমিটি |
পটভূমি
সম্পাদনা১৯৬৯ সালে পটুয়াখালী জেলা পূর্ব বাকেরগঞ্জ জেলা থেকে আলাদা করা হয়েছিল। পটুয়াখালী জেলা পটুয়াখালী সদর এবং বরগুনা মহকুমার সমন্বয়ে গঠিত হয়। ১৯৭১ সালের ২৫ এপ্রিল পাকিস্তান সশস্ত্র বাহিনী বরিশাল দখল করতে বরিশালে অপারেশন শুরু করে। ২৬শে এপ্রিল তারা পটুয়াখালী জেলা শহর দখল করে। ৬ পাঞ্জাব রেজিমেন্টের মেজর রাজা নাদির পারভেজ খান পটুয়াখালী জেলার সামরিক আইন প্রশাসক হিসাবে নিযুক্ত হন।
১৪ ই মে -তে পাকিস্তান সশস্ত্র বাহিনী একটি গানবোটে বরগুনায় এসে শহরটির নিয়ন্ত্রণ নিয়েছিল। ১৫ ই মে তারা পাথরঘাটার কিছু বাসিন্দাকে বন্দী করে বরগুনায় নিয়ে আসে। বন্দীদের কয়েকজনকে বিশখালীর তীরে হত্যা করা হয়েছিল বাকি সবাই বরগুনা মহকুমা কারাগারে বন্দী ছিল। পাথরঘাটার একজন প্রখ্যাত বাঙালি হিন্দু ব্যবসায়ী লক্ষ্মণ দাস এবং তার তিন ছেলে কারাগারে বন্দী ছিলেন। এরপরে পাকিস্তান সশস্ত্র বাহিনী পটুয়াখালীর উদ্দেশ্যে রওনা হয়।
পাকিস্তান সশস্ত্র বাহিনী বরগুনা ত্যাগ করার পরে, পিস কমিটির সদস্যরা ঘোষণা করল যে এখন হিন্দুরা শহরে ফিরে আসতে পারে। বর্ণ হিন্দু ব্যতীত তাদের কাউকে হত্যা করা হবে ন।[৩] শান্তি কমিটির কাছ থেকে আশ্বাস পাওয়ার পরে অনেক বাঙালি হিন্দু বরগুনায় তাদের বাড়িতে ফিরে এসেছিল। পরিষেবাধারীরা তাদের অফিসে যোগ দিলেন, অন্যরা তাদের দোকান খুললেন।
হত্যাকাণ্ড
সম্পাদনাবরগুনাবাসীর জন্য রক্তাক্ত স্মৃতি বিজড়িত দুটো দিন ২৯ ও ৩০ মে। একাত্তরে এ দুটি দিনে বরগুনা জেলখানায় আটককৃত নিরীহ বাঙ্গালীদের গুলি করে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়। বরগুনা শহরের পৌর এলাকার শহীদ স্মৃতি সড়কের পাশে শহীদদের গণকবর যেখানে বরগুনার মুক্তিকামী মানুষদের মাটি চাপা দেয়া হয়েছে। ১৯৯২ সনে সেখানে একটি স্মৃতি সৌধ নির্মাণ করা হয়েছে। স্মৃতি সৌধের শ্বেত পাথরে লেখা রয়েছে শহীদদের নাম। মুক্তিযোদ্ধারা বরগুনা ছেড়ে লোকালয়ে যাবার সুযোগে মুসলিমলিগ, জামায়াত ও অন্যান্য পাকিস্তানপন্থীরা বরগুনা শহর দখল করে এবং পাক-বাহিনীকে বরগুনা নিয়ে আসে। তখন বরগুনা শহর ছিল প্রায় জনমানবহীন। এসডিও’র জেটিতে পাক-বাহিনী পজিশন নিয়ে কোর্ট বিল্ডিং এলাকায় কিছু লোক জড়ো করে ভাষণ দেয়। পরের দিন ১৫ মে পাথরঘাটা থানার বেশ কয়েকজনকে ধরে এনে বিষখালী নদীর তীরে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়। সেদিন মুক্তিযোদ্ধাদের আহাজারী ও স্বজন হারাদের কান্নায় আকাশ বাতাস ভারী হয়ে ওঠে। বিষখালী নদীর পানি রক্তে লাল হয়ে গিয়েছিল। আর এ হত্যাকান্ডে নেতৃত্ব দিয়েছিল, পটুয়াখালী জেলা সামরিক আইন প্রশাসক মেজর নাদের পারভেজ। এসময় পাথরঘাটার বিশিষ্ট ব্যবসায়ী লক্ষন দাস, তার ছেলে কৃষ্ণ দাস, অরুন দাস ও স্বপন দাসকে ধরে এনে বরগুনা কারাগারে আটক রাখা হয় এবং মুক্তিযুদ্ধের স্বপক্ষে অবস্থানের কারণে সাবেক সিও আতিকুল্লাহ, এস আই আবদুল মজিদ, সিপাহী আড়ি মিয়া ও আবদুল জববার এবং বরগুনার সিদ্দিকুর রহমান (পনু) চেয়ারম্যানকে পটুয়াখালী নিয়ে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়।
২৮ মে পটুয়াখালী জেলা সামরিক আইন প্রশাসক মেজর নাদের পারভেজ বরগুনায় আসে এবং ২৯ মে বরগুনা জেলখানায় প্রহসনমূলক বিচারের ব্যবস্থা করে গণহত্যা শুরু করে। জেলখানার উত্তর-পশ্চিম পাশে বরগুনা জেলা স্কুল অবস্থিত। প্রতিদিনের ন্যায় সেদিনও ছাত্ররা স্কুলে এসেছিল। ক্লাস শুরুর ঘণ্টা বাজার সাথে সাথেই প্রচন্ড গুলির শব্দে শহরময় আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে, সবাই দিক-বিদিক ছুটোছুটি শুরু করে দেয়। বরগুনা জেলখানায় গুলিবিদ্ধ হয়ে তখন একের পর এক মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ে। প্রথম দিন তারা ৫৫ জনকে হত্যা করেছিল। অনেকে সেদিন গুলি খেয়ে অচেতন অবস্থায় পড়ে রয়েছিল। কিন্তু তাদেরও শেষ রক্ষা হয়নি। পরের দিন আবারও ১৭ জনকে গুলি করে হত্যা করা হয়। এ জেলায় মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন মীর মোশারেফ হোসেন,নায়েক মোঃ আলতাফ হোসেন,নগেন্দ্রনাথ ধুপী,নাসিরউদ্দিন তাং,এম.এ.বারেক খান,মজিবর রহমান কনক,আলী আহমদ খান,আলাউদ্দিন সহ অনেক মুক্তিযোদ্ধা সম্মুখ যুদ্ধে শহীদ হন।[৪]
ফলাফল
সম্পাদনাবেঁচে থাকা অনেককে পটুয়াখালীতে নিয়ে গিয়ে হত্যা করা হয়। পরবর্তী সময়ে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে কারাগারে অনেক লোক নিহত হয়েছিল। ডাঃ এম.এ. হাসানের মতে, মহকুমার পাথরঘাটা, আমতলী, বেতাগী ও বামনা এলাকায় হাজার হাজার নিরীহ মানুষকে পাকিস্তান সশস্ত্র বাহিনী হত্যা করেছিল। তবে তৎকালীন বরগুনা মহকুমায় বা বর্তমান বরগুনা জেলাতে মোট মৃত্যুর সংখ্যা সম্পর্কে কোনও খাঁটি তথ্য পাওয়া যায় না। গণহত্যার শিকার ব্যক্তিরা বাংলাদেশ সরকার মুক্তিযুদ্ধের শহীদ হিসাবে সরকারিভাবে স্বীকৃতি পেয়েছে।
তথ্যসূত্র
সম্পাদনা- ↑ মনির হোসেন কামাল (২০১২)। "বরগুনা জেলা"। ইসলাম, সিরাজুল; মিয়া, সাজাহান; খানম, মাহফুজা; আহমেদ, সাব্বীর। বাংলাপিডিয়া: বাংলাদেশের জাতীয় বিশ্বকোষ (২য় সংস্করণ)। ঢাকা, বাংলাদেশ: বাংলাপিডিয়া ট্রাস্ট, বাংলাদেশ এশিয়াটিক সোসাইটি। আইএসবিএন 9843205901। ওএল 30677644M। ওসিএলসি 883871743।
- ↑ Kamal, Monir Hossain (২৯ মে ২০১২)। "২৯ ও ৩০ মে বরগুনা গণহত্যা দিবস"। amaderbarisal.com (Bengali ভাষায়)। Barisal। ২ অক্টোবর ২০১৫ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ২৮ ডিসেম্বর ২০১৪।
- ↑ Das, Shankar Lal (৫ এপ্রিল ২০১৪)। "বরগুনার গণহত্যা ॥ শহীদ স্বজনদের যন্ত্রণা"। The Daily Janakantha (Bengali ভাষায়)। Dhaka। ২০১৬-০৩-০৩ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ২৮ ডিসেম্বর ২০১৪।
- ↑ "বরগুনা জেলা"
|ইউআরএল=
এর মান পরীক্ষা করুন (সাহায্য)। http (ইংরেজি ভাষায়)। সংগ্রহের তারিখ ২০১৯-০৯-২৩।[স্থায়ীভাবে অকার্যকর সংযোগ]