ফ্রিডম ফ্রম ফিয়ার (চিত্রকর্ম)

ফ্রিডম ফ্রম ফিয়ার হল মার্কিন চিত্রশিল্পী নরম্যান রকওয়েল কর্তৃক সৃষ্ট জনপ্রিয় ফোর ফ্রিডমস তৈলচিত্রের শেষটি। সিরিজটি জানুয়ারি ৬,১৯৪১ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রপতি  ফ্রাঙ্কলিন ডি. রুজভেল্ট কর্তৃক প্রদেয় ফোর ফ্রিডমস নামে বিবৃত চারটি লক্ষের উপর ভিত্তি করে তৈরি। মার্চ ১৩, ১৯৪৩ সালে দ্যা সেটারডে ইভিনিং পোস্ট -এ সেসময়ের  বিশিষ্ট চিন্তাবিদ স্টিফেন ভিনচেন্ট বেনেটের প্রবন্ধ এর সাথে সিরিজের এই কর্মটি প্রকাশিত হয়েছিল। চিত্রকর্মটি সাধারণত দ্যা ব্লিটজ (দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে নাজি জার্মানি কর্তৃক যুক্তরাজ্যের উপর বোমাহামলা) এর সময় অভিভাবক কর্তৃক  শিশুদের ঘুম পারানো হচ্ছে তা বুঝানো হয়।

নরমান রকওয়েল কর্তৃক অঙ্কিত ফ্রিডম ফ্রম ফিয়ার হল দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়ে বেসামরিক জনশক্তিকে অনুপ্রাণিত করতে যুদ্ধকালীন পোস্টার

নেপথ্য কথা সম্পাদনা

ফ্রিডম ফ্রম ফিয়ার সিরিজের চারটি তৈলচিত্রের মধ্যে সর্বশেষ। ফোর ফ্রিডমস চিত্র চারটি অঙ্কন করেছিলেন নরম্যান রকওয়েল। তৈলচিত্রগুলো অঙ্কনের ক্ষেত্রে অনুপ্রেরণা ছিলো স্টেট অফ দ্য ইউনিয়ন অ্যাড্রেসে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ফ্র্যাঙ্কলিন ডি. রুজভেল্টের বক্তব্য। ৭৭তম ইউনাইটেড কংগ্রেসে তিনি এ বক্তব্য রাখেন। দিনটি ছিলো ৬জানুয়ারী ১৯৪১।[১] পরবর্তীতে এদের আটলান্টিক চার্টার গ্রহণ করে।[২][৩] জাতিসংঘের চার্টারের একটি অংশে পরিণত হয়ে এটি। এই চিত্রকর্মের সিরিজটি দ্য স্যাটারডে ইভনিং পোস্ট-এ প্রকাশিত হয়। [১] পর পর চার সপ্তাহে প্রখ্যাত লেখকদের রচনার সঙ্গে ছবিগুলো যুক্ত করে প্রকাশ করে পত্রিকাটি।ফ্রিডম অফ স্পিচ(২০ ফেব্রুয়ারি), ফ্রিডম অফ ওরশিপ(২৭ ফেব্রুয়ারি), ফ্রিডম ফ্রম ওয়ান্ট(৬ মার্চ) এবং ফ্রিডম ফ্রম ফিয়ার(১৩ মার্চ). ফলশ্রুতিতে, এই সিরিজটি ব্যাপকহারে ছড়িয়ে পড়লো, পোস্টাকারে প্রকাশিত হলো তারা। ইউএস গভার্নমেন্ট ওয়ার বন্ড ড্রাইভে সহায়ক হিসেবে তাদের ব্যবহার করা হয়।


দ্যা ব্লিটজ হল দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় জার্মানি দ্বারা যুক্তরাজ্যে চলমান কৌশলগত বিমান আক্রমণকাল। ৭ই সেপ্টেম্বর ১৯৪০ এবং ২১শে মে ১৯৪১ এর মধ্যে ১৬ ব্রিটিশ শহরের উপর বড় ধরনের বিমান আক্রমণ হয়েছিল। ৭ই সেপ্টেম্বর ১৯৪০ থেকে শুরু করে ক্রমাগত ৫৭ টি রাত লুফটওয়াফে লন্ডনের ওপর বোমাবর্ষণ করেছিল।[৪] লন্ডনের একলক্ষের অধিক ঘর বাড়ি ক্ষতিগ্রস্ত বা ধ্বংস হয়ে গিয়েছিল এবং ৪০,০০০ এরও অধিক বেসামরিক লোক নিহত হয়েছিল, যাদের প্রায় অর্ধেক হয়েছিল লন্ডনে।[৫]

বর্ণনা সম্পাদনা

চিত্রকর্মটি শিশুদের এই বিশ্বের বিপদসমুহ না জেনে নিরাপদে তাদের বিছানায় শয়ন প্রদর্শন করে যেখানে পিতা-মাতা তাদের দিকে চেয়ে থাকে। মা যখন তাদের ঘুম পাড়াচ্ছে তখন বাবা একটি সংবাদপত্র ধরে আছে যেখানে যুদ্ধের বিষাদ বর্ণিত আছে।কিন্তু বাবার দৃষ্টি সম্পূর্ণরূপে তার সন্তানদের উপর, ভীতিপদ খবরগুলোর উপর নয়। যদিওবা চিত্রকর্মটি সাধারণত দ্যা ব্লিটজ এর সময় পিতামাতা কর্তৃক আমেরিকান শিশুদের ঘুম পারানো হচ্ছে তা বুঝানো হয়েছে, কিন্তু শিশুরা ইতোমধ্যেই ঘুমিয়ে পড়েছে। পিতামাতা ঘুমিয়ে পড়ার আগে সন্তানদেরকে তাদের সংকীর্ণ বিছানায় দেখতে এসেছে। মাকে বিছানার চাদর ঠিক করতে দেখা যায়। বাবা "ক্লাসিক রকওয়েল অনলুকার" হিসাবে প্রদর্শিত হয়েছে, যে কিনা চিত্রকর্মে দর্শকের ভূমিকা পালন করে। যেহেতু তিনি তার চশমা ধরে আছেন, তাই আমরা অনুমান করি যে তিনি তার হাতের বেনিংটন ব্যানার পড়া শেষ করেছেন। সংবাদ পত্রটির শিরোনাম "Bombings Ki ... Horror Hit", যা কিনা বিমান আক্রমণকে নির্দেশ করে।[৬] পেছনে দরজার সাথে সংযোগকারী হলওয়ে ও সিঁড়ি রয়েছে।[৬]

রকওয়েল কাজটির তেমন যত্ন নেননি। তার মতে ছবিটা একটি সোজা ধারণা থেকে আঁকা হয়েছে। লন্ডনে বোমাবর্ষণের সময় আঁকা ছবিটা বোঝাতে চেয়েছে " ধন্যবাদ ঈশ্বর, আমরা আমাদের সন্তানদের নিরাপত্তা ও এ অনুভূতি দিয়ে ঘুম পাড়াতে পেরেছি যে তারা জানে রাতে তাদের হত্যা করা হবে না।"[৭]

সৃজন সম্পাদনা

এই চিত্রকর্মের জন্য মডেল হয়েছিলেন জিম মার্টিন, মিস এডগার লরেন্স (ডরোথি)[৮], এবং রকওয়েলের ছুতার ওয়াল্ট স্কয়ারসের দুই সন্তান।সবাই ছিলেন ওলিংটন, ভারমন্টে রকওয়েলের প্রতিবেশী।[৯] রকওয়েলের অনুরোধে এই কাজে ব্যবহারের জন্য বেনিংটন ব্যানার একটি প্রতীকী সংস্করণ প্রস্তুত করেছিল।[৮] মার্চ ১৩, ১৯৪৩ সালে দ্যা সেটারডে ইভিনিং পোস্টে স্টিফেন ভিনচেন্ট বেনেটের প্রবন্ধের সাথে সিরিজের এই চিত্রকর্মটি প্রকাশিত হয়েছিল। [১০] কাকতালীয়ভাবে যেদিন এটা প্রকাশিত হয়েছিল সেদিন কবি,ঐপন্যাসিক এবং ছোট-গল্প লেখক বেনেট মারা গিয়েছিলেন। [১১]

ইতিহাস সম্পাদনা

"চতুর্থটি হল ফ্রিডম ফ্রম ফিয়ার- বৈশ্বিক পরিভাষায় যার অর্থ দাঁড়ায়, বিশ্ব পরিসরে এমন এক পর্যায় পর্যন্ত এবং এমন এক উপায়ে যুদ্ধোপকরণ হ্রাস পায় যেন কোন জায়গার কোন দেশ যাতে প্রতিবেশী কারো প্রতি আগ্রাসনে সক্ষম না থাকে"

—ফ্র্যাঙ্কলিন ডি. রুজভেল্ট ,৬জানুয়ারী ১৯৪১ ,৭৭তম ইউনাইটেড কংগ্রেসে

এই চিত্রকর্মটি হল ফোর ফ্রিডম সিরিজটি গঠনের পূর্বের একমাত্র নতুন চিত্রকর্ম। যদিও এটি মূলত ব্রিটেনের যুদ্ধকে পেশ করতে সৃষ্টি করা হয়েছিল, কিন্তু সেটারডে ইভিনিং পোস্ট এটিকে প্রকাশ করেনি।[১২] ১৯৪৩ সালে প্রকাশিত হওয়ার পর যুক্তরাষ্ট্রের ট্রেজারি ডিপার্টমেন্ট ফোর ফ্রিডমের চিত্রকর্মগুলোকে দেশব্যাপী পরিভ্রমণ করায়। ফোর ফ্রিডমের চিত্রকর্মগুলোর পরিভ্রমণ $১৩০,০০০,০০০ এর পর্যন্ত ওয়ার বন্ডের বিক্রি বাড়ায়।[১২] রকওয়েলের ফোর ফ্রিডমের চিত্রকর্মগুলো ওয়ার বন্ড প্রদর্শনীতে বিক্রির জন্য ডাকটিকিট স্মারক হিসেবে পুনঃ প্রস্তুত করা হয়েছিল।[১৩]

সমালোচকদের মন্তব্য সম্পাদনা

দৃশ্যটিকে মাত্রাতিরিক্ত অন্তরঙ্গ হিসাবে বর্ণনা করা হয়েছে। আসবাবপত্রের ও আলোক বিন্যাস এই অন্তরঙ্গতা সৃজনে ভূমিকা রেখেছে।[১২] ডেবোরাহ সোলোমন দৃশ্যটিকে এমনভাবে বর্ণনা করেছেন, "কিছুটা ফ্রান্সের অভ্যন্তরীণ অনুভব, সাথে ভালোবাসার অত্যাধুনিক ছোঁয়া।.[৬]দ্য ওয়াল স্ট্রিট জার্নাল এর ব্রুস কোল বলেছেন,"যুদ্ধের এই প্রসংগটা এতই সুনির্দিষ্ট যে, এটি ভয় বা রুজভেল্টের বৈশ্বিক নিরস্ত্রীকরণ পরিকল্পনা সম্পর্কে সামান্য চিহ্নই বহন করে। রকওয়েল তার হাত হালকা বাঁধাগুলোর পাশ দিয়ে নিয়ে যেতে পারেনি।"[১৪]

আরও দেখুন সম্পাদনা

তথ্যসূত্র সম্পাদনা

  1. "100 Documents That Shaped America:President Franklin Roosevelt's Annual Message (Four Freedoms) to Congress (1941)"U.S. News & World Report। U.S. News & World Report, L.P.। ২০১৩-১১-০৪ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ২০০৮-০৪-১১ 
  2. Boyd, Kirk (২০১২)। 2048: Humanity's Agreement to Live Together। ReadHowYouWant। পৃষ্ঠা 12। আইএসবিএন 1-4596-2515-3 
  3. Kern, Gary (২০০৭)। The Kravchenko Case: One Man's War on StalinEnigma Books। পৃষ্ঠা 287। আইএসবিএন 1-929631-73-1 
  4. Bruce Robinson (২০১১-০৩-৩০)। "The Blitz"। BBC। সংগ্রহের তারিখ ২০১২-০৩-২৭ 
  5. Richards 1954, p. 217.
  6. Solomon, p. 210.
  7. Halpern, Richard (২০০৬)। Norman Rockwell: The Underside of InnocenceUniversity of Chicago Press। পৃষ্ঠা 35–36। আইএসবিএন 0-226-31440-5 
  8. Murray and McCabe
  9. Meyer, p. 133.
  10. "Norman Rockwell's Four Freedoms: Images That Inspire a Nation"Amazon.com, Inc.। ২০০৮। সংগ্রহের তারিখ ২০০৮-১২-১৯ 
  11. Murray and McCabe, p. 62.
  12. Hennessey and Knutson, p. 102 উদ্ধৃতি ত্রুটি: <ref> ট্যাগ বৈধ নয়; আলাদা বিষয়বস্তুর সঙ্গে "HaK102" নামটি একাধিক বার সংজ্ঞায়িত করা হয়েছে
  13. Claridge, p. 313.
  14. Cole, Bruce (২০০৯-১০-১০)। "Free Speech Personified: Norman Rockwell's inspiring and enduring painting"The Wall Street Journal। সংগ্রহের তারিখ ২০১৩-১২-৩১ 

গ্রন্থপঞ্জি সম্পাদনা

  • Claridge, Laura (2001). "21: The Big Ideas". Norman Rockwell: A Life. Random House. pp. 303–314. ISBN 0-375-50453-2. 
  • Hennessey, Maureen Hart and Anne Knutson (1999). "The Four Freedoms". Norman Rockwell: Pictures for the American People. Harry N. Abrams, Inc. with High Museum of Art and Norman Rockwell Museum. pp. 94–102. ISBN 0-8109-6392-2. 
  • Meyer, Susan E. (1981). Norman Rockwell's People. Harry N. Abrams. pp. 128–133. ISBN 0-8109-1777-7. 
  • Richards, Denis. Royal Air Force 1939–1945: Volume I The Fight at Odds. London: HMSO, 1953. (No ISBN)
  • Solomon, Deborah (2013). "Fifteen: The Four Freedoms (May 1942 to May 1943)". American Mirror: The Life and Art of Norman Rockwell. Farrar, Straus and Giroux. pp. 201–220. ISBN 978-0-374-11309-4. 

বহিঃসংযোগ সম্পাদনা