ফিজার যুদ্ধ

প্রাক-ইসলামি যুগের যুদ্ধ

ফিজার যুদ্ধ ('অন্যায় যুদ্ধ', হারবুল ফিজার নামেও পরিচিত) হলো আরব অঞ্চলে সংঘটিত একটি যুদ্ধ, যা খ্রিষ্টীয় ষষ্ঠ শতাব্দীর শেষের দিকে, তৃতীয় আল-নুমানের (রাজত্বকাল ৫৮০ - ৬০২ খ্রিষ্টাব্দ) আমলে সংঘটিত হয়। নিষিদ্ধ বা পবিত্র মাসে যুদ্ধ হওয়ার কারণে একে ফিজার বা অন্যায় যুদ্ধ নামে অভিহিত করা হয়। মূলত আরব জাতিসমূহের মধ্যে নির্বিঘ্নে ব্যবসা করার সুবিধার জন্য যুদ্ধের এরূপ বিধিনিষেধ আরোপ করা ছিল। তৎকালীন সূত্রানুসারে আটদিনের যুদ্ধ চার বছরব্যাপী চলমান ছিল।[১]

প্রধান ব্যক্তি ও কারণ সম্পাদনা

ফিজার যুদ্ধ তৎকালীন আরবের দুইটি প্রধান শহর মক্কাতায়েফের মধ্য সংঘটিত হয়। যুদ্ধের এক পক্ষে গাতাফান গোত্র ছাড়া কায়েস আয়লান গোত্র এবং অন্য পক্ষে ছিল কুরাইশবনু কিনানা গোত্র।[১]

যুদ্ধের প্রধান কারণ এখনও বিতর্কিত,[২] তবে যুদ্ধের পেছনে কারণ হিসেবে নজদ এলাকার বাণিজ্যপথ এবং রাজস্ব আদায় সংক্রান্ত নিয়ন্ত্রণকে দায়ী করা হয়। কুরাইশরা সফলভাবে এই বাণিজ্যপথকে নিয়ন্ত্রণ করে, যা থেকে তাদের মিত্র ও ফিজার যুদ্ধের সেনাবাহিনীর খরচ প্রদান করে। তারওপর, যুদ্ধের উত্থানপতনের পর কুরাইশরা ব্যাপক প্রভাবশালী হিসেবে আবির্ভূত হয়।[১]

যুদ্ধের সাথে সম্পর্কিত সূত্রানুসারে, কুরাইশ বংশের মুহাম্মাদ (ইসলামের সর্বশেষ নবি) যুদ্ধের সাথে কিছু হলেও সম্পৃক্ত ছিলেন। যুদ্ধের সময় তার বয়স ১৪ থেকে ২৮ বছরের মধ্যে ছিল বলে অনেকের মতভেদ রয়েছে। কিছু কিছু সূত্রমতে, বিশেষত আল-আঘানি মতে, তিনি শামতার দিনে [সাহসিকতার সাথেই] যুদ্ধ করেছিলেন (যেখানে কুরাইশরা পরাজিত হয়েছিল)। অন্যান্য সূত্রমতে, বিশেষত ইবনে হিশামের মতে তিনি সরাসরি যুদ্ধ না করে কদাচিৎ কেবলমাত্র তার চাচাদের তীর সরবরাহ করেছিলেন।[১]

প্রথম বর্ষ সম্পাদনা

প্রথম তিন দিনের যুদ্ধে (কখনো কখনো একটি যুদ্ধ আবার কখনো তিনটি যুদ্ধ হিসেবে গণ্য করা হয়) "নিছক বাকযুদ্ধ" বলে বর্ণিত।[১]

তবুও, এই যুদ্ধ চার বছরব্যাপী প্রলম্বিত হয়। পবিত্র মাসে কিনানা গোত্রের আল-বাররাদ ইবনে কায়েস আল-দামি বিশ্বাসঘাতকতাপূর্বক হাওয়াজিনদের গোত্রভুক্ত বনু আমির ইবনে সা'সা'আ গোত্রের উরওয়া আল-রাহহালকে আক্রমণ করেন। হাওয়াজিনরা কায়েস-আয়লানদের গুরুত্বপূর্ণ অংশ ছিল। আক্রমণের সময় উরওয়া তৃতীয় আল-নুমানের ব্যবসায়িক কাফেলা নিয়ে ইরাকের আল-হিরা থেকে উকাজ মেলায় আসছিলেন।[১]

হত্যার খবর উকাজে পৌঁছায়, যেখানে আল-বাররাদ নেতা হারব ইবনে উমাইয়া ও কুরাইশদের নেতারা একত্রে সমাগত ছিলেন। বনু আমির ইবনে সা'সা'আ উরওয়া আল-রাহহালের মৃত্যুর প্রতিশোধ নিতে চাইবে, বুঝতে পেরে কুরাইশ ও কিনানার লোকেরা মক্কায় ফেরত যেতে শুরু করে। হাওয়াজিনরা কুরাইশদের অনুসরণ করে নাখলা নামক স্থানে এসে তাদের আক্রমণ করে। স্থানের নামানুসারে একে নাখলার দিনের যুদ্ধ (ইয়ামুল নাখলা) নামে অভিহিত করা হয়। একে ফিজার যুদ্ধের চতুর্থ দিন এবং দ্বিতীয় যুদ্ধের প্রথম দিন (কারও কারও মতে প্রথম যুদ্ধের চতুর্থ দিন) হিসেবেও গণ্য করা হয়।[১]

নাখলার দিনের পর রাতের বেলায় কুরাইশ ও কিনানারা মক্কার পবিত্র শহরে পলায়ন করতে সক্ষম হয়।[১]

দ্বিতীয় বর্ষ সম্পাদনা

পরের বছর বিবাদমান দুই পক্ষই আরও একবার উকাজের নিকটে শামতা/শামজা নামক স্থানে একত্রিত হয়। এই দিনের লড়াই ইয়াওমুল শামতা বা শামতার দিনের যুদ্ধ নামে অভিহিত। বিবাদমান দুই পক্ষই প্রথম বছরের অনুরূপে ছিল, শুধুমাত্র বনু আমির ইবনে সা'সা'আর সাথে তাদের উপগোত্র বনু কাব ও বনু কিলাব অন্তর্ভুক্ত ছিল না। সেই যুদ্ধে হাওয়াজিনরা বিজয়ী হয়।[১]

তৃতীয় বছর সম্পাদনা

পরের বছর উকাজেই আবার যুদ্ধ সংঘটিত হয়, যেখানে হাওয়াজিনরা পুনরায় বিজয়ী হয়। এই যুদ্ধ ইয়াওমুল আবলা বা আবলার দিনের যুদ্ধ নামে পরিচিত।[১]

চতুর্থ বছর সম্পাদনা

চতুর্থ বছরের যুদ্ধ বা সপ্তম দিন ইয়াওমুল উকাজ বা ইয়াওমুল শারাব নামে পরিচিত। এই যুদ্ধে কুরাইশ এবং কিনানারা বিজয়ী হয়। তারপরেও অষ্টম দিনের মতো যুদ্ধ আরম্ভ হয়, যা উকাজের নিকট হাররা নামক স্থানের অনুসারে ইয়ামুল হুরায়রা নামে পরিচিত। এই যুদ্ধে হাওয়াজিনরা পুনরায় বিজয়ী হয়। পরবর্তী আরও কিছু ছোটোখাটো খণ্ডযুদ্ধের পর দুই গোত্রের মধ্যে শান্তি পুনঃপ্রতিষ্ঠা করা হয়।[১]

তথ্যসূত্র সম্পাদনা

  1. Fück, J. W. (১৯৬৫)। "Fidjār"। Lewis, B; Pellat, Ch; Schacht, J.। The Encyclopedia of Islam, Vol. 2, C-G (2nd সংস্করণ)। Leiden: Brill। পৃষ্ঠা 883–884। আইএসবিএন 90-04-07026-5ডিওআই:10.1163/1573-3912_islam_SIM_2358 .
  2. Karim Samji, 'Narrative Early Islāmic History' (unpublished Ph.D. thesis, University of Michigan, 2013), pp. 20-21.

আরও পড়ুন সম্পাদনা