ফণীন্দ্রচন্দ্র দত্ত

ভারতীয় বাঙালি রসায়নবিদ

অধ্যাপক ড.ফণীন্দ্রচন্দ্র দত্ত (৩১ জানুয়ারি ১৯১২ – ১৩ জুন ১৯৮৩) ছিলেন একজন ভারতীয় বাঙালি রসায়নবিদ। তিনি জৈব রসায়নের ক্ষেত্রে জৈব সংশ্লেষণ, বিশেষকরে অ্যালিসাইক্লিক যৌগগুলির সংশ্লেষণ গবেষণায় কৃতিত্ব অর্জন করেন এবং উল্লেখযোগ্য অবদান রাখেন। [২]

ফণীন্দ্রচন্দ্র দত্ত
জন্ম(১৯১২-০১-৩১)৩১ জানুয়ারি ১৯১২
মৃত্যু১৩ জুন ১৯৮৩(1983-06-13) (বয়স ৭১)
মাতৃশিক্ষায়তনকলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়
হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়
বৈজ্ঞানিক কর্মজীবন
কর্মক্ষেত্রজৈব রসায়ন
প্রতিষ্ঠানসমূহইন্ডিয়ান অ্যাসোসিয়েশন ফর দ্য কালটিভেশন অব সায়েন্স কলকাতা
ডক্টরাল উপদেষ্টাপল কারার
গিলবার্ট স্টর্ক
ডক্টরেট শিক্ষার্থীঊষারঞ্জন ঘটক
সারন আধার নারঙ্গ
অমলেন্দু দাস
নিত্যগোপাল কুণ্ডু[১]

জন্ম ও শিক্ষাজীবন সম্পাদনা

ফণীন্দ্রচন্দ্র দত্তের জন্ম বৃটিশ ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যের আগরতলায়। পিতা নবচন্দ্র দত্ত ছিলেন তৎকালীন ত্রিপুরা সরকারের অফিস সুপারিনটেনডেন্ট। মাতা রাজলক্ষ্মী দেবী। তাদের ছয় পুত্র ও তিন কন্যাসহ মোট নয় সন্তানের মধ্যে ফণীন্দ্রচন্দ্র ছিলেন পঞ্চম সন্তান। পিতামাতার অত্যন্ত আধুনিক দৃষ্টিভঙ্গির কারণে পুত্রদের সঙ্গে তিন কন্যাও সুশিক্ষিত হন। তবে ফণীন্দ্রচন্দ্র ছিলেন সবচেয়ে মেধাবী। তার বিদ্যালয়ের পাঠ শুরু হয় আগরতলার উমাকান্ত অ্যাকাডেমিতে। সেখান থেকে ১৯২৯ খ্রিস্টাব্দে ম্যাট্রিক পাস করেন ও স্কলারশিপ পান। ১৯৩১ খ্রিস্টাব্দে রাজশাহী কলেজ থেকে আইএসসি পাশ করেন। বাংলায় রাজনৈতিক বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি হলে তিনি গুয়াহাটি চলে যান এবং সেখানকার কটন কলেজ বর্তমানে কটন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতকে প্রথম হন এবং গণিতে সর্বোচ্চ নম্বর পাওয়ায় আর. কে. বরাট স্বর্ণপদক লাভ করেন। পরে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে রসায়নে এমএসসি পাশের পর ১৯৩৫ খ্রিস্টাব্দে রাসবিহারী ঘোষ রিসার্চ ফেলোশিপ লাভ করে রসায়নের পালিত অধ্যাপক প্রফুল্লচন্দ্র মিত্রের অধীনে গবেষণায় যুক্ত হন। ১৯৪০ খ্রিস্টাব্দে তিনি জৈব রসায়নে মৌলিক গবেষণার জন্য ডিএসসি ডিগ্রি, নাগার্জুন পুরস্কার ও স্বর্ণপদক লাভ করেন। তার গবেষণার বিষয় ছিল- "সিনথেসিস অফ অ্যালিসাইক্লিক কম্পাউন্ডস"। তার গবেষণাটি নোবেলজয়ী রসায়নবিদ অধ্যাপক ওয়াল্টার নর্মান হেওয়র্থ, এফআরএস, অধ্যাপক আই এম হেইলব্রন, এফআরএস, ও অধ্যাপক এস স্মিথ, এফআরএস, দ্বারা উচ্চ প্রশংসিত হয়েছিল। ১৯৪১ খ্রিস্টাব্দে ফণীন্দ্রচন্দ্র স্যার প্রফুল্লচন্দ্র রায় ফেলোশিপ পান এবং ইন্ডিয়ান কেমিক্যাল সোসাইটির জে. এম. দাশগুপ্ত স্বর্ণ পদক লাভ করেন। পরের বছরেই তিনি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে সাম্মানিক প্রভাষক নিযুক্ত হন। ১৯৪৪ খ্রিস্টাব্দে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রেমচাঁদ-রায়চাঁদ বৃত্তি , মোকাট স্বর্ণপদক লাভ করেন। ওই বৎসরেই ইম্পেরিয়াল কেমিক্যাল ইন্ড্রাস্টিজ রসায়নে ভারতে প্রথম রিসার্চ স্কলারশিপ প্রবর্তন করলে, ফণীন্দ্রচন্দ্র তা পেয়ে যান। সেই সাথে রাসবিহারী ঘোষ ট্রাভেলিং ফেলোশিপ নিয়ে ফণীন্দ্রচন্দ্র ১৯৪৭ খ্রিস্টাব্দে বিদেশে যান এবং জুরিখ বিশ্ববিদ্যালয়ে নোবেলজয়ী সুইস জৈব রসায়নবিদ অধ্যাপক পল কারারের অধীনে সালফার পরমাণুর সংযোজনে ভিটামিন- ই এর ভিটামিন বিরোধী কার্যকারিতার উপর কাজ করেন। ১৯৪৮ খ্রিস্টাব্দ অধ্যাপক গিলবার্ট স্টর্কের অধীনে স্টেরয়েড হরমোন - 'cortisone' সম্পর্কিত 11-ketoperhydrophenanthrenes নামের জৈব যৌগের সংশ্লেষণের উপর কাজ করে পোস্ট ডক্টরাল ফেলোশিপ লাভ করেন। ১৯৫৩ খ্রিস্টাব্দের মার্চ মাসে দেশে ফিরে আসেন এবং কলকাতার ইন্ডিয়ান অ্যাসোসিয়েশন ফর দ্য কালটিভেশন অব সায়েন্সে প্রথমে রীডারের পদে যোগ দিয়ে পরে বিভাগীয় প্রধান হন।

কর্মজীবন সম্পাদনা

ইন্ডিয়ান অ্যাসোসিয়েশন ফর দ্য কালটিভেশন অব সায়েন্সের তৎকালীন অধিকর্তা বিশ্ববিশ্রুত বিজ্ঞানী অধ্যাপক মেঘনাদ সাহা সদ্য নিযুক্ত প্রভাষক ফণীন্দ্রচন্দ্রের উপর প্রতিষ্ঠানের জৈব রসায়ন বিজ্ঞান বিভাগের সার্বিক উন্নয়নের ভার অর্পণ করেন। তিনি তার চারিত্রিক মিশনারি উদ্যমে দীর্ঘ চব্বিশ বৎসরের কর্মজীবনে বিভাগটিকে আন্তর্জাতিক মানে উন্নীত করেন। ১৯৫৫ খ্রিস্টাব্দে মেঘনাদ সাহার প্রয়াণের ঠিক পূর্বেই তিনি প্রথম অধ্যাপক হন। ১৯৫৯ খ্রিস্টাব্দে রয়েল সোসাইটির বার্সারি এবং নুফিল্ড ফাউন্ডেশনের ফেলোশিপ নিয়ে লন্ডনের ইম্পেরিয়াল কলেজ অফ সায়েন্স ও অক্সফোর্ডের 'ডাইসন পেরিনস ল্যাবরেটরি'-তে ভিজিটিং প্রফেসর হিসাবে চার মাস অতিবাহিত করেন। ১৯৬৪ খ্রিস্টাব্দে জাপানে এক আন্তর্জাতিক সিম্পোজিয়ামে অংশগ্রহণের পর ওই বৎসরের নভেম্বরে হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপক আর বি উডওয়ার্ড সঙ্গে ম্যাগনামাইসিন বা কর্বোমাইসিন (C42H67NO16) এর উপর কাজ করেন। পোল্যান্ড, হাঙ্গেরি, রাশিয়া, আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্র সহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশ হতে আমন্ত্রণ পান এবং বক্তৃতা, সেমিনার ও গবেষণার বিষয়ে অংশ নেন। তার এই উদ্যমের মধ্য দিয়ে নিজের ও প্রতিষ্ঠানের পরিচিতি যেমন সমক্ষে এনেছেন তেমনই ল্যাবরেটরির জন্য রসায়নিক দ্রব্যের সংযোজন ও গবেষণার ফলাফলের তথ্য আলোচনার মাধ্যমেই বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্ত হতে সংগ্রহ করে সমৃদ্ধ করেছেন। এছাড়াও, তিনি ব্যক্তিগত যোগাযোগ ও প্রভাবে বৈজ্ঞানিক এবং শিল্পোদ্যোগ গবেষণা সংস্থা তথা সিএসআইআর-এর রসায়ন গবেষণা কমিটির হতে দেশের গবেষণা সংস্থার উন্নতিতে আধুনিক প্রযুক্তির যন্ত্রপাতি, গবেষণার জন্য প্রয়োজনীয় আর্থিক সাহায্যেরও ব্যবস্থা করেছিলেন।

১৯৭৭ খ্রিস্টাব্দের জানুয়ারি মাসে অবসর গ্রহণের পরও এমেরিটাস বিজ্ঞানীর পদে থেকে বৈজ্ঞানিক গবেষণায় অসাধারণ অবদান রেখেছেন। পশ্চিমবঙ্গ সরকারের - "কুইনাইন থেকে কুইনিডিনে রূপান্তর"-এর অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ পরিকল্পনায় যুক্ত ছিলেন।

কর্মজীবনে অধ্যাপক দত্ত দেশে ও বিদেশে যে যে পদ অলঙ্কৃত করেন সেগুলি হল -

  • ১৯৬৭ খ্রিস্টাব্দে ভারতের লখনউ-এর সেন্ট্রাল ড্রাগস্ রিসার্চ ইনস্টিটিউটের পরিচালন পর্ষদের সদস্য হন ছয় বৎসরের জন্য।

পারিবারিক জীবন সম্পাদনা

অধ্যাপক ফণীন্দ্রচন্দ্র দত্ত ১৯৪৩ খ্রিস্টাব্দে ছবি দাশগুপ্ত কে বিবাহ করেন। তার স্ত্রী সুইজারল্যান্ডে প্রশিক্ষিত একজন মাইক্রো অ্যানালিস্ট ছিলেন এবং কলকাতার ইন্ডিয়ান অ্যাসোসিয়েশন ফর দ্য কালটিভেশন অব সায়েন্সের মাইক্রোঅ্যানালিটিক্যাল ল্যাবরেটরিটিতে কাজ করতেন। তাদের এক পুত্র সুধীনও একজন রসায়নবিদ এবং হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তনী।

জীবনাবসান সম্পাদনা

অধ্যাপক ফণীন্দ্রচন্দ্রের পুত্র সুধীন কর্মক্ষেত্র যুক্তরাষ্ট্রে পাড়ি দিলে ছবি দেবী পুত্রের সঙ্গে যান। কিন্তু ফণীন্দ্রচন্দ্র কলকাতায় রয়ে যান। তার দেখাশোনা করেন তার এক অবিবাহিতা ভগিনী লীনা দত্ত ও আর এক ভগিনী ভিক্টোরিয়া ইনস্টিটিউশনের শিক্ষিকা বীণাপাণি দেব। শেষের দিকে অধ্যাপক দত্ত অত্যন্ত অসুস্থ হন এবং স্বল্প সময়ের রোগভোগের পর ১৯৮৩ খ্রিস্টাব্দের ১৩ জুন ৭১ বৎসর বয়সে পরলোক গমন করেন।

তথ্যসূত্র সম্পাদনা

  1. "Chemistry Tree - Phanindra Chandra Dutta"। সংগ্রহের তারিখ ২০২২-০৬-১৯ 
  2. "Phanindra Chandra Datta (ইংরাজীতে)" (পিডিএফ)। সংগ্রহের তারিখ ২০২২-০৬-১৭ 
  3. "Deceased Fellow - Phanindra Chandra Dutta"। সংগ্রহের তারিখ ২০২২-০৬-১৯