ফজলুল হক খোন্দকার
ফজলুল হক খোন্দকার (৩ জুলাই ১৯২৬ - ১৯ মার্চ ২০১২) তৎকালীন ব্রিটিশ ভারতের নরসিংদী মহকুমার রায়পুরা থানার বাহেরচর গ্রামে জন্মগ্রহণকারী বিশিষ্ট কৃষক নেতা, সমাজ-সংস্কারক ও মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক ছিলেন। আর্ত মানবতার মহান ব্রতে নিবেদিত প্রাণ ছিলেন তিনি। বামধারার রাজনীতিবিদ হিসেবে তিনি অসংখ্য শিক্ষা প্রতিষ্ঠানসহ বিভিন্ন সমাজসেবামূলক প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলে স্মরণীয় করে রেখেছেন নিজেকে।
ফজলুল হক খোন্দকার | |
---|---|
জন্ম | বাহেরচর, রায়পুরা, নরসিংদী, অবিভক্ত ভারত | ৩ জুলাই ১৯২৬
মৃত্যু | ১৯ মার্চ ২০১২ নরসিংদী সদর হাসপাতাল, বাংলাদেশ | (বয়স ৮৫)
জাতীয়তা | বাংলাদেশী |
নাগরিকত্ব | ব্রিটিশ ভারত (১৯৪৭ সাল পর্যন্ত) পাকিস্তান (১৯৭১ সালের পূর্বে) বাংলাদেশ |
পেশা | শিক্ষাবিদ, সংগঠক, সমাজসেবী |
পরিচিতির কারণ | মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক, শিক্ষক, রাজনীতিবিদ, সমাজসেবক |
আত্মীয় | সাত ভাই ও এক বোন |
প্রাথমিক জীবন
সম্পাদনাফজলুল হক খোন্দকার বাংলাদেশের নরসিংদী জেলার রায়পুরা থানার বাহেরচর গ্রামে ১৯২৬ সালের ৩ জুলাই জন্মগ্রহণ করেন। তার বাবার নাম মিলাব আলী খন্দকার এবং মা সামিনা খাতুন। সাত ভাই ও এক বোনের মধ্যে তিনি ছিলেন সর্বকনিষ্ঠ।[১]
তিনি ১৯৩৪ সালে প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ভর্তি হন। প্রাথমিক বিদ্যালয়ের পড়াশোনা শেষে ১৯৩৮ সালে মাদ্রাসায়। এরপর ১৯৪৯ সালে ৮ম শ্রেণীতে হাইস্কুলে। অতঃপর ১৯৫৪ সালে ভৈরব কলেজ থেকে আই.এ পাশ করেন। ১৯৫৭ সালে জগন্নাথ কলেজে (বর্তমানে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়) বি.এ শ্রেণিতে ভর্তি হন। এরপর ১৯৬১ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলা বিষয়ে স্নাতক (সম্মান) শ্রেণিতে অধ্যয়ন শেষে ১৯৬৫ সালে এম.এ ডিগ্রী অর্জন করেন।[২] জগন্নাথ কলেজে অধ্যয়নকালীন সময়েই ১৯৫৭ সালে দৌলতকান্দি হাইস্কুলে চার বছর শিক্ষকতা করেন ফজলুল হক খোন্দকার। এম.এ পাশ করার পর ১৯৬৬ সালে কাপাসিয়া কলেজে প্রভাষক হিসেবে যোগদান করেন। ৯০-এর দশকে নারায়ণপুর রাবেয়া মহাবিদ্যালয়ে অধ্যক্ষেরও গুরুদায়িত্ব পালন করেন তিনি।
রাজনৈতিক জীবন
সম্পাদনা১৯৪৮ সালে অবিভক্ত ভারতের তৎকালীন পশ্চিম বাংলার কমিউনিস্ট পার্টির সেক্রেটারী রমেন মিত্র রায়পুরায় আত্মগোপনে ছিলেন। নবম শ্রেণীতে পড়া অবস্থায় এক বন্ধুর মাধ্যমে ইলা মিত্রের স্বামী রমেন মিত্র এবং সুনীল রায়ের সংস্পর্শে এসেছিলেন তিনি। এরপর থেকেই ধীরে ধীরে রাজনীতির সাথে জড়িয়ে পড়েন তিনি। ১৯৬৭-৬৮ সালে কৃষক আন্দোলনের সাথে পুরোপুরি যুক্ত হন। এ কারণে কাপাসিয়া থেকে গ্রেফতার হন তিনি। শামসুল হক, আব্দুল হাই প্রমুখ রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বদেরকে নিয়ে বেলাবো এলাকায় ইজারা বিরোধী আন্দোলন করেন। ১৯৬৫ সালে বারৈচার কাছাকাছি শিবপুর বাজারে মাওলানা ভাসানী, মতিয়া চৌধুরী'র অংশগ্রহণে কৃষক সমিতির জাতীয় সম্মেলনে খাদ্য ব্যবস্থাপনার দায়িত্ব পালন করেন তিনি। ১৯৭৩ সালে বাংলাদেশ কৃষক সমিতির কেন্দ্রীয় কমিটির সাধারণ সম্পাদক এবং পরবর্তী দুইবার সভাপতি নির্বাচিত হন।[২] এছাড়াও, তিনি ন্যাপ (মুজাফফর)-এর যুগ্ম সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেন।
ভাষা আন্দোলন থেকে শুরু করে সব ধরনের আন্দোলনেই সম্পৃক্ত ছিলেন তিনি। ভাষা আন্দোলনে রায়পুরা এলাকায় নেতৃত্ব দেন। ৮/১০টি স্কুলে গিয়ে ছাত্রদেরকে সংগঠিত ও উদ্বুদ্ধ করেন। ফজলুল হক খোন্দকার একাত্তরের স্বাধীনতা যুদ্ধে মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক হিসেবে রায়পুরা অঞ্চলের মুক্তিযোদ্ধাদেরকে সংগঠিত করেছিলেন।
১৯৭০-এর নির্বাচনে ন্যাপ বা ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টির পক্ষ থেকে নির্বাচনে অংশগ্রহণ করেন। এতে তিনি আটাশ হাজারেরও অধিক ভোট পান। ১৯৭৩ সালের সাধারণ নির্বাচনে পান আটত্রিশ হাজার ভোট। কিন্তু দুইবারই কারচুপির মাধ্যমে তাকে নির্বাচনে পরাজিত করা হয়েছিল বলে জনশ্রুতি রয়েছে।[২] ১৯৯১ সালের জাতীয় সংসদ নির্বাচনে পঁচিশ হাজারেরও অধিক ভোট পেয়ে ৩য় স্থান অর্জন করেছিলেন।
১৯৭১ সালের ১২ মার্চ রায়পুরায় মুক্তিযুদ্ধে পাকবাহিনীর বিরুদ্ধে প্রতিরক্ষা কার্যক্রম গ্রহণে যৌথ সংগ্রাম কমিটি গঠিত হয়। এ কমিটিতে এড. আফতাব উদ্দিন ভূঁইয়া, হাজী গয়েছ আলী মাষ্টার, সাদত আলী মোক্তারের পাশাপাশি তিনিও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন।[৩]
সামাজিক অবদান
সম্পাদনামানুষের কল্যাণে গ্রামে প্রতিষ্ঠা করেন সামাজিক সংগঠন চেতনা বিকাশ কেন্দ্র। এ সংগঠনটি গ্রামের সুবিধাবঞ্চিত ও অবহেলিত লোকজনকে চিকিৎসাসেবা প্রদানসহ বিভিন্ন সামাজিক কাজে অংশগ্রহণ করে থাকে। এছাড়াও, স্বাস্থ্যসেবাবঞ্চিত মানুষকে চিকিৎসাসেবা প্রদানের জন্য হাশিমপুর মৌলভীবাজারে একটি চিকিৎসা কেন্দ্র পরিচালনার দায়িত্বে ছিলেন তিনি।[১]
গ্রামে নারী শিক্ষার প্রসার ও উন্নয়নের জন্য ফজলুল হক খোন্দকার প্রতিষ্ঠা করেন শতদল বালিকা উচ্চ বিদ্যালয় এবং রহিমা হক চেতনা বিকাশ মহিলা কলেজ। উভয় প্রতিষ্ঠানেরই সভাপতি ছিলেন তিনি। রায়পুরা ডিগ্রী কলেজ, এএনএম উচ্চ বিদ্যালয়-সহ অনেক শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের উদ্যোক্তা ছিলেন তিনি।
মৃত্যু
সম্পাদনাঅকৃতদার ফজলুল হক খোন্দকার দীর্ঘ ৩৫ বৎসরকাল ডায়াবেটিসজনিত কারণে বিভিন্ন জটিল রোগে আক্রান্ত হয়ে ২০১২ সালের ১৯ মার্চ সালে নরসিংদী সদর হাসপাতালে মৃত্যুবরণ করেন। পরদিন তাকে রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় দাফন করা হয়। এতে অংশগ্রহণ করেন গণফোরাম কেন্দ্রীয় কমিটির সভাপতি ড. কামাল হোসেন-সহ সমাজের সকল স্তরের ব্যক্তিবর্গ।
তথ্যসূত্র
সম্পাদনা- ↑ ক খ দৈনিক কালের কণ্ঠ, মাঠের রাজনীতি, মুদ্রিত সংস্করণ, ২০ অক্টোবর, ২০১১ইং, পৃষ্ঠাঃ ১৯
- ↑ ক খ গ সাপ্তাহিক বর্তমান সংলাপ, মুদ্রিত সংস্করণ, ১০ মার্চ, ২০১১ইং, প্রধান পাতা
- ↑ "দৈনিক ইত্তেফাকের প্রতিবেদন: আজ যেসব এলাকা হানাদারমুক্ত হয়, সংগ্রহকাল: ২২ মার্চ, ২০১২ইং"। ৪ মার্চ ২০১৬ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ২৫ মার্চ ২০১২।