তাজুল ইসলাম (পণ্ডিত)

পূর্ব পাকিস্তানের ইসলামি পণ্ডিত, শিক্ষাবিদ, রাজনীতিবিদ ও সমাজ সংস্কারক

তাজুল ইসলাম (ফখরে বাঙ্গাল নামেও পরিচিত; ১৮৯৬ – ৩ এপ্রিল ১৯৬৭) ছিলেন পূর্ব পাকিস্তানের একজন দেওবন্দি ইসলামি পণ্ডিত, শিক্ষাবিদ ও রাজনীতিবিদ।[১] তিনি দীর্ঘ ৪২ বছর ব্রাহ্মণবাড়িয়ার জামিয়া ইসলামিয়া ইউনুছিয়া মাদ্রাসার মহাপরিচালক ছিলেন। তিনি শিরক, বিদআতকাদিয়ানিদের বিরুদ্ধে সংগ্রামের জন্য পরিচিত ছিলেন। জমিয়ত উলামায়ে হিন্দ, জমিয়ত উলামায়ে ইসলাম, নেজামে ইসলাম পার্টির নেতা হিসেবে তিনি ইসলামি রাজনীতিতে অবদান রাখেন।

ফখরে বাঙ্গাল
ফখরুল উলামা
হাফিজুল হাদিস

তাজুল ইসলাম
ব্যক্তিগত তথ্য
জন্ম১৮৯৬
মৃত্যু৩ এপ্রিল ১৯৬৭(1967-04-03) (বয়স ৭০–৭১)
ধর্মইসলাম
জাতীয়তাপাকিস্তানি
সন্তান৪ ছেলে, ২ মেয়ে
পিতামাতা
  • আনোয়ার আলী (পিতা)
জাতিসত্তাবাঙালি
যুগআধুনিক
আখ্যাসুন্নি
ব্যবহারশাস্ত্রহানাফি
আন্দোলনদেওবন্দি
প্রধান আগ্রহহাদিস, ফিকহ, লেখালেখি, তাসাউফ, সমাজ সংস্কার
যেখানের শিক্ষার্থী
আত্মীয়কারী ইব্রাহিম উজানি (শ্বশুর)
মুসলিম নেতা
শিক্ষক
যার দ্বারা প্রভাবিত

প্রারম্ভিক জীবন সম্পাদনা

তাজুল ইসলাম ১৮৯৬ সালে ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার নাসিরনগর উপজেলার ভুবন গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন।[২] তার পিতা আনোয়ার আলী একজন আলেম ছিলেন। গ্রামের পাঠশালায় তার প্রাথমিক শিক্ষার হাতেখড়ি হয়। আব্দুল করিমের কাছে তিনি প্রাথমিক কিতাবাদি অধ্যায়ন করেন। তারপর তিনি ভর্তি হন শ্রীঘর মাদ্রাসায়। শ্রীঘর মাদ্রাসায় কিছুকাল পড়ার পর তাকে বাহুবল মাদ্রাসায় ভর্তি করানো হয়। বাহুবল মাদ্রাসায় তিনি ২ বছর লেখাপড়া করেছেন। এরপর তিনি মুহাম্মদ সাহুল ভাগলপুরীর তত্ত্বাবধানে সিলেট আলিয়া মাদ্রাসায় লেখাপড়া শুরু করেন এবং ১৩৩৭-৩৮ হিজরি শিক্ষাবর্ষের সর্বশেষ পরীক্ষায় প্রথম বিভাগে প্রথম স্থান অধিকার করেন। আরও উচ্চশিক্ষা লাভের উদ্দেশ্যে তিনি ভারতের দারুল উলুম দেওবন্দ মাদ্রাসায় চলে যান।[২] এখানে তিনি আনোয়ার শাহ কাশ্মীরির সান্নিধ্য লাভ করেন। দেওবন্দ মাদ্রাসায় ৪ বছর অধ্যয়নকালে তিনি আরও যে সকল উস্তাদের সান্নিধ্য পেয়েছেন তার মধ্যে উল্ল্যেখযোগ্য শাব্বির আহমদ উসমানি, ইজাজ আলী আমরুহী, ইব্রাহিম বলিয়াভি ও আসগর হুসাইন দেওবন্দি[৩] হুসাইন আহমদ মাদানির নিকট তিনি তাসাউফ বিষয়ক জ্ঞান অর্জন করেন। হিজরি ১৩৪২ সালে তিনি দেওবন্দ মাদ্রাসায় লেখাপড়া শেষ করে স্বদেশে প্রত্যাবর্তন করেন। দেওবন্দ মাদ্রাসায় শিক্ষাজীবনের শেষ পর্যায়ে একটি বিতর্কে কাদিয়ানিদের কুরআন ও হাদিসের আলোকে কাফের প্রমাণ করায় তাকে উপস্থিত জনতা ‘ফখরে বাঙ্গাল’ উপাধি প্রদান করেন।[১]

কর্মজীবন সম্পাদনা

হাদিসের শিক্ষকতার মাধ্যমে তার কর্মজীবন শুরু হয়। প্রথমে তিনি কুমিল্লার জামিয়া মিল্লিয়া ও কলকাতা আলিয়া মাদ্রাসায় কিছুদিন শিক্ষকতা করেন। ১৩৪৫ হিজরিতে তিনি ব্রাহ্মণবাড়িয়ার জামিয়া ইসলামিয়া ইউনুছিয়া মাদ্রাসায় পরিচালক পদে যোগদান করেন এবং মৃত্যুর পূর্ব পর্যন্ত ৪২ বছর এই পদে ছিলেন।[৩]

তিনি জমিয়ত উলামায়ে হিন্দের নেতা ছিলেন। পাকিস্তানের প্রতিষ্ঠালগ্নে তিনি জমিয়ত উলামায়ে ইসলামে যোগদান করেন। পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর তিনি আতহার আলীর সাথে নেজামে ইসলাম পার্টি গঠন করেন। পরে তিনি নিখিল পাকিস্তান নেজামে ইসলাম পার্টির সহ সভাপতি হন। ১৯৪৭ সালের জুন মাসে অনুষ্ঠিত সিলেট গণভোটেও তিনি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন।[৪]

তিনি সকল প্রকার বিদআতের বিরুদ্ধে সোচ্চার ছিলেন। ব্রাহ্মণবাড়িয়া শহর থেকে পতিতালয় উচ্ছেদ করা তার অন্যতম কীর্তি। তার পরামর্শ ও তত্ত্বাবধানে ব্রাক্ষণবাড়িয়ায় স্বেচ্ছাশ্রমের ভিত্তিতে এন্ডারসন খাল খনন করা হয়।[৪] ছাত্রজীবন থেকে তিনি কাদিয়ানিদের বিরুদ্ধে সংগ্রাম শুরু করেন; অসংখ্য বিতর্কে উত্তীর্ণ হন। অসংখ্য কাদিয়ানি তার হাতে ইসলাম গ্রহণ করেছিল।[৫]

পূর্ব পাকিস্তানের একমাত্র প্রতিনিধি হিসেবে তিনি ১৯৬৪ সালে পূর্বেকার মাজহাবসমূহ ও আয়েম্মায়ে মুজতাহিদীনের পরিবর্তে নতুন মাজহাব ও মুজতাহিদীন গঠন করা প্রসঙ্গে মিশরের রাজধানী কায়রোতে অনুষ্ঠিত বিশ্ব উলামা সম্মেলনে যোগদান করে তথ্যভিত্তিক ও যুক্তির মাধ্যমে নতুন মাজহাব গঠনের প্রস্তাব নাকচ করে দেন। উক্ত সম্মেলনে তিনি ফখরুল উলামা বা উলামাদের গৌরব ও হাফিজুল হাদিস উপাধিতে ভূষিত হন।[১]

পরিবার সম্পাদনা

তিনি কারী ইব্রাহিম উজানির তৃতীয় কন্যার সাথে প্রথম বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন। তার এই সংসারে ২ ছেলে ও ১ মেয়ের জন্ম হয়। বাংলাদেশের স্বাধীনতার কিছুকাল পরে তার প্রথম স্ত্রী মৃত্যুবরণ করেন। এছাড়াও তিনি সরাইল থানার উবায়দুল হকের এক কন্যাকে বিবাহ করেন। তার এই সংসারেও ২ ছেলে ও ১ মেয়ের জন্ম হয়।[৫]

মৃত্যু সম্পাদনা

তিনি ১৯৬৭ সালের ৩ এপ্রিল ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে মৃত্যুবরণ করেন।[৬]

তার ৫৪ তম মৃত্যুবার্ষিকীতে ২০২১ সালের ৭ জুন ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলা শহরের দাতিয়ারাস্থ ফখরে বাঙ্গাল আল্লামা তাজুল ইসলাম (রহ.) মাদ্রাসা ও মসজিদ কমপ্লেক্স মিলনায়তনে ‘আল্লামা তাজুল ইসলাম স্মরণসভা’র আয়োজন করা হয়।[৭]

তার জীবনীগ্রন্থের মধ্যে ইসলামিক ফাউন্ডেশন বাংলাদেশ প্রকাশিত ফখরে বাঙ্গাল আল্লামা তাজুল ইসলাম ও সাথীবর্গ, নাসীম আরাফাতের ফখরে বাঙ্গাল আল্লামা তাজুল ইসলাম রহ., শরীফ মুহাম্মদের এই গরবের ধন, এইচ. এম. জাবেদ হোসাইনের এক মনীষীর গল্প শোনো অন্যতম।

আরও দেখুন সম্পাদনা

তথ্যসূত্র সম্পাদনা

উদ্ধৃতি সম্পাদনা

  1. মোহাম্মদ এনামুল হাসান, মুফতী (২০ এপ্রিল ২০১৭)। "আউলিয়াদের জীবন : ফখরে বাঙ্গাল আল্লামা তাজুল ইসলাম (রহঃ)"দৈনিক ইনকিলাব। সংগ্রহের তারিখ ১৯ আগস্ট ২০২১ 
  2. নিজামপুরী ২০১৩, পৃ. ১৪০।
  3. নিজামপুরী ২০১৩, পৃ. ১৪১।
  4. আজাদ, আবুল কালাম (২২ জুন ২০১৬)। "ফখরে বাঙ্গাল তাজুল ইসলাম রহ. : জীবন ও কর্ম"কমাশিসা 
  5. নিজামপুরী ২০১৩, পৃ. ১৪২।
  6. নিজামপুরী ২০১৩, পৃ. ১৪৩।
  7. "আল্লামা তাজুল ইসলাম স্মরণসভা"দৈনিক ইনকিলাব। ৭ জুন ২০২১। 

গ্রন্থপঞ্জি সম্পাদনা

জীবনীগ্রন্থ সম্পাদনা

অন্যান্য সম্পাদনা