প্রবারণা পূর্ণিমা
প্রবারণা পূর্ণিমা বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীদের পালিত একটি একটি ধর্মীয় উৎসব; যা আশ্বিনী পূর্ণিমা নামেও পরিচিত।[১] বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীদের নিকট এটি দ্বিতীয় বৃহত্তম ধর্মীয় উৎসব।[২] আশ্বিন মাসের পূর্ণিমা তিথিতে এই উৎসব পালিত হয়।[৩]
প্রবারণা পূর্ণিমা | |
---|---|
![]() রাজগুরু বৌদ্ধ বিহার থেকে বৌদ্ধ ধর্মাবলাম্বী কর্তৃক | |
আনুষ্ঠানিক নাম | আশ্বিনী পূর্ণিমা |
অন্য নাম |
|
পালনকারী | বৌদ্ধ ধর্মাবলাম্বী |
উপাসনার রঙ |
|
ধরন | বৌদ্ধধর্মীয় উৎসব |
তাৎপর্য |
|
তারিখ |
|
ব্যুৎপত্তিসম্পাদনা
‘প্রবারণা’ শব্দের পালি আভিধানিক অর্থ নিমন্ত্রণ, আহ্বান, মিনতি, অনুরোধ, নিষেধ, ত্যাগ, শেষ, সমাপ্তি, ভিক্ষুদের বর্ষাবাস পরিসমাপ্তি, বর্ষাবাস ত্যাগ, বর্ষাবাস ত্যাগের কার্য অথবা শিষ্টাচার, বিধি, তৃপ্তি বা সন্তুষ্টির বিষয়, ক্ষতিপূরণ, প্রায়শ্চিত্ত, ঋণ পরিশোধ প্রভৃতি বুঝায়।[৪]
বর্ষাবাস সমাপনান্তে ভিক্ষুগণ তাদের দোষত্রুটি অপর ভিক্ষুগণের নিকট প্রকাশ করে তার প্রায়শ্চিত্ত বিধানের আহবান জানায়; এমনকি অজ্ঞাতসারে কোনো অপরাধ হয়ে থাকলে তার জন্যও ক্ষমা প্রার্থনা করা - এটিই হলো প্রবারণার মূল।[১]
উৎপত্তিসম্পাদনা
রাজকুমার সিদ্ধার্থ (পরবর্তীতে গৌতম বুদ্ধ) জাগতিক সকল দুঃখমুক্তি লাভের আশায় রাজ্য, রাজত্ব, ভোগ-বিলাস, ধনকুম্ভ সব ত্যাগ করে সংসার পরিত্যাগ করেছিলেন শুভ আষাঢ়ী পূর্ণিমা তিথিতে। তিনি সারথি ছন্দককে সঙ্গে নিয়ে অশ্ব কন্থকের পিঠে চড়ে অনোমা নদীর তীরে পৌঁছালেন। রাজ-আবরণ ছন্দককে বুঝিয়ে দিয়ে তিনি সন্ন্যাস-ব্রত গ্রহণ করলেন। এরপর ভাবলেন, ‘আমি এখন সন্ন্যাসী, রাজকীয় বাহারি চুল কী-বা প্রয়োজন?’[৫]
তরবারি দিয়ে চুলের গোছা কেটে নিয়ে মনে মনে অধিষ্ঠান করলেন, ‘যদি বুদ্ধ হওয়ার মতো গুণ আমার মধ্যে থেকে থাকে তাহলে ঊর্ধ্বদিকে নিক্ষিপ্ত চুলের গোছা মাটিতে না পড়ে আকাশে স্থিত থাকুক।’[৫][৬]
এই সংকল্প করে তিনি চুলের গোছা উপরের দিকে নিক্ষেপ করলেন। বড়ই আশ্চর্যের ব্যাপার! একটা চুলও মাটিতে পড়ল না। বৌদ্ধধর্ম মতে, স্বর্গের ইন্দ্ররাজা চুলগুলো হীরা, মণি, মানিক্যখচিত স্বর্ণপাত্রে ধারণ করে তাবতিংস স্বর্গে উক্ত কেশ-ধাতু স্থাপন-পূর্বক একটি চৈত্য নির্মাণ করেন এবং এই চৈত্যের নাম রাখা হয় ‘চুলামনি চৈত্য’।[৭] স্বর্গের দেবতারা এখনও এর পূজা করে থাকেন। এ পুণ্যময় পূর্ণিমা তিথিতে গৌতম বুদ্ধ তাবতিংস স্বর্গে মাতৃদেবীকে অভিধর্ম দেশনার পর ভারতের সাংকাশ্য নগরে অবতরণ করেন এবং মানব জাতির সুখ, শান্তি ও কল্যাণে দিকে দিকে স্বধর্ম প্রচারের জন্য তার ভিক্ষু সংঘকে নির্দেশ প্রদান করেন; একই সঙ্গে, এদিনেই তার তিন মাসের বর্ষাবাসের পরিসমাপ্তি ঘটে।[২]
কথিত আছে এই তিথিতে গৌতম বুদ্ধ ৬০ জন প্রশিক্ষিত শিষ্যকে ধর্ম প্রাচারণার জন্য বিভিন্ন স্থানে প্রেরণ করেন এবং তাদের বলেন, ‘‘চরত্থ ভিকখবে চারিকং, বহুজন হিথায় বহুজন সুখায়’’ - অর্থাৎ, তোমরা বহুজনের হিতের জন্য, বহুজনের সুখের জন্য চারিদিক ছড়িয়ে পড়।[৮]
উদযাপনসম্পাদনা
পৃথিবীর বুদ্ধভক্ত পূজারীরা স্বর্গে তো আরোহণ করতে পারেন না। তাই তারা পরম শ্রদ্ধায় কাগুজে ফানুস তৈরি করে একটি বিশেষ দিনে ধর্মীয় রীতি-নীতি মেনে চুলামনি চৈত্যকে পূজা করার উদ্দেশ্যে আকাশ-প্রদীপ হিসেবে ফানুস বাতি উত্তোলন করে থাকেন। ধর্মীয় গাথা বা মন্ত্র পাঠ করে উৎসর্গ করে খালি পায়ে বৌদ্ধরা ফানুস উড়িয়ে দেন। মন্ত্রপাঠের মাধ্যমে সাধু-ধ্বনির সুরে সুরে ফানুস উড়ানো হয়।
আষাঢ়ী পূর্ণিমাতে বৃষ্টি ও আকাশ মেঘাচ্ছন্ন থাকায় অনেক সময় ফানুস ওড়ানোর পরিবেশ এবং সুযোগ কোনোটিই থাকে না। তাই প্রবারণা পূর্ণিমা বা আশ্বিনী পূর্ণিমায় দিনে ফানুস ওড়ানো হয়।[৯]
এ উৎসবকে ঘিরে বৌদ্ধবিহারগুলো সাজানো হয়েছে নতুন সাজে। সন্ধ্যার পর পাড়ায় পাড়ায় উৎসবমুখর পরিবেশে উড়ানো হয়ে থাকে ফানুস বাতি। সকাল থেকে পাড়ায় পাড়ায় চলছে নানা রকম বাহারি পিঠা, পুলি, পায়েস তৈরির ধুম।এছাড়া ওয়াগ্যোয়াই পোয়ে উৎসবের মূল আকর্ষণ হলো মঙ্গল রথযাত্রা। বিশেষ পদ্ধতিতে তৈরি ময়ূর আকৃতির একটি বিশাল রথ তৈরি করে তার ওপর একটি বুদ্ধমূর্তি স্থাপন করা হয়। এরপর মঙ্গল রথটি কেন্দ্রীয় বৌদ্ধবিহার থেকে রশি দিয়ে টেনে রাতে শহরের অলিগলি ঘোরানো হয়। এ সময় বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী নারী-পুরুষ, শিশু-কিশোর, যুবক-যুবতী মোমবাতি জ্বালিয়ে বুদ্ধমূর্তিকে শ্রদ্ধা জানায়।[১০][১১]
আরও দেখুনসম্পাদনা
তথ্যসূত্রসম্পাদনা
- ↑ ক খ সুকোমল বড়ুয়া (জানুয়ারি ২০০৩)। "প্রবারণা পূর্ণিমা"। সিরাজুল ইসলাম। বাংলাপিডিয়া। ঢাকা: এশিয়াটিক সোসাইটি বাংলাদেশ। আইএসবিএন 984-32-0576-6। সংগ্রহের তারিখ ৭ সেপ্টেম্বর ২০১৯।
- ↑ ক খ "আজ শুভ প্রবারণা পূর্ণিমা"। একুশে টেলিভিশন - অনলাইন ভার্সন। ২৪ অক্টোবর ২০১৮। সংগ্রহের তারিখ ৭ সেপ্টেম্বর ২০১৯।
- ↑ প্রবারণা পূর্ণিমা, বাংলাপিডিয়া
- ↑ "প্রবারণা পূর্ণিমার বৈশিষ্ট্য ও তাৎপর্য"। ভোরের কাগজ - অনলাইন ভার্সন। ২৪ অক্টোবর ২০১৮। ১৪ অক্টোবর ২০১৯ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ৭ সেপ্টেম্বর ২০১৯।
- ↑ ক খ টেলিভিশন, Ekushey TV | একুশে। "বৌদ্ধ প্রবারণা সম্প্রীতি উৎসব"। Ekushey TV (ইংরেজি ভাষায়)। সংগ্রহের তারিখ ২০২২-১০-০৭।
- ↑ উদ্ধৃতি ত্রুটি:
<ref>
ট্যাগ বৈধ নয়;deng
নামের সূত্রটির জন্য কোন লেখা প্রদান করা হয়নি - ↑ "ফানুস উত্তোলন কেন?"। bibartanonline.com (ইংরেজি ভাষায়)। সংগ্রহের তারিখ ২০২১-১০-২৯।
- ↑ "প্রবারণা পূর্ণিমা"। অনুশীলন ডটকম। সংগ্রহের তারিখ ৭ সেপ্টেম্বর ২০১৯।
- ↑ amadernotunshomoy.com (২০১৮-০৯-২৫)। "ফানুস উত্তোলন কী এবং কেন"। Amadernotun Shomoy। ২০২১-১০-২৯ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ২০২১-১০-২৯।
- ↑ "বিহারে-বিহারে সুখ ও শান্তি কামনা"। Jugantor (ইংরেজি ভাষায়)। সংগ্রহের তারিখ ২০২২-১০-০৮।
- ↑ "প্রবারণা পূর্ণিমা এবং দানোত্তম শুভ কঠিন চীবরদান"। Jugantor (ইংরেজি ভাষায়)। সংগ্রহের তারিখ ২০২২-১০-০৯।
বহিঃসংযোগসম্পাদনা
- Rhys Davids,T.W. & Hermann Oldenberg (trans.) ([1881]). Vinaya Texts (Part I). Oxford:Clarendon Press. Available on-line at http://www.sacred-texts.com/bud/sbe13/sbe1313.htm. The chapter on Pavarana Day, "Fourth Khandhaka (The Parâvanâ Ceremony)," is available at http://www.sacred-texts.com/bud/sbe13/sbe1315.htm.
- Tieken, Hermann (২০০২)। "The Buddhist Pavarana Ceremony to the Pali Vinaya"। Journal of Indian Philosophy। 30 (3): 271–289। এসটুসিআইডি 169274764। জেস্টোর 23496839। ডিওআই:10.1023/a:1016153122649।