প্রথম রত্নমাণিক্য

পঞ্চদশ শতাব্দীর ত্রিপুরা রাজ্যের রাজা

প্রথম রত্নমাণিক্য পঞ্চদশ শতাব্দীর শেষ ভাগে ত্রিপুরা রাজ্যের রাজা ছিলেন।

প্রথম রত্নমাণিক্য
ত্রিপুরা রাজ্যের রাজা
পূর্বসূরিডাঙ্গর ফা
উত্তরসূরিপ্রথম প্রতাপমাণিক্য
রাজবংশমাণিক্য রাজবংশ
পিতাডাঙ্গর ফা

সংক্ষিপ্ত জীবনী সম্পাদনা

রাজমালা অনুসারে, প্রথম রত্নমাণিক্য ত্রিপুরা রাজ্যের রাজা ডাঙ্গর ফার আঠারোজন পুত্রের মধ্যে সর্বকনিষ্ঠ পুত্র ছিলেন।[১]:৫৬ কৈশোরে তার পিতা তাকে গৌড়ের নবাবের দরবারে পাঠিয়ে দেন।[২]:৫৮ এরপর রত্ন গৌড়ের সৈন্য নিয়ে ত্রিপুরা আক্রমণ করে রাঙ্গামাটি জয় করলে তার সতেরো জন ভাই যুদ্ধক্ষেত্র থেকে পলায়ন করেন। ডাঙ্গর ফা এই সময় খানাসি শৈলাবাসে মৃত্যুবরণ করলে রত্ন ত্রিপুরার সিংহাসন অধিকার করেন। গৌড়ের নবাবকে এর পরিবর্তে তিনি একশো হাতি সহ একটি মণি উপহার দিলে গৌড়েশ্বর তাকে মাণিক্য উপাধি প্রদান করেন।[৩]:৬২-৬৩ এই রাজাই প্রথম ত্রিপুরায় মুদ্রা প্রবর্তন করেন। রাজমালা অনুসারে এই রাজার আবির্ভাব ত্রয়োদশ শতকের শেষদিকে হলেও প্রাপ্ত মুদ্রা ১৩৮৬ শকাব্দের (১৪৬৪-৬৫ খ্রিষ্টাব্দ)।[৪] পরবর্তী রাজা মুকুটমাণিক্যের ১৪১১ শকাব্দের (১৪৮৯ খ্রিষ্টাব্দ) মুদ্রা পাওয়া যাওয়ায়[৪][৫] রত্নমাণিক্যের রাজত্বকাল বর্তমানে ১৪৬৪–১৪৮৯ খ্রি. ধরা হয়[৬][৭], এই হিসাবে তাকে মাণিক্য উপাধি দিয়েছিলেন বাংলার সুলতান রুকনউদ্দিন বারবাক শাহ[৬]

১২৭৯ খ্রিস্টাব্দের যুদ্ধ সম্পাদনা

রাজমালা অনুসারে রত্নমাণিক্যের পিতার মৃত্যুর পর তার ১৭ জন ভাই নিজেদের মধ্যে রাজ্য ভাগ করে নেন। রত্ন তখন গৌড়ের দরবারে ছিলেন, গৌড়ের নবাবের সৈন্য-সাহায্য নিয়ে ভাইদের উচ্ছেদ করে তিনি রাজা হন। মুদ্রার সাক্ষ্য অনুযায়ী রত্নমাণিক্য সেসময় থাকতে পারেন না, কিন্তু এই যুদ্ধের কথা অন্য সূত্র থেকেও জানা যায়। চার্লস স্টুয়ার্টের বাংলার ইতিহাস অনুযায়ী সে বছর বাংলার শাসক তুগরাল খান মেঘনার পরপারে অবস্থিত[৮] জাজনগর (ত্রিপুরা) আক্রমণ করেন।[৯] এই জাজনগর উড়িষ্যা না ত্রিপুরায় ছিল, তা নিয়ে বিতর্ক আছে, কিন্তু মেঘনা নদীর উল্লেখ ত্রিপুরার দিকেই ইঙ্গিত করে। ত্রিপুরার রাজকুমার ও ঐতিহাসিক সমরেন্দ্রচন্দ্র দেববর্মণের মতে নুরনগর পরগণার জাজিসাব গ্রামটিই প্রাচীন জাজনগর।[১০]

রত্নমাণিক্যের মুদ্রা সম্পাদনা

রত্নমাণিক্যের আগেকার কোন ত্রিপুরার রাজার মুদ্রা পাওয়া যায় নি। রত্নমাণিক্যের প্রায় চল্লিশ রকম মুদ্রা পাওয়া গেছে, যেগুলি মুদ্রা-বিশেষজ্ঞ ও সংগ্রাহকদের বিশেষ আগ্রহের কারণ।[১১] উঁচু জাতের কারিগরি কৌশলে শিল্পসৌকর্যের সঙ্গে মুদ্রাগুলি তৈরি হয়েছিল। এই মুদ্রাগুলির কৃৎকৌশল, সিংহচিহ্ন, বাক্যাবলী ও রূপরেখায় তৎকালীন বাংলার শাসকদের মুদ্রার ছাপ দেখা যায়, যথা রাজা গণেশ, মহেন্দ্রদেব, জালালুদ্দীন মহম্মদ শাহ, নাসিরুদ্দীন মাহমুদ শাহ এবং রুকনুদ্দীন বারবাক শাহ। কারিগরদেরও সম্ভবত বাংলা থেকে আনা হয়েছিল। রাজমালা অনুযায়ী এই রাজার রাজত্বকাল ১২৭৯-১৩২৩ খ্রিষ্টাব্দ এবং ১২৮০ সালে ইনি গৌড়ের সুলতানের কাছ থেকে মাণিক্য উপাধি লাভ করে মাণিক্য রাজবংশের সূচনা করেন। কিন্তু মুদ্রা ও তাম্রশাসনের সাক্ষ্য তা বলে না। এই রাজার ১৩৮৬-১৩৮৯ শকাব্দের মুদ্রা পাওয়া গেছে, পরবর্তী রাজা প্রথম বিজয়মাণিক্যের ১৪১০ শকাব্দের মুদ্রা পাওয়া গেছে; ফলে এই রাজার রাজত্বকাল বর্তমানে ধরা হয় ১৪৬৪-১৪৮৯ খ্রিষ্টাব্দ। তাম্রশাসনের সাক্ষ্য অনুযায়ী রত্নমাণিক্যের আগে ছিল মাণিক্য উপাধিধারী মহামাণিক্য ও প্রথম ধর্মমাণিক্যের শাসন (বিস্তৃত বিবরণের জন্য ছেংথুম ফা নিবন্ধ দেখুন)। ফলে ধরা যেতে পারে যে কয়েক পুরুষ ফা ও মাণিক্য উপাধি পাশাপাশি চলেছিল, কিন্তু রত্নমাণিক্যের সময় থেকে ফা পরিত্যক্ত হয়ে মাণিক্য উপাধি পাকাপোক্ত হয়। রাজমালা অনুসারে রাজা হওয়ার আগে রত্ন বেশ কিছুদিন গৌড় দরবারে ত্রিপুরার প্রতিনিধিত্ব করেন, তার প্রবর্তিত সংস্কারগুলিতেও সেই বঙ্গ-সংস্কৃতির ছাপ পাওয়া যায়। রত্নমাণিক্যের প্রথম বছরের (১৩৮৬ শকাব্দের) মুদ্রা ছিল অপেক্ষাকৃত পুরনো ঘরানার, যাতে রাণী লক্ষ্মী মহাদেবীর নাম আগে এবং রাজার নাম আছে পরে, ধরা যেতে পারে ত্রিপুরার তৎকালীন মাতৃতান্ত্রিক সমাজ-ব্যবস্থার কারণে; একই বছরের আরেকটি মুদ্রায় ত্রিপুরার আরাধ্য চতুর্দশ দেবতার উল্লেখ আছে।[৪] পরবর্তী মুদ্রাগুলিতে সেরকম নেই। রত্নমাণিক্য প্রচুর বাঙালি পরিবারকে ত্রিপুরায় স্থাপন করেছিলেন এবং নিজেও বাংলায় বেশ কিছুদিন ছিলেন, তার পরের দিকের মুদ্রাগুলিতে সেই ব্রাহ্মণ্য প্রভাব লক্ষিত হয়। এই মুদ্রাগুলিতে বাংলা হরফে সংস্কৃত লেখা পাওয়া যায়। একমাত্র অল্প-পরবর্তী মুকুটমাণিক্যের রাণী (মাছত্রী দেবী) বাদে রত্ন-পরবর্তী আর কোন রাজার মুদ্রায় রাজা বা রাণীর উপজাতীয় নাম দেখা যায় না। ফলে ধরা যেতে পারে যে রত্নমাণিক্যের সময় থেকেই ত্রিপুরা ব্রাহ্মণ্য প্রভাবে আসে, যা প্রবলতর হয় ধন্যমাণিক্যের সময়ে। এছাড়াও তিনি বাংলার ধাঁচে ত্রিপুরার প্রশাসন ব্যবস্থার পুনর্গঠন করেন, সেরেস্তা ব্যবস্থা চালু করেন, প্রশাসনিক ভাষা হিসেবে বাংলা ও ফারসি প্রচলন করেন।[১২]

চিত্রশালা সম্পাদনা

 
রত্নমাণিক্যের মুদ্রা, তারিখবিহীন
 
 
রাণীর নাম আগে রেখে রত্নমাণিক্যের মুদ্রা, ১৩৮৬ শকাব্দ
 
 
মানুষের মুখধারী পাখাসমেত ড্রাগনসহ রত্নমাণিক্যের মুদ্রা, ১৩৮৬ শকাব্দ,
স্থানীয় সংস্কৃতিতে রত্নপুরে নির্মিত

তথ্যসূত্র সম্পাদনা

  1. চক্রবর্তী, ভূপেন্দ্রচন্দ্র (১৯৪৭) [১৯৪১]। "হরি রায়ের পুত্ৰগণের বুদ্ধি পরীক্ষা"। রাজমালা (দ্বিতীয় সংস্করণ)। টিচার্স এণ্ড কোং, আগরতলা, ত্রিপুরা 
  2. চক্রবর্তী, ভূপেন্দ্রচন্দ্র (১৯৪৭) [১৯৪১]। "গৌড়েশ্বরের দরবারে ত্রিপুরকুমার রত্ন"। রাজমালা (দ্বিতীয় সংস্করণ)। টিচার্স এণ্ড কোং, আগরতলা, ত্রিপুরা 
  3. চক্রবর্তী, ভূপেন্দ্রচন্দ্র (১৯৪৭) [১৯৪১]। "মাণিক্য উপাধি দান"। রাজমালা (দ্বিতীয় সংস্করণ)। টিচার্স এণ্ড কোং, আগরতলা, ত্রিপুরা 
  4. A Unique Early Coin of the Manikya Dynasty of Tripura[স্থায়ীভাবে অকার্যকর সংযোগ], জহর আচার্য, ২০১৩
  5. Some Epigraphical Records of the Medieval Period from Eastern India, দীনেশচন্দ্র সরকার, ৯২ পৃঃ
  6. The Manikya Dynasty, Genealogy, রয়্যাল আর্ক
  7. History of Tripura, Hubert Herald
  8. History of India, Volume 2, Mountstuart Elphinstone, ৪০ পৃঃ
  9. The History of Bengal, Charles Stewart, 1813, p. 70
  10. ত্রিপুরার স্মৃতি/সূচনা, সমরেন্দ্রচন্দ্র দেববর্মণ, ১৯২৭
  11. A New Coin of Ratna Manikya-I[স্থায়ীভাবে অকার্যকর সংযোগ], জহর আচার্য, ২০১৩
  12. Tripura Administration: The Era of Modernisation, 1870-1972, বাণীকণ্ঠ ভট্টাচার্য, ১৯৮৬, ১৪ পৃঃ
প্রথম রত্নমাণিক্য
রাজত্বকাল শিরোনাম
পূর্বসূরী
ডাঙ্গর ফা
ত্রিপুরা রাজ্যের রাজা
ত্রয়োদশ শতাব্দী
উত্তরসূরী
প্রথম প্রতাপমাণিক্য