প্রথম মালিক শাহ

সেলজুক সুলতান

জালাল আল-দৌলা মালিক-বেগ[] (মালিক শাহ) (ফার্সি : ملكشاه, আধুনিক তুর্কি : Melikşah) ১০৫৫ সালে জন্মগ্রহণ করেন। জন্মকালে তার নাম ছিলো জালাল আল-দৌলা মালিক বেগ, ১০৭২ সালে তিনি তার পিতা সেলজুক সুলতান আল্প আরসালানের উত্তরাধীকারী হন। এবং মালিক শাহ উপাধি গ্রহণ করেন। ১০৯২ সালে তার মৃত্যুর আগ পর্যন্ত তিনি ক্ষমতায় আসীন ছিলেন। [][] তার শাসনকালে সেলযুক সাম্রাজ্য অর্ধ-পৃথিবী পর্যন্ত বিস্তৃত ছিলো।

প্রথম মালিক শাহ
১৪শ শতকের বই জামিউত তাওয়ারিখ থেকে প্রথম মালিক শাহের অভিষেকের দৃশ্য
মহান সেলজুক সাম্রাজ্যের সুলতান
রাজত্ব১৫ই ডিসেম্বর ১০৭২ – ১৯শে নভেম্বর ১০৯২
পূর্বসূরিআল্প আরসালান
উত্তরসূরিমাহমুদ প্রথম
জন্ম১৬ই আগস্ট ১০৫৫
ইসফাহান, সেলজুক সাম্রাজ্য
মৃত্যু১৯ নভেম্বর ১০৯২(1092-11-19) (বয়স ৩৭)
বাগদাদ, সেলজুক সাম্রাজ্য
সমাধি
ইসফাহান
দাম্পত্য সঙ্গী
  • তেরকেন খাতুন
  • যুবাইদা খাতুন
  • তাজুদ্দীন খাতুন সাফারিয়্যা[] (উপপত্নী)
বংশধর
রাজবংশসেলজুক
পিতাআল্প আরসালান
ধর্মসুন্নী ইসলাম
প্রথম মালিক শাহ (মিনিয়েচার চিত্র)

পিতার হত্যাকাণ্ডের পর তিনি তার চাচা কাভুর্টের সাথে তাকে মোকাবেলা করতে হয়। ১০৭৪ সালের জানুয়ারিতে হামাদানের নিকটে তাদের বাহিনী মুখোমুখি হয়। কাভুর্টের বাহিনী আল্প আরসালানের সেনাবাহিনীর তুর্কমেনদের নিয়ে গঠিত হয়েছিল। অন্যদিকে মালিক শাহের বাহিনী গোলাম এবং কুর্দি ও আরব সৈন্য দ্বারা গঠিত হয়েছিল। তুর্কমেনদের দলত্যাগের কারণে কাভুর্ট যুদ্ধে পরাজিত হন। মালিক শাহ তাকে ক্ষমা করলেও পরে বিষপ্রয়োগে হত্যা করা হয়। ধারণা করা হয় যে, মালিক শাহের উজির নিযামুল মুলকের আদেশে এই হত্যাকাণ্ড ঘটে।[]

মালিক শাহের মৃত্যুকালে সেলজুক সাম্রাজ্যের সীমানা, ১০৯২ সাল

মালিক শাহ সেলজুক সাম্রাজ্যের প্রধান হলেও তার উজির নিযামুল মুলকই কার্যত সার্বভৌম ক্ষমতার অধিকারী ছিলেন।[] নিযামের অধীনে সেলজুক সেনাবাহিনী গজনভিদের খোরাসানে অবরুদ্ধ করে রাখে, ফাতেমীদেরকে সিরিয়া থেকে বিতাড়িত করে, সেলজুক রাজত্বের দাবিদারদের পরাজিত করে, জর্জিয়াকে করদ রাজ্যে পরিণত করে, আঞ্চলিক গভর্নরদেরকে আনুগত্য প্রকাশে বাধ্য করে এবং আব্বাসীয় খলিফাকে হীনবল করে ফেলে।[] আনাতোলিয়ায় একটি তুর্কি অভিযানের মধ্যে দিয়ে ১০৭১ সালে আল্প আরসালান মানযিকার্টের যুদ্ধে জয়ী হন। এই অভিযানটি আতসিজ ইবনে উভাকের মত স্বাধীন তুর্কমেন সেনাবাহিনী পরিচালনা করে, কোনো সেলজুক সেনাবাহিনী নয়। এই কারণে রোম সালতানাত সেলজুক পরিবারের কর্তৃত্ব অস্বীকার করে।

১০৭৫ সালে জালালী ক্যালেন্ডার সংস্কার করা হয়[] এবং মালিক শাহের রাজত্বকালে সেলজুক শাসনাধীন অঞ্চল জুড়ে নতুন নতুন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান গড়ে তোলা হয়।[১০] ১০৯২ সালে বাগদাদ যাওয়ার সময় সিহনার কাছে নিযামুল মুলক আততায়ীর হাতে নিহত হন। হত্যাকারী সুফির ছদ্মবেশে ছিল।[১১] নিযামের দেহরক্ষীরা তাকে তৎক্ষণাৎ হত্যা করে তাই তার সম্পর্কে তথ্য উদ্‌ঘাটন করা সম্ভব হয়নি। একটি মত হল হল সে ইসমাঈলীদের কর্তৃক নিযুক্ত হয়েছিল। এরা প্রায়ই সেলজুক কর্মকর্তা ও শাসকদের উপর এগার শতক থেকে আক্রমণ চালিয়ে আসছিল।[১২] এরপর মেলিকশাহ নিজেও অসুস্থ বোধ করেন এবং কয়েক মাস পর মৃত্যুবরণ করেন । এবং তাকে আততায়ীরা বিষ প্রয়োগে হত্যা করেছিল তা ও জানা যায়।[১৩]

তার মৃত্যুর পর সেলজুক রাজবংশ বিশৃঙ্খলায় পতিত হয়। উত্তরাধীকারের প্রতিদ্বন্দ্বী ও বিভিন্ন আঞ্চলিক শাসকরা সাম্রাজ্যকে ছিন্নভিন্ন করে ফেলে এবং একে অন্যের বিরুদ্ধে যুদ্ধে অবতীর্ণ হয়। প্রথম ক্রুসেডের ফলে সেলজুক সাম্রাজ্যের পরিস্থিতি আরো জটিল হয়ে পড়ে। এই ক্রুসেডের ফলে সিরিয়াফিলিস্তিনের বিরাট অংশ মুসলিমদের নিয়ন্ত্রণমুক্ত হয়ে পড়ে। প্রথম ক্রুসেডের সাফল্য মালিক শাহের মৃত্যুর ফলে সৃষ্ট রাজনৈতিক অস্থিরতার উপর নির্ভর করেছে।[১৪]

মালিক শাহ এর ৪ পুত্র ছিল । বার্কিয়ারুক, মুহাম্মাদ তপার , আহমেদ সেনজার এবং মাহমুদ প্রথম ।

মেলিকশাহের স্ত্রী ক্ষমতালোভী টের্কেন মেলিকশাহ এর মৃত্যুর পর আব্বাসীয় খলিফার সহায়তায় ৪ বছরের শিশু মাহমুদকে ক্ষমতায় বসায় । অথচ সিংহাসনের যোগ্য দাবিদার বার্কিয়ারুক, তপার এবং সেনজারকে সিংহাসনে আরোহণ করা হয়নি । নিজামিয়া পরিবারের সহায়তায় তিন ভাই বার্কিয়ারুক, মুহাম্মদ তপার এবং আহমেদ সেনজার ঐক্যবদ্ধভাবে 1094 সালে চূড়ান্তভাবে টের্কেন এবং তাজুল মুল্ককে পরাজিত করে এবং বার্কিয়ারুক সিংহাসনে আরোহণ করে । সেই সময় সাম্রাজ্যের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতার জন্য বার্কিয়ারুকের নির্দেশে আমির তাজুলমুল্ককে ফাঁসি দেওয়া হয় । এবং মেলিকশাহের বিশ্বস্থ সহকারী হাজিব কামাজকে বার্কিয়ারুক তার উজির-ই-আজম ( Khaze ) এবং আতাবেগ হিসেবে নিয়োগ দেয় । মেলিকশাহের এর মৃত্যুর পর সাম্রাজ্য বিশৃঙ্খলায় পতিত হয়েছিল । মহান আল্লাহর কৃপায় বার্কিয়ারুক সেই কঠিন সময়ে সেলজুক সাম্রাজ্যের হাল ধরেন এবং সেলজুক সাম্রাজ্যের পুরনো জৌলুস ফিরিয়ে আনতে চেষ্ঠা করেন । তিনি প্রায় সফল ও হয়েছিলেন । তার সময়ে সেলজুক সাম্রাজ্য এক আলোকবর্তিতাকে দেখতে পায় । কিন্তু দূর্ভাগ্যজনক হলেও সত্যি যে এই মহান সুলতান মাত্র ৮ - ১০ বছর শাসন করতে পেরেছিলেন । 1105 সালে মাত্র ২৬ বছর বয়সে যক্ষ্মা রোগে আক্রান্ত হয়ে একটা যুদ্ধের পূর্বমুহুর্তে সেলজুক সাম্রাজ্যের আলোকবর্তিতা মহান সুলতান বার্কিয়ারুক পরলোকগমণ করেন ।

তারপর সুলতান হয় বার্কিয়ারুকের ছেলে ২য় মেলিকশাহ । সে বয়সে ছোট হওয়ার জন্য মুহাম্মদ তপার সিংহাসন যুদ্ধে নিজের ভাইপোকে পরাজিত করে সিংহাসনে আরোহণ করেন । তপারও একজন মহান সুলতান ছিলেন । তার সময়ে গৃহযুদ্ধ কিছুটা নিবারণ হয় । তিনি ন্যায়নিষ্ঠার সাথে সাম্রাজ্য পরিচালনা করেছিলেন । 1118 সালে সুলতান তপারও মৃত্যুবরণ করেন ।

এরপর সুলতান হয় তার ভাই আহমেদ সেনজার । তিনিই সেলজুক সাম্রাজ্যের সর্বশেষ প্রভাবশালী ব্যাক্তিত্বের একজন। তার কোনো ছেলেসন্তান ছিল না । তাই তার মৃত্যুর পর সুযোগ্য উত্তরসূরীর অভাবে মহান সেলজুক সাম্রাজ্যের পতন হয় এটা ধরে নেয়া যায়৷ কারণ আহমেদ সেনজার এর মৃৃৃৃত্যুর পর সেলজুকরা শুধু ইরান ও আজারবাইজানীয় কিছু অঞ্চল শাসন করত । তবে কিলিজ আরসলান দ্বারা প্রতিষ্ঠিত আনাতোলিয়ায় সেলজুক সাম্রাজ্যের Seljuk Rum Sultanate অনেকদিন টিকেছিল । কোনিয়া ছিল সেলজুুুক রুম সালতানাতের রাজধানী ।

তথ্যসূত্র

সম্পাদনা
  1. Henry Melvill Gwatkin (১৯২৩)। The Cambridge Medieval History: The Eastern Roman empire (717-1453)। পৃষ্ঠা 307। Malik Shāh was recognised by the Caliph as his successor, and invested with the title of 'Amir-al-Mu'minin 
  2. Massignon 1982, পৃ. 162।
  3. "বেগ (পদবি) - উইকিপিডিয়া"। সংগ্রহের তারিখ ২০১৭-১১-১৬ 
  4. Renee Grousset, The Empires of the Steppe:A History of Central Asia, Trans. Naomi Walford, (Rutgers University Press, 1991), 152.
  5. Alp Arslan, C. Cahen, The Encyclopaedia of Islam, Vol. 1, Ed. H.A.R. Gibb, J.H. Kramers, E. Levi-Provencal and J. Schacht, (E.J. Brill, 1986), 421.
  6. Kawurd, C.E. Bosworth, The Encyclopaedia of Islam, Vol. 4, Ed. E. van Donzel, B. Lewis and C. Pellat, (E.J. Brill, 1997), 807.
  7. Gib, H A R (১৯৬০–১৯৮৫)। The Encyclopedia of Islam, vol. 8। Brill Lieden। পৃষ্ঠা 70। 
  8. Gib, H A R (১৯৬০–১৯৮৫)। The Encyclopedia of Islam, vol. 7। Brill Lieden। পৃষ্ঠা 273–275। 
  9. Djalali, S.H. Taqizadeh, The Encyclopaedia of Islam, Vol. 2 , Ed. B.Lewis, C. Pellat and J. Schacht, (E.J. Brill, 1991), 397-398.
  10. Gib, H A R (১৯৬০–১৯৮৫)। The Encyclopedia of Islam, vol. 8। Brill Lieden। পৃষ্ঠা 71। 
  11. Gib, H A R (১৯৬০–১৯৮৫)। The Encyclopedia of Islam, vol. 8। Brill Lieden। পৃষ্ঠা 69–72। 
  12. Gib, H A R (১৯৬০–১৯৮৫)। The Encyclopedia of Islam, vol. 8। Brill Lieden। পৃষ্ঠা 72। 
  13. Gib, H A R (১৯৬০–১৯৮৫)। The Encyclopedia of Islam, vol. 7। Brill Lieden। পৃষ্ঠা 275। 
  14. Jonathan Riley-Smith, The Oxford History of the Crusades, (Oxford University Press, 2002), 213.
পূর্বসূরী
আল্প আরসালান
মহামতি সেলজুকের সুলতান
১০৭২–১০৯২
উত্তরসূরী
মহামতি সেলজুকের মাহমুদ I