প্রত্নতত্ত্ব

বস্তুগত নিদর্শনের ভিত্তিতে অতীত পুনঃনির্মাণ করার বিজ্ঞান

বাংলা প্রত্নতত্ত্ব শব্দটি 'প্র+ত্ন= প্রত্ন' অর্থ- পুরাতন ও 'তৎ+ত্ব= তত্ত্ব'অর্থ-বিজ্ঞান। সমষ্টিগত অর্থ হল, পুরাতন বিষয়ক জ্ঞান। প্রচলিত ধারণায়, বস্তুগত নিদর্শনের ভিত্তিতে অতীত পুনঃনির্মাণ করার বিজ্ঞানকেই প্রত্নতত্ত্ব বলে চিহ্নিত করা হয়।[১] অতীতের সংস্কৃতি ও পরিবেশগত নিয়ে চর্চা করে এমন অন্যান্য বিজ্ঞান বা বিষয়গুলোর (যেমন- ভূতত্ত্ব, পরিবেশ বিজ্ঞান, ভূগোল, ইতিহাস, মনোবিজ্ঞান, দর্শন, ধর্মতত্ত্ব ইত্যাদি) মধ্যে প্রত্নতত্ত্বের বিশেষত্ব হলো- এটি কেবল বস্তুগত নিদর্শন অর্থাৎ প্রামাণ্য তথ্য নিয়ে কাজ করে এবং তার সাথে মানুষের জীবনধারার সম্পর্ক নির্ণয় করে।[২] উদাহরণ হিসেবে বলা যায়- ভূতাত্ত্বিক ও পরিবেশ বিজ্ঞানীরা প্রাচীন ভূমিরূপ ও অন্যান্য পরিবেশগত তথ্য বিশ্লেষণ করে ইনামগাঁওয়ের কয়েকহাজার বছরের বৃষ্টিপাতের ধরনের একটি উপাত্ত হাজির করেছেন। প্রত্নতাত্ত্বিকরা প্রাচীন ভূমিরূপ ও অন্যান্য পরিবেশগত তথ্য উদ্ধারের এই প্রক্রিয়ার সাথে যুক্ত থাকলেও ওই বিশেষ বৃষ্টিপাতের পরিস্থিতিতে মানুষ কীভাবে বসবাস ও জীবনযাপন, এই বিশেষ বিশ্লেষণটি প্রত্নতাত্ত্বিকরা করে থাকেন। ইনামগাওয়ের পরিবৈশিক তথ্য ও গর্তবসতিগুলো এই দুই প্রাচীন উপাদান মিলিয়ে প্রত্নতাত্ত্বিকরা সেই সময়ের মানুষের জীবনপ্রণালি বিশ্লেষণ করতে চেষ্টা করেন। তাই প্রত্নতত্ত্বের অধ্যয়নের মূল বিষয়গুলো হলো- ভৌত ধ্বংসাবশেষ, পরিবেশগত তথ্য, জৈব অবশেষ বা জীবাশ্ম, প্রাকৃতিক-সাংস্কৃতিক ভূদৃশ্যাবলী ইত্যাদি। আর প্রত্নতত্ত্বের কাজ হলো- এইসব বিষয়কে বিশ্লেষণ করে প্রাচীনকালের মানুষ এবং পরিবেশ ও প্রকৃতির তৎকালীন চিত্র বোঝা এবং তার মাধ্যমে মানুষ এবং পরিবেশ ও প্রকৃতির পরিবর্তনের ধারা ব্যাখ্যার মাধ্যমে ভবিষ্যতের মানুষ এবং পরিবেশের রূপরেখা নির্মাণ করা। এর ফলে প্রত্নতত্ত্ব প্রধানত ইতিহাস ও পরিবেশ বিজ্ঞানের এক সহযোগী। তবে পরিবৈশিক প্রেক্ষিতের চেয়ে মানুষের সংস্কৃতির সাথে সরাসরি সম্পর্কিত এমন বিষয়েই দীর্ঘকাল ধরে প্রত্নতাত্ত্বিক কর্মকাণ্ড সীমিত ছিল। কাজেই সাধারণত প্রত্নস্থান ও পুরাতন জিনিসপত্র আবিষ্কার, স্থান ও বস্তু চিহ্নিতকরণ ও নথিভুক্তকরণ এবং বস্তু ও কাঠামোর বিজ্ঞানসম্মত সংরক্ষণ ও তা জনসমক্ষে উপস্থাপন এর মধ্যেই প্রত্নতাত্ত্বিক চর্চা সীমাবদ্ধ ছিল। প্রাকৃতিক ও পরিবৈশিক প্রেক্ষিত এবং অবস্তুগত ভাবগত নিদর্শন যেমন সামাজিক সম্পর্ক ও মনোস্তাত্ত্বিক বিশ্লেষণ বর্তমানে প্রত্নতত্ত্বে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে। এর ফলে প্রত্নতত্ত্ব বর্তমানে মানুষের অতীত ইতিহাসের গৃহবন্দী চর্চার বদলে পরিবেশ, ভূপ্রকৃতি এবং উদ্ভিদ ও প্রাণীজগতের অন্যান্য বিষয়ের অতীত অধ্যয়নের মধ্য দিয়ে ভবিষ্যত নির্মাণের বিজ্ঞান হিসেবে চর্চিত হচ্ছে।

দুজন প্রত্নতাত্ত্বিক বিভিন্ন নিদর্শন বিশ্লেষণ করছেন

উদ্ভব ও বিকাশ সম্পাদনা

খ্রিষ্টপূর্ব ৫৫৬-খ্রিষ্টপূর্ব ৫৩৯ অব্দে বেবিলনের সিপপুরে সামাথ নামক একটি ধ্বংসপ্রাপ্ত মন্দিরের নির্মাতার নাম জানার উদ্দেশ্যে সম্রাট নবনিডাস (Nabonidus) ধ্বংসস্তুপের মধ্যে খননকাজ পরিচালনা করেন। তার এই কীর্তির জন্য তাকে পৃথিবীর প্রথম প্রত্নতাত্ত্বিক বলে অভিহিত করা হয়। সম্রাটের কন্যা এন্নিগালডি নান্না (Ennigaldi Nanna) খননে প্রাপ্ত এবং পার্শ্ববর্তী এলাকা থেকে সংগৃহীত নিদর্শনাদি প্রদর্শনের ব্যবস্থা করেন।

গ্রিক ঐতিহাসিক থুকিডাইডেস (Thucydides)-এর বর্ণনা থেকে জানা যায়, খ্রিষ্টপূর্ব ৪৬০- খ্রিষ্টপূর্ব ৩৮৬ অব্দে এথেন্সের প্রত্নতাত্ত্বিকরা দেলস (Delos)-এর ঈজিয়ান দ্বীপের (Aegean Islands) প্রাচীন সমাধিগুলোতে খনন পরিচালনা করে খননে প্রাপ্ত নিদর্শনাদি সম্পর্কে সেই সময়ের রাজনৈতিক ও সামাজিক প্রেক্ষিতে ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করেছেন। অন্য দিকে, প্রাচীন চীনে পূর্ব-প্রজন্মের নিদর্শনাদি সংরক্ষণের মাধ্যমে পারিবারিক ও মৌখিকভাবে হাজার বছরের প্রাচীন ইতিহাস সংরক্ষণের প্রচলন ছিল। রোমান দার্শনিক লুকরেটিয়াস (Lucretius) খ্রিষ্টপূর্ব ৯৯-খ্রিষ্টপূর্ব ৫৫ অব্দে এবং চীনা দার্শনিক ইউয়ান কং (Yuan K'ang) খ্রিস্টীয় প্রথম শতাব্দীতে চীনাদের প্রত্ননিদর্শন সংরক্ষণের এই চর্চা এবং এই নিদর্শনগুলোর বিশ্লষেণ করে প্রাচীন চীনা সংস্কৃতির রূপরেখা উপস্থাপনের চেষ্টা করেছেন।

ভারতে সুলতানী শাসনামলে প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন সংগ্রহ ও এর ভিত্তিতে ইতিহাস চর্চার সূচনা হয়। মুহম্মদ বিন তুঘলক (১৩২৪-১৩৫১) ব্যাপক প্রত্নতাত্ত্বিক অনুশীলন করেন। তিনি সারা ভারতের বিভিন্ন স্থান থেকে অসংখ্য প্রাচীন নিদর্শন সংগ্রহ করেন এবং এগুলোর আলোকে ইতিহাস রচনার জন্য পেশাদার প্রত্নতাত্ত্বিক নিয়োগ করেন। অশোকস্তম্ভসমূহের শিলালিপির পাঠোদ্ধারের জন্য তার ঐকান্তিক প্রচেষ্টা পৃথিবীর প্রথম পেশাদারী প্রত্নতাত্ত্বিক চর্চার গুরুত্বপূর্ণ উদাহরণ।

চতুদর্শ শতক থেকে ইউরোপের রেনেসাঁ পর্বে অভিজাতদের মধ্যে প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন সংগ্রহের প্রবণতা বৃদ্ধি পায়; ফলে প্রত্নতাত্ত্বিক ও প্রত্ন-লুটেরা উভয় সম্প্রদায় মূলত যেকোনো উপায়ে প্রত্ন নিদর্শন সংগ্রহ করার জন্য উৎসাহী হয়ে ওঠেন। মিশরের পিরামিড ও ইউরোপের প্রাচীন সমাধিগুলোতে প্রত্নতত্ত্ব চর্চার নামে এক ধ্বংসযজ্ঞ পরিচালনা করা হয়। ইতালিতে (রোম) যাচ্ছেতাই খনন এবং নিদর্শন বাণিজ্য এতো জনপ্রিয় হয়ে ওঠে যে, সেখানে বেশকিছু প্রত্ননিদর্শন বিক্রির বাজার ও বার্ষিক প্রত্ননিদর্শন বিক্রয় মেলা আয়োজন করা হতো।

এই প্রথায় প্রথম বিপরীতমুখী প্রয়াস চালান ইংরেজ গবেষক জন লিল্যান্ড (John Leland)। ১৫৩৩ থেকে ১৫৪৭ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত তিনি প্রাচীন নথিপত্র সংগ্রহ, সংরক্ষণ ও গবেষণায় নিয়োজিত থাকেন। অপর ইংরেজ গবেষক উইলিয়াম কার্ডেন (William Carden) ১৫৮৬ খ্রিষ্টাব্দ থেকে ইংল্যান্ডের প্রাচীন নিদর্শনসমূহের এক বিস্তারিত তালিকা প্রণয়ন করেন যা "ব্রিটানিয়া" নামে প্রকাশিত হয়।[৩][৪] তার গবেষণাকর্মটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ, কেননা, তিনি স্থানিক প্রেক্ষিতের সাথে সঙ্গতি রেখে প্রাচীন নিদর্শনগুলোর ব্যাখ্যা করেন এবং উদ্ভিদের দেহবৃদ্ধির ধরনের পার্থক্যের ভিত্তিতে মাটির নিচে চাপা পড়া প্রত্নস্থান শনাক্তকরণের পদ্ধতি আবিষ্কার করেন। প্রত্নস্থান চিহ্নিতকরণ ও বিশ্লেষণের এই এরিয়াল পদ্ধতি (প্রাযুক্তিক উৎকর্ষের কারণে বিবর্তিত হলেও) আজো অত্যন্ত জনপ্রিয়। অপর ইংরেজ প্রত্নতাত্ত্বিক জন অব্রে (John Aubrey) Stonehenge ও Abebury নামে দুটি প্রত্নস্থানের বিশদ বিবরণ ও বিশ্লেষণ করেন। তার বিবরণের ওপর নির্ভর করে ১৭০৯ খ্রিষ্টাব্দে হারকুল্যুনেউম ও পম্পেই অঞ্চলে সুনির্দিষ্ট বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে প্রথম প্রত্নতাত্ত্বিক খনন পরিচালিত হয়। ১৭৬৫ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত এখানে একটানা খনন পরিচালিত হয়, এবং প্রাপ্ত নিদর্শনসমূহের অদ্ভুত ধাঁধায় খনন পরিত্যাক্ত হয় এবং তা থেকে কোনো ইতিহাস ব্যাখ্যা করা সম্ভব হয়নি। পরবর্তীতে ১৮৬০ খ্রিষ্টাব্দে খনন আবার শুরু হয়, এখনো সেখানে খনন চলছে।

১৮১৮ খ্রিষ্টাব্দে ডেনিশ প্রত্নতাত্ত্বিক ও কিউরেটর সি জে থমসন "থ্রি এজ সিস্টেম" আবিষ্কার করলে ইতিহাসের অনেক অমীমাংসিত প্রশ্নের উত্তর দেওয়া সহজ হয়ে ওঠে। ফলে প্রত্নতত্ত্ব চর্চা এক নতুন গতি পায়। তিনি পৃথিবীর ইতিহাসকে পাথর যুগ, ব্রোঞ্জের যুগলোহার যুগ - এই তিনটি ভাগে ভাগ করলে, পাথরের হাতিয়ার ও ব্রোঞ্জের হাতিয়ারগুলো আসলে কী তা বোঝা সম্ভব হয়, এবং ধর্মগ্রন্থ অনুযায়ী ব্যাখ্যা প্রদানের হাত থেকে প্রত্নতত্ত্ব রক্ষা পায়। অপর ডেনিশ প্রত্নতাত্ত্বিক জে জে ওয়ারসাই ১৮৩৬ খ্রিষ্টাব্দে এই গবেষণাকে একটি একক প্রত্নস্থানের স্তরবিন্যাসের মাধ্যমে প্রমাণ করতে সক্ষম হন। একটি প্রত্নস্থানের বিভিন্ন গভীরতায় বিভিন্ন ধরনের প্রত্নসামগ্রী যে একই সময়ের ব্যক্তিরা ব্যবহার করেনি, তা যে মানুষের ইতিহাসের বিকাশের ও পরিবর্তনের ধারাবাহিকতা এই তথ্য প্রত্নতাত্ত্বিক গবেষণায় এক অভাবনীয় গতি দেয়।

১৮৬০ খ্রিষ্টাব্দে ব্যাপক উৎসাহ ও উদ্দীপনা নিয়ে পম্পেই ও হারকুল্যুনেউম-এ প্রত্নতাত্ত্বিক খনন শুরু হয় এবং এইবার প্রত্নতাত্ত্বিকরা উক্ত প্রত্নস্থলের মানুষের জীবনপ্রণালি ব্যাখ্যায় অগ্রগতি লাভ করেন। এই সাফল্য দেশ-বিদেশের প্রত্নতাত্ত্বিকদের মধ্যে প্রত্নতাত্ত্বিক খননের এক উৎসবের সূচনা করে। কার্টিয়াস গ্রিসের অলিম্পিয়ায়, কোল্ডওয়ে এবং ওয়াল্টার মেসোপটেমিয়ায়, হার্বাট কনসট্যান্টিন্যাপল ও তুরস্কের বিভিন্ন জায়গায়, পিট রিভার্স ইংল্যান্ডে এবং হুইলার ভারতে প্রত্নতাত্ত্বিক খনন সূচনা করেন। এই প্রত্যেকটি খনন পৃথিবীর ইতিহাসে নতুন অধ্যায় যুক্ত করতে সক্ষম হয়েছে।

আধুনিক প্রত্নতত্ত্ব সম্পাদনা

আধুনিক প্রত্নতত্ত্ব চর্চা শুরু হয় জার্মানদের হাতে। জার্মান মানবতাবাদী ও প্রাক-ইতিহাসবেত্তা (প্রিহিস্টোরিয়ান) গুস্তাফ কোসিনা ১৮৯৫ হতে ১৯৩১ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত মৃত্যুর আগ পর্যন্ত "বসতি প্রত্নতত্ত্ব" (সেটেলমেন্ট প্রত্নতত্ত্ব) নামে প্রত্নতত্ত্বের এক আধুনিক মতবাদের বিকাশ ঘটান। এর মূল ভিত্তি ছিল, বস্তুনিদর্শনের (আর্টিফ্যাক্ট) ধরনের মাধ্যমে মানব সংস্কৃতি নির্ণয় এবং স্বতন্ত্র সাংস্কৃতিক অঞ্চলকে প্রাচীন ট্রাইব বা এথনিক গ্রুপের বসতি এলাকা বলে চিহ্নিত করা। তার পদ্ধতির সবচে সমস্যাযুক্ত বিষয় হলো বর্তমান মানুষের সংস্কৃতির সঙ্গে অতীত সংস্কৃতির ধারাবাহিকতাকে সরাসরি বর্ণনা করা। এর মাধ্যমে তিনি বর্তমান জার্মানদেরকেই নর্ডিক, আর্য বা ইন্দো-ইউরোপীয় (ইন্দো-জার্মান)-দের উত্তরাধিকার ঘোষণা করেন। তিনি অন্য সংস্কৃতি ও মানুষদের ওপরে জার্মানদের শ্রেষ্ঠত্ব ঘোষণা করেন। প্রথম বিশ্বযুদ্ধে জার্মানদের পরাজয়ের পর তিনি প্রত্নতাত্ত্বিক গবেষণার মাধ্যমে যুক্তি করতে থাকেন, লৌহ যুগে পোল্যান্ড জার্মানদের বসতির একটি অংশ ছিল। কোসিনার মৃত্যুর পর জাতীয় সমাজতান্ত্রিকদের উদ্ভব হলে তারাও তার এই ডগমা গ্রহণ করে। থার্ড রাইখের সময় (হিটলারের নাজী শাসনামলকে থার্ড রাইখ বলা হয়) এই মতবাদ পৃষ্ঠপোষকতা পায়। নাজী শাসনে এটি প্রাতিষ্ঠানিক সহযোগিতা পায়। আলফ্রেড রোজেনবার্গ এবং হাইনরিখ হিমলার এই মতবাদ বৈজ্ঞানিকভাবে প্রমাণের চেষ্টা করেন। এডলফ হিটলার এদের উভয়কে সরাসরি সাহায্য করেন। হিমলার গড়ে তোলেন Deutsches Ahnenerbe (জার্মান বংশগতির উত্তরাধিকার) নামক একটি সংস্থা। এরা কোসিনার বসতি প্রত্নতত্ত্বের বাধ্যতামূলক ব্যবহার করে (Jones ১৯৯৮:৩)। তারা জার্মানীর পূর্বদিকে বিস্তার আবিষ্কার করে। এই বিস্তার ছিল পোল্যান্ড, দক্ষিণ রাশিয়া এবং ককেশাস অঞ্চলে। প্রত্নতত্ত্বের এই ধারার সঙ্গে আরও যারা এই দলে যুক্ত ছিলেন তাদের মধ্যে হ্যান্স রাইনার্থ ও হারমান উইর্থের নাম উল্লেখযোগ্য। ইউরোপ বা বৈশ্বিকভাবে ব্যাপারটি যেমন-ই হোক না কেন, এই গবেষণা জার্মানদের জাতীয় চেতনা ও অহমবোধ বিকাশে যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ ছিল।

অন্যদিকে, পোলিশ প্রত্নতাত্ত্বিক Konrad Jazdewski ১৯৪৯ খ্রিষ্টাব্দে ইউরোপের প্রত্নতাত্ত্বিক অ্যাটলাস প্রকাশ করেন, তাতে তিনি ব্রোঞ্জ যুগে মধ্য ও পূর্ব ইউরোপে স্লোবানিক জাতির সম্প্রসারনকে চিত্রিত করেন (Kristiansen ১৯৯২:১৮), অর্থাৎ এক অর্থে তিনি পোলিশ (স্লোবানিক)-দেরকেই ইউরোপের প্রকৃত মালিক হিসেবে উপস্থাপন করেন; এটি পোলিশদের আত্মশ্লাঘার একটি হাতিয়ার হিসেবে আজো ক্রিয়াশীল।

একই ভাবে ফ্রান্সে রোমান সাম্রাজ্যের সম্প্রসারণ প্রতিহতকরণে গলদের প্রতিরোধের প্রত্নতাত্ত্বিক নথিগুলো ফরাসি জাতীয় চেতনা বিকাশে কেন্দ্রীয় ভূমিকা পালন করে। আয়ারল্যান্ডের জাতীয় চেতনার বিকাশ ঘটেছে লা টেনে-র ওপরে প্রত্নতত্ত্বের গবেষণালব্ধ তথ্যগুলো প্রকাশিত হওয়ার পর। যদিও জার্মানদের মতো এখানেও তা একটি রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের কারণ ঘটায়, কিন্তু আইরিশ জাতীয় প্রেরণার এক উৎস হিসেবেই থেকে যায়। একই ভাবে ইসরাইলের মাসাদা অঞ্চলে প্রত্নতাত্ত্বিক উৎখননের পর দেখা যায়- সেখানে রোমান সাম্রাজ্যের বিরোধিতাকারী একদল ইহুদি গণ-আত্মহত্যা করেছিল; এই ঘটনা এবং স্থানটি ইসরাইল রাষ্ট্রটির জাতীয় চেতনার প্রতীক হিসেবে তৈরি হয়েছে, স্থানটি সামরিক অনুষ্ঠানাদির কেন্দ্র হিসেবেও গড়ে উঠেছে (Zarubavel ১৯৯৪)।

প্রত্নতত্ত্বের এই ধারার বিকাশ উত্তর আফ্রিকা এবং ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রাম গড়ে তুলতে একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে (Mattingly ১৯৯৬:৫৬-৯ এবং Paddayya ১৯৯৫:১৪১)। সাম্প্রতিক সময়ে অযোধ্যার বাবরি মসজিদ-রামমন্দির বিতর্কেও এটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ রূপে ব্যবহৃত হয়েছে (Rao ১৯৯৪, Pollock ১৯৯৬)।

বসতি প্রত্নতত্ত্বের পর প্রত্নতত্ত্বের যে মতবাদটি সবচেয়ে বেশি প্রভাব-বিস্তারী ছিল তা হলো সংস্কৃতি-ঐতিহাসিক প্রত্নতত্ত্ব। গর্ডন চাইল্ড এই মতবাদের প্রধান উদ্যোক্তা। প্রত্নতত্ত্ব চর্চায় তার ব্যাপক অবদানের জন্য অনেকে তাকে প্রত্নতত্ত্বের জনক-ও বলে থাকেন। যেসব বিষয় সাধারণভাবে সংস্কৃতির অংশ বলে গণ্য হয় এবং প্রায়ই যা প্রাচীন সামাজিক সত্তার বিভিন্ন খণ্ডাংশের ফল হিসেবে গণ্য হয় তার এককের স্থানিক ও সময়গত কাঠামোর মধ্যে তৈরি বস্তুগত নিদর্শনের অভিজ্ঞতাবাদী সারসংক্ষেপ, বর্ণনা এবং শ্রেণীকরণের (ক্লাসিফিকেশন) বৈশিষ্ট্যকেই সংস্কৃতি-ইতিহাস বলা যেতে পারে। সংস্কৃতি-ঐতিহাসিক প্রত্নতত্ত্বের বিভিন্ন আঞ্চলিক ও জাতীয় ঐতিহ্যের ভিন্নতা (বা বৈচিত্র্য) সত্ত্বেও এটাই ছিল বিশ শতকের ইউরোপ ও পৃথিবীর অন্যত্র প্রধান প্রত্নতাত্ত্বিক মতবাদ। এই পদ্ধতি অনুসরণ করে অতীত জনগণ বা জাতিগোষ্ঠীর সাংস্কৃতিক ইতিহাস তৈরি করা হয়, যা আসলে নাজি জার্মানীর প্রত্নতাত্ত্বিক কাঠামোর মূলনীতির সঙ্গে একই।

জাপানের ঐতিহ্যবাহী কৃষি ও কৃষিনির্ভর সংস্কৃতির প্রতি জাতীয় গুরুত্ব আরোপ এবং অস্ট্রেলিয়ার আদিবাসীদের ভোটাধিকার প্রতিষ্ঠায় প্রত্নতত্ত্বের এই ঘরানার গবেষণাগুলো অত্যন্ত প্রভাব বিস্তার করে।

১৯৭৮ খ্রিষ্টাব্দে যুক্তরাষ্ট্রের অ্যারিজোনায় তাসকান শহরে ড. উইলিয়াম রাথজে পরিচালিত ফেলনাময়লা প্রকল্প (The Garbage Project) আধুনিক প্রত্নতত্ত্বের এক মাইলস্টোন। শহরের অধিবাসীদের ফেলে দেওয়া ময়লা-আবর্জনা থেকে শহরের মানুষের স্বভাব-চরিত্র-সংস্কৃতি বিশ্লেষণ করে তিনি প্রাচীন নিদর্শন থেকেও যে প্রাচীন মানুষের সংস্কৃতি ব্যাখ্যা করা সম্ভব তা প্রমাণ করেন। এর ফলে প্রত্নতত্ত্ব শুধু বিজ্ঞানকে হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করে, তা-ই নয়, বরং পদ্ধতি হিসেবেও প্রত্নতত্ত্ব যে বৈজ্ঞানিক তা প্রমাণিত হয়। এই গবেষণা প্রকাশিত হওয়ার পর বিভিন্ন দেশে সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন দপ্তরে প্রত্নতাত্ত্বিক পদ্ধতিতে তথ্য আহরণ করা শুরু হয় এবং বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রত্নতত্ত্ব জনপ্রিয় বিষয় হিসেবে চালু করা হয়। এর ফলে আশির দশক থেকে বিশ্বব্যাপী প্রত্নতত্ত্ব চর্চা ব্যাপক বৃদ্ধি পেলে এর মতাদর্শিক ঘরানারও ব্যাপক বিস্তার ঘটে। কাঠামোবাদী, প্রক্রিয়াবাদী, উত্তর-প্রক্রিয়াবাদী, নির্মাণবাদী ইত্যাদি নানা ঘরানা দ্রুত প্রকাশিত হয়। আপাত অর্থে বিভিন্ন ছোট ছোট ইস্যুতে প্রত্নতাত্ত্বিকদের মধ্যে আলাদা আলাদা গ্রুপ সৃষ্টি হয়, পিটার আকো একে বলছেন "ঘেটো"। এই সময় প্রথমবারের মতো মানুষের ক্রিয়া প্রতিক্রিয়াকে পরিস্থিতি (সিচুয়েশন) এবং প্রেক্ষিত (কনটেক্সট) এর নিরিখে গবেষণা করার প্রচেষ্টা শুরু হয়। আরও পরিষ্কার করে বললে, প্রত্নতত্ত্বের রাজনৈতিক গুরুত্ব বৃদ্ধি পায়; অতীত মানুষের বিভিন্ন গোষ্ঠী, তাদের পারস্পরিক সম্পর্ক-সূত্র ও সম্পর্কের সামর্থ্য, রাজনৈতিক সংগঠন ও সামাজিক স্তরায়নকে আরও ঘনিষ্ঠভাবে বিশ্লেষণের মাধ্যমে ঊনিশশো আশির দশকের বিশ্ব পরিস্থিতির ব্যাখ্যা করার ও সমাধানের পথনির্দেশের জন্য প্রত্নতাত্ত্বিকরা তাদের অবস্থান থেকে অবদান রাখার চেষ্টা করেন। গোষ্ঠী, শ্রেণী, সীমানা, আদিবাসী, জাতিত্ব ইত্যাদি প্রকরণগুলো প্রত্নতত্ত্বে আলোচিত হতে থাকে। এই সময় আকো, জোনস ও আরও কিছু লন্ডন বিশ্ববিদ্যালয়ভিত্তিক প্রত্নতাত্ত্বিকের উদ্যোগে কাজের তত্ত্ব বলে এক তত্ত্বহীন ঘেটো-র উদ্ভব ঘটে, এদের মূল বক্তব্য হলো- কাজ করতে করতেই একজন গবেষক তার তত্ত্ব খুঁজে পাবেন, যার সাথে পৃথিবীতে প্রচলিত অন্য তত্ত্বসমূহের কোনো মিল না-ও থাকতে পারে। কিন্তু অন্য তত্ত্বের প্রতি পূর্ব-ধারণার (প্রি-কনসেপ্ট) ফলে তিনি যদি ভ্রান্ত সিদ্ধান্তে উপনীত হন, সেটি সত্যিই বিপজ্জনক।

প্রত্নতত্ত্বের কাজের পদ্ধতি সম্পাদনা

জরিপ সম্পাদনা

উৎখননের সম্ভাব্যতা বা বাস্তবতা যাচাই করার জন্যই জরিপ করা হয়।পদ্ধতিগতভাবে,প্রত্নস্থান বা প্রত্ননির্দশন শনাক্ত করা, খুঁজে বের করা,তা ভূ-পৃষ্ঠে চিহ্নত করা, মানচিত্রে শনাক্ত করা,এবং গবেষণার জন্য প্রয়োজনীয় তথ্য উপাত্ত সংগ্রহ করাকে প্রত্নতাত্ত্বিক জরিপ বলে। জরিপ গবেষণা ২ ধরনের হয়ে থাকে।যথাঃ ১.জরিপ-পূর্ব গবেষণা. ২.মাঠ জরিপ গবেষণা.

অনুসন্ধান সম্পাদনা

কোন প্রত্নতাত্ত্বিক উৎখননের পূর্বে প্রাকখনন গবেষণা সম্পাদন করতে হয়। এর জন্য প্রথম Archaeo- book study বা library work কার্য সম্পর্কে ধারণা অর্জন এর পর কোন জায়গায় প্রত্ননিদর্শন আছে কিনা বা ঐ স্থানটি প্রত্নস্থান কিনা তা পায়ে হেটে জরিপ/খুজে বের করার মাধ্যমকে অনুসন্ধান বলে।

উৎখনন সম্পাদনা

কোনো গবেষণার ক্ষেত্রে অনুসন্ধানের ঠিক পরের স্থানটি দখল করে আছে উৎখনন। এটি এমন একটি প্রক্রিয়া যা কোনো পুস্তকে লিপিবদ্ধ নয়। উৎখনন হলো এমন একটি বিষয় যা কোনো প্রত্নতত্ত্ববিদও পুনঃপুন খনন কার্য সম্পাদনের মাধ্যমেও কোনো প্রত্নস্থান সম্পর্কে সঠিক তথ্য পাওয়ার বিশেষ প্রক্রিয়া। বিভিন্ন বৈজ্ঞানিক প্রক্রিয়া যেমন; grid পদ্ধতি, এরিয়াল ইমেজ, স্যাটেলাইট ইমেজ ইত্যাদি পদ্ধতি অবলম্বন করে উৎখনন কার্য সম্পন্ন করা যায়।

সংরক্ষণ সম্পাদনা

আমরা যখন কোনো প্রত্নস্থান থেকে কোন প্রকার প্রত্নবস্তুু পাই সেটাকে নানা প্রকার পদার্থ দ্বারা এটিকে তার সাথে মানানসই করে এটিকে কোন একটি জাদুঘর বা প্রত্নতাত্ত্বিক দর্শনীয় জায়গায় রাখি এটাই সংরক্ষণ।আবার যাতে কোনো প্রকার বিলুপ্তির আশংক্ষা না থাকে সে পর্যায়ে রাখাকে সংরক্ষণ বলে।

নথিভুক্তকরণ সম্পাদনা

আমরা যখন কোনো প্রত্নবস্তু পাই সেটি কীভাবে পেলাম,সেটি কোন সময়ের,তার ওজন কত,তার উচ্চতা,তার রং,তার নাম,কতটুকু মাটির নিচে পেলাম,কোন অঞ্চলের,এভাবে খুঁটিনাটি সব লিখাকেই বলে নথিভুক্তকরন।

প্রত্নতত্ত্বের উপাদান সম্পাদনা

প্রত্নতত্ত্বের উপাদান হিসেবে সাধারণভাবে ভৌত ধ্বংসাবশেষ, পরিবেশগত তথ্য, জৈব অবশেষ বা জীবাশ্ম, প্রাকৃতিক-সাংস্কৃতিক ভূদৃশ্যাবলী ইত্যাদিকে বিবেচনা করা হয়। তবে ভাবগত নিদর্শন যার আপাত অর্থে কোনো বহনযোগ্য, বাণিজ্যযোগ্য বা দৃশ্যমান অস্তিত্ব নাই এমন কোন বিষয়ও হতে পারে প্রত্নতাত্ত্বিকের প্রধান সূত্র।ক

আরও দেখুন সম্পাদনা

তথ্যসূত্র সম্পাদনা

  1. Sinclair, A. (২০১৬)। "The Intellectual Base of Archaeological Research 2004–2013: A visualisation and analysis of its disciplinary links, networks of authors, and conceptual language"। Internet Archaeology (42)। ডিওআই:10.11141/ia.42.8  
  2. Kristiansen, Kristian (২০০৯)। "The Discipline of Archaeology"The Oxford Handbook of ArchaeologyOxford University Pressআইএসবিএন 9780191743443 
  3. "John Leland"Encyclopaedia Britannica (Online সংস্করণ)। ১৪ এপ্রিল ২০২১। ২২ এপ্রিল ২০১৬ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ২৭ অক্টোবর ২০২১ 
  4. "William Camden"Encyclopaedia Britannica (Online সংস্করণ)। ২৮ এপ্রিল ২০২১। ২৭ অক্টোবর ২০২১ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ২৭ অক্টোবর ২০২১ 

প্রত্নতত্ত্বের ইতিহাস ও নীতিমালা