পূর্ব পাকিস্তান রেনেসাঁ সোসাইটি

সংস্থা

পূর্ব পাকিস্তান রেনেসাঁ সোসাইটি হলো একটি রাজনৈতিক সংগঠন যেটি মূলত ভারতীয় মুসলমানদের, বিশেষত বাঙালি মুসলমানদের জন্য পৃথক মুসলিম রাষ্ট্রের ধারণাটি সাংস্কৃতিক ও বুদ্ধিবৃত্তিকভাবে প্রচার ও প্রসারের উদ্দেশ্যে গঠিত হয়েছিল।[১] সংগঠনের প্রতিষ্ঠাতা ও নেতাদের মধ্যে ছিলেন উক্ত সোসাইটির সভাপতি আবুল কালাম শামসুদ্দিন, হাবিবুল্লাহ বাহার চৌধুরী এবং মুজিবুর রহমান খান[১][২][৩][৪]

পূর্ব পাকিস্তানের মানচিত্র, যা পরবর্তীকালে বাংলাদেশ হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে।

ইতিহাস সম্পাদনা

"দ্বিজাতিতত্ত্ব" এর মূলকথা হলো ভারতের হিন্দু এবং মুসলমানরা কোন একক জাতি নয় এবং তারা জাতি হিসাবে একসঙ্গে থাকতে পারে না। স্যার মুহাম্মদ ইকবাল, চৌহদারি রহমত আলী এবং নিখিল ভারত মুসলিম লীগের সভাপতি মুহাম্মদ আলী জিন্নাহর মতো মুসলিম রাজনীতিবিদ এবং বুদ্ধিজীবীরা এই দ্বিজাতিতত্ত্বের পক্ষে ছিলেন এবং তাঁরা এটি প্রচারের জন্য কাজ করেছিলেন।[৫][৬] ১৯৪০ সালের ২৩ শে মার্চ নিখিল ভারত মুসলিম লীগ লাহোর প্রস্তাব (যা পাকিস্তান প্রস্তাব নামেও পরিচিত) গ্রহণ করলে ভারতীয় মুসলমানদের জন্য পৃথক রাষ্ট্রের দাবি স্পষ্ট আকার ধারণ করে। প্রস্তাবটিতে ব্রিটিশ ভারতের মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ প্রদেশগুলিকে পৃথক, স্বতন্ত্র রাষ্ট্র হিসেবে গঠন করার আহ্বান জানানো হয়েছিল - সুস্পষ্টভাবেই এতে কোন একক রাষ্ট্র গঠনের কথা বলা হয়নি।[১]

প্রতিষ্ঠা সম্পাদনা

১৯৪২ সালের ৩০ আগস্ট কলকাতায় আজাদ পত্রিকার কার্যালয়ে অনুষ্ঠিত এক সভায় বাঙালি মুসলিম নেতাকর্মীরা সাংস্কৃতিক ও মেধাগত দিক থেকে একক মুসলিম রাষ্ট্রের ধারণাকে সমর্থন করার একটি মঞ্চ হিসাবে পূর্ব পাকিস্তান রেনেসাঁ সোসাইটি গঠনের সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন। সোসাইটির পক্ষ থেকে নিয়মিত সাপ্তাহিক সভা আয়োজন করা হত এবং সেখানে বিভিন্ন বিষয় উপস্থাপন ও সেগুলি নিয়ে আলোচনা করা হত। সোসাইটি গঠনের মূল ভিত্তি ইসলাম হওয়া সত্ত্বেও সভাগুলি যে কেবল মুসলমানদেরই জন্য এমন কোন বাধ্যবাধকতা ছিল না।[৪] তেমনি একটি সভায় মনবেন্দ্রনাথ রায় পাকিস্তান ও গণতন্ত্রের বিষয়ে একটি ভাষণ দিয়েছিলে। এতে তিনি ভারতীয় মুসলমানদের জন্য স্ব-শাসনের আবশ্যকতা তুলে ধরেছিলেন।[৪] ১৯৪৪ সালের সেপ্টেম্বর মাসে মুজিবুর রহমান খান, অর্থনীতিবিদ এম সাদেকের সঙ্গে যৌথভাবে পূর্ব পাকিস্তান: এর জনসংখ্যা, সীমানা ও অর্থনীতি শীর্ষক একটি পুস্তিকা প্রকাশ করেন যেখানে ভবিষ্যৎ পূর্ব পাকিস্তানের সরকারব্যবস্থা, অর্থনীতি, জনসংখ্যা, ভৌগোলিক সীমানা এবং নিরাপত্তা প্রভৃতি বিষয়বস্তু সম্পর্কে আলোচনা করা হয়।[৪]

১৯৪৪ সালের জুলাই মাসে কলকাতার ইসলামিয়া কলেজে সোসাইটির প্রথম পরিষদ গঠন করা হয়। উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে উপস্থিতদের মধ্যে ছিলেন খাজা নাজিমুদ্দিন, হোসেন শহীদ সোহ্‌রাওয়ার্দী, হাসান সোহরাওয়ার্দী, নুরুল আমিন, মোহাম্মদ আকরাম খান, একে ফজলুল হক, আবুল কাসেম, মৌলভি তমিজউদ্দিন খান, শাহাদাত হোসেন, গোলাম মোস্তফা, এস ওয়াজিদ আলী, আবু জাফর শামসুদ্দিন, আবুল হুসেন, গোলাম কুদ্দুস, সুভাষ মুখোপাধ্যায়, গোপাল হালদার প্রমুখ।[৪]

আদর্শগত ভিন্নতা সম্পাদনা

মুসলিম লীগ এবং পাকিস্তান রাষ্ট্রের সমর্থকদের বেশিরভাগই ব্রিটিশ ভারতীয় প্রদেশ পাঞ্জাব, খাইবার পাখতুনখোয়া (তদানীন্তন উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশ), সিন্ধু, বেলুচিস্তান এবং বাংলাকে নিয়ে গঠিত একক পাকিস্তান রাষ্ট্রের দাবি জানিয়েছিল এবং উর্দু ভাষাকে মুসলমানদের একমাত্র সরকারী ভাষা ও পারস্পরিক যোগাযোগের মাধ্যম হিসেবে প্রতিষ্ঠা করতে চেয়েছিল।[১] তবে, পূর্ব পাকিস্তান রেনেসাঁস সোসাইটির যুক্তি ছিল যে হিন্দু-মুসলিমই কেবল পৃথক জাতি ছিল না, বরং জাতিগত, সাংস্কৃতিক এবং ভৌগোলিক ভিত্তিতে বাঙালি মুসলমানরাও ভারতের অন্যান্য অঞ্চলের মুসলমানদের থেকে আলাদা ছিল।[১][৩] সোসাইটি যুক্তি দিয়েছিল যে জাতিগত বিভিন্নতা, সাংস্কৃতিক বৈচিত্র, ভৌগোলিক সীমানা প্রভৃতিকে বুড়ো আঙ্গুল দেখিয়ে কেবল ধর্মের ভিত্তিতে একটি রাষ্ট্র গঠিত হতে পারে না।[১][৩] সোসাইটি এবং বাঙ্গালি মুসলিম লীগের সমর্থকরা দৃঢ়ভাবে জানিয়েছিল যে বাঙালি মুসলমানদের জন্য একক পাকিস্তান রাষ্ট্রের অংশ না হয়ে "পূর্ব পাকিস্তান" নামে একটি স্বাধীন রাষ্ট্র গঠন করাই মঙ্গলজনক হবে।[১][২] সোসাইটি বাঙালি সংস্কৃতি ও ভাষার মর্যাদাকে গুরুত্ব দিয়েছিল। তবে পাকিস্তানের অনেক সমর্থকই একে "হিন্দুয়ানী" এবং "সংস্কৃত কালচার" বলে সমালোচনা করেছিলেন।[১][৭]

পরিণাম সম্পাদনা

১৯৪৭ সালে ভারত বিভাগ হয়। এই বিভাজনের ফলে মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ পূর্ব বাংলা (পূর্ব পাকিস্তান নামেও পরিচিত) তৈরির জন্য বাংলাকে ভাগ করা হয়। ফলে পূর্ব বাংলা পাকিস্তানের অংশ হয়ে যায়; আর হিন্দু সংখ্যাগরিষ্ঠ পশ্চিমবঙ্গ এবং আসাম ভারতের অংশে পরিণত হয়। দেশ বিভাগের পর এই সোসাইটি বিলুপ্ত হয়ে যায় । সোসাইটির বেশ কয়েকজন নেতৃবৃন্দ বাংলা ভাষা আন্দোলনে (১৯৫৩-১৯৫৬) সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করেন এবং নেতৃত্ব দেন। উল্লেখ্য যে বাংলা ভাষা আন্দোলন ছিল উর্দুর পাশাপাশি বাংলা ভাষাকে পাকিস্তানের দ্বিতীয় রাষ্ট্রভাষা হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়ার জন্য পূর্ব পাকিস্তানে সংঘটিত গণ-সংগ্রাম।[১][২][৩]

তথ্যসূত্র সম্পাদনা

  1. Ian Talbott (১৯৯৮)। Pakistan: A Modern History। Palgrave Macmillan। পৃষ্ঠা 88–92। আইএসবিএন 978-0-312-21606-1 
  2. Harun-or-Rashid (২০০৩)। The foreshadowing of Bangladesh: Bengal Muslim League & Muslim politics, 1906–47। University Press। আইএসবিএন 978-984-05-1688-9 
  3. Nagendra Kr. Singh (২০০৩)। Encyclopaedia of Bangladesh। Anmol Publications Pvt. Ltd.। পৃষ্ঠা 180–82। আইএসবিএন 978-81-261-1390-3 
  4. ওয়াকিল আহমদ (২০১২)। "পূর্ব পাকিস্তান রেনেসাঁ সোসাইটি"ইসলাম, সিরাজুল; মিয়া, সাজাহান; খানম, মাহফুজা; আহমেদ, সাব্বীর। বাংলাপিডিয়া: বাংলাদেশের জাতীয় বিশ্বকোষ (২য় সংস্করণ)। ঢাকা, বাংলাদেশ: বাংলাপিডিয়া ট্রাস্ট, বাংলাদেশ এশিয়াটিক সোসাইটিআইএসবিএন 9843205901ওএল 30677644Mওসিএলসি 883871743 
  5. Robin W. Winks, Alaine M. Low (২০০১)। The Oxford history of the British Empire: Historiography। Oxford University Press। আইএসবিএন 978-0-19-924680-9 
  6. Liaquat Ali Khan (১৯৪০)। Pakistan: The Heart of Asia। Thacker & Co. Ltd.। আইএসবিএন 978-1-4437-2667-2 
  7. Oldenburg, Philip (আগস্ট ১৯৮৫)। ""A Place Insufficiently Imagined": Language, Belief, and the Pakistan Crisis of 1971"। The Journal of Asian Studies, Vol. 44, No. 4: 711–733। আইএসএসএন 0021-9118জেস্টোর 2056443ডিওআই:10.2307/2056443