পিয়েতা (মাইকেলেঞ্জেলো)

পিয়েতা (১৪৯৮ - ৯৯) হল ইউরোপীয় নবজাগরণ বা রেনেশাঁস যুগের বিশ্ববিখ্যাত শিল্পী, চিত্রকর, ভাস্কর ও স্থপতি মাইকেলেঞ্জেলোর সৃষ্ট এক অনবদ্য কীর্তি। পঞ্চদশ শতাব্দীর একেবারে শেষে তৈরি এই অনুপম ভাস্কর্যটি বর্তমানে রোমে ভ্যাটিকান সিটির সন্ত পিওত্‌র্‌'এর ব্যাসিলিকা গির্জায় রক্ষিত। এই একই বিষয়ের উপর তৈরি শিল্পীর একাধিক শিল্পকর্মর মধ্যে এটি প্রথম। কারারা-মার্বেলে তৈরি এই মূর্তিটি আসলে ফরাসি কার্ডিনাল জ্যঁ দ্য বিলেরে'র নির্দেশে গির্জায় তার স্মৃতিরক্ষার্থে একটি আলঙ্কারিক ফলক হিসেবে তৈরি করা হয়েছিল।[১] কিন্তু অষ্টাদশ শতাব্দীতে এই ভাস্কর্যটি তার বর্তমান অবস্থানে সরিয়ে নিয়ে আসা হয়। মাইকেলেঞ্জেলোর তৈরি এটি এমন একটি বিরল মূর্তি, যার উপর শিল্পীর নিজ সাক্ষর রক্ষিত আছে।[২]

পিয়েতা
শিল্পীমাইকেলেঞ্জেলো
বছর১৪৯৮ - ৯৯
ধরনমার্বেল
আয়তন১৭৪ সেমি × ১৯৫ সেমি (৬৮.৫ ইন × ৭৬.৮ ইন)
অবস্থানসন্ত পিওত্‌র্‌'এর ব্যাসিলিকা, ভ্যাটিকান সিটি

ভাস্কর্যটির মূল বিষয়বস্তু হল, মা মেরির কোলে শায়িত যিশুর মৃতদেহ। এখানে প্রতিটি চরিত্রই এতটাই জীবন্ত যা সত্যিই বিষ্ময়ের উদ্রেক করে। নবজাগরণের যুগের ইতালীয় ভাস্কর্যের অন্যতম মূল বৈশিষ্ট্যই হল ফুটে ওঠা প্রতিটি চরিত্রর এই প্রাণময়তা, যা তাদের বাস্তবের অত্যন্ত কাছাকাছি এনে ফেলে।

ইতিহাস সম্পাদনা

 
১৫৫০ সালের আগে তৈরি পিয়েতা'র এই ভাস্কর্যটি ফ্লোরেন্সের অপেরা দেল দুওমো'র সংরক্ষণশালায় রক্ষিত আছে।

১৪৯৬ - ১৫০১ খ্রিষ্টাব্দে মাইকেলেঞ্জেলো যখন প্রথমবারের জন্য রোমে বসবাস করছিলেন, এই ভাস্কর্যটি সেই সময়েরই সৃষ্টি। শিল্প-ইতিহাসে এই ভাস্কর্যটির গুরুত্ব আরও বেশি হওয়ার কারণ হল এটি নবজাগরণের যুগে কোনও ইতালীয় ভাস্করের হাতে এই বিষয়বস্তুর উপর তৈরি অন্যতম প্রথম কাজ। ভাস্কর্য শিল্পের বিষয়বস্তু হিসেবে যিশুর মৃত্যুতে শোকার্ত মাতা মেরি'র এই থিমটি তখন উত্তরে ফ্রান্সে যথেষ্ট জনপ্রিয় হলেও ইতালিতে তা তখনও খুব একটা জনপ্রিয় হয়ে ওঠেনি। ফরাসি কার্ডিনাল বিলেরে'র প্রস্তাব হাতে পেয়েই মাইকেলেঞ্জেলো এই কাজে হাত দেন। কিন্তু বিষয়বস্তুটি যে তাকে যথেষ্ট আকর্ষণ করেছিল, তা আমরা বুঝতে পারি, যখন দেখি এই থিমের উপর এই প্রথম কাজটির পরেও একই বিষয়ের উপর তিনি আরও কয়েকটি ভাস্কর্য তৈরি করেন। তবে এখানে মনে রাখা ভালো, মাইকেলেঞ্জেলোর এই রোমীয় পিয়েতা এই বিষয়বস্তুর উপর নবজাগরণের যুগের ইতালিতে তৈরি প্রথম দিকের একটি কাজ হলেও, এর আগেও এই বিষয়বস্তুর উপর ইতালিতে আরও কাজ হয়েছে, যদিও শিল্প সৌকর্য্যের মান বিচার করতে গেলে সেগুলির কোনওটিই মাইকেলেঞ্জেলোর কাজের পাশে উল্লিখিত হওয়ার যোগ্যতা ধরে না।[৩] উদাহরণস্বরূপ পাশের চিত্রে প্রদর্শিত পিয়েতা ভাস্কর্যটি লক্ষ করে দেখতে পারেন।

সৃষ্টির ইতিহাস সম্পাদনা

১৪৯৭ খ্রিষ্টাব্দে ভ্যাটিকানে সম্রাট অষ্টম শার্লের দূত ও সাঁ দেনির বেনেডিক্টাইন অর্ডারের সন্ন্যাসী, ফরাসি কার্ডিনাল জ্যঁ দ্য বিলেরে রোমের একজন অভিজাত ব্যাঙ্কার জাকোপো গালি'র মাধ্যমে তার মৃত্যুর পর তার স্মৃতিরক্ষার্থে সন্ত পিওত্‌রের ব্যাসিলিকার দক্ষিণদিকে অবস্থিত সান্তা পেত্রোনিলা গির্জার একটি চ্যাপেলে অলঙ্করণ হিসেবে বসানোর জন্য এই মর্মর মূর্তিটি তৈরি করার দায়িত্ব দেন মাইকেলেঞ্জেলোকে। অর্থাৎ সেই হিসেবে দেখতে গেলে মাইকেলেঞ্জেলোর রোমীয় পিয়েতা একটি অর্ডারি শিল্পকর্ম। অবশ্য সে' যুগে এটিই ছিল রেওয়াজ ও সে' যুগের বেশির ভাগ শিল্পকর্মরই সৃষ্টির ইতিহাস আমরা দেখতে পাই এ'রকমই। ১৪৯৭ খ্রিষ্টাব্দের শেষের দিকে এই বাবদ শিল্পী কিছু আগাম অর্থও লাভ করেন। কিন্তু মূল অর্ডারটি তার কাছে আসে পরের বছর, ২৭ আগস্ট। ইতোমধ্যেই ৬ আগস্ট, ১৪৯৮ কার্ডিনালের মৃত্যু ঘটেছে। কিন্তু অর্ডারপত্রে আমরা দেখতে পাই কার্ডিনাল খুব স্পষ্ট ভাষাতেই পিয়েতা সম্পর্কে তার ধারণা ব্যক্ত করেছেন - এটি হতে হবে মর্মর নির্মিত, যেখানে মাতা মেরির বয়স হবে কম, তিনি হবেন সম্পূর্ণ পোশাক পরিহিতা, আর তার কোলে শায়িত থাকবেন ক্রশ থেকে নামানো, মৃত ও অর্ধনগ্ন প্রভু যিশু।[১] এছাড়াও অর্ডারপত্রে খুব পরিষ্কার ভাষাতেই উল্লেখ করা হয় যে মূর্তিটি হতে হবে প্রমাণ আকারের এবং শিল্প-সৌকর্যের দিক থেকে তাকে সেই সময় পর্যন্ত রোমে রক্ষিত অন্যান্য সমস্ত মর্মরভাস্কর্যের তুলনায় হতে হবে শ্রেষ্ঠতর। স্বভাবতই, সেইসময় রোমে রক্ষিত অসংখ্য ভাস্কর্যের কথা মাথায় রাখলে বলতেই হয় এ' ছিল এক যথেষ্টই বলিষ্ঠ দাবি।[৪] এছাড়াও দাবি করা হয় যে একবছরের মধ্যেই সমগ্র কাজটি সম্পূর্ণ হওয়া চাই।[১]

১৪৯৮ সালের মার্চ মাসে মাইকেলেঞ্জেলো কারারা যান।[১] সেখানে মূর্তির জন্য প্রয়োজনীয় মনমতো মার্বেলের ব্লকটি নিজের হাতে বেছে নেওয়াই ছিল তার উদ্দেশ্য। পরবর্তীকালেও তার অন্যান্য বিভিন্ন ভাস্কর্যের ক্ষেত্রেও আমরা দেখতে পাই, এটাই ছিল তার অভ্যেস। এরপর তিনি নিজেই দাঁড়িয়ে থেকে সেই পছন্দ হওয়া মার্বেল ব্লকটি কারারা থেকে রোমে আনার ব্যবস্থা করেন। অর্থাৎ, ১৪৯৮ সালের গ্রীষ্মের আগে তার পক্ষে মূর্তির কাজে হাত দেওয়া নিশ্চিতভাবেই সম্ভব হয়নি। মূর্তিটি শেষ করতে এরপর তার সময় লাগে প্রায় এক বছর। অর্থাৎ এটির কাজ শেষ হয় ১৪৯৯[৫] বা ১৫০০ খ্রিষ্টাব্দে[৬]। এইসময় ১৪৭৫ সালের ৬ মার্চ জন্মগ্রহণ করা শিল্পীর বয়স ছিল প্রায় ২৫ বছর। ঊনবিংশ শতাব্দীর বিখ্যাত জার্মান শিল্প-ঐতিহাসিক ভিলহেলম ল্যুবকা'র মতে শিল্পী মাইকেলেঞ্জেলোর অল্পবয়সের শ্রেষ্ঠ শিল্পকীর্তি এই পিয়েতাই।[৭] এরপর তিনি ক্রমে আরও পরিণতির দিকে এগিয়ে যান।

সাম্মানিক সম্পাদনা

পিয়েতা সৃষ্টির জন্য মাইকেলেঞ্জেলো সাম্মানিক হিসেবে ৪৫০ স্বর্ণ ডুকাট লাভ করেন (রাটনার/ডানৎসারের হিসেব অনুযায়ী তার আনুমানিক মূল্য আজকের হিসেবে প্রায় ৫০ হাজার ইউরো বা ৪০ লক্ষ (ভারতীয়) টাকা)।[৮]

স্থাপনা সম্পাদনা

চুক্তি অনুযায়ী মূর্তিটি প্রথমে বসানোর কথা ছিল সান্তা পেত্রোনিলা গির্জায়। কিন্তু ১৫১৭ সালে নবজাগরণের যুগের বিখ্যাত স্থপতি দোনাতে ব্রামান্তে'র পরিকল্পনা অনুযায়ী সন্ত পিওত্‌রের গির্জার সংস্কারের সময় তার দক্ষিণদিকে অবস্থিত এই গির্জাটি ভাঙা পড়লে মূর্তিটিকে সরিয়ে নিয়ে গিয়ে বসানো হয় পুরনো সন্ত পিওত্‌রের গির্জার 'ভার্জিনা দেলা ফেব্রা' চ্যাপেলে। পরবর্তীকালে মূর্তিটি আরও কবার স্থানান্তরিত হয়। কিছুদিনের জন্য তা চতুর্থ সিক্সটাসের কয়ের'এও ছিল। শেষপর্যন্ত ১৭৪৯ সালে তা সন্ত পিওত্‌রের ব্যাসিলিকার প্রথম চ্যাপেলের অভ্যন্তরে ডানদিকের দেওয়ালে পবিত্র দরজা ও সন্ত সেবাস্তিয়ানের বেদির (অলটার) মাঝে তার বর্তমান অবস্থানে স্থানান্তরিত হয়। সেই থেকে এই চ্যাপেলেই তার অবস্থানের কারণে তাকে অনেকসময় 'চ্যাপেলের পিয়েতা' নামেও অভিহিত করা হয়ে থাকে।[১]

সেই সময় থেকে আজ পর্যন্ত একমাত্র ১৯৬২-৬৪ সালে নিউ ইয়র্কে অনুষ্ঠিত বিশ্বমেলার ভ্যাটিকান প্যাভিলিয়নে প্রদর্শনের উদ্দেশ্যেই প্রথম ও শেষবারের জন্য এই বিশ্বখ্যাত ভাস্কর্যটিকে তার স্থানচ্যুত করা হয়।[৯]

ক্ষতিসাধন সম্পাদনা

মাইকেলেঞ্জেলোর এই চ্যাপেল পিয়েতাকে বেশ ক' বার ক্ষতির সম্মুখীন হতে হয়েছে। ১৭৩৬ সালে তাকে একবার স্থানান্তরিত করার সময় মাতা মেরির বাঁহাতের চারটি আঙুল খসে পড়ে। সেই সময় শিল্পী জিউসেপে লিরিওনি সেই আঙুল চারটিকে মেরামত করেন। সেই কারণে আঙুল চারটির মূল রূপ পুনরুদ্ধার হয়েছে কিনা, তাই নিয়ে শিল্পমহলে এখনও যথেষ্ট বিতর্ক আছে।[১] ১৯৭২ সালের ২১ মে মূর্তিটি আরেকটি ভয়ঙ্কর আক্রমণের সম্মুখীন হয়। এক হাঙ্গেরিজাত অস্ট্রেলীয় নাগরিক লাসজলো টোথ হঠাৎ "আমিই যিশু" বলে চিৎকার করে উঠে একটি হাতুড়ি নিয়ে মূর্তির উপর উপর্যুপরি আঘাত হানতে শুরু করেন। পরপর পনেরোটি আঘাতে মেরির নাক খসে পড়ে, একটি চোখের পাতার ক্ষতি হয়, বাঁহাতটিও কনুই'এর কাছে অত্যন্ত ক্ষতিগ্রস্ত হয়। যারা কাছাকাছি ছিল, তারা ভেঙে পড়া খণ্ডগুলির অনেকগুলিই স্মৃতি হিসেবে সরিয়ে নিয়ে যায়। পরে সনির্বন্ধ অনুরোধে কিছু টুকরো ফেরত পাওয়া গেলেও, নাকের ভাঙা টুকরোটিসহ বেশ কিছু টুকরো আর ফেরত পাওয়া যায়নি। ফলে মেরামতির কাজে যতদূর সম্ভব মূল টুকরোগুলিকেই ব্যবহার করা হলেও না পাওয়া টুকরোগুলির অভাব পূরণ করতে শেষপর্যন্ত মূর্তির পিছনদিক থেকে খানিকটা মার্বেল কেটে নিয়েই মূর্তিটি মেরামত করতে হয়। এক্ষেত্রে জোড়া লাগাতে মর্মরগুঁড়ো ও আধুনিক পলিয়েস্টার প্রযুক্তির ব্যবহার করা হয়। এরপর থেকে সুরক্ষার খাতিরে মূর্তিটিকে একটি বুলেটপ্রুফ কাচের আধারে রাখা হয়েছে।[১০][১১]

তথ্যসূত্র সম্পাদনা

  1. Frederick Hartt, David Finn: Michelangelo's three Pietàs, Thames and Hudson Ltd: London, 1974. পৃঃ - ২৭।
  2. William E. Wallace: "Life and Early Works". Michelangelo: Selected Scholarship in English. 1995. আইএসবিএন ০-৮১৫৩-১৮২৩-৫ পৃঃ - ২৩৩।
  3. Jacob Burckhardt: Der Cicerone. 1855. Band 2 der Kritischen Gesamtausgabe, C.H.Beck 2001, আইএসবিএন ৩-৪০৬-৪৭১৫৬-০, 9783406471568 পৃঃ - ৫৩১।
  4. Pina Ragionieri: Michelangelo: The Man and the Myth. University of Pennsylvania Press, 2008, আইএসবিএন ৯৭৮-০-৮১২২-২০৫৪-৪. পৃঃ - ১১৮।
  5. Umberto Baldini: Michelangelo scultore. Rizzoli: Mailand, 1973. পৃঃ - ৯২।
  6. Edith Weinberger: Michelangelo the Sculptor. Taylor & Francis 1967. পৃঃ - ৬৮।
  7. Wilhelm Lübke: Grundriss der Kunstgeschichte. 3. Auflage. Ebner & Seubert, 1866. পৃঃ - ৫১৭।
  8. Josef Rattner, Gerhard Danzer: Die Geburt des modernen europäischen Menschen in der italienischen Renaissance 1350–1600: literarische und geistesgeschichtliche Essays. Königshausen & Neumann, 2004, আইএসবিএন ৩-৮২৬০-২৯৩৪-৮. পৃঃ - ১৩৫।
  9. Pietà by Michelangelo. ওয়েব্যাক মেশিনে আর্কাইভকৃত ১৮ মে ২০১৪ তারিখে romaviva.com. সংগৃহীত ১৩ জুন, ২০১৫।
  10. Doris Wacker: Die Kunst zu bewahren. 2. Auflage. München 2002.
  11. "Time Essay: Can Italy be Saved from Itself?". June 05, 1972. সংগৃহীত ১৩ জুন, ২০১৫।

আরও দেখুন সম্পাদনা

বহিঃস্থ ভিডিও
 
  Michelangelo's Pietà, Smarthistory

গ্রন্থপঞ্জি সম্পাদনা

  • Pope-Hennessy, John (1996). Italian High Renaissance and Baroque Sculpture. London: Phaidon
  • Hibbard, Howard. 1974. Michelangelo. New York: Harper & Row.
  • Matthew 13:55–56 Passage Lookup – New International Version BibleGateway.com
  • Wallace, William E. (2009). Michelangelo; the Artist, the Man, and his Times. Cambridge: Cambridge University Press.

বহিঃসংযোগ সম্পাদনা