পাকিস্তানে নারীবাদ

পাকিস্তানের জাতীয় নারীবাদী আন্দোলন

পাকিস্তানে নারীবাদ পাকিস্তানি নারীদের অধিকার বিষয়ক আলোচনা সম্পর্কিত। পাকিস্তানের নারীদের সামাজিক, আর্থনীতিক এবং রাজনীতিক অধিকার এবং পুরুষদের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলাটা পাকিস্তানে নারীবাদের অন্যতম আলোচ্য বিষয়।[১][২][৩] পাকিস্তানের স্বাধীনতা পর থেকেই পাকিস্তানের নারীসমাজের জন্য অধিকার বিষয়ক কর্মকাণ্ড হয়ে আসছে; এছাড়া পাকিস্তানে স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলন নারীবাদের সঙ্গে সম্পর্কিত ছিলো। পাকিস্তানে নারীরা অনেক ধরনের সমস্যায়ই পড়েছেন তাদের ন্যায্য অধিকার প্রতিষ্ঠা করতে গিয়ে কারণ পাকিস্তানের সমাজ ঐতিহাসিকভাবেই পুরুষতান্ত্রিক ছিলো।[৪]

পেছনের কাহিনী সম্পাদনা

লিঙ্গ সমতার ক্ষেত্রে পাকিস্তানের সমাজের অবস্থা অনেক ঋণাত্মক; বিশ্বের ১৫৩টি দেশের ভেতরে পাকিস্তান ১৫১তম অবস্থানে এসেছিলো ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরাম-এর একটি জরিপে এমনটাই উঠে এসেছিলো যে পাকিস্তানে লিঙ্গ সমতা নেই বললেই চলে।[৫] একই সংস্থা থেকে আরো একটি বিস্ময়কর তথ্য ২০২০ সালে উঠে আসে যে পাকিস্তানের ৫০ লাখ মেয়ে শিশুকে বিদ্যালয়ে যেতে দেওয়া হয়না। ইউনিসেফ-ও বলে যে, পাকিস্তানে নাকি মেয়েদের খুবই অল্প বয়সে বিয়ে করিয়ে দেওয়া হয়। পাকিস্তানের অনেক অশিক্ষিত সমাজে আবার অমুসলিম মেয়েদেরকে জোর করে মুসলিম বানিয়ে বিয়ে করা হয় - এরকম খবরও এসেছে; মোদ্দা কথা যে, পাকিস্তানের সমাজে মেয়েদের অবস্থান ভালো নেই।[৬] আর যারা ভালো থাকেন তারা পাকিস্তানের অভিজাত শ্রেণীর নারী এবং শিক্ষিত নারীদের কাতারে পড়েন।

জয়া রহমান নাম্নী একজন পাকিস্তানি নারীবাদী বলেন যে, পাকিস্তানের সমাজে মেয়েদের শরীর নিষিদ্ধ, যৌনতা নিষিদ্ধ, সমাজে মেয়েদের বিন্দুমাত্র স্বাধীনতা দেওয়া হয়না। তিনি আরো দাবি করেন যে, পাকিস্তান রাষ্ট্রটি জন্ম থেকেই পুরুষতান্ত্রিক এবং নারীবিদ্বেষী; নারীরা ভালোবেসে বিয়ে করলে অনার কিলিং-এর শিকার হয়।[৭] পাকিস্তানে সংস্কৃতি অনেক রক্ষণশীল যেখানে পুরুষরা নারীদেরকে বিয়ে করার জন্য মুখিয়ে থাকে - এমন কথা বলেছিলেন আরেক নারীবাদী নাহার জিয়া; তিনি বলেছিলেন, পাকিস্তানি সংস্কৃতিই মেয়েদের স্বাধীনতা আটকিয়ে রাখে, সমাজ হচ্ছে অবদমনমূলক, কোনো স্বাধীনতা নেই; পুরুষরা বেকার থাকলে বিয়ে করেনা বা করতে পারেনা।

পাকিস্তানের ১৯৪৭ সালে স্বাধীনতার পর থেকে পাকিস্তানের সমাজের অভিজাত শ্রেণীর নারীরা নারীবাদ, নারী-অধিকার এইগুলো ব্রিটিশ সমাজ থেকে শিখে আসতে শুরু করেছিলেন কিন্তু পাকিস্তানের সব সমাজে তাদের প্রচেষ্টার কোনো উপাদান আসতে পারেনি। অল পাকিস্তান উইমেন অ্যাসোসিয়েশন সংস্থাটি মূলত ধনী নারীদের জন্য ছিলো; ১৯৫৬ সালের পাকিস্তানের প্রথম সংবিধানে নারীদের সেরকম কোনো অধিকার আলাদাভাবে উল্লেখিত হয়নি; ১৯৬০-এর দশকে আইয়ুব খানের শাসনও অভিজাত নারীসমাজের উন্নয়ন নিয়ে ব্যস্ত ছিলেন এবং তিনি ১৯৬১ সালে একটি পুরুষতান্ত্রিক বিয়ে আইন চালু করেন।[৮][৯]

প্রথম ধাপঃ ১৯৪৭-'৫২ সম্পাদনা

১৯৪৭ সালে পাকিস্তান রাষ্ট্রটি জন্মের সময় নাকি ৭৫,০০০ নারী ভারতীয়দের দ্বারা ধর্ষিত হয়েছিলো এবং এই ঘটনার কোনো বিচার হয়নি। পাকিস্তানের জাতির জনক হিসেবে পরিচিত মুহাম্মদ আলী জিন্নাহর বোন ফাতেমা জিন্নাহ উইমেন্স রিলিফ কমিটি নামের একটি সংস্থা বানান ১৯৪৭ সালেই যদিও এই সংস্থা নারীদের কল্যাণে বিশেষ কোনো কাজে আসতে পারেনি।

বেগম রানা লিয়াকত আলি খান অল পাকিস্তান উইমেন অ্যাসোসিয়েশন নামের সংস্থা গড়ে তোলেন ১৯৪৮ সালে; ১৯৫১ সালে তার স্বামী প্রধানমন্ত্রী লিয়াকত আলি খান খুন হন, এতে রানা'র তৈরিকৃত সংস্থাটির কার্যক্রম কার্যত নষ্ট হয়ে যায়। ১৯৫২ সালে রানা জাতিসংঘে পাকিস্তানের নারীসমাজ নিয়ে বক্তব্য রেখেছিলেন।

পাকিস্তানের সমাজের এরপর ১৯৮০-এর দশকের আগ পর্যন্ত নারীবাদী কোনো কার্যক্রম দেখা যায়নি।

দ্বিতীয় ধাপঃ আশির দশক সম্পাদনা

১৯৭০-এর দশকে জুলফিকার আলি ভুট্টোর শাসনামল নারীদেরকে কিছু দেয়নি; ১৯৭৭ সালে সেনাবাহিনী প্রধান (পাকিস্তান) জেনারেল জিয়াউল হক সামরিক আইন জারী করেন। জেনারেল জিয়া ছিলেন পুরোদস্তুর একজন ইসলামপন্থী শাসক যিনি পাকিস্তানের আইনে ইসলামী আইনের অনেক কিছু চালু করেন; জিয়ার আমলে প্রেম-ভালোবাসা, যৌনতা বা পুরুষদের সঙ্গে নারীদের মেলামেশা খুব কড়াকড়িভাবে নজরের আওতায় আনা হয়েছিলো; ইসলামী আইন অনুযায়ী এইসব কর্মকাণ্ডের বিচার হতো এবং জিয়ার সরকার সমালোচনার মুখে পড়েছিলেন পাকিস্তানে ইসলামী আইন আনা জন্য; এর মধ্যেই নারীবাদীদের 'উইমেন্স অ্যাকশন ফোরাম' নামের একটি সংগঠন তৈরি হয় ১৯৮১ সালে।[১০] জিয়ার সরকার বোরকা পরা নারীদেরকে বোরকা পরতে উৎসাহিত করতো এবং সাধারণ নারীদের উপর পুলিশ নজরদারি করতো যে তারা বোরকা পরছে কিনা যদিও জেনারেল জিয়া পরে নম্র হন এবং সংবাদপত্রে নারীদের নারীবাদী লেখা লিখার অনুমতি দেন; নারীরা যারা চলচ্চিত্র, নাটক এবং টেলিভিশনে চাকরি করতো তাদের উপর জিয়ার সরকার শুরুতে কড়াকড়ি করলেও পরে নমনীয় হয়ে যায়; নারীদের অভিনয় করা, গান গাওয়া এগুলো জিয়া বেশি দিন দাবিয়ে রাখতে সক্ষম হননি।[১১] অনেক নারীবাদী নারী জোর গলায় জেনারেল জিয়ার শাসনের বিরোধিতা করতে থাকেন।

জিয়া পরবর্তী যুগ; ১৯৮৮-২০০৮ সম্পাদনা

জিয়া ১৯৮৮ সালে একটি বিমান দূর্ঘটনায় মারা যান এবং বেনজির ভুট্টো পাকিস্তানের প্রথম নারী প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব নেন; পাকিস্তান হয়ে যায় প্রথম মুসলিম দেশ যেটাতে একজন নারী প্রধানমন্ত্রী হয়েছেন। বেনজির নারীবাদ, নারী-অধিকার, নারী-সমতা এগুলোর ওপর জোর দিতে থাকেন। বেনজির যদিও বেশিদিন ক্ষমতায় থাকতে পারেননি তবে তার শাসনামলে নারীদের বাধ্যতামূলক ভাবে বোরকা পরাটা বাতিল করা হয় যেটা জেনারেল জিয়া করে গিয়েছিলেন; বেনজিরের পর নওয়াজ শরীফ এবং তার পরে জেনারেল পারভেজ মুশাররফ ক্ষমতায় আসেন; এই দুই সরকারই নারীদের ব্যাপারে অন্য যে কোনো সরকারের তুলনায় উদার ছিলো।[১২]

২০০৮-বর্তমান সম্পাদনা

২০০৮ সাল থেকে এর পরের বছরগুলোতে পাকিস্তানের নারীসমাজ অনেক আন্দোলনে জড়ানোর অধিকার পায় খুব ভালো করে। পাকিস্তান পিপলস পার্টি পাকিস্তানের সমাজে নারীদের অধিকারের ব্যাপারে প্রচারণা চালায়; তাছাড়া পাকিস্তান তেহরিক-ই-ইনসাফ দলটিও নারীদের ক্ষেত্রে নমনীয়।

পাকিস্তানে উদারপন্থী নারীবাদ সম্পাদনা

পাকিস্তানে ২০১০-এর দশকে উদারপন্থী নারীবাদ চালু হয় যারা নারীদের প্রেম-ভালোবাসা এবং যৌনতার স্বাধীনতার পক্ষে সংবাদপত্রে লেখালেখি করে।

নারীবাদী প্রচারণা সম্পাদনা

পাকিস্তানে নাটক, চলচ্চিত্র এবং সাহিত্যের মাধ্যমে ২০১০-এর দশকে অনেক নারীবাদী প্রচারণা দেখা গেছে।[১৩] যদিও এসব কিছুই মূলত পাকিস্তানের অভিজাত এবং শিক্ষিত সমাজে দেখা যায়, সমগ্র পাকিস্তানে এগুলো অনুপস্থিত। ইসমত চুগতাই ভারতীয় লেখক হলেও তার কদর পাকিস্তানের সমাজে অনেক।

তথ্যসূত্র সম্পাদনা

  1. "The Aurat March challenges misogyny in our homes, workplaces and society, say organisers ahead of Women's Day"Images। ২০১৯-০৩-০৭। সংগ্রহের তারিখ ২০১৯-০৩-১১ 
  2. "Feminism and the Women Movement in Pakistan"www.fes-asia.org। ২০১৮-০৪-২০ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ২০১৯-০৩-১১ 
  3. "Pakistani women hold 'aurat march' for equality, gender justice"www.aljazeera.com। সংগ্রহের তারিখ ২০১৯-০৩-১১ 
  4. "Feminism in Pakistan: A brief history - The Express Tribune"The Express Tribune। ২০১৪-০৯-২৩। সংগ্রহের তারিখ ২০১৭-০৮-২০ 
  5. Abdel-Raouf, Fatma; Buhler, Patricia M. (২০২০-০৮-২১), "The Global Gender Pay Gap", The Gender Pay Gap, Routledge, পৃষ্ঠা 136–148, আইএসবিএন 978-1-003-00373-1, ডিওআই:10.4324/9781003003731-11, সংগ্রহের তারিখ ২০২০-১২-০৫ 
  6. "Forced marriages and forced conversions in the christian community of Pakistan" (পিডিএফ)cloudfront। সংগ্রহের তারিখ ২০২০-১২-১৪ 
  7. Rehman, Zoya (২০১৯-০৭-২৬)। "Aurat March and Undisciplined Bodies"Medium (ইংরেজি ভাষায়)। সংগ্রহের তারিখ ২০২০-০৩-০৪ 
  8. Zia, Afiya S. (৩০ নভেম্বর ২০১৭)। Faith and Feminism in Pakistan: Religious Agency or Secular Autonomy?। Sussex Academic Press। আইএসবিএন 978-1845199166 
  9. Shah, Bina (২০১৪-০৮-২০)। "Opinion | The Fate of Feminism in Pakistan"The New York Timesআইএসএসএন 0362-4331। সংগ্রহের তারিখ ২০১৯-০৪-১৫ 
  10. Zia, Afiya Shehrbano (ফেব্রুয়ারি ২০০৯)। "the reinvention of feminism in Pakistan"। Feminist Review91 (1): 29–46। আইএসএসএন 0141-7789এসটুসিআইডি 145073625ডিওআই:10.1057/fr.2008.48 
  11. "Feminists…in Pakistan?"The Feminist Wire। ২০১২-১০-১৫। সংগ্রহের তারিখ ২০১৯-০৪-১৪ 
  12. Khan Ayesha, Kirmani Nida (২০১৮)। "Moving Beyond the Binary: Gender-based Activism in Pakistan" (পিডিএফ)Feminist Dissent3: 151 191। ডিওআই:10.31273/fd.n3.2018.286। ১৯ জুন ২০২১ তারিখে মূল (পিডিএফ) থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ৩ মার্চ ২০২১ – researchcollective.org-এর মাধ্যমে। 
  13. Zia, Afiya S. (২০২০-০২-০৩)। "The contrite gender formula of Meray Paas Tum Ho and the portrayal of women in cultural scripts"DAWN.COM (ইংরেজি ভাষায়)। সংগ্রহের তারিখ ২০২০-০২-০৪ 

বহিঃসংযোগ সম্পাদনা