পাকিস্তানের বৈদেশিক সম্পর্কসমূহ
পাকিস্তান ,ইন্দোনেশিয়ার পরে, বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম মুসলমান-প্রধান দেশ।[১] পাকিস্তান একটি ঘোষিত পারমাণবিক শক্তি এবং দেশটি বিশ্ব রাজনীতিতে অত্যন্ত সক্রিয়।
পাকিস্তানের বিদেশ নীতি বেশ স্বাধীন, বিশেষত পরমাণু শক্তি উন্নয়নের ক্ষেত্রে। পাকিস্তানের ভূরাজনৈতিক অবস্থান সামুদ্রিক তেল সরবরাহ ব্যবসার জন্য গুরুত্বপূর্ণ। পাকিস্তান অর্গানাইজেশন অফ ইসলামিক কোঅপারেশান-এর গুরুত্বপূর্ণ সদস্য, এবং ন্যাটো সদস্য না হলেও সন্ত্রাসবাদ মোকাবিলায়ে দেশটি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সহযোগী। দেশটি একটি অত্যন্ত সুশৃঙ্খল ও পেশাদার সেনাবাহিনীর অধিকারী।
পাকিস্তানের বিদেশনীতি
সম্পাদনাপাকিস্তানের অর্থনীতি আধা শিল্পায়িত, এবং জিডিপি অনুযায়ী দেশটি বিশ্বের ৪৫ তম অথনৈতিক শক্তি। পাকিস্তানের বার্ষিক প্রতিরক্ষা বাজেট ৬.৯৮ বিলিয়ন, যা বিশ্বব্যাপী সামরিক ব্যয়ের ০.৩৭ শতাংশ। এই মুহুর্তে, বিদেশ মন্ত্রী সরতাজ আজিজ বৈদেশিক কূটনীতির দ্বায়িত্বে থাকলেও, দেশের বিদেশ নীতি প্রধানমন্ত্রী নওয়াজ শরীফ-ই গঠন করেন।[২][৩] পাকিস্তানের বিদেশ নীতির উদ্দেশ্য তাদের জাতীয় ও অর্থনৈতিক স্বার্থ রক্ষা করা, এবং একই সাথে তাদের নৈতিক লক্ষ্য পূরণ করা। ২০১৩ সালের সাধরন নির্বাচনের পর তারিক ফাতিমি এবং জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা সরতাজ আজিজ বিদেশ নীতির বিষয়ে প্রধান মন্ত্রীর প্রধান উপদেষ্টাগণ নিযুক্ত হন।[৪][৫]
ঐতিহাসিক রূপরেখা
সম্পাদনা১৯৪৭ সালে পাকিস্তানের প্রতিষ্ঠাতা মুহাম্মদ আলী জিন্নাহ একটি বেতার বার্তার মাধ্যমে স্বাধীন পাকিস্তানের বিদেশ নীতির উদ্দেশ্য স্পষ্ট করেছিলেন। তিনি বলেছিলেন " আমাদের বৈদেশিক নীতির ভিত্তি হল সারা বিশ্ব জুড়ে সকল জাতির সঙ্গে বন্ধুত্ব"।[৬] তবে, জিন্নার সারা বিশ্বের সকল জাতির সাথে বন্ধুত্বের স্বপ্ন বাস্তবে পূরণ হয়েছে, তা কিন্তু বলা যায় না।
১৯৪৭ সালে স্বাধীনতার পর থেকেই, পাকিস্তানের সাথে প্রতিবেশী সোভিয়েত ইউনিয়নের সম্পর্ক ভালো নয়। এর প্রধান কারণ সোভিয়েত ইউনিয়নের সাথে ভারত ও আফগানিস্তানের সুসম্পর্ক। ১৯৪৭ থেকে ১৯৯১ পর্যন্ত, সোভিয়েতের সমর্থন বরাবর ছিল ভারতের দিকে, বিশেষত কাশ্মীর ইস্যু-তে। কাশ্মীর বিবাদ কে কেন্দ্র করেই ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে তিনটি যুদ্ধ হয়, যার সর্বশেষ নজির ১৯৯৯ সালের কার্গিল যুদ্ধ। এরপর ষাটের দশকে, দুরান্দ সীমান্ত কে কেন্দ্র করে আফগানিস্তান এর সাথে পাকিস্তানের সম্পর্ক খারাপ হয়। পাকিস্তানের সাথে সৌদি আরব, ইরান আর চীন দেশের সম্পর্ক বিশেষ গুরত্বপূর্ণ। স্নায়ুযুদ্ধ পরবর্তী যুগে, চীন আর পোল্যান্ড এর সাথে পাকিস্তান এর সম্পর্ক ভালো হয়। এই তিন দেশের জোটের মূল উদ্দেশ্য ছিল এশিয়া ও ইউরোপ এ সোভিয়েতের প্রভাব বিস্তার রুখে দেওয়া। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সাথে পাকিস্তান এর সম্পর্ক বরাবর পরিবর্তনশীল।[৭]
উল্লেখযোগ্য মিত্রতা
সম্পাদনা১৯৫১ সালে, পাকিস্তানের প্রধান মন্ত্রী লিয়াকত আলি খান মার্কিন যুক্তরাষ্টের উদ্দেশ্যে এক ঐতিহাসিক যাত্রা করেন। সেখানে তিনি প্রেসিডেন্ট হ্যারি এস. ট্রুম্যান ছাড়াও অন্যান্য উচ্চপদস্থ সামরিক কর্তাদের সাথে দেখা করেন। তাদের আলোচনার মূল বিষয়বস্তু ছিল পারস্পরিক সামরিক সাহায্য। আদর্শগত দিক থেকে, লিয়াকত আলি খান ছিলেন সাম্যবাদ বিরোধী। সেই সময় পাকিস্তানের জাতীয় অর্থনীতি ও সুরক্ষা ব্যবস্থা ছিল অনুন্নত। ১৯৫৪-১৯৫৬ সালে এই কারণেই দুই দেশের মধ্যে পারস্পরিক প্রতিরক্ষা সহায়তা চুক্তি সাক্ষর হয়, ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র পাকিস্তানের সেনাবাহিনীকে প্রশিক্ষণ দিতে রাজি হয়।[৮]
১৯৫৫ সালে পাকিস্তান যুক্তরাষ্ট্রের সেন্ট্রাল ট্রিটি অরগানাইজেশন বা কেন্দ্রীয় চুক্তি সংস্থা ও ১৯৫৬ সালে সিয়াটো -তে যোগ দেয়। ১৯৭৪ সাল থেকেই পাকিস্তান অর্গানাইজেশন অফ ইসলামিক কোঅপারেশান-এর সদস্য ও বরাবর মধ্য প্রাচ্যের দেশগুলির সাথে পাকিস্তানের সম্পর্ক বন্ধুত্বপূর্ণ।
উল্লেখযোগ্য দ্বন্দ্ব
সম্পাদনাস্বাধীনতার পর থেকেই ভূরাজনৈতিক সমস্যা কে ঘিরে পাকিস্তানের সাথে তার দুই প্রতিবেশী দেশ ভারত ও আফগানিস্তান এর সম্পর্ক ভালো নয়। কাশ্মীর কে কেন্দ্র করে তিন তিন বার ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধ হয়েছে। আফগানিস্তান -এর সাথে পাকিস্তানের বিবাদ দুরান্দ সীমান্ত কে ঘিরে। সত্তরের দশকে এই বিবাদ চরম আকার ধারণ করে।এই সময়ে, বেশ কয়েকবার দুই দেশের মধ্যে গোলাবর্ষণের খবরও পাওয়া যায়। সাম্প্রতিক কালে আফঘানিস্তানে তালিবানের দাপট তুলনামূলক কম হওয়ার পরে, দুই দেশের মধ্যে সম্পর্ক কিছুটা ভালো হয়েছে। কিন্তু ভারতের সাথে পাকিস্তানের সম্পর্কের আরো অবনতি ঘটেছে। আজও, দুই দেশ পরস্পরের বিরুদ্ধে নিত্যদিন অস্ত্র বিরতি চুক্তি লঙ্ঘন করার অভিযোগ আনে। [৯]
আন্তর্জাতিক সংগঠনসমূহ
সম্পাদনাপাকিস্তান রাষ্ট্রসংঘের সক্রিয় সদস্য। দেশটি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বাধীন সেনটো ও সিয়াটো সামরিক জোটের প্রাক্তন সদস্য। সোভিয়েত-আফগান যুদ্ধের সময়ে যুক্তরাষ্ট্রের সাথে পাকিস্তানের ঘনিষ্ঠতা বেড়ে ওঠে এবং এর ফলস্বরূপ পাকিস্তান উক্ত দুটি সংগঠন এ যোগ দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়। ১৯৬৪ সালে পাকিস্তান তুরস্ক ও ইরানের সাথে রিজিওনাল কো-অপেরাশান ফর ডেভেলপমেন্ট চুক্তি সাক্ষর করে। ইরানি বিপ্লব এর পরে তুরস্ক ও পাকিস্তান যৌথভাবে অর্থনৈতিক সহযোগিতা সংস্থা স্থাপন করে। পাকিস্তান রাষ্ট্রসংঘের নিরাপত্তা পরিষদে ভারতের স্থায়ী সদস্যপদের বিরোধী সংস্থা কফি ক্লাবেরও সক্রিয় সদস্য।[১০]
সংস্থা | সদস্যপদের ধরন ও যোগদানের তারিখ | টীকা |
---|---|---|
প্যান-আরব স্টেটস | সদস্য নয় |
২০০০ সালের গোড়ার দিকে, পাকিস্তান আরব লিগ-এর সংস্থাটির পর্যবেক্ষক সদস্য হওয়ার ইচ্ছে প্রকাশ করে তাদের সাথে সমঝোতা স্বারক সাক্ষর করে। পাকিস্তানও জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদে আরব লীগের বৃহত্তর প্রতিনিধিত্বের দাবি সমর্থন করে।[১১][১২] |
আসিয়ান | সদস্য নয় | |
ইউরোপীয় ইউনিয়ন | সদস্য নয় | |
আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল | পূর্ণ সদস্য | পাকিস্তান আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের পূর্ণ সদস্য এবং অতীতে পাকিস্তান সংস্থাটির থেকে আর্থিক সহায়তা পেয়েছে।[১৩] |
অর্থনৈতিক সহযোগিতা সংস্থা | প্রতিষ্ঠাতা সদস্য, ১৯৮৫ | পাকিস্তান, তুরস্ক ও ইরান অর্থনৈতিক সহযোগিতা সংস্থার প্রতিষ্ঠাতা সদস্য। |
ন্যাটো | সদস্য নয় | ন্যাটো সদস্য না হলেও সন্ত্রাসবাদ মোকাবিলায়ে দেশটি আমেরিকার সহযোগী। |
অর্গানাইজেশন অফ ইসলামিক কোঅপারেশান | পূর্ণ সদস্য, ১৯৬৯ | |
দক্ষিণ এশীয় আঞ্চলিক সহযোগিতা সংস্থা | পূর্ণ সদস্য, ১৯৮৫ | পাকিস্তান সার্কের প্রতিষ্ঠাতা সদস্যদের অন্যতম। |
সাংহাই সহযোগিতা সংস্থা | পূর্ণ সদস্য | পাকিস্তানের সাংহাই সহযোগিতা সংস্থার পূর্ণ সদস্য।[১৪] |
জাতিসংঘ | পূর্ণ সদস্য, ৩০শে সেপ্টেম্বর ১৯৪৭ |
তথ্যসূত্র
সম্পাদনা- ↑ By 2050, India to have world’s largest populations of Hindus and Muslims
- ↑ Ahmed, Hafeez Ashfaq। "Pakistan's Foreign Policy"। Scrib, 19 November 2012। সংগ্রহের তারিখ ১৯ নভেম্বর ২০১২।
- ↑ "বিদেশ মন্ত্রণালয়"। পাকিস্তান সরকার। সরকারী নীতি বিবৃতি। ৩১ অক্টোবর ২০১২ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ১৯ নভেম্বর ২০১২।
- ↑ পাকিস্তান সরকার। "National Security Advisor"। পাকিস্তান সরকার। বিদেশ মন্ত্রক। ১৪ জুলাই ২০১৮ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ৬ অক্টোবর ২০১৩।
- ↑ পাকিস্তান সরকার। "জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা সার্তাজ আজিজ"। পাকিস্তান সরকার। পাকিস্তান সরকার। ১২ জুন ২০১৮ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ৬ অক্টোবর ২০১৩।
- ↑ পাকিস্তান বিদেশ মন্ত্রকের সরকারি ওয়েবসাইট
- ↑ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সরকার। "Hisotry of Pakistan's Foreign Policy"। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সরকার। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র পররাষ্ট্র গবেষণা। সংগ্রহের তারিখ ১৯ নভেম্বর ২০১২।
- ↑ হামিদ হুসেন। "Tale of a love affair that never was: United States-Pakistan Defence Relations"। হামিদ হুসেন। হামিদ হুসেন, পাকিস্তান প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়। ৪ মার্চ ২০১২ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ১২ ফেব্রুয়ারি ২০১২।
- ↑ ২০১৪-১৫ ভারত-পাকিস্তান সীমান্তে বিচ্ছিন্ন লড়াই - ইংরেজি উইকিপিডিয়া
- ↑ রাষ্ট্রসংঘের নিরাপত্তা পরিষদ বিতর্ক|globalpolicy.org
- ↑ "সংরক্ষণাগারভুক্ত অনুলিপি"। ১৬ অক্টোবর ২০১৫ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ১ নভেম্বর ২০১৫।
- ↑ APP (২০১০-০৬-২৯)। "Pakistan calls for OIC, Arab League to be represented in UNSC – The Express Tribune"। Tribune.com.pk। সংগ্রহের তারিখ ২০১২-১১-২৪।
- ↑ "IMF Resident Representative Office in Pakistan"। সংগ্রহের তারিখ ২১ ফেব্রুয়ারি ২০১৫।
- ↑ APP (২০১০-১১-০৩)। "Shanghai Cooperation Organisation: Pakistan eyes full member status – The Express Tribune"। Tribune.com.pk। সংগ্রহের তারিখ ২০১২-১১-২৪।