পঞ্চরথ

ভারতের একটি হিন্দু মন্দির

পঞ্চরথ বা পাণ্ডবরথ হল বঙ্গোপসাগরের করমণ্ডল উপকূলের মহাবলীপুরমে অবস্থিত একটি স্মারক চত্বর। এই চত্বর ভারতের তামিলনাড়ু রাজ্যের কাঞ্চীপুরম জেলায় অবস্থিত। পঞ্চরথ ভারতের মনোলিথিক প্রস্তরখোদাই স্থাপত্য শিল্পকলার একটি নিদর্শন। খ্রিস্টীয় সপ্তম শতাব্দীর শেষভাগে পল্লব রাজা প্রথম মহেন্দ্রবর্মণ ও তার পুত্র প্রথম নরসিংহবর্মণের (৬৩০–৬৮০ খ্রিষ্টাব্দ; এঁদের "মামল্ল" বা "মহাযোদ্ধা"-ও বলা হত) রাজত্বকালে এই রথগুলি নির্মিত হয়। এই স্মারকগুলি প্রথম নরসিংহবর্মণের বিশেষ কৃতিত্ব। কারণ, এই ধরনের স্থাপত্য ভারতে তার আগে নির্মিত হয়নি। চত্বরটি এখন আর্কিওলজিক্যাল সার্ভে অফ ইন্ডিয়ার (এএসআই) তত্ত্বাবধানে রয়েছে। পঞ্চরথ স্মারকগুলি "মহাবলীপুরম স্মারকস্থল" নামে পরিচিত ইউনেস্কো বিশ্ব ঐতিহ্যবাহী স্থানের একটি অংশ।

পঞ্চরথ
"পঞ্চরথ", "মামল্লপুরম" বা "মহাবলীপুরমের পঞ্চরথ"
ইউনেস্কো বিশ্ব ঐতিহ্যবাহী স্থান
মামল্লপুরমের (মহাবলীপুরম) পঞ্চরথ (৬৩০–৬৩৮ খ্রিস্টাব্দ)
class="wikitable "

পঞ্চরথ চত্বরের প্রতিটি স্মারক ঠিক রথের মতো দেখতে। এগুলির প্রত্যেকটিই একটিমাত্র দীর্ঘ পাথর খোদাই করে নির্মিত। পাথরগুলি গ্র্যানাইট পাথর। এগুলি সামান্য বাঁকা অবস্থায় উত্তর-দক্ষিণে প্রসারিত।[১][২][৩] এগুলিকে মন্দির হিসেবে উল্লেখ করা হলেও, এগুলি আসলে তা নয়। কারণ, এগুলির নির্মাণকাজ শেষ হওয়ার আগেই প্রথম নরসিংহবর্মণের মৃত্যু হওয়ায় এগুলিকে ধর্মীয় প্রথা অনুযায়ী প্রতিষ্ঠা করা হয়নি।[১][৩][৪] এই স্মারকগুলির নামকরণ করা হয়েছে ভারতীয় মহাকাব্য মহাভারত-এর পঞ্চ পাণ্ডব ও তাদের সাধারণ স্ত্রী দ্রৌপদীর নামানুসারে।[২][৩][৫] আকার অনুযায়ী এই রথগুলির নাম হল ধর্মরাজ রথ, ভীম রথ, অর্জুন রথ, নকুল সহদেব রথদ্রৌপদী রথ

ব্যুৎপত্তি সম্পাদনা

এই স্মারকগুলির নামকরণ করা হয়েছে পাণ্ডব – যুধিষ্ঠির ("ধর্মরাজ"), ভীম, অর্জুন, নকুলসহদেব – এবং দ্রৌপদীর নামানুসারে। তবে এই নামকরণ যথাযথ নয়। কারণ এই স্মারকগুলির সঙ্গে মহাভারত-এর প্রধান চরিত্রগুলির কোনো সম্পর্ক নেই। এগুলির কোনো ধর্মীয় গুরুত্বও নেই। কারণ এগুলি অসম্পূর্ণ ও অপ্রতিষ্ঠিত। স্মারকগুলির পাদদেশে ও শীর্ষদেশে অখোদিত পাথরের অংশটি এখনও দেখা যায়। এএসআই-এর মতে, পাদদেশে ও শীর্ষদেশের এই অখোদিত অংশগুলি থেকে অনুমিত হয় যে এগুলিকে বিমান বলা হত। তবে পাণ্ডবদের নামগুলি থেকেই যায়।[১][৬][৭][৮]

ইতিহাস সম্পাদনা

স্মারক চত্বরে এএসআই স্থাপিত একটি ফলকে লেখা আছে, পল্লব রাজারা প্রাচীনকালের কাঠের রথের আদলে পাথরের রথের মডেল হিসেবে এই স্থাপত্যগুলি নির্মাণ করিয়েছিলেন।[৮] রাজা প্রথম মহেন্দ্রবর্মণ ও তার পুত্র প্রথম নরসিংহবর্মণের রাজত্বকালে এই পঞ্চরথ স্মারকগুলি খোদাই করা হয়েছিল। ৬৬৮ খ্রিষ্টাব্দে নরসিংহবর্মণের মৃত্যুর পর পঞ্চরথ নির্মাণের কাজ বন্ধ হয়ে যায়।[৪][৯] স্মারকগুলি অসম্পূর্ণ থেকে যাওয়ায়, এগুলি কেন নির্মাণ করা হচ্ছিল তা আর জানা যায় না। এই স্মারকগুলি মহাবলীপুরম স্মারকস্থলের অংশ। এই স্মারকস্থলটিকে ১৯৮৪ সালে ইউনেস্কো বিশ্ব ঐতিহ্যবাহী স্থানের মর্যাদা দিয়েছে।[২]

ভূগোল সম্পাদনা

এই স্মারকস্থলটি বঙ্গোপসাগরের করমণ্ডল উপকূলে অবস্থিত মহাবলীপুরমে (আগেকার নাম মামল্লপুরম) অবস্থিত। এটি ভারতের তামিলনাড়ু রাজ্যের কাঞ্চীপুরম জেলার অন্তর্গত। এই স্মারকস্থল রাজ্য রাজধানী চেন্নাই থেকে প্রায় ৩৫ মাইল (৫৬ কিমি) দক্ষিণে অবস্থিত।[৬] চেঙ্গলপট্টু এখান থেকে প্রায় ২০ মাইল (৩২ কিমি) দূরে অবস্থিত।[১০] এই রথগুলি এখানকার নয়টি মনোলিথিক পাথরখোদাই স্মারকের অন্তর্গত।[১১]

স্থাপত্য সম্পাদনা

 
রথ স্মারকস্থলের নকশা
 
পঞ্চরথ চত্বরের সম্পূর্ণ দৃশ্য
ভূমির নকশা

পাঁচটি রথের প্রতিটিই মনোলিথিক স্থাপত্যের নিদর্শন। এগুলি গোপালি গ্র্যানাইট পাথর খোদাই করে নির্মিত হয়েছে। উত্তর-দক্ষিণে প্রসারিত সামান্য ঢালযুক্ত একটি সাধারণ ভিত্তির উপর রথগুলি অবস্থিত। প্রতিটি আলাদা আলাদা নকশা অনুযায়ী নির্মিত। কোনোটি চৌকো, কোনোটি আয়তাকার, আবার কোনোটি গম্বুজাকার। সবচেয়ে বড়োটির আকার ৪২ বাই ৩৫ ফুট (১৩ মি × ১১ মি)। উচ্চতম স্মারকটির উচ্চতা ৪০ ফুট (১২ মি)।

প্রতিনিধিত্ব

পঞ্চরথ স্মারকস্থলে দ্রাবিড়ীয় স্থাপত্যকলার নানা শৈলী সন্নিবেশিত হয়েছে। সম্ভবত কাঠের মন্দিররথের আদলে এগুলি নির্মিত হয়েছিল এবং পরবর্তীকালে তামিলনাড়ুতে নির্মিত বৃহত্তর মন্দিরগুলির মডেল হিসেবে ব্যবহৃত হত।[৫][১২] কথিত আছে, অধিকাংশ রথই বৌদ্ধ বিহার ও চৈত্যের আদলে নির্মিত হয়েছিল।[৯]

নকশা

পঞ্চরথের একতল থেকে ত্রিতল মিনারগুলির নকশা দক্ষিণ ভারতীয় দ্রাবিড় স্থাপত্যের এক অদ্বিতীয় নিদর্শন। প্রস্তরশিল্পীর খোদাইগুলি কোনো কোনো পাথরের সন্ধিস্থলের উপর করা হয়েছে। দেওয়ালগুলি সুসংহত ও সুনির্দিষ্টভাবে পৃথকীকৃত। দেওয়ালগুলির গঠনভঙ্গিমা দেখে এগুলিকে শীর্ণাকার স্তম্ভ মনে হয়। দেওয়ালে গায়ে আয়তাকার খোপে দেবদেবী, উপদেবতা ও রাজাদের ভাস্কর্য খোদিত আছে। ছবির পাশে হিংস্র জলজন্তুর ছবিও আছে।[১৩] দেওয়াল-স্তম্ভগুলি বাঁকা খিলান সৃষ্টি করেছে। বারান্দার স্তম্ভগুলি উপরে একটি গুহার ভার বহন করছে। আর্চ-আকৃতির জানালাগুলির উপর কোথাও কোথাও ছবি দেখা যায়। কাঠামোটি বারান্দার ছাদে এসে মিশেছে। উপরের গুহার খোদাই ও চিত্রগুলি ছোটো আকারের। এগুলি প্রতিটি স্মারকে একই সরলরেখা বরাবর নির্মিত।[১৩]

সংরক্ষণ

রথগুলি গ্র্যানাইট পাথরে নির্মিত বলে এগুলিতে ক্ষয় কম হয়। এমনকি বঙ্গোপসাগরের নোনা হাওয়া এবং ত্রয়োদশ শতাব্দী ও ২০০৪ সালের সুনামিতেও এগুলি ক্ষতিগ্রস্ত হয়নি।[২][৩][৮]

 
রথের সঙ্গে হাতির মূর্তি

উল্লেখযোগ্য স্মারক সম্পাদনা

ধর্মরাজ রথের স্থাপত্যগত বৈশিষ্ট্য হল এটির পিরামিড-সদৃশ্য আকৃতি যা তিনটি ধাপে উঠেছে। এটি চৌকো জমিখণ্ডের উপর নির্মিত। এর গায়ে হিন্দু দেবতা হরিহর, ব্রহ্মা, স্কন্দ, অর্ধনারীশ্বর ও রাজা প্রথম নরসিংহবর্মণের খোদাইচিত্র রয়েছে। রথটির পূর্ব দিকে ঐরাবত হাতির পিঠে বসা ইন্দ্রের মূর্তি দেখা যায়। এই রথের পাশে খোলা জায়গায় নন্দীর একটি মনোলিথিক প্রস্তর ভাস্কর্য দেখা যায়। এর পরেই আছে অর্জুন রথ এটিও ধর্মরাজ রথের মতো সুসজ্জিত। তারপর রয়েছে ভীম রথ। এটি আয়তাকার জমিখণ্ডের উপর নির্মিত। এটির দুপাশে সিংহ-অঙ্কিত স্তম্ভযুক্ত চিত্রমালা দেখা যায়। এরপর আছে নকুল সহদেব রথ। এটির নকশা সাধারণ। এতে কোনো উল্লেখযোগ্য খোদাইচিত্র নেই। এই রথের পরে ফাঁকা জায়গায় একটি হাতির ভাস্কর্য রয়েছে। এরপর আছে দ্রৌপদী রথ। এটির আকৃতি বর্গাকার। এটি অনেকটা পাতার ছাউনি দেওয়া গ্রাম্য কুটিরের মতো দেখতে। এর ভিতর বেদিতে দেবী দুর্গার একটি ফ্রেস্কো আছে।[১১][১৪]

পাদটীকা সম্পাদনা

  1. "File:Five Rathas, Mahabalipuram.jpg"। Archarological Survey of India, Chennai Circle। সংগ্রহের তারিখ ৯ এপ্রিল ২০১৩  উদ্ধৃতি ত্রুটি: <ref> ট্যাগ বৈধ নয়; আলাদা বিষয়বস্তুর সঙ্গে "Plaque" নামটি একাধিক বার সংজ্ঞায়িত করা হয়েছে
  2. "Group of Monuments at Mahabalipuram"। World Heritage। সংগ্রহের তারিখ ২০০৭-০২-০৮ 
  3. "Pancha Rathas, Mamallapuram"। Arhaeological Survey of India। সংগ্রহের তারিখ ২৩ অক্টোবর ২০১২ 
  4. "Mahabalipuram"। UCLA Education, South Asia। সংগ্রহের তারিখ ৩০ ডিসেম্বর ২০১২ 
  5. "The Rathas, monolithic [Mamallapuram]"। Online Gallery of the British Library। সংগ্রহের তারিখ ১৯ ফেব্রুয়ারি ২০১৩ 
  6. Gunther, Michael D.। "Pancha Rathas, Mamallapuram"art-and-archaeology.com। সংগ্রহের তারিখ ২৩ অক্টোবর ২০১২ 
  7. Ring, Trudy; Watson, Noelle; Schellinger, Paul (১২ নভেম্বর ২০১২)। Asia and Oceania: International Dictionary of Historic Places। Taylor & Francis। পৃষ্ঠা 554–555, 912–। আইএসবিএন 978-1-884964-04-6। সংগ্রহের তারিখ ৩ জানুয়ারি ২০১৩ 
  8. "World Heritage Sites – Mahabalipuram: Group of Monuments Mahabalipuram (1984), Tamil Nadu"। Archaeological Survey of India by National Informatics Centre। সংগ্রহের তারিখ ৩০ ডিসেম্বর ২০১২  উদ্ধৃতি ত্রুটি: <ref> ট্যাগ বৈধ নয়; আলাদা বিষয়বস্তুর সঙ্গে "Sites" নামটি একাধিক বার সংজ্ঞায়িত করা হয়েছে
  9. "Rock Cut Architecture"। culturalindia.net। সংগ্রহের তারিখ ৩০ ডিসেম্বর ২০১২  উদ্ধৃতি ত্রুটি: <ref> ট্যাগ বৈধ নয়; আলাদা বিষয়বস্তুর সঙ্গে "Culture" নামটি একাধিক বার সংজ্ঞায়িত করা হয়েছে
  10. Ayyar, P. V. Jagadisa (১৯৮২)। South Indian Shrines: Illustrated। Asian Educational Services। পৃষ্ঠা 157–। আইএসবিএন 978-81-206-0151-2। সংগ্রহের তারিখ ৭ ফেব্রুয়ারি ২০১৩ 
  11. "A monumental effort"। Front Line India's National Magazine from the publishers of The Hindu। ৮ নভেম্বর ২০০৩। ১০ এপ্রিল ২০১৩ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ৩০ ডিসেম্বর ২০১২ 
  12. "Pancha Rathas"। Art-and-Archaeology.com। সংগ্রহের তারিখ ১১ জানুয়ারি ২০১২ 
  13. Michell 1977, পৃ. 132।
  14. Schreitmüller, Karen; Dhamotharan, Mohan and Szerelmy, Beate (২০১২)। Baedeker India। Baedeker। পৃষ্ঠা 589–। আইএসবিএন 978-3-8297-6622-7 

গ্রন্থপঞ্জি সম্পাদনা

বহিঃসংযোগ সম্পাদনা