নেমেসিস (নুরুল মোমেনের নাটক)

দ্বি‌তীয় বিশ্ব‌যুদ্ধকালীন সময়ে বাংলা (১৩৪৯-৫০ সাল) সংঘটিত মন্ব‌ন্তরের প্রেক্ষাপটে রচিত একটি বিখ্যাত নাটক "নেমেসিস" । ১৯৪৪ সালে নাটকটি "শনিবারের চিঠি" পত্রিকায় প্রকাশিত হয় । ১৯৪৮ সালে এটি গ্রন্থাকারে প্রকাশিত হয় । নাটকটি চোরাকারবারীর শিকার সুরজিত নন্দীর অনুশোচনা,যন্ত্রণা,দ্ব‌ন্দ্ব‌ এবং এর থেকে আত্মমুক্তির বিষয়বস্তু । সম্পূর্ণ‌ নাটকটি এক চরিত্র বিশিষ্ট । 

বাংলা নাট্যসহিত্যে নূরুল মোমেন (১৯০৮-১৯৯০) তার নেমেসিস(১৯৪৮) নাটকের মধ্যদিয়ে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ(১৯৩৯-১৯৪৫)মধ্যবর্তী সময়কালে দুর্ভিক্ষের সময় চোরাকারবারিদের নিয়ে গড়ে উঠেছে যেখানে আঙ্গুল ফুলে কলা গাছ হয়ে যাওয়া একটি চরিত্র সুরজিত নন্দী।এই নাটকে নূরুল মোমেন দেখিয়েছেন যে, অসৎ উপায়ে অর্থ উপার্জনের মাধ্যমে সুরজিত নন্দী সাধারণ মানুষের জীবনে যে দুঃখ- দুর্দশা বয়ে এনেছে তার প্রতিশোধ হিসেবে দেবী নেমেসিস(প্রতিহিংসার দেবী)তার জীবন কেড়ে নিয়েছে। নূরল মোমেন মূলত ষাটের দশকের নাট্যকার। তার সমসাময়িক নাট্যকাররা হলেন, গোলাম মোস্তফা (১৮৯৭-১৯৬৪), জসীম উদ্‌দীন (১৯০৩-১৯৭৬), শামসুর রাহমান (১৯২৯-২০০৬), ফররুখ আহমদ (১৯১৮-১৯৭৪), আ.ন.ম বজলুর রশীদ (১৯১১-১৯৮৬), আলাউদ্দিন আল আজাদ (১৯৩২-২০০৯)।

নূরল মোমেন বাংলা নাট্যসাহিত্যে চরিত্রের সংঘাত সৃষ্টিতে অনন্য দক্ষতার পরিচয় দিয়েছেন। নূরল মোমেন ১৯৪৪ সালে ‘আনন্দ বাজার’ পত্রিকায় তার ‘রূপান্তর’ নাটিকাটি প্রকাশের মাধ্যমে বাংলা নাটকে প্রবেশ করেন। নূরল মোমেনের উল্লেখযোগ্য নাটকগুলো হল যদি এমন হত (১৯৬০), নয়া খান্দান (১৯৬২), আইনের অন্তরালে (১৯৬৭), শতকরা আশি (১৯৬৯), যেমন ইচ্ছা তেমন (১৯৭০) ইত্যাদি। দেশের আর্থ-সামাজিক সমস্যাকে বিষয় হিসেবে গ্রহণ করে উদ্দেশ্যবাদী চিন্তা থেকে নাট্যচর্চা করেছেন। ‘নেমেসিস’ বাংলা নাটকের অভিনব সংযোজন। এটি একক চরিত্রের নাটক। বাংলা সাহিত্যে একক চরিত্রের নাটক রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ছাড়া আর কেউ লিখেনি।

এ নাটক সম্পর্কে নূরুল মোমেনের মন্তব্য হল, ‘ এই নাটকটিতে গ্রিক ট্র্যাজেডির চিরায়িত সময়, স্থান ও ক্রিয়া- এই ঐক্যত্রয়ের আঙ্গিক ঠিক রেখে চতুর্থ ঐক্য চরিত্রের একত্ব সংযোগ করা হয়েছে’। নাটকে আমরা দেখতে পাই, দরিদ্র স্কুল মাস্টার সুরজিত নন্দী বিত্তবান হওয়ার চুক্তি করে হবু শ্বশুর নৃপেন বোসের কাছে, শুধুমাত্র প্রিয়তমা সুলতাকে পাওয়ার জন্য। ‘তোমার মত তাঁকে দিয়েও প্রতিজ্ঞা করিয়েছি, তিন মাস তোমার সাথে সংশ্রব না রাখতে। ঝুন্রমাল ো অসীমের সাহায্য পেলে এই সময়ের মাঝে পাঁচলক্ষ টাকা আয় করা কোন অসম্ভব প্রস্তাব নয়। বিবেকটাকে সাপের খোলসের মত ত্যাগ করে নতুন হয়ে বেরিয়ে এসো। সময়ে আবার খোলস পড়বে। এ বর্ণচোরা দেশে মহারথীদের সামিল হওয়া ঐ একই পন্থা’ প্রিয়তমা সুলতাকে পাওয়ার জন্য মূলত দরিদ্র মাস্টার সুরজিত নন্দী দেশজাতির সাথে বিশ্বাসঘতকতায় লিপ্ত হয়। নৃপেন বোসের শর্তপূরণের জন্য আর মাত্র এক লক্ষ টাকা বাকি এসময় সুরজিতের কণ্ঠে উচ্চারিত হয়,

‘লক্ষ্মীর ভান্ডার বাংলাদেশ আজ নিরন্ন! বিশ্বের দোষ দেব না। আমাদের নালিশ আজ বাংলাদেশের লোকের বিরুদ্ধে, যারা দেশবাসীর উদ্যত হা’র সমুখ থেকে অন্ন সরিয়ে নিচ্ছে চারগুণ লাভের আশায়। অনাহার আর ক্ষুধায় দেশটাকে পিষ্ট করেছে। মা’র স্তনে দুধ নেই। চুষে চুষে দুধ না পেয়ে সন্তানগুলো কুকুরছানার মত কেই কেই করছে মার বুকে’। সেশজাতির সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করতে করতে সুরজিতের মনে ভয়ানক ক্লান্তি নেমেছে। সে কৃতকর্মের জন্য আনুশচনায় ভুগতে শুরু করে। ‘আমার মৃত্যুর পর আমার স্থাবর অস্থাবর সমস্ত সম্পত্তি ও ব্যাংকের টাকা দরিদ্রের সেবায় ব্যয় করিবার জন্য একটি ট্রাস্ট গঠন করছি’। সুরজিত প্রতিনিয়ত অনুশোচনায় ভোগে। সামান্য অর্থ লোভের জন্য কতবড় অন্যায় করেছে সে। তখন তার বিবেক বলে,

‘ মানুষের উপর রকমারি অত্যাচার করেছো। মৃত্যুদূতের দুহাত কাজে ভরে দিয়েছ। তাঁকে সব্যসাচী করে তুলেছো- তুমি। অন্ন থেকে বঞ্চিত করে, মরার পথে মানুষকে শুধু বসিয়ে দাও নাই, ওষুধ থেকে বঞ্চিত করে বেঁচে উঠার লড়াইয়ের হাতিয়ার থেকে বঞ্চিত করেছো- এই তুমি’। এক সময়ের বন্ধু অসীম, যে তাকে হাত ধরে অন্ধকার পথে নামিয়েছিল সে-ই তার বুকে ছুরি বসিয়ে দেয়। হত্যা করে। সে সুলেখার মুখখানি, অনাগত সন্তানের মুখ দেখে যেতে পারে নি। ‘ একটা ধোঁকার উপর আমার একমাত্র সন্তানকে আমার সম্পদ থেকে বঞ্চিত করতে , ওগো প্রতি হিংসার দেবী, তোমার লজ্জা করলো না। তুমি নীচ, তুমি হীন, তুমি জঘন্য’। নূরুল মোমেন যে উদ্দেশ্য নিয়ে নাটক রচনা করেছেন তিনি তার জায়গায় সফল। তিনি মনে প্রাণে চেয়েছেন অপরাধীদের করুণ শাস্তি হউক যারা দুর্ভিক্ষে সাধারণ মানুষকে কষ্ট দিয়েছে। তাইতো নেমেসিস দেবীর মাধ্যমে সুরজিতের করুণ পরিণতি রচনা করেছেন।

তথ্যসূত্র

সম্পাদনা