নবীকরণ

নিত্যনতুন ধারণার বাস্তবায়নের মাধ্যমে ক্রেতা, গ্রাহক বা ব্যবহারকারীর কাছে পণ্য বা সেবার মূল্য
(নূতনের প্রবর্তন থেকে পুনর্নির্দেশিত)

সাধারণভাবে নবীকরণ বলতে কোনও সংগঠনে নতুন কোনও কাজের নীতি, পরিচালনার কৌশল, কর্মসূচী, ধারণা, পণ্য, সেবা, উৎপাদন পদ্ধতি, নির্মাণ কৌশল, ইত্যাদি সৃষ্টির প্রক্রিয়াকে বোঝানো হয়। আরও নির্দিষ্টভাবে নবীকরণ বলতে এমন একটি প্রক্রিয়াকে বোঝায় যাতে কোনও পণ্য, সেবা বা প্রক্রিয়াতে ছোট কিংবা বড়, মৌলিক কিংবা ক্রমবর্ধমান পরিবর্তন সাধন করে কোনও সংগঠনে নতুন কিছুর প্রবর্তন করা হয়, যার ফলে ক্রেতার কাছে উৎপাদিত পণ্য বা সেবার মূল্য বৃদ্ধি পায় এবং পণ্য বিক্রয়কারী বা সেবা প্রদানকারী সংগঠনটির কর্মদক্ষতা, পণ্য বা সেবার মান, কাজের অভিজ্ঞতা, বিক্রির পরিমাণ, মুনাফা, জ্ঞানভাণ্ডার, ইত্যাদির উন্নতি সংঘটিত হয়। নবীকরণ অতিবৃহৎ সংগঠন বা একক উদ্যোক্তা, মুনাফাভিত্তিক ব্যবসায় কিংবা হাসপাতাল বা স্থানীয় সরকার, ইত্যাদি সকল ধরনের সংগঠনের জন্য প্রযোজ্য। নবীকরণ উপরোক্ত কোনও সংগঠনের যেকোনও স্তরে - ব্যবস্থাপনা দল থেকে শুরু করে বিভাগীয় পর্যায় ও প্রকল্প দল হয়ে এমনকি একক কর্মী বা শ্রমিকের ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা পর্যন্ত ঘটতে পারে।[১]

নবীকরণের বিভিন্ন ধাপ

নবীকরণ এমন একটি প্রক্রিয়া যেখানে সংগঠনের অভ্যন্তরে এমন কোনও নতুন ধারণা বাস্তবায়িত হয়, যার ফলে গ্রাহক বা ক্রেতার কাছে ঐ সংগঠনের কোনও পণ্য বা সেবার মূল্য বৃদ্ধি পায়। গ্রাহক বা ক্রেতা এই নতুন বা পরিবর্তিত পণ্যটি ক্রয় করেন বা সেবাটি গ্রহণ করেন এবং পণ্য বা সেবাটি ব্যবহার করে তার অভিজ্ঞতার উন্নতিসাধন করেন। এভাবে উত্তরোত্তর নতুন পণ্য বা সেবা প্রদান বা বিক্রয়ের ফলে সেগুলির সৃষ্টিকারী সংগঠনটিরও প্রবৃদ্ধি হয়। কোনও সংগঠনকে টিকে থাকতে হলে তাকে অবিরাম নবীকরণ করতে হয় এবং বিদ্যমান পণ্য, সেবা বা প্রক্রিয়াকে ক্রেতা, গ্রাহক বা ব্যবহারকারীর জন্য অধিকতর কার্যকর ও মূল্যবান কিছু দিয়ে প্রতিস্থাপন করতে হয়। যেকোনও নবপ্রবর্তিত বস্তুর একটি জীবনচক্র থাকে, অর্থাৎ শুরু ও শেষ থাকে। আজকের নবপ্রবর্তিত বস্তু ভবিষ্যতে বিলুপ্ত হয়ে যাবে। প্রতিটি সংগঠনের তাই লক্ষ্য থাকে সাফল্যের সাথে নতুন নতুন ভালো ধারণার জন্ম দেওয়া ও সেগুলি দিয়ে পুরাতন প্রতিষ্ঠিত ধারণাগুলিকে প্রতিস্থাপন করা। নবীকরণ একটি বিরামহীন প্রক্রিয়া, তাই কোনও সংগঠনের ভেতরে নতুন নতুন ধারণার সৃষ্টি বা জ্ঞানের সৃষ্টি কীভাবে করতে হয়, তা শেখা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। কার্যকরীভাবে নবীকরণ করতে চাইলে সংগঠনের ভেতরে জ্ঞানের সঠিক ব্যবস্থাপনা জানা প্রয়োজন। কোনও সংগঠনের ভেতরে নবীকরণ প্রক্রিয়ার ব্যবস্থাপনা তাই অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ, যার মধ্যে ধারণা ব্যবস্থাপনা, লক্ষ্য স্থিরকরণ, প্রকল্পের অগ্রাধিকার প্রদান, যোগাযোগ উন্নতকরণ, কর্মীদলগুলিকে উৎসাহ ও প্রেষণা প্রদান, ইত্যাদি ব্যাপারগুলি অন্তর্ভুক্ত। একটি সংগঠনকে বিরামহীনভাবে বাহ্যিক উদ্দীপকের প্রতি সাড়া দিয়ে শিখতে হয় ও নিজের আচরণ পরিবর্তিত করতে হয় এবং নিজের সামষ্টিক জ্ঞানভাণ্ডারে অবিরত নতুন নতুন ধারণা বা জ্ঞান যোগ করতে হয়। সাধারণত উদীয়মান প্রযুক্তি; প্রতিদ্বন্দ্বী প্রতিষ্ঠানের কর্মকাণ্ড; ক্রেতা, কৌশলগত অংশীদার ও কর্মীদের থেকে আগত নতুন ধারণা; এবং বাহ্যিক পরিবেশে উদ্ভূত পরিবর্তন - এই ব্যাপারগুলি নবীকরণের চালিকাশক্তি হিসেবে কাজ করে।[১]

নবীকরণ ধারণাটির সাথে সৃজনশীলতা, বৈজ্ঞানিক ও প্রযুক্তিগত উদ্ভাবন, নকশাকরণ, নিজস্বার্থসাধন, প্রবৃদ্ধি, পরিবর্তন, ব্যর্থতা, শিল্পোদ্যোগ, ক্রেতা বা গ্রাহক, জ্ঞান ও সর্বোপরি সমাজের মতো ধারণাগুলি ঘনিষ্ঠভাবে সম্পর্কিত। এজন্য নবীকরণ ধারণাটি বেশ কিছু শাস্ত্রে গুরুত্বের সাথে অধ্যয়ন করা হয়, যাদের মধ্যে অর্থশাস্ত্র, ব্যবসায় বিদ্যা, প্রকৌশল বিদ্যা, বিজ্ঞানসমাজবিজ্ঞান অন্তর্ভুক্ত।[১]

যদি কোনও সংগঠনের ভেতর এমন কোনও মৌলিক প্রকৃতির নবীকরণ ঘটে যাতে ব্যবসা করার স্বাভাবিক বা চিরায়ত পদ্ধতিতে আমূল পরিবর্তন আসে, তাহলে সেই নবীকরণটিকে বিপর্যস্তকারী নবীকরণ (Disruptive innovation) ডাকা হয়ে থাকে।[১]

কোনও নবীকরণকে এর উপযোগিতা, প্রাসঙ্গিকতা, উদ্দীষ্ট ক্রেতা বা গ্রাহকসমাজে এর গ্রহণের দ্রুতি ও বিস্তার, ইত্যাদি মানদণ্ডের নিরিখে মূল্যায়ন করা হয়ে থাকে।

নবীকরণের উপাদানসমূহ সম্পাদনা

কোনও প্রক্রিয়াকে তখনই নবীকরণ বলা হয়, যদি সেটি নতুন কোনও ধারণার অবতারণা করে, বাস্তব বিশ্বের কোনও সমস্যা সমাধানে বা চাহিদা মেটাতে পণ্য বা সেবায় সেই নতুন ধারণাটির বাস্তব প্রয়োগ ঘটে এবং সর্বোপরি ক্রেতা বা গ্রাহকের কাছে পণ্য বা সেবার অর্থনৈতিক মূল্য বৃদ্ধি পাওয়ার ফলে সেটি বাজারে টিকে থাকতে সমর্থ হয়। এই তিনটি শর্ত পূরণ না হলে তাকে নবীকরণ বলা যায় না। যদি নতুন কোনও ধারণার অবতারণা না হয়, তাহলে তা বিদ্যমান পরিস্থিতির একটি ধারাবাহিকতা মাত্র। যদি নতুন ধারণাটির বাস্তব প্রয়োগ না ঘটে, তাহলে তা সৃজনশীল কল্পনা মাত্র। যদি কোনও সমস্যার সমাধান বা চাহিদার পূরণ না হয়, তাহলে সেটি অর্থনৈতিকভানে মূল্যবান ও টেকসই নয়।

যদি উপরোক্ত তিনটি শর্তের মধ্যে দুইটি পূরণ হয়, তাহলে এমন কিছু সৃষ্টি হয়, যাকে নবীকরণ বলা চলে না। যেমন কোনও নতুন ধারণা যদি বাস্তবায়ন করা হয়, কিন্ত বাস্তব বিশ্বে এর কোনও অর্থনৈতিক মূল্য বা বাজারে টিকে থাকার সামর্থ্য না থাকে, তাহলে সেটিকে "নতুনত্ব" বা "অভিনবত্ব" বলা চলে। আবার কোনও নতুন ধারণার যদি অর্থনৈতিক মূল্য থাকে কিন্তু বাস্তবায়ন না ঘটে, তাহলে তাকে একটি "উপকারী সৃজনশীল ধারণা" বলা চলে। আবার যদি কোনও ধারণা বাস্তবায়নের ফলে যদি অর্থনৈতিক মূল্য বা বাজারে টিকে থাকার সামর্থ্য বৃদ্ধি পায়, কিন্তু ধারণাটি যদি নতুন কিছু না হয়, তাহলে সে ঘটনাটিকে "উন্নতিসাধন" বা "উৎকর্ষসাধন" বলা যায়।

অর্থাৎ নবীকরণ প্রক্রিয়াতে একই সাথে নতুনত্ব, বাস্তব প্রয়োগ ও অর্থনৈতিক উৎকর্ষসাধন - এই তিনটি উপাদানের মিলন ঘটে।

সংশ্লিষ্ট অন্যান্য ধারণার সাথে পার্থক্য সম্পাদনা

উদ্ভাবন সম্পাদনা

উদ্ভাবন হল সমস্যা সমাধানের লক্ষ্যে নতুন কিছু সৃষ্টি করা। উদ্ভাবক যখন ব্যবসায়িক উদ্যোক্তার মাধ্যমে তার উদ্ভাবন সফলভাবে বাজারজাত করেন, তখন সেটিকে নবীকরণ বলা যায়।

সৃজনশীলতা সম্পাদনা

সৃজনশীলতা হল নতুন ধারণা সৃষ্টির প্রক্রিয়া। কিন্তু সৃজনশীল ধারণার যদি অর্থনৈতিক তাৎপর্য না থাকে এবং সেটি যদি বাস্তবায়নযোগ্য না হয়, তাহলে সেটি থেকে নবীকরণ হবে না।

উৎকর্ষসাধন সম্পাদনা

কোনও ধারণার বাস্তবায়নের ফলে যদি কোনও সমস্যার সমাধান হয় বা অর্থনৈতিক মূল্য বৃদ্ধি পায়, তাহলে সেটিকে উৎকর্ষসাধন বলা চলে, কিন্তু যদি নতুনত্বের অভাবে সেটিকে নবীকরণ বলা যাবে না। অন্য ভাষায়, নবীকরণ মাত্রেই এক প্রকারের উৎকর্ষসাধন, কিন্তু উৎকর্ষসাধন মাত্রেই নবীকরণ নয়।

তথ্যসূত্র সম্পাদনা

  1. David O'Sullivan; Lawrence Dooley (জুন ২০০৮), "Defining Innovation", Applying Innovation, SAGE Publications, Inc