অধ্যাপক নির্মল দাশ (১৪ ফেব্রুয়ারি ১৯৪০ - ৪ মার্চ ২০১৬) বাঙালি ভাষা বিজ্ঞানী, বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের যশস্বী অধ্যাপক প্রাজ্ঞ গবেষণা নির্দেশক ও বাংলায় সাক্ষরতা আন্দোলনের এক পুরোধা ব্যক্তিত্ব।[১]

নির্মল দাশ
স্থানীয় নাম
নির্মল দাশ
জন্ম (1940-02-14) ১৪ ফেব্রুয়ারি ১৯৪০ (বয়স ৮৪)
বীরকুৎসা, রাজশাহী, ব্রিটিশ ভারত (বর্তমান বাংলাদেশ)
মৃত্যু৪ মার্চ ২০১৬(2016-03-04) (বয়স ৭৬)
কলকাতা, পশ্চিমবঙ্গ, ভারত
পেশাঅধ্যাপনা
ভাষাবাংলা
জাতীয়তাভারতীয় ভারত
ধরনগবেষণা গ্রন্থ, সম্পাদনা শিশু-কিশোর ও পাঠ্যপুস্তক
দাম্পত্যসঙ্গীরমলা দাশ

জন্ম ও শিক্ষা জীবন সম্পাদনা

নির্মল দাশের জন্ম অবিভক্ত বাংলার রাজশাহী জেলার বীরকুৎসা (অধুনা বাংলাদেশের) গ্রামে। পিতা চিকিৎসক সুরেন্দ্রনাথ দাশ ও মাতা বিশিষ্ট শিক্ষিকা সবিতা দাশ। নির্মল দাশের ঠাকুরদা ছিলেন বাংলাদেশের রংপুর জেলার গাইবান্ধা মহকুমার বেলকা গ্রামের অবস্থাপন্ন ব্যক্তি। পিতা সুরেন্দ্রনাথ পারিবারিক 'সরকার' পদবি দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশের অনুকরণে বদলে 'দাশ' করে নেন। নির্মল দাশের স্কুলের পড়াশোনা শুরুতে মাতুলালয়ে রাজশাহী জেলার তাহিরপুর স্কুলে, তারপর জলপাইগুড়ি জেলার রংধামালি স্কুলে এবং শেষে শহরের মেহেরুন্নেসা হাই স্কুলে। ১৯৫৬ খ্রিস্টাব্দে স্কুল ফাইনাল পাশের পর ভর্তি হন জলপাইগুড়ির আনন্দচন্দ্র কলেজে ইন্টারমিডিয়েটে। পরে ১৯৬০ খ্রিস্টাব্দে কলকাতার স্কটিশ চার্চ কলেজ হতে বাংলায় স্নাতক হন। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় হতে ১৯৬২ খ্রিস্টাব্দে প্রথম শ্রেণীতে প্রথম হয়ে এম.এ পাশ করেন। ১৯৭০ খ্রিস্টাব্দে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় হতেই প্রখ্যাত অধ্যাপক বিজনবিহারী ভট্টাচার্যের তত্ত্বাবধানে 'বাংলা ভাষার ব্যাকরণ ও তার ক্রমবিকাশ' বিষয়ে গবেষণা করে পি.এইচ.ডি. ডিগ্রি লাভ করেন।

কর্মজীবন সম্পাদনা

নির্মল দাশের কর্মজীবন শুরু হয় ১৯৬৩ খ্রিস্টাব্দে রায়গঞ্জ কলেজে অধ্যাপনায়। ১৯৬৬ খ্রিস্টাব্দে যোগ দেন কোচবিহারের ভিক্টোরিয়া কলেজে (বর্তমানে এ.বি.এন.শীল কলেজে)। এরপর ১৯৭০ খ্রিস্টাব্দে চলে আসেন কলকাতার গোয়েঙ্কা কলেজে। অবশেষে ১৯৭২ খ্রিস্টাব্দে যোগ দেন রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ে। ২০০১ খ্রিস্টাব্দে অবসর গ্রহণের পর কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অতিথি অধ্যাপক নিযুক্ত হন। কিছুদিন তিনি বেলুড় রামকৃষ্ণ মিশন বিবেকানন্দ বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিজিটিং অধ্যাপক ছিলেন।

সাহিত্য ও ভাষাচর্চা সম্পাদনা

জলপাইগুড়ির মেহেরুন্নেসা স্কুলে পাঠ চলাকালীন অধ্যাপক নির্মল দাশের সাহিত্যচর্চার সূত্রপাত 'জনমত' পত্রিকা ও 'ডানপিটেদের আসর' এর মধ্য দিয়ে। অধ্যাপক বিজন বিহারী ভট্টাচার্যের তত্ত্বাবধানে তার চমৎকার গবেষণাপত্র - ' বাংলাভাষার ব্যাকরণ ও তার ক্রমবিকাশ' বিগত অর্ধশতাব্দী কালের মধ্যে শ্রেষ্ঠ বলে বিবেচিত হয়। নিজেকে উত্তরবঙ্গের মানুষ হিসাবে পরিচয় দিতেন। সেখানকার বিভিন্ন জনগোষ্ঠী বিশেষ করে রাজবংশী ও অন্য সম্প্রদায়ের মধ্যে বাংলাভাষার আঞ্চলিক ব্যবহার লক্ষ্য করেছেন। বহু পরিশ্রম ও অধ্যবসায়ে ক্ষেত্রসমীক্ষা আর বিভিন্ন দৃষ্টিকোণে বিশ্লেষণ করেছেন। বাংলাভাষার চরিত্রের ও তার ব্যাকরণের উৎস সন্ধানে অনেক পথ পরিক্রমা করেছেন। ফলস্বরূপ বাংলা সাহিত্য সমৃদ্ধ হয়েছে বেশ কয়েকটি মৌলিক গবেষণা গ্রন্থে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল - 'চর্যাগীতি পরিক্রমা', 'ভাষা পরিচ্ছেদ', 'মধ্যযুগের কাব্যপাঠ', 'লোকভাষা থেকে ভাষালোক'। কয়েকটি গ্রন্থে' র সম্পাদনা ছাড়াও স্কুল পাঠ্য পুস্তক সহ শিশু ও কিশোরদের জন্য কয়েকটি বই রচনা করেছেন। এমনকি স্বল্প সাক্ষরদের উপযোগী চারটি পুস্তক রচনা করেছেন।

১৯৮৬ খ্রিস্টাব্দে পশ্চিমবঙ্গ বাংলা আকাদেমি গঠনের পর রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয় হতে অধ্যাপক নির্মল দাশ, যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয় হতে অধ্যাপক পবিত্র সরকারকলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় হতে অধ্যাপক অরুণ কুমার মুখোপাধ্যায়কে নিয়ে এক বাংলা বানান বিধি গঠনের উপসমিতি গঠিত হয়। এঁরাই যে ভিত্তিপত্র তৈরি করেন তারই উপর আকাদেমি বানান অভিধান প্রকাশিত হয়। এই বাংলা বানান অভিধানসহ বাংলা বানানের সমতা বিধানে ও বাংলা লিপিছাঁদের স্বচ্ছতার ক্ষেত্রে যথেষ্ট অবদান রেখেছেন তিনি।

জনশিক্ষা প্রসার সম্পাদনা

ভাষা নিয়ে গবেষণা করতে গিয়ে নির্মল দাশ কেবল ভাষার বিশ্লেষণে নিজেকে সীমাবদ্ধ রাখেননি। বরং সমকালীন বাংলার মানুষজনের বিশেষ করে শ্রমজীবী মানুষের জীবন যাপনও প্রভাবিত করেছে তাঁকে। বয়স্ক শিক্ষা ও সাক্ষরতার কাজে তিনি আনন্দ পেতেন। তিনি বিশ্বাস করতেন সাধারণ মানুষকে লেখাপড়া শিখিয়ে তাদের মনোজগতের উত্তরণ ঘটাতে পারলে তবেই সমাজের উন্নতি হবে। ১৯৮৬ খ্রিস্টাব্দে যখন রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ে 'বয়স্ক শিক্ষা' র বিভাগ গঠিত হয়, তার পরিকাঠামো, পরিকল্পনা, কর্মী প্রশিক্ষণ প্রভৃতির গুরুদায়িত্ব আন্তরিকতার সাথে গ্রহণ করেন। এই কাজের সূত্রে তার পরিচয় ঘটে জনশিক্ষার মহান পথিকৃৎ সত্যেন মৈত্রর সাথে। সাক্ষরতার অভিযানে ও প্রবহমান শিক্ষার কর্মসূচিতে সক্রিয় অংশ নিয়ে আমৃত্যু জনশিক্ষায় যুক্ত ছিলেন। ১৯৯৬ খ্রিস্টাব্দে সত্যেন মৈত্রর মৃত্যুর পর গঠন করলেন 'সত্যেন মৈত্র জনশিক্ষা সমিতি'। তারই উদ্যোগে জনশিক্ষার অতি মূল্যবান ত্রৈমাসিক পত্রিকা 'জনশিক্ষা ভাবনা' প্রকাশিত হতে থাকে।

প্রকাশিত গ্রন্থসমূহ সম্পাদনা

গবেষণা গ্রন্থ সম্পাদনা

  • চর্যাগীতি পরিক্রমা (১৯৭২)
  • মধ্যযুগের কাব্যপাঠ (১৯৭৮)
  • বাংলা ভাষার ব্যাকরণ ও তার ক্রমবিকাশ (১৯৮৭)
  • উত্তরবঙ্গের ভাষা প্রসঙ্গ ( ১৯৮৪)
  • ভাষা পরিচ্ছেদ ( ১৯৯৫)
  • কামতাপুরি ভাষা আন্দোলন: ঐতিহাসিক বাস্তবতা (১৯৯৭)
  • লোকভাষা থেকে ভাষালোক (২০০৯), দে'জ পাবলিশার্স, কলকাতা।
  • বহুব্রীহি - নির্বাচিত রচনা সম্ভার (২০১৫)
  • সুনীতিবাবুর কিন্নাহার এবং (২০১৫)

সম্পাদিত গ্রন্থ সম্পাদনা

  • ত্রৈলোক্য রচনাসমগ্র (২ য় খণ্ড)
  • যোগেন্দ্রচন্দ্র বসু রচনাবলী (৩ য় খণ্ড)
  • মদনমোহন তর্কলঙ্কার স্মারক গ্রন্থ (২০০৮)

পাঠ্য বই সম্পাদনা

  • বাংলা ভাষা : মিতি ও নির্মিতি ( ৯ম ও ১০ম শ্রেণি) ২০০৪
  • ভাষাজননী (৭মও ৮ ম শ্রেণি) ২০০৪
  • আ মরি বাংলা ভাষা (৬ষ্ঠ শ্রেণি) ২০০৪
  • আগুনের পরশমণি (সাহিত্য সংকলন) ২০০৫
  • আলোকের এই ঝর্নাধারা (সাহিত্য সংকলন) ২০০৫

আলো আমার আলো (সাহিত্য সংকলন) ২০০৫

শিশু ও কিশোরদের গ্রন্থ সম্পাদনা

  • ছড়ায় জানি নানান প্রাণী (২০০৭)
  • ছড়ায় মোড়া ফুলের তোড়া (২০০৮)
  • গল্পে ছোটদের বাল্মিকী রামায়ণ (২০০৮)
  • গল্পে ছোটদের ব্যাস মহাভারত

স্বল্প ও নবসাক্ষরদের গ্রন্থ সম্পাদনা

  • ছড়ায় ছড়ায় সাক্ষরতা
  • সোয়া সের গম
  • পণ্ডিত মশাই
  • দুই কৃষকের দুই গল্প

তথ্যসূত্র সম্পাদনা

  1. জনশিক্ষা ভাবনা অষ্টম বর্ষ,এপ্রিল-জুন-২০১৬ সত্যেন মৈত্র জনশিক্ষা সমিতি কলকাতা প্রকাশিত আইএসএসএন|2319-6610
  • অধ্যাপক নির্মল দাশ: ৭৫তম জন্মজয়ন্তী স্মারকগ্রন্থ
  • Janashiksha Bhabana Vol.8 No.1 April-June,2016 published by Satyen Maitra Janashiksha Samiti, Kolkata আইএসএসএন 2319-6610