নিবেদিতা নাগ

ভাষা সৈনিক ও বাঙালি বিপ্লবী

নিবেদিতা নাগ (বিবাহের পূর্বে নিবেদিতা চৌধুরী) (৪ আগস্ট ১৯১৮ - ০৫ মে ২০১৩) ছিলেন ভারতীয় উপমহাদেশের ব্রিটিশ বিরোধী স্বাধীনতা আন্দোলনের একজন সংগ্রামী, বাংলা ভাষা আন্দোলনের এক নেত্রী ও শিক্ষাবিদ।[১] তিনি কমিউনিস্ট স্বামী নেপাল নাগের সঙ্গে প্রথমদিকে পূর্ব পাকিস্তানের গোপন কমিউনিস্ট পার্টির এবং পরে পশ্চিমবঙ্গের কলকাতায় সাম্যবাদী আদর্শে এবং শেষে মার্কসবাদী কমিউনিস্ট পার্টির সঙ্গে যুক্ত থেকে নিবেদিত ছিলেন শোষিত মানুষের সংগ্রামে, বিশেষকরে নারী আন্দোলন ও সাম্যবাদী আন্দোলনে।[২] বাংলা ভাষা আন্দোলনে তার কাজের স্বীকৃতি স্বরূপ বাংলাদেশ সরকার ২০০০ খ্রিস্টাব্দে ভাষা সৈনিক সম্মাননা প্রদান করে।[১] মুক্তিযুদ্ধে অবদানের জন্য ২০১৩ সালে বাংলাদেশ সরকার তাকে স্বাধীনতা-মৈত্রী পদক প্রদান করে।[৩]

নিবেদিতা নাগ
জন্ম
নিবেদিতা চৌধুরী

(১৯১৮-০৮-০৪)৪ আগস্ট ১৯১৮
মৃত্যু৫ মে ২০১৩(2013-05-05) (বয়স ৯৪)
কলকাতা, (বর্তমান ভারত ভারত)
সমাধিকেওড়াতলা মহাশ্মশান কলকাতা
নাগরিকত্ব ব্রিটিশ ভারত (১৯৪৭ সাল পর্যন্ত)
 পাকিস্তান (১৯৫৫ সাল পর্যন্ত)
 ভারত
শিক্ষাএম.এ
মাতৃশিক্ষায়তনচট্টগ্রাম কলেজ
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
পেশাঅধ্যাপনা, রাজনীতিবিদ
পরিচিতির কারণব্রিটিশ বিরোধী স্বাধীনতা আন্দোলনে যুক্ত
উল্লেখযোগ্য কর্ম
নেপাল নাগ স্মৃতিচারণা
ঢাকা থেকে কলকাতা
রাজনৈতিক দলস্বাধীনতার পুর্বে ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি, স্বাধীনোত্তর কালে বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি
আন্দোলনব্রিটিশ বিরোধী স্বাধীনতা আন্দোলন
দাম্পত্য সঙ্গীনেপাল নাগ (বি. ১৯৪৩, মৃ.১৯৭৮)
সন্তানসুজয় নাগ (পুত্র)
সুমিতা নাগ (কন্যা)
পিতা-মাতাসঞ্জীবকুমার চৌধুরী (পিতা)
অমিয়বালা চৌধুরী (মাতা)

জন্ম ও প্রারম্ভিক জীবন সম্পাদনা

নিবেদিতা চৌধুরীর জন্ম ১৯১৮ খ্রিস্টাব্দের ৪ আগস্ট ব্রিটিশ ভারতের অধুনা বাংলাদেশের নারায়ণগঞ্জের আমলাপাড়ায় তার মাতুলালয়ে। মাতামহ আনন্দ রায়ের পরিবারে ছিল স্বাধীনতা সংগ্রামীদের আনাগোনা। পিতা অধ্যাপক সঞ্জীবকুমার চৌধুরী ছিলেন চট্টগ্রাম অস্ত্রাগার লুন্ঠনের নেতা সূর্য সেনের সহপাঠী। মাতা অমিয়বালা চৌধুরীও ছিলেন একজন স্কুল শিক্ষিকা। নিবেদিতার স্কুলজীবন শুরু হয়েছিল চট্টগ্রামের বিপ্লবী পরিবেশে। অল্প বয়সেই তিনি বিপ্লবীদের সঙ্গে যোগাযোগ রাখতেন, তাদের সাহায্যও করতেন। সেকারণে তিনি স্কুল থেকে বহিষ্কৃত হন। শেষে মামার বাড়ি নারায়ণগঞ্জের হাইস্কুলে ভর্তি হন এবং ১৯৩৪ খ্রিস্টাব্দে ম্যাট্রিক পাশ করেন। ম্যাট্রিক পাশের পর তিনি কলকাতার বেথুন কলেজে ভর্তি হন এবং সর্বভারতীয় ছাত্র ফেডারেশনের সক্রিয় সদস্য হন। ছাত্র সংগঠনের ডাকে ধর্মঘট সংগঠিত করতে গিয়ে কলেজ থেকেও বহিষ্কৃত হন। শেষে চট্টগ্রামে ফিরে যান এবং ১৯৩৮ খ্রিস্টাব্দে চট্টগ্রাম কলেজ থেকে স্নাতক হন। ১৯৪১ খ্রিস্টাব্দে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় হতে ইংরাজী ভাষা ও সাহিত্যে এম.এ পাশ করেন।

কর্মজীবন ও রাজনৈতিক ক্রিয়াকলাপ সম্পাদনা

এম.এ পাশের পর শিক্ষকতা দিয়ে কর্মজীবন শুরু করেন। তিনি ঢাকা ও কলকাতাতেও অধ্যাপনা করেছেন। নারায়ণগঞ্জের সরকারি তোলারাম কলেজ প্রতিষ্ঠায় অগ্রণী ভূমিকা নেন এবং ১৯৪৭ খ্রিস্টাব্দের ওই কলেজের অধ্যক্ষা ছিলেন তিনি।[১][৪] সেই সঙ্গে অবিভক্ত বাংলার কমিউনিস্ট আন্দোলনের ঢাকা জেলার মহিলা আত্মরক্ষা সমিতি'র সম্পাদক এবং পরে ১৯৪৩ খ্রিস্টাব্দে কমিউনিস্ট পার্টির নিয়মিত সদস্য হন এবং একনিষ্ঠ কর্মী হিসাবে গুরুত্বপূর্ণ অবস্থানে ছিলেন। ১৯৪৩ খ্রিস্টাব্দের ১৭ মে পরিবারের অমতে কমরেড নেপাল নাগকে বিবাহ করেন।[৫]

তাদের পুত্র সুজয় নাগ রিউম্যাটিক হার্টের অসুখে আক্রান্ত হওয়ায় নিবেদিতা নাগ ১৯৫৫ খ্রিস্টাব্দে পূর্ব পাকিস্তান থেকে কলকাতায় চলে আসেন। কিন্তু পূর্ব পাকিস্তানের তথা পরবর্তীতে বাংলাদেশের নারী আন্দোলন পুরোধা ব্যক্তিত্ব ছিলেন। কমিউনিস্ট পার্টির নারী সংগঠনে কাজ করতে গিয়ে তিনি সহযোদ্ধা হিসেবে পেয়েছেন আশালতা সেন, লীলা রায়, মণিকুন্তলা সেনসুফিয়া কামালের মতো বরেণ্য নেত্রীদের।[৩] অপরদিকে তার স্বামী নেপাল নাগ ১৯৬৪ খ্রিস্টাব্দে ভেঙ্গে যাওয়া আন্তর্জাতিক কমিউনিস্ট পার্টির চীনের নীতির পক্ষে সমর্থন জানিয়ে কলকাতায় সিপিএমের রাজনীতিতে যুক্ত হন। চরম অসুস্থ অবস্থায় তিনি প্রয়াত হন ১৯৭৮ খ্রিস্টাব্দের ৫ অক্টোবর।

ভাষা আন্দোলন ও মুক্তিযুদ্ধে অবদান সম্পাদনা

১৯৪৮ খ্রিস্টাব্দের ২৩ জানুয়ারি পাকিস্তানের গণপরিষদে বাংলা ভাষার দাবি নাকচ হয়ে গেলে বিচ্ছিন্নভাবে শুরু হয় ছাত্র আন্দোলন। সেখানে লিলি খান, লায়লা সামাদ মনোরমা বসু সহ অন্যদের সঙ্গে নিবেদিতাও সামিল হন। এই ভাষা আন্দোলনের সময় থেকেই কমিউনিস্ট পার্টির সর্বক্ষণের কর্মী হন।

শহীদুল্লা কায়সার ছিলেন তাঁর অনুজপ্রতিম সহযোদ্ধা। ভাষা আন্দোলনের সময় একই কমিউনে ছিলেন তাঁরা। কলকাতায় অবস্থানের কারণে যদিও তিনি একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধে প্রত্যক্ষে অংশ নিতে পারেন নি। তবে কমিউনিস্ট পার্টির সদস্য হিসাবে যুদ্ধরত কমরেডদের এবং নির্যাতিত, দুর্গত মানুষের পাশে দাঁড়ান। মুক্তিযুদ্ধের দিনগুলিতে কলকাতায় তাঁর বাসস্থান ছিল বাংলাদেশের বামপন্থী মুক্তিযোদ্ধাদের অন্যতম আশ্রয়স্থল।

সম্মাননা সম্পাদনা

ভাষা আন্দোলনে ও বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের অবদানের জন্য বাংলাদেশ সরকার যথাক্রমে ২০০০ খ্রিস্টাব্দে ভাষা সৈনিক' সম্মাননা[১] এবং ২০১২ খ্রিস্টাব্দে রাষ্ট্রীয় সম্মাননা প্রদান করে।[৪]

জীবনাবসান সম্পাদনা

বাংলা ভাষা আন্দোলনের সৈনিক, মুক্তিযুদ্ধের সহযোদ্ধা ও শিক্ষাবিদ অধ্যাপক নিবেদিতা নাগ ২০১৩ খ্রিস্টাব্দের মে মাসের প্রথম দিক থেকেই বার্ধক্যজনিত কারণে অসুস্থ ছিলেন। ৫ মে রবিবার সকালে কলকাতার এক বেসরকারি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। ওই দিনই কলকাতার কেওড়াতলা মহাশ্মশানে তার শেষকৃত্য সম্পন্ন করা হয়। মৃত্যুকালে তার বয়স হয়েছিল ৯৪ বৎসর।[৪]

তথ্যসূত্র সম্পাদনা

  1. "ভাষাকন্যা নিবেদিতা নাগ"। সংগ্রহের তারিখ ২০২২-১০-২০ 
  2. "নিবেদিতা নাগ: জন্মশতবর্ষে শ্রদ্ধাঞ্জলি"। সংগ্রহের তারিখ ২০২২-১০-২০ 
  3. "কমরেড নিবেদিতা নাগের জন্মশতবার্ষিকী আজ"। সংগ্রহের তারিখ ২০২২-১০-২১ 
  4. "ভাষাসৈনিক নিবেদিতা নাগ আর নেই"। সংগ্রহের তারিখ ২০২২-১০-২০ 
  5. "নিবেদিতা নাগ - এক মহিয়সী নারী, ভাষা সৈনিক, রাজনৈতিক এবং শিক্ষাবিদ..."। ২০২২-১০-২০ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ২০২২-১০-২০