নাগেশ্বরী উপজেলা

কুড়িগ্রাম জেলার একটি উপজেলা

নাগেশ্বরী উপজেলা বাংলাদেশের কুড়িগ্রাম জেলার একটি সুসজ্জিত এলাকা বা উপজেলা।

নাগেশ্বরী
উপজেলা
মানচিত্রে নাগেশ্বরী উপজেলা
মানচিত্রে নাগেশ্বরী উপজেলা
স্থানাঙ্ক: ২৫°৫৮′৫৪″ উত্তর ৮৯°৪২′২৩″ পূর্ব / ২৫.৯৮১৬৭° উত্তর ৮৯.৭০৬৩৯° পূর্ব / 25.98167; 89.70639 উইকিউপাত্তে এটি সম্পাদনা করুন
দেশবাংলাদেশ
বিভাগরংপুর বিভাগ
জেলাকুড়িগ্রাম জেলা
প্রতিষ্ঠা২৩ শে জানুয়ারি , ১৯৮৪
আয়তন
 • মোট৪১৭.৫৭ বর্গকিমি (১৬১.২২ বর্গমাইল)
জনসংখ্যা (২০০১)
 • মোট৪,০২,১০১ []
সময় অঞ্চলবিএসটি (ইউটিসি+৬)
পোস্ট কোড৫৬৬০ উইকিউপাত্তে এটি সম্পাদনা করুন
প্রশাসনিক
বিভাগের কোড
৫৫ ৪৯ ৬১
ওয়েবসাইটদাপ্তরিক ওয়েবসাইট উইকিউপাত্তে এটি সম্পাদনা করুন

নামকরণ

সম্পাদনা

নাগেশ্বরী বিলের নাম অনুযায়ী এই এলাকার নাম হয় নাগেশ্বরী। এই বিলের নামকরণ নিয়ে দুটি মত প্রচলিত আছে। কথিত আছে, নাগেশ্বরী বিলের তীরে অবস্থিত মন্দিরে দুর-দুরান্ত থেকে নাগা সন্ন্যাসীরা এসে পূজা দিত; এ থেকে এ বিলের নাম হয় নাগেশ্বরী। আবার কেউ কেউ মনে করেন, এ বিলে বিভিন্ন প্রজাতির নাগ বা সাপ যেমন- শীষ নাগ, কাল নাগ, পঙ্খীরাজ নাগ, দুধ নাগ ইত্যাদি থাকতো; তাই এ বিলের নাম নাগেশ্বরী।

অবস্থান ও আয়তন[]

সম্পাদনা

৪১৫.৮০ বঃকিঃমি আয়তনের এই উপজেলার উত্তরে ভূরুঙ্গামারী উপজেলাভারতের পশ্চিমবঙ্গ, দক্ষিণে কুড়িগ্রাম সদর উপজেলা, পূর্বে ভারতের আসাম, পশ্চিমে ফুলবাড়ী উপজেলা। এই উপজেলা ২৫ ডিগ্রি ৫১ উত্তর অক্ষাংশ ও ২৬ ডিগ্রি ০৪ দক্ষিণ অক্ষাংশে অবস্থিত এবং ৮৯ ডিগ্রি ০৬ ও ৮৯ ডিগ্রি ৫৩ পূর্ব দ্রাঘিমাংশে অবস্থিত।

ইতিহাস ও পটভূমি[]

সম্পাদনা

জানা যায়, এক সময় এ অঞ্চল প্রাচীন কামরুপ বা প্রাক জ্যোতিষপুর রাজ্যের অধীনে ছিল। ১২০৬ সালে গৌড়ের শাসনকর্তা গিয়াস উদ্দিন খিলজী কামরুপ দখল করে নেন। এ সময় ব্রক্ষ্মপুত্র নদের উপত্যকা অর্থাৎ পুরো নাগেশ্বরী তাঁর অধীনে চলে যায়। এদিকে বাদশা মোহাম্মদ শাহ'র আদেশে তাঁর ভাগ্নে মালিক খসরু কুড়িগ্রামের ব্রহ্মপুত্র নদ দিয়ে চীন বিজয়ের উদ্দেশ্যে অগ্রসর হন। কিন্তু অতিবৃষ্টি, দুর্গম পথ ও পাহাড়ী ঢলের কারণে বিপক্ষ দলের আক্রমনের শিকার হয়ে এক লক্ষ অশ্বারোহী বাহিনী থাকা সত্বেও তিনি বিফল হয়ে ফিরে আসেন। তের শতাব্দীতে অহোমগণ ব্রক্ষ্মপুত্র নদের পূর্বাংশ দখল করে এর নাম করণ করেন অহম রাজ্য। যা বর্তমানে আসাম রাজ্য হিসেবে স্বীকৃত। ঠিক এই সময় কামরুপ রাজ্যের পশ্চিম সীমানায় কামাতাপুর নামে একটি পৃথক রাজ্য স্থাপিত হয়। এবং কুড়িগ্রামের রৌমারী, রাজিবপুর ব্যতীত কুড়িগ্রামের সমগ্র অঞ্চল ও আসামের গোয়ালপাড়া, ধুবড়ী এ রাজ্যেরই অন্তর্ভুক্ত ছিল। ভূরুঙ্গামারী বাসষ্ট্যান্ডের নিকটবর্তী কামাতা আঙ্গারিয়া গ্রাম কামাতাপুর রাজ্যের ঐতিহ্য বা সাক্ষী হয়ে আজও দাঁড়িয়ে আছে।

এদিকে গৌড়ের সুলতান বারবক শাহ্ এর সেনাপতি শাহ ইসমাইল গাজী ১৪৭৪ খ্রিস্টাব্দে কামরুপ রাজ্য জয় করে নেন। যার ফলে বৃহত্তর রংপুর জেলা তাঁর হস্তগত হয়। ধারণা করা হয়, নাগেশ্বরীর সন্তোষপুর নামক স্থানে শাহ্ ইসমাইল গাজীর সাথে কামরুপের অধিপতি কামেশ্বরের যুদ্ধ সংগঠিত হয়। পরবর্তীতে পঞ্চদশ শতাব্দীতে কামাতাপুর রাজ্যে খেন বংশীয় হিন্দু রাজারা কিছু কালের জন্য রাজত্ব করেন। ১৫০৬ সালে তরবক খা নাগেশ্বরী তথা কামাতাপুর রাজ্য দখল করতে বিশাল নৌবহর নিয়ে ব্রহ্মপুত্র নদ দিয়ে আগমন করেন, কিন্তু ব্যর্থ হয়ে ফিরে যান।

এরপর আলাউদ্দিন হোসেন শাহ’র দুর্বল উত্তরাধীকারীদের সুযোগে বিষ্ণু নামক একজন কোচ সর্দার আফগান শাসনের অবসান ঘটিয়ে তৎকালীন বৃহত্তর রংপুরের একাংশ দখল করে এর নামকরণ করেন কোচবিহার। এ সময় নাগেশ্বরীও কোচবিহারে অন্তর্ভুক্ত হয়। ১৯৫৩ সাল পর্যন্ত কোচবিহার স্বাধীন রাজ্য হিসেবে বিরাজমান ছিল।

১৫৪১ সালে শের শাহ বাংলাদেশ দখল করার সময় নাগেশ্বরী অঞ্চলকে কোচবিহার থেকে সুবে বাংলা প্রদেশের অধীনস্থ করেন। তিনি শাসন কার্যের সুবিধার্থে তৎকালীন পুরো বাংলাকে ১৯টি সরকারে বিভক্ত করেন। এর একটি হলো ঘোড়াঘাট সরকার যা বর্তমানে দিনাজপুর জেলার অন্তর্ভুক্ত। সে সময় নাগেশ্বরী ঘোড়াঘাট সরকারের অধীনস্থ ছিল। যেহেতু এ এলাকা সবাই দখল করতে চাইত তাই শেরশাহ এ অঞ্চলকে বিশেষভাবে চিহ্নিত করার জন্য এর নাম করণ করেন 'সরকার বাঙ্গালভূম' অথবা বাংলার ভূমি।

শের শাহ’র মৃত্যুর পর কোচ রাজা ১৫৪৫ সালে সরকার এই বাঙ্গালভূম নিজ দখলে নিয়ে আসেন। এমনকি সম্রাট আকবরের সময়ও এ অঞ্চল মোঘলরা কোচদের কাছ থেকে কোনভাবেই উদ্ধার করতে পারেনি। ১৬৬১ সালে আওরঙ্গজেবের সেনাপতি মীর জুমলা কোচবিহার আক্রমমণ করেন এবং সফলতার সাথে সরকার বাঙ্গালভূম উদ্ধার করতে সমর্থ হন। এ সময় মীর জুমলা ভূরুঙ্গামারী উপজেলার মোঘলকাটায় প্রায় তিন বছর অবস্থান করেন। দ্বিতীয় বার তিনি ফিরে যাবার সময় ১৬৬৩ সালে পথিমধ্যে অসুস্থ হয়ে আসামের মানকের চরে মৃত্যু বরণ করেন। আসামের একটি পাহাড়ে তাঁকে সমাহিত  করা হয। এ পাহাড়টি বর্তমানে মীর জুমলা পাহাড় নামে পরিচিত। তখন থেকেই নাগেশ্বরী মোঘল এবং তাদের সৃষ্ট জমিদারদের দ্বারা শাসিত হতো।

১৭৫৭ সালে পলাশির যুদ্ধের ফলাফলকে এ অঞ্চলের মানুষ কোনভাবেই মেনে নিতে পারে। এ কারণে বৃহত্তর রংপুর ও দিনাজপুর জেলার কিছু অংশের স্থানীয় অধিবাসী এই অঞ্চলকে একটি স্বাধীন রাজ্য হিসেবে ঘোষণা করেন। এবং তারা এ স্বাধীন রাজ্যের নাম করণ করেন স্বাধীন রঙ্গপুর রাজ্য।

ঊনবিংশ শতকের প্রথম দশক পর্যন্ত ইংরেজরা স্বাধীন রঙ্গপুর দখল করার জন্য দীর্ঘদিন যুদ্ধ পরিচালনা করে। এ যুদ্ধ মোকাবেলা করার জন্য নবাব নুরুলদ্দীন রঙ্গপুর রাজ্য কে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র অংশে বিভক্ত করে। ঊনবিংশ শতকের প্রথম দশকে রঙ্গপুর রাজ্যের পতন হয় এবং নাগেশ্বরী থানা এ দেশের ইংরেজ কর্তৃক অধিকৃত সর্বশেষ স্বাধীন থানা/এলাকা। লর্ড কর্ণ ওয়ালিশ কোড অনুযায়ী ইংরেজরা বাংলাদেশের অন্যান্য স্থানে পুলিশ স্টেসন স্থাপিত করলেও নাগেশ্বরী থানা স্থাপিত হয় ১৮১০ সালের কাছাকাছি সময়ে। উল্লেখ্য যে, ইংরেজরা এ উপজেলা দখল করার পর, নাগেশ্বরী থানাকে পয়ড়াডাঙ্গায় পূর্ণ প্রতিষ্ঠা না করে পয়ড়াডাঙ্গার তিন মাইল উত্তরে হলদিকুড়া ব্রিজের নিকট থানা স্থানান্তর করা হয়। এরশাদ সরকার ক্ষমতায় আসার পর প্রশাসনিক ইউনিট হিসেবে থানাকে মান উন্নীত থানায় রূপান্তর করা হয়। এসব মান উন্নীত থানাকে পরবর্তীতে উপজেলা হিসেবে নামকরণ করা হয়। ১৪ এপ্রিল ১৯৮৪ সালে নাগেশ্বরী থানাকে উপজেলায় উন্নীত করা হয়।

মুক্তিযুদ্ধ

সম্পাদনা

১৫ মাচ ১৯৭১ জনাব মোজাহার হোসেন চৌধুরীর নেতৃত্বে নাগেশ্বরীতে থানা সংগ্রাম কমিটি গঠিত হয়। তাদের নেতৃত্বে তৈরি করা হয় ১১০ টি বাংলাদেশের মানচিত্র খচিত পতাকা। ঐ দিন তারা তহশিল অফিস সংলগ্ন পাবলিক ক্লাবের সামনে স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলন করেন। ২৮ নভেম্বর দক্ষিণ ব্যাপারী হাটে পাক সেনাদের সাথে মুক্তিবাহিনী ও ভারতীয় সেনাদের সম্মলিত বাহিনীর যুদ্ধ হয়। ঐ দিন স্বাধীন হয় নাগেশ্বরী।

অবস্থান ও আয়তন

সম্পাদনা

এ উপজেলার উত্তরে ভূরুঙ্গামারী উপজেলাভারতের পশ্চিমবঙ্গ, দক্ষিণে কুড়িগ্রাম সদর উপজেলা, পূর্বে ভারতের আসাম, পশ্চিমে ফুলবাড়ী উপজেলা

প্রশাসনিক এলাকা

সম্পাদনা

গ্রাম ৩৬৭ টি।

সংসদীয় এলাকা: ১টি

নাম ও এলাকা- কুড়িগ্রাম-১ (নাগেশ্বরী, ভূরুঙ্গামারী)।

পৌরসভা- নাগেশ্বরী পৌরসভা

ইউনিয়ন ১৪টি।

ইউনিয়নের তালিকা

সম্পাদনা

এ উপজেলার ওপর দিয়ে প্রবাহিত দুধকুমর, ফুলকুমর, ব্রহ্মপুত্র নদ, গঙ্গাধর, সংকোষ ও অসংখ্য গিড়াই নদী। তাছাড়া এ এলাকায় সর্বত্রই ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে অসংখ্য জলাশয়। তার মধ্যে গোর্দ্ধার, নাগেশ্বরী, মসলিয়া, চতলা, ভোসতুলি, নকাইঝাড়, মাদারের কুড়া, দিঘীরপাড় বটগাছ, হাড়াগিলা, বড়মানি, ছোটমানি, মন্নেয়ারকুড়া, কুমড়িয়া, শিবেরহাট, ভেলকারদহ, ভেলাকোবা, শিতলয়া, শুটকিয়া, কালাপাঠের কুড়া, কাশিরডারা, সাতকুড়া, কালাপানি ও আসমিতা, অন্তাই, বোয়ালের ডারা, কোটলডাঙ্গা, ফুলকুড়া, নরশিংডাঙ্গা, রায়গঞ্জ খাসবিল, পয়ড়াডাঙ্গা, মতিরছড়া, লটবিল, সারিসুরি, বুড়িরছড়া, বাগডাঙ্গা, সতিবাড়ি, নাওডাঙ্গা, ধরকা, নিমকুর্শা, ছোটধানী, বড়ধানী ও মাধাইখাল বিল প্রভৃতি জলাশয় অন্যতম।

জনসংখ্যার উপাত্ত

সম্পাদনা
  • মোট ৪,০২,১০১ জন; পুরুষ ২,০৯,০১৬ জন ও মহিলা ১,৯৩,০৮৫ জন।
  • মুসলমান ৩,০৫,০১১ জন।
  • হিন্দু ১৬,৯২১ জন।
  • বৌদ্ধ ৫৬ জন।
  • খ্রিস্টান ১০১ জন।
  • আদিবাসী ১৪ জন (কোচ)।
  • প্রতি বর্গ কিলোমিটারে ৯৬৬ জন।
  • বাৎসরিক জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার- ১.৪৩ (২০০১ সাল)
  • জন্মের হার ১.৪৮ জন।
  • মৃত্যুর হার ০.২৬ জন।
  • মোট ভোটার সংখ্যা- ২৩৭৪০৭ জন।
  • পুরুষ ভোটার সংখ্যা- ১১৬১৬৮ জন।
  • মহিলাভোটার সংখ্যা- ১২১২৩৯ জন।

শিক্ষা

সম্পাদনা
  • শিক্ষার হার: ৩০.২৯%
  • কলেজ: ১২টি
  • হাইস্কুল: ৮৩টি
  • মাদ্রাসা: ৩৯টি
  • সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়: ৯৫টি
  • বেসরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়: ৮৪টি

অর্থনীতি

সম্পাদনা
  • পাকা রাস্তা: ৭২ কি. মি.
  • কাঁচা রাস্তা: ১২৮০ কি. মি.
  • মোট আবাদী জমি: ৭৫৫০০ একর
  • অর্থকরী ফসল: ধান, পাট, গম প্রভৃতি
  • শিল্প প্রতিষ্ঠান: শাহেরা অটো রাইস মিল

ধর্মীয় উপাসনালয়

সম্পাদনা
  • মসজিদ: ৬৫৭টি
  • মন্দির: ১৬টি

দর্শনীয় স্থান

সম্পাদনা
  • ভিতরবন্দ জমিদার বাড়ি
  • মাধাইখাল কালী মন্দির
  • দিঘীরপাড় বটগাছ
  • নাগেশ্বরী ডিগ্রি কলেজ
  • গাগলা বাজার
  • সুমি পাগলির আস্তানা, গাগলা।

আরও দেখুন

সম্পাদনা

তথ্যসূত্র

সম্পাদনা
  1. "এক নজরে নাগেশ্বরী"বাংলাদেশ জাতীয় তথ্য বাতায়ন। গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার। জুন ২০১৪। ২৬ নভেম্বর ২০১৩ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ২১ ডিসেম্বর ২০১৪ 
  2. "নাগেশ্বরী উপজেলা"nageshwari.kurigram.gov.bd (ইংরেজি ভাষায়)। ২০২১-১০-২২ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ২০২১-১০-২১ 
  3. "নাগেশ্বরী উপজেলা"nageshwari.kurigram.gov.bd (ইংরেজি ভাষায়)। সংগ্রহের তারিখ ২০২১-১০-২১ [স্থায়ীভাবে অকার্যকর সংযোগ]

বহিঃসংযোগ

সম্পাদনা