নাগা সন্ন্যাসী

নাগা সন্ন্যাসী পাহাড়ে বসবাস করা নাগা সাধুদের বলা হয়।[১][২]

নাগা সন্ন্যাসীদের উৎপত্তিসম্পাদনা

সংস্কৃত ভাষায় নাগা অর্থ পর্বত। পাহাড় এবং আশেপাশে বসবাসকারীরা পাহাড়ি বা নাগা নামে পরিচিত। নাগা সাধুদের ইতিহাস অনেক প্রাচীন । প্রাচীন মহেঞ্জাদারো জনপদের মুদ্রার চিত্রে নাগা সাধুদের অস্তিত্বের প্রমাণ মেলে। এই চিত্রগুলোতে দেখা যায়, নাগা সাধুরা পশুপতিনাথ রূপে মহাদেব শিবের উপাসনা করে।জানা যায়, ভারতে যখন বকধার্মিকদের দৌরাত্ম্য বেড়ে গিয়েছিল তখন গুরু শংকরাচার্য্য (শংকর আচার্য্য) তাদের রুখতে একটি খারু গঠন করেন। এই সঙ্ঘের মাধ্যমেই নাগা সাধুদের বর্তমান ধারার উৎপত্তি ঘটে। নাগা সাধু বা সন্ন্যাসীরা বরাবরই শাস্ত্রজ্ঞান ও অস্ত্রজ্ঞান উভয় বিষয়েই সমান দক্ষ। শরীরে প্রচন্ড শক্তি রাখে

নগ্ন থাকার কারণসম্পাদনা

অনেকের মনেই প্রশ্ন জাগতে পারে নাগারা নগ্ন থাকেন, তাদের কি কামবাসনা নেই? নাগা সাধুদের প্রশিক্ষণের চূড়ান্ত পর্যায়ে ব্রহ্মমুহূর্তে তাদের মন্ত্রদান করা হয়। যে মন্ত্র এক কঠিন সাধনা লব্ধ। তারা কাম বাসনার উর্ধ্বে থাকার জন্য যৌন আকাঙ্ক্ষা মুক্ত হয়। বিশেষ প্রক্রিয়ায় তাদের যৌনাঙ্গ নষ্ট করে দেয়া হয়।

যৌন কামনার প্রবল বেগকে সামলে একজন প্রকৃত নাগা হয়ে ওঠে। তাদের শরীর এবং মনে কোনো কাম বাসনা এবং জাগতিক চিন্তা ভাবনা থাকেনা। নাগা সাধুদের সাধনায় যাতে পার্থিব কোনো কিছু স্পর্শ না করে সেজন্য তারা বস্ত্রও পরিত্যাগ করে। এজন্য তারা কোন বিষয়ে ক্ষেপে গেলে নিয়ন্ত্রণ করা কঠিন। কারণ তারা জাগতিক চিন্তার বাইরে থাকায় ও পরিবারের প্রতি পিছুটান না থাকায় মরতে বা মারতে বিন্দু মাত্র চিন্তা করে না।

ছবিসম্পাদনা

নাগা সন্ন্যাস গ্রহণের পদ্ধতি ও আহারসম্পাদনা

দীর্ঘ এবং কঠোর প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে একজন নাগা সন্ন্যাসীতে পরিণত হন। খুব ছোট বয়স থেকে এই প্রক্রিয়া শুরু হয়। নাগা সাধু তৈরির প্রক্রিয়া খুব গোপনীয়। প্রাথমিক অবস্থায় ১২ বছর কঠোর প্রশিক্ষণ চলে। এই সময় খাদ্যের অনেক বিধি-নিষেধ থাকে। তারা নিজেরাই খাদ্য তৈরি করে খায়। প্রাথমিক এই স্তরে নিজের গুরু সেবা তাদের কাছে গুরুত্বপূর্ণ।

একজন প্রকৃত নাগা সাধু হওয়ার পথে ভুল হওয়ার সুযোগ খুবই কম থাকে। যদি কেউ প্রশিক্ষণ চলাকালীন কোনো ভুল করে তাকে কঠোর শাস্তি পেতে হয়। একজন নাগা সন্ন্যাসী প্রস্তুত হতে ২০ বছর সময় লাগে। আট বছর বয়সে নাগা সাধু হতে ইচ্ছুকদের কঠিন পরীক্ষা নেয়া হয়।

শিশুরা এই পরীক্ষায় পাশ করলে প্রশিক্ষণের জন্য নির্বাচিত হয়। এরপর একটা মন্ত্র দেয়া হয় অতঃপর ১২ বছর বয়সে প্রশিক্ষণ শুরু হয়। ছোটদের এই প্রশিক্ষণ অনেকটা সামরিক বাহিনীর মতো বললেও ভুল হবে না। যে কোনো কঠিন পরিস্থিতিতে তাদের অটল থাকার প্রশিক্ষণ দেয়া হয়। দেশ এবং সমাজের প্রয়োজনে তাদের অস্ত্র ধারণের প্রশিক্ষণও দেয়া হয়।

নাগা সন্ন্যাসীদের সাথে আফগান সৈন্যদের যুদ্ধসম্পাদনা

নাগা সন্ন্যাসীর সনাতন বা হিন্দু ধর্ম রক্ষার ক্ষেত্রে অতীতে বড় ভূমিকা রেখেছিল। ভারতীয় উপমহাদেশে মুসলিম শাসকরা যখন আক্রমণ করে দখল করে শাসন ব্যবস্থা প্রচলিত করে তখন বিভিন্ন সময় নাগা সাধুরা স্ব-ধর্ম রক্ষায় ত্রিশূল ও তরবারি হাতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে। ইংরেজদের বিরুদ্ধেও তারা অনেক আন্দোলনে তাদের ভূমিকা রয়েছে । এর মধ্যে ১৭৬০ এর দশকে ফকির-সন্ন্যাসী বিদ্রোহ ও আফগান সৈন্যদের সাথে যুদ্ধে তাদের অংশগ্রহণ উল্লেখযোগ্য। সেসময় অনেক জমিদারের পক্ষ নিয়েও তারা ইংরেজদের বিরুদ্ধে লড়াই করেছে।

১৭৫৭ সালে যখন উন্মাদী আফগান সেনা ভারতীয় ধন সম্পত্তি লুটতে লুটতে ও মহিলাদের অপহরণ করতে করতে গোকুলে পৌঁছেছিল তখন নাগা সাধুরা যুদ্ধ ঘোষণা করেছিল। আফগান সেনারা গোকুলের সমস্ত মন্দির লুটপাট করার পরিকল্পনা বানিয়েছিল। তখন তৎকালীন শাসক নাগা সন্ন্যাসীদের কাছে সহযোগিতা চাইলে ৫ হাজার নাগা সাধুর সেনা আফগান সেনার বিরুদ্ধে যুদ্ধে নেমে পড়ে। সেই যুদ্ধে আফগান সেনাপতি আহমেদ শাহ আব্দালি যাকে আধুনিক আফগান গঠনের জনক বলা হয় খোদ তিনিই প্রথমে নাগা সাধুদের যুদ্ধে নামা মজার ছলে নিয়েছিল। কিন্তু যুদ্ধ শুরু হতেই নাগা সাধুদের রুদ্র রূপ দেখে আফগান সেনারা দলে দলে পলায়ন শুরু করে। ইতিহাসবিদদের মতে এক একজন নাগা সাধু ১০ জন আফগান সেনাকে শেষ করেছিল। কিছু কিছু সাধু ১০০ জনকে পর্যন্ত এক শেষ করে বীরত্বের পরিচয় দিয়েছিল। হর হর মহাদেবের শ্লোগানে আফগান সেনা ভয়ে কেঁপে উঠেছিল। ব্রহ্মচর্যের শক্তিতে মাত্র ৫ হাজার নাগা সাধু আফগানদের বিশাল সেনাকে মুহূর্তের মধ্যে শবদেহের স্থপে পরিণত করেছিল। জটাধারী নাগা সাধুদের যে আফগানরা মজার পাত্র মনে করেছিল সেই সাধুদের তান্ডব আফগান সেনার মধ্যে হাহাকার ছড়িয়ে যায় । পরে আফগান সেনাপতি আরও সেনাকে যুদ্ধে আসার জন্য নির্দেশ দেয় । তা সত্ত্বেও নাগা সাধুরা যে তান্ডব চালায় তাতে যুদ্ধক্ষেত্র রক্তে লাল হয়ে উঠে। আফগান সেনার হার নিশ্চিত দেখে তাদের সেনাপতি বেঁচে থাকা সেনাদের নিয়ে পলায়ন করে। সেই যুদ্ধে হাজারেরও বেশি নাগা সাধুরাও নিজেদের বলিদান দিয়েছেন।

নাগা সন্ন্যাসীদের বসবাসসম্পাদনা

সংসার জীবন থেকে বহু দূরে তাদের অবস্থান। তাদের নেই বাবা-মা, আত্মীয়-স্বজন কিংবা স্ত্রী-সন্তান। এভাবেই দিন পার করে যাচ্ছেন একদল ধ্যানমগ্ন সন্ন্যাসীরা। নাগা সন্ন্যাসীরা সারাবছর নানান প্রতিকূল পরিস্থিতি উপেক্ষা করে পবর্ত ও হিমালয়ে বরফের উপর নগ্ন হয়ে বসে তপস্যা করে। ইশ্বরের সাধনায় মগ্ন থাকা মাথায় জটাধারী, গায়ে ছাইভষ্ম মাখা এই নাগা সন্ন্যাসীরা হয়ে থাকেন নানান ধরনের শক্তি ও অলৌকিক ক্ষমতার অধিকারী বলে বিশ্বাস করেন অনেকেই। এক বিশেষ পদ্ধতিতে এই ছাইভষ্ম তৈরি করেন তাঁরা। যাতে যজ্ঞের ভস্মে গোবর, কলাপাতা, বেলপাতা, কলা, ঘি, কাঁচা দুধ মিশিয়ে তৈরি হয় ওই বিশেষ মিশ্রন। হিমালয়ে বা পর্বতে ধ্যান করার সময় এই ছাই গায়ে মাখলে মশা বা বিষাক্ত সাপ ধারে কাছে ঘেঁষেনা।

সাধারণত হিমালয় ও পর্বতের আখড়ায় বাস করা এসব নাগা সন্ন্যাসীদের লোকালয়ে কদাচিৎ দেখা গেলেও প্রতি কুম্ভমেলায় তারা নেমে আসেন লোকালয়ে। ২০০৭ সালের জানুয়ারি-ফেব্রুয়ারি মাস নাগাদ ৪৫ দিন ব্যাপী সর্বশেষ অর্ধকুম্ভ আয়োজিত হয়েছে। সাত কোটিরও বেশি হিন্দু তীর্থযাত্রী প্রয়াগে এই মেলায় যোগ দেন। ১৫ জানুয়ারি মকর সংক্রান্তি দিন ৫০ লক্ষ মানুষ তীর্থস্নান করেন। ২০০১ সালে সর্বশেষ মহাকুম্ভে যোগ দিয়েছিলেন ছয় কোটি হিন্দু। এটিই ছিল ইতিহাসের বৃহত্তম জনসমাবেশ। পৃথিবীর প্রায় দেশ থেকে এসময় তীর্থ যাত্রীর যোগ দেন নাগা সন্ন্যাসীদের সাথে। ভারতের বিভিন্ন পর্বতের আখড়াই ৪৬ লাখের বেশি নাগা সন্ন্যাসীরা বাস করে।

তথ্যসূত্রসম্পাদনা

  1. "নাগা সন্ন্যাসী আসলে কারা?"কালের কণ্ঠ। জানুয়ারি ২১, ২০১৯। সংগ্রহের তারিখ সেপ্টেম্বর ২৫, ২০২২ 
  2. "নাগা সাধুরা মোহমুক্ত, থাকেন নগ্ন"www.sunnews24x7.com। সংগ্রহের তারিখ ২০২২-০৯-২৫