ধর্মাদিত্য ধর্মাচার্য

নেপালি সাংবাদিক

ধর্মাদিত্য ধর্মাচার্য (দেবনাগরী: धर्मादित्य धर्माचार्य) (জন্ম জগৎ মান বৈদ্য) (১৯০২ – ১৯৬৩) হলেন একজন নেপালি লেখক, বৌদ্ধ পণ্ডিত এবং ভাষা কর্মী। তিনি নেপাল ভাষার উন্নয়ন এবং নেপালে থেরোবাদী বৌদ্ধ ধর্মের পুনর্জাগরণের ক্ষেত্রে ভূমিকা রাখেন। নেপালের তৎকালীন রাণা শাসকেরা উভয় কর্মকাণ্ডই বিপজ্জনক হিসেবে চিহ্নিত করে এবং এর ফলে তাকে কারাবরণ করতে হয়।[১][২]

ধর্মাদিত্য ধর্মাচার্য
ধর্মাদিত্য ধর্মাচার্য, আনুমানিক ১৯৩০
ধর্মাদিত্য ধর্মাচার্য, আনুমানিক ১৯৩০
জন্মজগৎ মান বৈদ্য
১৯০২ (1902)
চিকান বহি, ললিতপুর, নেপাল
মৃত্যু১৯৬৩ (বয়স ৬০–৬১)
পেশালেখক, বৌদ্ধ পণ্ডিত, ভাষা কর্মী
ভাষানেপাল ভাষা
সাহিত্য আন্দোলননেপাল ভাষার পুনর্জাগরণ
বুদ্ধ ধর্ম ওয়া নেপাল ভাষা ("বৌদ্ধ ধর্ম ও নেপাল ভাষা") সাময়িকীর প্রচ্ছদ, আগস্ট ১৯২৯

ধর্মাদিত্য নেপাল সংবৎকে দেশের রাষ্ট্রীয় দিনপঞ্জি করতে আন্দোলন করেন। এছাড়াও নেপাল ভাষায় প্রথম সাময়িকী প্রকাশের কৃতিত্ব ধর্মাদিত্যের। নেপাল ভাষার পুনর্জাগরণের ক্ষেত্রেও তার ব্যাপক প্রভাব ছিল।[৩][৪] নেপাল ভাষায় তার অবদানের জন্য তাকে নেপাল ভাষার চার স্তম্ভের পর পঞ্চম স্তম্ভ হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়।

প্রারম্ভিক জীবন সম্পাদনা

ধর্মাদিত্য ধর্মাচার্য নেপালের ললিতপুর জেলার চিকন বহিতে বৈদ্য পরিবারের জন্মগ্রহণ করেন। তার পিতার নাম বৈদ্য বৃষ্মণ বন্দ্য এবং মায়ের নাম মুনি ঠাকুন বন্দ্য। তিনি কাঠমান্ডুর দরবার হাই স্কুলে ভর্তি হন এবং কলকাতা থেকে প্রবেশিকা সম্পন্ন করেন। এরপর উচ্চশিক্ষার জন্য তিনি কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হন।

বৌদ্ধ ধর্মীয় কর্মকাণ্ড সম্পাদনা

কলকাতায় অবস্থানকালীন ধর্মাদিত্য বৌদ্ধ ধর্মীয় চিত্র সংগ্রহ করতেন এবং ছুটির সময়ে কাঠমান্ডুতে ফিরে ধর্মীয় অনুষ্ঠান ও সে সমস্ত চিত্রের প্রদর্শনীর আয়োজন করতেন। ১৯২৪ খ্রিষ্টাব্দে তিনি ধর্ম মান তুলাধরের গৃহে বুদ্ধ ধর্ম সাপোর্ট অ্যাসোসিয়েশন নামক সংগঠন প্রতিষ্ঠা করেন। সংগঠনের সদস্যদের তিনি বৌদ্ধ ধর্মীয় বই পড়তে এবং ইংরেজি ও পালি ভাষায় লিখিত ধর্মীয় গ্রন্থগুলোকে নেপাল ভাষায় অনুবাদে উৎসাহিত করতেন।

কলকাতায় প্রত্যাবর্তনের পর তিনি নেপালি বৌদ্ধ সংগঠন প্রতিষ্ঠা করেন, যার কাজ ছিল সাহায্য প্রয়োজন এমন নেপালি বণিকদের নিকট সহায়তা পৌঁছানো এবং সেই সাথে বৌদ্ধ ধর্মীয় শিক্ষা প্রদান। ১৯২৮ খ্রিষ্টাব্দে তিনি সর্ব ভারতীয় বৌদ্ধ সম্মেলন আয়োজনে সহযোগিতা করেন।[৫]

দার্জিলিংয়ের নেপালিদের মধ্যে বৌদ্ধ ধর্মের প্রচারের জন্য তিনি ১৯২৭ খ্রিষ্টাব্দে নেপালি ভাষায় হিমালয় বৌদ্ধ এবং ইংরেজি ভাষায় বুদ্ধিস্ট ইন্ডিয়া নামে দুইটি সাময়িকী প্রকাশ করেন। তিনি ও বেণীমাধব বড়ুয়া (বি এম বড়ুয়া) সাময়িকী দুইটির সম্পাদক ছিলেন।[৬][৭]

ভাষাকেন্দ্রিক কর্মকাণ্ড সম্পাদনা

ধর্মাচার্য একজন জাতীয়তাবাদী সাংস্কৃতিক ছিলেন। নেপাল ভাষার প্রচার ও উন্নয়ন এবং ভাষার পক্ষে আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি আদায়ের জন্য তিনি নিজেকে উৎসর্গ করেন।[৮]

১৯২৫ খ্রিষ্টাব্দে তিনি ভারতের কলকাতা থেকে বুদ্ধ ধর্ম ওয়া নেপাল ভাষা (बुद्ध धर्म व नॆपाल भाषा; "বৌদ্ধ ধর্ম ও নেপাল ভাষা") নামে একটি সাময়িকী প্রকাশ করেন। এটি নেপাল ভাষায় প্রকাশিত সর্বপ্রথম পত্রিকা।[৯] এতে বৌদ্ধ ধর্মের ওপর নিবন্ধ প্রকাশের পাশাপাশি নেপালের লেখকদের লেখাও প্রকাশ করতো, যা নেপাল সরকারের ভাষার প্রতি বিরূপ মনোভাবের কারণে স্বদেশে করা সম্ভব ছিল না।[১০]

ক্রমবর্ধমান নেপাল ভাষা আন্দোলনকে সমর্থনের জন্য এবং দেশ ও বিদেশের স্বীকৃতি আদায়ের জন্য ধর্মাদিত্য ১৯২৬ খ্রিষ্টাব্দে কলকাতায় "নেপাল ভাষা সাহিত্য মণ্ডল" নামে একটি সাহিত্য সংগঠন প্রতিষ্ঠা করেন। এটিও নেপাল ভাষা বিষয়ে প্রথম কোনো সাহিত্য সংগঠন ছিল।[১১]

ধর্মাদিত্য ধর্মাচার্য পালি ভাষায় মাস্টার্স ডিগ্রি সম্পন্ন করে কাঠমান্ডুতে ফিরে আসেন। এরপর তিনি শিল্প কাউন্সিলের প্রশাসনিক কর্মকর্তা হিসেবে যোগ দেন। অস্ত মায়ার সাথে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হওয়ার পর গৃহস্থ হিসেবে জীবন অতিবাহিত করেন।

কারাবরণ সম্পাদনা

১৯৪০ খ্রিষ্টাব্দে গণতান্ত্রিক আন্দোলনের বিরুদ্ধে সরকারের কঠোর পদক্ষেপের অংশ হিসেবে অন্যান্য আন্দোলনকর্মী, লেখক ও সমাজ সংস্কারকদের সাথে ধর্মাদিত্য ধর্মাচার্যকেও কারারুদ্ধ করা হয়। নেপাল ভাষার অন্যান্য লেখকদের সাথে তিনিও তিন মাস জেলে আবদ্ধ থাকেন। এই ঘটনার পর সমাজ সংস্কার কর্ম থেকে পাঁচ বছরেরও অধিক সময় নিজেকে সরিয়ে রাখেন। পরবর্তীকালে অধ্যাপনা ও লেখালেখি করে জীবন কাটান।[১২]

স্বীকৃতি সম্পাদনা

 
ধর্মাদিত্য ধর্মাচার্যের আবক্ষ ভাস্কর্য, পুলচক, ললিতপুর

১৯৫৬ খ্রিষ্টাব্দে চোয়াসা পাসা ধর্মাদিত্য ধর্মাচার্যকে "ভাষা থুয়া" (ভাষার রক্ষক বা পোষক) উপাধিতে ভূষিত করে।[১৩] ললিতপুরের পুলচকে ধর্মাদিত্যের একটি আবক্ষ ভাস্কর্য স্থাপন করা হয়।

তথ্যসূত্র সম্পাদনা

  1. Singh, Harischandra Lal (1996). Reflections on Buddhism of the Kathmandu Valley. Kathmandu: Educational Enterprise. Pages 5–7.
  2. Dietrich, Angela (১৯৯৬)। "Buddhist Monks and Rana Rulers: A History of Persecution"Buddhist Himalaya: A Journal of Nagarjuna Institute of Exact Methods। ১ অক্টোবর ২০১৩ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ২৫ মার্চ ২০১২ 
  3. Murti, Ven. PaĪĪā (২০০৫)। "A Historical Study of Pariyatti Sikkhâ in Nepal" (পিডিএফ)। Bangkok, Thailand: Mahachulalongkornrajavidyalaya University। ২৭ সেপ্টেম্বর ২০১১ তারিখে মূল (পিডিএফ) থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ৩০ জুন ২০১১  Pages 15–16.
  4. Bajracharya, Phanindra Ratna (2003). Who's Who in Nepal Bhasha. Kathmandu: Nepal Bhasa Academy. Page 36.
  5. "From Editorial Desk"Buddhist Himalaya: A Journal of Nagarjuna Institute of Exact Methods। ১৯৯৭। সংগ্রহের তারিখ ৭ ফেব্রুয়ারি ২০১২ [স্থায়ীভাবে অকার্যকর সংযোগ]
  6. Hridaya, Chittadhar (1982, third ed.) Jheegu Sahitya ("Our Literature"). Kathmandu: Nepal Bhasa Parisad. Page 172.
  7. Sen, Jahar and Indian Institute of Advanced Study (1992). India and Nepal: Some aspects of culture contact. Indian Institute of Advanced Study. আইএসবিএন ৮১-৮৫১৮২-৬৯-৮, আইএসবিএন ৯৭৮-৮১-৮৫১৮২-৬৯-৮. Page 98.
  8. Lecomte-Tilouine, Marie and Dollfus, Pascale (2003) Ethnic Revival and Religious Turmoil: Identities and Representations in the Himalayas. Oxford University Press. আইএসবিএন ০-১৯-৫৬৫৫৯২-৩, আইএসবিএন ৯৭৮-০-১৯-৫৬৫৫৯২-৬. Page 100. Retrieved 3 February 2012.
  9. LeVine, Sarah and Gellner, David N. (2005) Rebuilding Buddhism: The Theravada Movement in Twentieth-Century Nepal. Harvard University Press. আইএসবিএন ৯৭৮-০-৬৭৪-০১৯০৮-৯. Pages 27–28. Retrieved 2 February 2012.
  10. Lienhard, Siegfried (1992). Songs of Nepal: An Anthology of Nevar Folksongs and Hymns. New Delhi: Motilal Banarsidas. আইএসবিএন ৮১-২০৮-০৯৬৩-৭. Page 4.
  11. Shrestha, Bal Gopal (জানুয়ারি ১৯৯৯)। "The Newars: The Indigenous Population of the Kathmandu Valley in the Modern State of Nepal)" (পিডিএফ)CNAS Journal। সংগ্রহের তারিখ ২৩ মার্চ ২০১২  Page 89.
  12. LeVine, Sarah and Gellner, David N. (2005) Rebuilding Buddhism: The Theravada Movement in Twentieth-Century Nepal. Harvard University Press. আইএসবিএন ৯৭৮-০-৬৭৪-০১৯০৮-৯. Page 29. Retrieved 30 June 2013.
  13. Hridaya, Chittadhar (1982, third ed.) Jheegu Sahitya ("Our Literature"). Kathmandu: Nepal Bhasa Parisad. Page 192.