দেউরী (ইংরেজি: Deori) হল বৃহৎ অসমীয়া জাতি-এর অন্তর্গত একটি জনগোষ্ঠী। এই জনগোষ্ঠীর লোকদের প্রধানভাবে আসাম, অরুণাচল প্রদেশ এবং নাগাল্যান্ডে পাওয়া যায়। তাঁরা প্রধানভাবে অসমীয়া ভাষা এবং তিব্বতীয় বার্মা ভাষা ব্যবহার করেন। প্রায় ২ লক্ষ্যেরও অধিক দেউরী জনগোষ্ঠীর লোক ব্রহ্মপুত্র নদীর কাছের উপত্যকায় বসবাস করেছে[]

দেউরী জনগোষ্ঠী
উল্লেখযোগ্য জনসংখ্যার অঞ্চল
আসাম, অরুণাচল প্রদেশ, নাগাল্যান্ড:
  
ভাষা
দেউরী ভাষা, অসমীয়া ভাষা
ধর্ম
হিন্দু ধর্ম

দেউরী নামের ইতিহাস

সম্পাদনা
 
দেউরী লোকদের প্রতীক

'দেউরী' শব্দের উৎপত্তি প্রধানভাবে "দেব" নামের থেকে হয়েছে বলে অনুমান করা হয়[]। এই নাম সম্পর্কে একটি কিম্বদন্তি আছে। "প্রবাদ আছে যে, এসময়ের মহামায়া তাম্রশ্বরী গোঁসাঁনী তাঁর মায়া ছলনার শক্তি প্রকাশ করে জগতের কল্যাণ সাধনার্থে শিলারূপে দিবাং নদীতে ভেসে ছিলেন। তাকে দেখে ভীষ্মক রাজা 'হেন্দুবান'-এর দেশস্থ লোককে আনিয়ে মহামায়ার শিলারূপিনী দেবীমূর্তিটি যথাস্থানে আনতে আদেশ করেন। তাঁরাও দেবীমূর্তিকে তার থেকে নিতে পারল না। শেষে নিরুপায় হয়ে তিনি ঢোল পিটিয়ে লোকেদের জানিয়ে দিলেন যে, যে দেবীমূর্তিকে নিয়ে যাবে তাঁকে তাঁর রাজপুরোহিত হয়ে বিখ্যাত বুঢ়া-বুঢ়ী, বলিয়া বাবা এবং তাম্রেশ্বরী মন্দিরের পূজারী হবে। এই কথা প্রচার হওয়ার সাথে সাথে নানান জাতির মানুষ এসে মূর্তি আনতে চেষ্টা করায় এমন হয়ে পড়ল যে কুড়ি-পঁচিশজন মানুষ থাকা স্থান থেকে নড়াচড়া করতে পারলেন না। অবশেষে চারজন চুভিজাই গা ধুয়ে শুচি-সংযত হয়ে মাতাকে স্তুতি মিনতি করে তাঁদের অত্যন্ত পরিশুদ্ধ এবং পবিত্র অন্তরের সমবেত প্রার্থনাবাণী দেবীর অন্তর প্রবেশ করল। দেবী মূর্তি হালিজালি আপনা আপনি জায়গায় গেল। তখন সেই চারজন চুতীয়া দেবী মূর্তি গোঁসাঁনীকে দোলাতে তুলে নিয়ে গিয়ে তাম্রেশ্বরী মন্দিরে রাখলেন। তখন থেকে এই চারজনকে চুতীয়াদের রাজপুরোহিত করা হয় এবং এদের দেউরী বলা হয়। কারণ 'সর্বভূতে অবস্থিতা পূর্ণব্রহ্মরূপী এই অতি প্রাকৃত বা অতিজাগতিক মহাশক্তিকে উপাসনা করা সকলেই দেউরী।

দেউরীদের চারি খেল এবং চারি শাল

সম্পাদনা

দেউরীদের প্রধান খেল বা ফৈদ চারটি। সেগুলি হচ্ছে-

  1. দিবঙীয়া - এরা শাল কুণ্ডিমামা বা বুঢ়া-বুঢ়ী শাল,
  2. টেঙাপনীয়া - এদের শাল বলিয়া বাবা (শিবের বর পুত্র) শাল,
  3. বরগঞা - এদের শাল কেচাইখাতী বা তাম্রেশ্বরী গোঁসাঁনী শাল এবং
  4. পাটর গঞা - এরা শাল পাটর শাল।

দেউরীদের পাটের গঞা ফৈদটি বর্তমান গবেষণার বিষয় হয়ে পড়েছে। কারণ এই ফৈদর লোকরা বিভিন্ন স্থানে বিভিন্ন ধরনে বিলীন হয়ে বিক্ষিপ্ত হয়ে থাকার প্রমাণ পাওয়া গিয়েছে। দেউরীদের চারটি ফৈদর নাম স্থানবাচক বলা যায়। অতীতে কুণ্ডিল রাজ্যে দিবং নদীর পারে বাস করা ফৈদকে দিবঙীয়া, টেঙাপনী নদীর পারে বসতি করা ফদৈকে টেঙাপনীয়া, বরনদীর পারে বাস করা ফৈদকে বরগীঞা এবং পাট শদিয়াতে বাস করাদের পাটের গঞা বলা হত। দেউরী জনগোষ্ঠীর এই চারটি প্রধান খেল বা মুখ্যফৈদর সংশ্লিষ্ট লোকরা পুনরায় কয়েকটি উপফৈদ বা উপখেলে বা উপগোত্রে বিভক্ত হয়ে আছে।

বাস করা পদ্ধতিতে

সম্পাদনা

দেউরীরা গ্রাম করে চাংঘরে বাস করার প্রথা অতি পুরানো কাল থেকে চলে আসছে। কাঠের জখলায় উঠে ঘরে ঢুকে প্রথমে পাওয়া যায় সুবচনী কোঠালি। এই কোঠালিটি গৃহ দেবতার নামে রাখা হয়। অবশ্য দিবঙীয়া এবং বরগঞা খেলের মধ্যে এই সুবাচনী কোঠালি রাখার প্রথাটি নেই। ঘরের এমাথা থেকে সেমাথা পর্যন্ত একটি দীর্ঘ বাট রাখা হয়। সমুখের দরজা দিয়ে ঢুকে এই দীর্ঘ বাট দিয়ে ঘরের অনেকগুলি কোঠালিতে প্রবেশ করার ব্যবস্থা থাকে। একেবারে ওমাথায় থাকে রন্ধনশালা। রন্ধনশালের কাছে থাকে ঘরের প্রধান বা পিতা-মাতার কোঠা। এই প্রধানের কোঠাতে পরিবারের অনেকগুলি পুরুষ একসাথে বসে খাওয়া-দাওয়া করেন। বেতের এক বিশেষ পদ্ধতিতে নির্মিত 'মেহেঙা' নামের সরঞ্জামের উপর ভাতের কাঁহী রেখে ভাত খাওয়ার নিয়ম। মহিলাদের রন্ধনশালায় ভোজন করার নিয়ম চলে আসছে।

জীবিকা

সম্পাদনা

দেউরীরা সাধারনত কৃষিজীবী। তাঁদের জীবিকার প্রধান উপায়ই হচ্ছে কৃষি। বিশেষকরে ধান, মাষ, সরিষা, আলু, কচু, শাক-পাতা ইত্যাদি চাষের উপর নির্ভর করেই তাঁরা জীবিকা নির্বাহ করেন। কপাহ চাষ তাঁদের পরম্পরাগত চাষ। মহিলা এবং গাভরুরা আহু চাষে বন সাফাই করার চেয়ে কার্পাস চাষে বন সাফাই করার উপর গুরুত্ব দিয়েছিলেন। এদের সামান্য অংশই চাকরি করে জীবন নির্বাহ করলেও এরা সাধারণত কৃষিকর্ম করেন।

তথ্যসূত্র

সম্পাদনা

টেমপ্লেট:আসামের জনগোষ্ঠী