তাপস সেন
তাপস সেন (১১ সেপ্টেম্বর ১৯২৪ – ২৮ জুন ২০০৬) একজন আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন ভারতীয় আলোকসম্পাত শিল্পী।[১] আমৃত্যু তিনি তাঁর আলোর ছটায় শুধু বাংলা থিয়েটার বা ভারতীয় রঙ্গমঞ্চ নয় বিশ্ব রঙ্গমঞ্চ আলোকিত করেছেন। আলোক বিজ্ঞানকে নিয়ে গেছেন এক শিল্পের স্তরে।
তাপস সেন | |
---|---|
জন্ম | ১১ সেপ্টেম্বর ১৯২৪ |
মৃত্যু | ২৮ জুন ২০০৬ |
জাতীয়তা | ভারতীয় |
পেশা | আলোকসম্পাত শিল্পী |
দাম্পত্য সঙ্গী | গীতা সেন |
সন্তান | জয় সেন (পুত্র) জয়ন্তী সেন(কন্যা) |
পিতা-মাতা | মতিলাল সেন (পিতা) সুবর্ণলতা সেন(মাতা) |
পুরস্কার | সংগীত নাটক অকাদেমি পুরস্কার দীনবন্ধু পুরস্কার সংগীত নাটক আকাদেমি ফেলোশিপ কালিদাস সম্মান |
জন্ম ও প্রারম্ভিক জীবন
সম্পাদনাতাপস সেনের জন্ম ১৯২৪ খ্রিস্টাব্দের ১১ সেপ্টেম্বর বেঙ্গল প্রেসিডেন্সির বর্তমানে ভারতের অসম রাজ্যের গোয়ালপাড়া জেলার ধুবড়িতে। পিতার নাম মতিলাল সেন মায়ের নাম সুবর্ণলতা সেন। পিতার চাকরিসূত্রে এক বৎসর বয়সে ধুবড়ি হতে দিল্লি চলে যান এবং সেখানেই তাঁর শিক্ষাদীক্ষা। ১৯৪১ খ্রিস্টাব্দে রাইসিনা বেঙ্গলি হায়ার সেকেন্ডারি স্কুল থেকে ম্যাট্রিক পাশ করার পর দিল্লির পলিটেকনিক কলেজে ইলেকট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং পড়তে শুরু করেন। ছাত্রাবস্থাতেই আলো নিয়ে তাঁর সৃজনশীল কল্পনা বিকশিত হতে থাকে। আর তারই আকর্ষণে পাঠ অসম্পূর্ণ রেখে নাট্যজগতের প্রবেশ করেন। স্কুলের আঁকার শিক্ষক প্রতাপ সেনের কাছে তাঁর শিল্পে হাতেখড়ি। ১৯৩৯ খ্রিস্টাব্দে প্রথম আলোক সম্পাত করেন 'রাজপথ' নাটকে স্কুলের শিক্ষক মশাইয়ের সহায়তায়। ১৯৪৪ খ্রিস্টাব্দে দিল্লিতে ভারতীয় গণনাট্য সংঘের শাখা খোলার সঙ্গে তিনি হলেন তার প্রতিষ্ঠাতা সদস্য। আর সেখানেই সেই মাস্টারমশাই প্রতাপ সেনের সঙ্গে করলেন জীবনের প্রথম নজরকাড়া কাজ- পরশুরামের গল্প নিয়ে ছায়ানাট্য 'ভূশণ্ডীর মাঠে'। প্রথমে স্কুলের মাঠে, পরে দিল্লির সাউথ ইন্ডিয়া ক্লাবে।
কর্মজীবন
সম্পাদনাদিল্লিতে থাকার সময়ে প্রথমে নিউ দিল্লি মিউনিসিপ্যাল কর্পোরেশনে, আরউইন হাসপাতালে, শেষে দিল্লি ক্যান্টনমেন্টে সিপিডব্লিউডির বিজলি বিভাগে কাজ করেন। কিন্তু ক্যামেরা ও আলোর কাজ শেখার উদ্দেশ্যে ১৯৪৬ খ্রিস্টাব্দে পাড়ি দেন বোম্বে (বর্তমানে মুম্বই)। সেখানে কিছুদিন বিখ্যাত ক্যামেরাম্যান দিলীপ গুপ্তর সঙ্গে ফটোগ্রাফির কাজ করেন। ১৯৪৭ খ্রিস্টাব্দে স্বাধীনতার পর চলে আসেন কলকাতায়। এখানে এসে কষ্টকর জীবনযাপনের দিনগুলিতে তিনি শিল্পসৃষ্টির মঞ্চ খুঁজতে ভারতীয় গণনাট্য সংঘ,বহুরূপী, এল.টি.জি. ও অন্যান্য কিছু সংস্থায় কাজে যুক্ত হন। সাথে বামপন্থী আন্দোলনে যুক্ত হয়ে এসইউসি' সর্বক্ষণের কর্মী হন এবং শেষে 'নিউ থিয়েটার্সে কাজ পান। সেখানে শিল্প-নির্দেশক সৌরেন সেনের সহকারী হয়ে "রূপকথা' ছায়াছবির কিছু কাজ করেন। এখানে তার সঙ্গে আলাপ হয় হৃষিকেশ মুখোপাধ্যায় , বিজন ভট্টাচার্য, ঋত্বিক ঘটক,মৃণাল সেন, সলিল চৌধুরী প্রমুখ ব্যক্তিত্বদের সাথে। ১৯৪৯ খ্রিস্টাব্দে কলকাতায় প্রথম আলোকসম্পাত করেন শম্ভু মিত্রর 'পথিক' ও ঋত্বিক ঘটকের 'জ্বালা' নাটকে। তারপর করলেন নাট্যচক্র প্রযোজিত বিজন ভট্টাচার্য পরিচালিত 'নীলদর্পণ' এর আলোক পরিকল্পনা। উৎপল দত্তের এল.টি.জি. সঙ্গে প্রথম কাজ করেছেন 'সাংবাদিক' নাটকে। এরপর এই গ্রুপেই শেক্সপিয়ারের 'ম্যাকবেথ' ও রবীন্দ্রনাথের 'অচলায়তন' নাটকেও কাজ করেছেন। ইতিমধ্যে তিনি প্রখর নৈপুণ্যে আর স্বকীয় পরিকল্পনার আলোক বিজ্ঞানকে এক শিল্পের স্তরে নিয়ে এসেছেন। আলোক প্রয়োগকুশলতায় স্মরণীয় হয়ে গেছে 'রক্তকরবী', 'চারঅধ্যায়', রাজা,'রাজা অয়দিপাউস', 'পুতুলখেলা', অঙ্গার,'ফেরারি ফৌজ', 'কল্লোল',' ছেঁড়া তার','দশচক্র', 'বিশ্বরূপা' র 'সেতু', আরোগ্য নিকেতন' প্রভৃতি সফল নাটকগুলি। আসলে তার চিন্তার জগৎ এত বিস্তৃত, শিল্পভাবনার প্রতি এত আগ্রহ, প্রযুক্তিগতভাবে তিনি এত শক্তিশালী, মঞ্চ স্থাপত্য, রঙ, অভিনয় কম্পোজিশন সম্পর্কে তার প্রখর জ্ঞান, তার সাথে কল্পনা ও সৃজনীশক্তির প্রয়োগ করার অসীম ক্ষমতার কারণে অনুল্লেখযোগ্য নাটকও শিল্পের গুণাবলীর রূপ ধারণ করে কালোত্তীর্ণ হয়েছে তার আলোর বিচিত্রতায়। বিশ্বরূপা নাট্য উন্নয়ন পরিষদ আয়োজিত পূর্ণাঙ্গ নাটক প্রতিযোগিতায় ভারতীয় গণনাট্য সংঘ 'সংক্রান্তি' নাটক প্রদর্শিত হয়। নাটকটি আলোকসম্পাত-সহ এগারোটি পুরস্কার লাভ করে। এটিই ছিল তার প্রথম পুরস্কার প্রাপ্তি। নিজেকে 'আড়ালের মানুষ' ভাবলে কি হবে, তিনি এক কিংবদন্তিতে পৌঁছে গেছেন। তাছাড়া শুধু নাটক নয়, নৃত্যের আসরে, যাত্রার মঞ্চেও তাঁকে দেখা গেছে। ভারতী অপেরা, নট্ট কোম্পানির বেশ কিছু যাত্রাপালায় আলোক প্রক্ষেপণ করেছেন। ১৯৬০ খ্রিস্টাব্দে রাশিয়া,পূর্ব জার্মানি এবং ১৯৬৯ খ্রিস্টাব্দে বার্লিন সংগীত নাটক উৎসবে যোগদান করেন। চলচ্চিত্রের বিশেষ মুহূর্তের আলোক পরিকল্পনায় ভি.শান্তারাম, মৃণাল সেন তার সাহায্য নিয়েছেন। আলোক ধ্বনির সমাহারে ঐতিহাসিক স্থানের স্মৃতিচারণে সন-এৎ-লুমিয়ের একাধিক বিন্যাসে তিনি সংগীত স্রষ্টা ভাস্কর চন্দরভরকর ও বি ভি করন্থের সঙ্গে যৌথ ভূমিকা নিয়েছেন। নাটক, চলচ্চিত্র ছাড়া নৃত্যনাট্য, পুতুলনাটক, ছায়ানাটক, যাত্রার আসর, মেলাপ্রাঙ্গণ, প্রেক্ষাগৃহ - সর্বত্রই তার অসামান্য শিল্পপ্রতিভার নিদর্শন রয়েছে। একাধিকবার কাজের সূত্রে বিদেশেও গেছেন। প্যারিস ও মস্কোয় ভারত-উৎসবে আলোক পরিকল্পক হিসাবে যোগ দেন। ১৯৩৭ খ্রিস্টাব্দে লণ্ডনের ব্যাডফোর্ডে ফিল্ম, থিয়েটার ও টিভির আলোকশিল্পীদের আন্তর্জাতিক সম্মেলনে তিনি হাজির করলেন তার দৃশ্য-অভিজ্ঞতা। সম্মেলন একমাত্র ভারতীয় প্রতিনিধি হিসাবে সুনাম অর্জন করেন। উপস্থিত সকলকে অভিভূত করে দিয়েছেন আর পেয়ে গেলেন অ্যাসোসিয়েশন অব লাইটিং ডিজ়াইনার্স সাম্মানিক সদস্যপদ পরে অনারারি ফেলোশিপ।[২]
সম্মাননা
সম্পাদনাতাপস সেন ১৯৭২ খ্রিস্টাব্দে পেলেন এশিয়ার শ্রেষ্ঠ ‘লাইট ডিজ়াইনার’-এর স্বীকৃতি। ১৯৭৪ খ্রিস্টাব্দে 'সঙ্গীত নাটক অ্যাকাডেমি' পুরস্কার। ১৯৯২ খ্রিস্টাব্দে পশ্চিমবঙ্গ সরকার তাঁকে দীনবন্ধু পুরস্কার -এ সম্মানিত করে। ২০০৫ খ্রিস্টাব্দে ভারত সরকারের সংস্কৃতি মন্ত্রক করল ‘এমেরিটাস ফেলো’। শেষে মধ্যপ্রদেশ সরকার প্রদান করে 'কালিদাস সম্মান'। ১৯৯৭ খ্রিস্টাব্দে পশ্চিমবঙ্গ নাট্য আকাদেমি প্রবীণ নাট্যব্যক্তিত্ব হিসাবে সম্বর্ধিত করে। অমিত বসু ও ভদ্র বসুর পরিকল্পনায় ২০০০ খ্রিস্টাব্দে তার উপর একটি তথ্যচিত্র 'Let there be light' নির্মিত হয়। আমেরিকার প্রবাদপ্রতিম আলোকশিল্পী রিচার্ড পিলব্রো তার কাজ দেখে উচ্ছ্বসিত হন। তার মতে -
" তাপস সেনের কল্পনাশক্তি যন্ত্রের শক্তিকে ছাপিয়ে গেছে .... অবিশ্বাস্য রকমের সামান্য কিছু উপকরণ, কয়েকটি ল্যাম্প, আমাদের নিত্য ব্যবহার্য কয়েকটি জিনিস আর ছায়া—এই দিয়ে তিনি আলোর জাদু দেখাতেন।"
আলো ও তাঁর জীবন নিয়ে তাঁর লেখা কয়েকটি গ্রন্থে র মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল-
- 'অন্তরঙ্গ আলো'
- 'দ্বিতীয় অঙ্ক'
- 'প্রথম দৃশ্যের আলো'
- ' আলোছায়ার পরে'
মৃত্যু
সম্পাদনা২০০৬ খ্রিস্টাব্দের ২৮ জুন তাপস সেন কলকাতায় নিজ বাসভবনে প্রয়াত হন। মরণোত্তর দেহদানে তাঁর দেহটি চিকিৎসাশাস্ত্রে ব্যবহারে অর্পিত হয়।
তথ্যসূত্র
সম্পাদনা- ↑ অঞ্জলি বসু সম্পাদিত, সংসদ বাঙালি চরিতাভিধান, দ্বিতীয় খণ্ড, সাহিত্য সংসদ, কলকাতা, জানুয়ারি ২০১৯ পৃষ্ঠা ১৫২, আইএসবিএন ৯৭৮-৮১-৭৯৫৫-২৯২-৬
- ↑ "মঞ্চ জুড়ে যেন কবিতা,ছন্দে মগ্ন আলোর তাপস"। আনন্দবাজার। সংগ্রহের তারিখ ২৭ জুন ২০২০।