তাজউদ্দীন আহমদ
তাজউদ্দীন আহমদ (২৩ জুলাই ১৯২৫ - ৩ নভেম্বর ১৯৭৫) হলেন বাংলাদেশের প্রথম প্রধানমন্ত্রী ও স্বাধীনতা সংগ্রামের অন্যতম নেতা। তিনি ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময় বাংলাদেশ সরকারের প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করেন। তাজউদ্দীন আহমদ মুক্তিযুদ্ধকালীন বাংলাদেশের প্রথম সরকার গঠনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন যা “মুজিবনগর সরকার” নামে অধিক পরিচিত। স্বাধীনতা পরবর্তীকালে তিনি বাংলাদেশের অর্থমন্ত্রী হিসাবে ১৯৭৪ সাল পর্যন্ত দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান স্বপরিবারে নিহত হওয়ার পর আরও তিনজন জাতীয় নেতা-সহ তাঁকে বন্দি করে পুরাতন ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে রাখা হয়। পুরাতন ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে ১৯৭৫ সালের ৩রা নভেম্বর বন্দি অবস্থায় তাঁকে হত্যা করা হয়।
বঙ্গতাজ তাজউদ্দীন আহমদ | |
---|---|
বাংলাদেশের প্রথম প্রধানমন্ত্রী | |
কাজের মেয়াদ ১৭ই এপ্রিল, ১৯৭১ – ১২ই জানুয়ারি, ১৯৭২ | |
রাষ্ট্রপতি | শেখ মুজিবুর রহমান, সৈয়দ নজরুল ইসলাম (ভারপ্রাপ্ত) |
উত্তরসূরী | শেখ মুজিবুর রহমান |
বাংলাদেশের অর্থ ও পরিকল্পনা মন্ত্রী | |
কাজের মেয়াদ ১২ জানুয়ারি ১৯৭২ – ২৬ অক্টোবর ১৯৭৪ | |
ঢাকা-২০ আসনের সংসদ সদস্য (বর্তমান গাজীপুর-৪) | |
কাজের মেয়াদ ১৯৭৩ – ১৯৭৫ | |
উত্তরসূরী | মোহাম্মদ সানাউল্লাহ |
ব্যক্তিগত বিবরণ | |
জন্ম | ২৩ জুলাই, ১৯২৫ দরদরিয়া, গাজীপুর, বেঙ্গল প্রেসিডেন্সি, ব্রিটিশ ভারত |
মৃত্যু | ৩ নভেম্বর, ১৯৭৫ পুরাতন ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগার, ঢাকা, বাংলাদেশ |
রাজনৈতিক দল | বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ |
দাম্পত্য সঙ্গী | সৈয়দা জোহরা তাজউদ্দীন |
সন্তান | শারমিন আহমদ রিপি সিমিন হোসেন রিমি মাহজাবিন আহমদ মিমি তানজিম আহমেদ সোহেল তাজ |
পিতামাতা | মৌলভী মোঃ ইয়াসিন খান মেহেরুননেসা খান |
প্রাক্তন শিক্ষার্থী | ঢাকা কলেজ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় |
ধর্ম | ইসলাম |
ব্যক্তিগত জীবন
সম্পাদনাতাজউদ্দীন আহমদ ১৯২৫ সালের ২৩ জুলাই গাজীপুর জেলার অন্তর্গত কাপাসিয়ার দরদরিয়া গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তার পিতা মৌলভী মোঃ ইয়াসিন খান এবং মাতা মেহেরুননেসা খান।
তার স্ত্রী সৈয়দা জোহরা তাজউদ্দীন ছিলেন বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য। তাদের ৪ সন্তান রয়েছে।[১] বড় মেয়ে শারমিন আহমদ রিপি; মেজো মেয়ে লেখিকা ও কলামিস্ট এবং গাজীপুর-৪ আসনের সাবেক সংসদ সদস্য সিমিন হোসেন রিমি এবং কনিষ্ঠা মেয়ে মাহজাবিন আহমদ মিমি। পরিবারের সর্বকনিষ্ঠ সন্তান তানজিম আহমেদ সোহেল তাজ গাজীপুর-৪ আসনের সংসদ সদস্য হিসেবে আসীন অবস্থায় পদত্যাগ করেন ও ৭ জুলাই, ২০১২ইং তারিখে তার আসন শূন্য ঘোষণা করা হয়।[২]
শিক্ষাজীবন
সম্পাদনা৪ ভাই, ৬ বোনের মাঝে ৪র্থ তাজউদ্দীন আহমদের পড়াশোনা শুরু বাবার কাছে আরবি শিক্ষার মাধ্যমে। এই সময়ে ১ম শ্রেণীতে ভর্তি হন বাড়ি থেকে দুই কিলোমিটার দূরের ''ভূলেশ্বর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে''৷ ১ম ও ২য় শ্রেণীতে ১ম স্থান অর্জন করেন৷ ৪র্থ শ্রেণীতে ভর্তি হন বাড়ি থেকে প্রায় ৫ কিলোমিটার দূরের কাপাসিয়া মাইনর ইংলিশ স্কুলে।[৩] এরপর পড়েছেন কালিগঞ্জ সেন্ট নিকোলাস ইনস্টিটিউশন, মুসলিম সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়, ঢাকা ও সেন্ট গ্রেগরিজ হাই স্কুলে। তাজউদ্দীন আহমদ কুরআন হাফেজ ছিলেন, যা তিনি নিয়মিত লেখাপড়ার পাশাপাশি বাবার সান্নিধ্যে আয়ত্ত করেন। তিনি ম্যাট্রিক (১৯৪৪) ও ইন্টারমিডিয়েট পরীক্ষায় জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় (তৎকালীন জগন্নাথ কলেজ) থেকে অবিভক্ত বাংলার সম্মিলিত মেধাতালিকায় যথাক্রমে দ্বাদশ ও চতুর্থ স্থান (ঢাকা বোর্ড) লাভ করেন। ১৯৫০ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অর্থনীতিতে বি.এ (সম্মান) ডিগ্রী লাভ করেন। ১৯৬৪ সালে রাজনৈতিক বন্দী হিসেবে কারাগারে থাকা অবস্থায় এল.এল.বি. ডিগ্রির জন্য পরীক্ষা দেন এবং পাস করেন।
রাজনৈতিক জীবন
সম্পাদনারাজনৈতিক জীবনের সূচনা
সম্পাদনাআবুল হাশিম প্রাদেশিক মুসলিম লীগের সাধারণ সম্পাদক হওয়ার পর ১৯৪৩ সালে তাজউদ্দীন আহমদ মুসলিম লীগের রাজনীতিতে প্রত্যক্ষভাবে জড়িত হন। ১৯৪৪ সালে বঙ্গীয় মুসলিম লীগের কাউন্সিলের সদস্য নির্বাচিত হন।
পাকিস্তান আমল
সম্পাদনা১৯৪৮ সালের ৪ জানুয়ারি গঠিত পূর্ব পাকিস্তান ছাত্রলীগের (বর্তমানে বাংলাদেশ ছাত্রলীগ) অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন তাজউদ্দীন আহমদ। ১৯৪৮-এর ১১ এবং ১৩ মার্চ সর্বদলীয় সংগ্রাম পরিষদের গুরুত্বপূর্ণ সদস্য হিসেবে ধর্মঘট-কর্মসূচী ও বৈঠক করেন৷ ২৪ মার্চ মুহাম্মদ আলী জিন্নাহর সাথে রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের নেতারাসহ তিনি বৈঠক করেন৷ তিনি ১৯৪৯ সালের ২৩ জুন প্রতিষ্ঠিত আওয়ামী মুসলিম লীগের অন্যতম উদ্যোক্তা ছিলেন। ছিলেন সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের সদস্য। ১৯৫৩ থেকে ১৯৫৭ পর্যন্ত ঢাকা জেলা আওয়ামী মুসলিম লীগের (১৯৫৫ সালে আওয়ামী মুসলিম লীগ নাম পরিবর্তিত হয়ে হয় আওয়ামী লীগ) সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৫৪-এর নির্বাচনে তিনি যুক্তফ্রন্ট প্রার্থী হিসেবে মুসলিম লীগের সাধারণ সম্পাদককে পরাজিত করে পরিষদ সদস্য নির্বাচিত হন। ১৯৬৪ সালে প্রাদেশিক আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক এবং ১৯৬৬ সালে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন। ১৯৬৬ সালের ৬ ফেব্রুয়ারি লাহোরে যে সর্বদলীয় নেতৃসম্মেলনে শেখ মুজিবুর রহমান ছয়দফা দাবি উত্থাপন করেন, সেই সম্মেলনে শেখ মুজিবের সাথে তিনিও যোগদান করেন। সম্মেলনের বিষয় নির্বাচনী কমিটিতে তাজউদ্দীন ছিলেন অন্যতম সদস্য। এই বছরের ৮ মে তিনি দেশরক্ষা আইনে গ্রেফতার হন। ১৯৬৮ সালে জেলে থাকা অবস্থাতেই আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক পদে পুণঃনির্বাচিত হন। ৬৯’এর গণঅভ্যুত্থানের ফলশ্রুতিতে জেল থেকে মুক্তি পান। ১৯৭০ সালে তৃতীয়বারের মতো আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক পদে নির্বাচিত হন। এই বছরের সাধারণ নির্বাচনের জন্য গঠিত আওয়ামী লীগের পার্লামেন্টারি বোর্ডের সেক্রেটারি নির্বাচিত হন। ৭ ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত নির্বাচনে তিনি জাতীয় পরিষদের সদস্য নির্বাচিত হন।
মুক্তিযুদ্ধকালীন ভূমিকা
সম্পাদনানির্বাচনে বিপুল ব্যবধানে জয়লাভের পরও ইয়াহিয়া খান আওয়ামী লীগের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর না করে জাতীয় পরিষদের অধিবেশন স্থগিত করায় বঙ্গবন্ধুর ডাকে তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্তানে অসহযোগ আন্দোলন শুরু হয়। ১৯৭১ সালের ২৫শে মার্চ রাতে পাকিস্তান সেনাবাহিনী গণহত্যা শুরু করে। বঙ্গবন্ধুকে গ্রেফতার করে নিয়ে যাওয়া হয় পশ্চিম পাকিস্তানে। বাংলাদেশে মুক্তিযুদ্ধ শুরু হয়। তাজউদ্দীনের ভাষায়, 'আমি সেদিন সাড়ে সাত কোটি বাঙালির স্বার্থে যে সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম তা হলো : একটি স্বাধীন সরকার প্রতিষ্ঠা করে বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রাম পরিচালনার জন্য কাজ শুরু করা৷'[৪]
প্রথমে আত্মরক্ষা তারপর প্রস্তুতি এবং সর্বশেষে পাল্টা আক্রমণ এই নীতিকে সাংগঠনিক পথে পরিচালনার জন্য তিনি সরকার গঠনের চিন্তা করতে থাকেন। তাই তাজউদ্দীন আহমদ আত্মগোপন করেন এবং যুদ্ধকে সংগঠিত করার জন্য সীমান্তের দিকে যাত্রা করেন। এরই মধ্যে ৩০ মার্চ সন্ধ্যায় তিনি ফরিদপুর কুষ্টিয়া পথে পশ্চিম বাংলার সীমান্তে পৌঁছান।[৫] ব্যারিস্টার আমীর-উল ইসলামকে সঙ্গে নিয়ে ৩১ মার্চ মেহেরপুর সীমান্ত অতিক্রম করে ভারতে পদার্পণ করেন। সীমান্ত অতিক্রম করার বিষয়ে মেহেরপুরের মহকুমা শাসক তৌফিক-ই-এলাহী চৌধুরী তাদের সার্বিক সহায়তা প্রদান করেন। সীমান্ত অতিক্রম করার পর ভারতীয় সীমান্ত রক্ষী বাহিনীর মহাপরিদর্শক গোলক মজুমদার তাজউদ্দীন আহমদ ও ব্যারিস্টার আমীর-উল ইসলামকে যথোপযুক্ত সম্মান প্রদর্শনপূর্বক তাদের নিরাপদ আশ্রয়ের ব্যবস্থা করেন। গোলক মজুমদারের কাছে সংবাদ পেয়ে ভারতীয় সীমান্ত রক্ষী বাহিনীর মহাপরিচালক কেএফ রুস্তামজী তাদের আশ্রয়স্থলে এবং তাজউদ্দিন আহমদের সঙ্গে আলাপ আলোচনা করেন এবং পূর্ববাংলা সার্বিক পরিস্থিতি এবং বাঙালির স্বাধীনতা লাভের অদম্য স্পৃহা সম্পর্কে সম্যক অবগত হন। সীমান্তে পৌঁছে তাজউদ্দিন দেখেন যে বেঙ্গল রেজিমেন্টের বিদ্রোহী সেনাদের সমর্থনে ভারত সরকার থেকে নির্দেশ না পাওয়া পর্যন্ত ভারতীয় সামরিক বাহিনী এবং সীমান্তরক্ষী বাহিনীর কিছুই করার নেই। মুক্তিফৌজ গঠনের ব্যাপারে তাজউদ্দীন আহমদ বিএসএফ এর সাহায্য চাইলে তৎকালীন বিএসএফ প্রধান তাকে বলেন যে মুক্তি সেনা ট্রেনিং এবং অস্ত্র প্রদান সময় সাপেক্ষ কাজ। তিনি আরো বলেন যে ট্রেনিং বিষয়ে তখন পর্যন্ত ভারত সরকারের কোন নির্দেশ না থাকায় তিনি মুক্তিবাহিনীকে ট্রেনিং ও অস্ত্র দিতে পারবেন না। কেএফ রুস্তামজী দিল্লির ঊর্ধ্বতন সাথে যোগাযোগ করলে তাকে জানানো হয় তাজউদ্দীন আহমদ ও ব্যারিস্টার আমীর-উল ইসলামকে নিয়ে দিল্লি চলে আসার জন্য।[৬] উদ্দেশ্য ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী এবং তাজউদ্দিন আহমদের বৈঠক। দিল্লিতে যাবার পর ভারত সরকার বিভিন্ন সূত্র থেকে নিশ্চিত হন যে, তাজউদ্দীন আহমদ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ঘনিষ্ঠতম সহকর্মী। ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর সঙ্গে বৈঠকের আগে ভারত সরকারের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাদের সঙ্গে তাজউদ্দিন আহমদের কয়েক দফা বৈঠক হয় এবং তিনি তাদের বাঙালির মুক্তি সংগ্রাম পরিচালনার জন্য যেসব সাহায্য ও সহযোগিতার প্রয়োজন তা বুঝিয়ে বলেন। এসময় তিনি উপলব্ধি করেন যে আওয়ামী লীগের একজন নেতা হিসেবে তিনি যদি সাক্ষাৎ করেন তবে সামান্য সহানুভূতি ও সমবেদনা ছাড়া তেমন কিছু আশা করা যায় না। সরকার গঠন ও মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে ঐ সরকারের দৃঢ় সমর্থন ছাড়া বিশ্বের কোন দেশই বাংলাদেশের প্রতি সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেবে না। এছাড়া ভারতীয় প্রধানমন্ত্রীর সাথে বৈঠকের আগের দিন এক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা তাজউদ্দীনের কাছে জানতে চান যে স্বাধীন বাংলাদেশের পক্ষে কোন সরকার গঠিত হয়েছে কিনা। তখন তিনি সিদ্ধান্ত নেন যে বৈঠকে তিনি বাংলাদেশ সরকারের প্রতিনিধিরূপে নিজেকে তুলে ধরবেন। কারণ এতে 'পূর্ব বাংলার জনগণের সংগ্রামকে সাহায্য করার জন্য ৩১ মার্চ ভারতীয় পার্লামেন্টে যে প্রস্তাব গৃহীত হয়'[৭] তা কার্যকর রূপলাভ করতে পারে বলে তাজউদ্দিনের ধারণা হয়। ইন্দিরা গান্ধীর সাথে বৈঠকের সূচনাতে তাজউদ্দিন জানান যে পাকিস্তানি আক্রমণ শুরুর সঙ্গে সঙ্গেই ২৫/২৬ মার্চেই বাংলাদেশকে স্বাধীন ঘোষণা করে সরকার গঠন করা হয়েছে। শেখ মুজিব সেই স্বাধীন বাংলাদেশ সরকারের প্রেসিডেন্ট এবং মুজিব - ইয়াহিয়া বৈঠকে যোগদানকারী সকল প্রবীণ সহকর্মীই মন্ত্রিসভার সদস্য। মুজিবের গ্রেফতার ছাড়া তখন পর্যন্ত দলের অন্যান্য প্রবীণ নেতা-কর্মীর খবর অজানা থাকায় সমাবেত দলীয় প্রতিনিধিদের সাথে পরামর্শক্রমে দিল্লির উক্ত সভায় তাজউদ্দীন নিজেকে প্রধানমন্ত্রীরূপে তুলে ধরেন।[৫][৮] ঐ বৈঠকে তাজউদ্দীন আহমদ ইন্দিরা গান্ধীর কাছে স্বাধীন বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দানের জন্য অনুরোধ করেন। ইন্দিরা গান্ধী তাকে এই বলে আশ্বস্ত করেন যে, উপযুক্ত সময়ে আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি দেয়া হবে। এভাবেই অস্থায়ী বাংলাদেশ সরকারের ধারণার সূচনা।
৪ঠা এপ্রিল দিল্লিতে ইন্দিরা গান্ধীর সঙ্গে তাজউদ্দীনের আনুষ্ঠানিক আলোচনা হয়। ১০ এপ্রিল মেহেরপুর জেলার মুজিবনগরে বাংলাদেশের স্বাধীনতার সনদ ঘোষণা করা হয়। ১১ এপ্রিল তাজউদ্দীন বেতারে ভাষণ দেন। ১৭ এপ্রিল মুজিবনগরে আনুষ্ঠানিকভাবে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের অস্থায়ী সরকারের শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠিত হয়। তাজউদ্দীন আহমদ হন বাংলাদেশের প্রথম প্রধানমন্ত্রী। শেখ মুজিবুর রহমানের অনুপস্থিতিতে অস্থায়ী রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব নেন সৈয়দ নজরুল ইসলাম। অস্থায়ী সরকার ১৬ই ডিসেম্বর স্বাধীনতা অর্জন পর্যন্ত কলকাতা থেকে কার্য পরিচালনা করে। তাজউদ্দীন আহমদ দৃঢ়তা ও নিষ্ঠার সাথে এতে নেতৃত্ব দেন।
১৭ এপ্রিল বাংলাদেশের অস্থায়ী সরকার গঠনের পর তাজউদ্দিন আহমেদ ব্যারিস্টার আমিরুল ইসলামকে সাথে নিয়ে ভারতের উদ্দেশ্যে যাত্রা শুরু করেন। কিন্তু ভারতের সীমান্তে পৌঁছে, তিনি বিনা প্রটোকলে ভারতে প্রবেশ করেন নি। তিনি ঐ সময় বলেন, একটি স্বাধীন দেশের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে অন্য দেশে তিনি কোন প্রটোকল ও আমন্ত্রণ ছাড়া প্রবেশ করতে পারেন না। এটা করলে তা তার দেশের জন্য অসম্মানজনক। অতঃপর ওপারের ভারতীয় বাহিনী তাকে গার্ড অফ অনার দিয়ে ভারতে নিয়ে যায়।
স্বাধীন বাংলাদেশ
সম্পাদনাবহিঃস্থ ভিডিও | |
---|---|
[https://www.youtube.com/watch?v=gc03Dg1LArs তাজউদ্দিন এবং সৈয়দ নজরুল ইসলামের ২৫ ডিসেম্বর, ১৯৭১ এ ঢাকায় এপি-তে সাক্ষাৎকার, এপি, ইউটিউব ভিডিও |
২২শে ডিসেম্বর তাজউদ্দীন আহমদ, সৈয়দ নজরুল ইসলামসহ বাংলাদেশ সরকারের নেতৃবৃন্দ ঢাকায় প্রত্যাবর্তন করেন। শেখ মুজিবুর রহমান পাকিস্তানের কারাগার থেকে মুক্ত হয়ে ফিরে আসলে তাজউদ্দীন আহমদ প্রধানমন্ত্রীর পদ থেকে সরে দাঁড়ান। তিনি অর্থ ও পরিকল্পনা মন্ত্রী হিসেবে দায়িত্বভার গ্রহণ করেন। ১৯৭৩ সালের প্রথম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে তিনি সাবেক ঢাকা-২০ আসন বর্তমান গাজীপুর-৪ (কাপাসিয়া) আসন থেকে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন।[৯] বাংলাদেশের প্রথম জাতীয় বাজেট পেশ করেন, প্রথম পাঁচশালা পরিকল্পনা প্রণয়ন করেন।
১৯৭৪ সালে আওয়ামী লীগের দ্বি-বার্ষিক কাউন্সিলের সমাপনী অধিবেশনের বক্তৃতায় তিনি দল, সরকার এবং নেতা ও কর্মীদের মাঝে দূরত্ব দূর করে, সংগঠন এবং সরকারের মাঝে এক নিবিড় সম্পর্ক গড়ে তুলতে ভবিষ্যৎ নেতৃত্বের প্রতি আহ্বান জানান৷[৩]
পরবর্তীকালে শেখ মুজিবের সাথে তাজউদ্দীনের দূরত্বের সৃষ্টি হয়। শেখ মুজিবের সঙ্গে তার দীর্ঘ ৩০ বছরের বিশ্বস্ত এই রাজনৈতিক সহকর্মীর ভুল বোঝাবুঝি হয়। ১৯৭৪ সালের ২৬শে অক্টোবর তাজউদ্দীন মন্ত্রিসভা থেকে পদত্যাগ করেন। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট প্রথমে গৃহবন্দী ও পরে ২৩ আগস্ট গ্রেফতার করা হয় তাকে।[৩]
মৃত্যু
সম্পাদনা১৫ আগস্ট, ১৯৭৫-এ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে হত্যা করার পর হত্যাকারীদের নির্দেশে তাজউদ্দীন আহমদকে গৃহবন্দী করা হয়। ২৩ আগস্ট সামরিক আইনের অধীনে তাজউদ্দীন আহমদ-সহ ২০ জনকে গ্রেফতার করা হয়। তাকে পুরাতন ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে রাখা হয়। ৩রা নভেম্বরে কারাগারের ভিতরে তাজউদ্দীন আহমদ, সৈয়দ নজরুল ইসলাম, মুহাম্মদ মনসুর আলী এবং এ এইচ এম কামরুজ্জামানকে নৃশংসভাবে হত্যা করা হয়, যা বাংলাদেশের ইতিহাসে জেল হত্যা দিবস নামে পরিচিত।
জনপ্রিয় সংষ্কৃতিতে
সম্পাদনা- ২০০৭ খ্রিস্টাব্দে তানভীর মোকাম্মেল তাজউদ্দীন আহমেদকে নিয়ে "তাজউদ্দীনঃ নিঃসঙ্গ সারথী" নামক প্রামাণ্য তথ্যচিত্র নির্মাণ করেন, যা একই বছরের ২৫শে মার্চ মুক্তি পায়।
- ২০১৬ সালে নবীন লেখক সুহান রিজওয়ান তার "সাক্ষী ছিল শিরস্ত্রাণ" নামক রাজনৈতিক উপন্যাসে তাজউদ্দীন আহমেদের চরিত্রকে কেন্দ্রীয় চরিত্র হিসেবে উপস্থাপন করে উক্ত চরিত্রের দৃষ্টিকোণ থেকে মুক্তিযুদ্ধ ও মুক্তিযুদ্ধ পরবর্তী সময়কে নিজস্ব ঢঙে চিত্রায়িত করেন।
- ২০২০ সালের আগস্ট ১৯৭৫ চলচ্চিত্রে তৌকির আহমেদ তাজউদ্দীনের চরিত্রে অভিনয় করেন।
- বাংলাদেশের গাজীপুর জেলার সদর থানায় শহীদ তাজউদ্দীন আহমদ মেডিকেল কলেজ ও বঙ্গতাজ অডিটোরিয়াম মিলনায়তন তার নামে নামকরণ করা হয়েছে।
- ২০২৩ সালের আগস্টে দেশের একমাত্র আবাসিক বিশ্ববিদ্যালয় বলে পরিচিত জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে তাজউদ্দীন আহমেদের স্বরণে শহীদ তাজউদ্দীন হল নামে একটি আবাসিক হলের নামকরণ করা হয়েছে।
- এছাড়া গাজীপুরে অবস্থিত ঢাকা প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় এবং বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমান কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে তার স্বরণে আবাসিক ছাত্র হলের নামকরণ করা হয়েছে।
তথ্যসূত্র
সম্পাদনা- ↑ দৈনিক সংবাদ, মুদ্রিত সংস্করণ, ২৬ আগস্ট, ২০১২ইং, প্রধান পাতা, গাজীপুর-৪ উপনির্বাচন - আওয়ামী লীগের প্রার্থী রিমি
- ↑ দৈনিক প্রথম আলো, মুদ্রিত সংস্করণ, ২৬ আগস্ট, ২০১২ইং, প্রধান পাতা, তাজউদ্দীনকন্যা রিমি গাজীপুর-৪ আসনে মনোনয়ন পেলেন
- ↑ ক খ গ http://www.gunijan.org/GjProfDetails_action.php?GjProfId=172 ওয়েব্যাক মেশিনে আর্কাইভকৃত ৬ মে ২০১২ তারিখে গুণীজন ডট অর্গ এর ওয়েবসাইট
- ↑ তাজউদ্দীন আহমদ-ইতিহাসের পাতা থেকে। পৃষ্ঠা-২৯১
- ↑ ক খ "সংরক্ষণাগারভুক্ত অনুলিপি"। ৭ ফেব্রুয়ারি ২০১২ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ১৭ ডিসেম্বর ২০০৯।
- ↑ http://www.sangbad.com.bd/?view=details&pub_no=198&menu_id=23&news_type_id=1&type=single&val=18713 ওয়েব্যাক মেশিনে আর্কাইভকৃত ২৩ আগস্ট ২০১১ তারিখে দৈনিক সংবাদে প্রকাশিত নিবন্ধ
- ↑ weekly economist (London), 3 April 1971
- ↑ মঈদুল হাসান (২০০৪)। মূলধারা ৭১। ইউনিভার্সিটি প্রেস লিমিটেড। আইএসবিএন 984 05 0121 6।
- ↑ "১ম জাতীয় সংসদে নির্বাচিত মাননীয় সংসদ-সদস্যদের নামের তালিকা" (পিডিএফ)। জাতীয় সংসদ। বাংলাদেশ সরকার। ৯ সেপ্টেম্বর ২০১৮ তারিখে মূল (পিডিএফ) থেকে আর্কাইভ করা।
গ্রন্থপঞ্জি
সম্পাদনা- মূলধারা '৭১- মঈদুল হাসান
- আমার ছোটবেলা ১৯৭১ এবং বাবা তাজউদ্দীন আহমদ- সিমিন হোসেন রিমি
- বাংলাদেশের তারিখ- মুহাম্মদ হাবিবুর রহমান
- তাজউদ্দীন আহমদের ডায়েরী, ১৯৪৭-৪৮ প্রথম খন্ড, প্রতিভাস প্রকাশনী
- তাজউদ্দীন আহমদ: নেতা ও পিতা, শারমিন আহমদ
বহিঃসংযোগ
সম্পাদনাপূর্বসূরী: নেই |
বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী এপ্রিল ১১, ১৯৭১ - জানুয়ারি ১৩, ১৯৭২ |
উত্তরসূরী: শেখ মুজিবুর রহমান |