ঢেঙ্কানাল রাজ্য
ঢেঙ্কানাল রাজ্য ছিলো ব্রিটিশ শাসিত ভারতে অবস্থিত একটি দেশীয় রাজ্য, যা বর্তমানে ভারতের অন্তর্গত৷[১] রাজ্যটির রাজধানী ছিলো বর্তমান ঢেঙ্কানাল শহরে এবং এটি মোটামুটিভাবে বর্তমান ঢেঙ্কানাল জেলার সীমানা নির্দেশ করে৷ [২]
ঢেঙ্কানাল রাজ্য ଢେଙ୍କାନାଳ | |||||||
---|---|---|---|---|---|---|---|
ব্রিটিশ ভারতের দেশীয় রাজ্য | |||||||
১৫২৯–১৯৪৮ | |||||||
ইম্পেরিয়াল গেজেটিয়ার অব ইন্ডিয়া থেকে প্রাপ্ত ঢেঙ্কানাল রাজ্যের মানচিত্র | |||||||
আয়তন | |||||||
• ১৮৯২ | ৩,৭৮৯ বর্গকিলোমিটার (১,৪৬৩ বর্গমাইল) | ||||||
জনসংখ্যা | |||||||
• ১৮৯২ | ২,৭৩,৬৬২ | ||||||
ইতিহাস | |||||||
• প্রতিষ্ঠিত | ১৫২৯ | ||||||
১৯৪৮ | |||||||
|
ইতিহাস
সম্পাদনাঢেঙ্কানাল রাজ্য প্রতিষ্ঠা
সম্পাদনাবিভিন্ন ঐতিহাসিক বিবরণ অনুযায়ী ১৫২৯ খ্রিস্টাব্দের পূর্বে ছিল একটি উপজাতি রাজ্য, যা ঢেঙ্কা শবরদের দ্বারা শাসিত হতো। উৎকল রাজ্যের গজপতি মহারাজা শ্রীশ্রী প্রতাপরুদ্র দেব তার রাজত্বের দাক্ষিণাত্য বিভাগ সেনাধ্যক্ষ এবং বেদবর্তকে এই অঞ্চলের প্রেরণ করেন এবং রাজ্যটিকে নিজের বৃহত্তর উৎকল সাম্রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত করেন। ঢেঙ্কানাল পুরী থেকে দেড়শ কিলোমিটার উত্তরে অবস্থিত। গজপতি সৈন্যদল এবং ঢেঙ্কা শবরদের মধ্যে হওয়া যুদ্ধে গজপতির বেদবর্ত অশ্বারোহী বাহিনী এবং খুরসৈন্য নিয়ে তৎকালীন শবরদের প্রধানকে পরাজিত করেন। এই বিজয় উপলক্ষে উৎকলের গজপতি মহারাজ তার ওই বেদবর্তকে ঢেঙ্কানালের রাজা বলে ঘোষিত করেন এবং বংশপরম্পরায় এই সম্মান আবর্তিত হতে থাকে। এই বিজয়ের ফলে বৃহত্তম উৎকল রাজ্য আরো শক্তিশালী এবং বহিঃশত্রুর আক্রমণ প্রতিহত করতে সক্ষম হয়ে ওঠে।
কিছু শতাব্দী পরে এটি পশ্চিম দিক থেকে আসা মারাঠা আক্রমণ প্রতিহত করতে সক্ষম হয়। রাজা ভাগীরথী প্রতাপ ছিলেন এই রাজ্যের সর্বাধিক জনপ্রিয় এবং কর্মদক্ষ শাসক। তিনি তার বীরত্বের জন্য মাহিন্দ্র বাহাদুর উপাধি পান যা বংশপরম্পরায় ব্যবহৃত হতে থাকে।
বিংশ শতাব্দী
সম্পাদনারাজা শ্রী সুরপ্রতাপ সিংহদেও মাহিন্দ্র বাহাদুরের জ্যেষ্ঠ পুত্র রাজকুমার শঙ্করপ্রতাপ ১৯২৬ খ্রিস্টাব্দে রাজ সিংহাসনে আরোহন করেন৷ ঐ সময়ে তিনি কিশোর ছিলেন এবং তার বিদ্যাশিক্ষা তখনো অসম্পূর্ণ ছিলো৷ একই সঙ্গে তিনি ইংল্যান্ডে আইন সংক্রান্ত পড়াশুনা করছিলেন৷ শিক্ষা সম্পূর্ণ করে তিনি দেশে ফিরে আসেন এবং প্রশাসনিক কাজে মনোনিবেশ করেন৷
রাজা শ্রী শঙ্করপ্রতাপ সিংহদেও মাহিন্দ্র বাহাদুর ইংল্যান্ডে থাকাকালীন তার অনুপস্থিতিতে তার অনুজ ভ্রাতা পট্টায়ৎ নৃসিংহপ্রতাপ সিংহদেও ঢেঙ্কানাল রাজ্য শাসনের দায়ভার গ্রহণ করেছিলেন৷ তার রাজত্বকালে তিনি জোরপূর্বক শ্রমিকদের দিয়ে ১০০ ঘর বিশিষ্ট রাজবাড়ি নির্মাণ করিয়েছিলেন৷[৩] শ্রমিকদের ওপর এ যাবৎ অকথ্য অত্যাচার করা হয়েছিলো৷ রাজার হিসাবরক্ষকও এই সুযোগ নিয়ে সাধারণ প্রজাদের থেকে যথেচ্ছ পরিমান লুঠ করেছিলেন৷ এসমস্ত অত্যাচারের পর রাজা শ্রী শঙ্করপ্রতাপ বিদেশ থেকে নিজ রাজ্যে ফিরে অনুজের থেকে রাজ্যের দায়ভার নিজে গ্রহণ করলে রাজ্যবাসী একটি সুষ্ঠু রাজ্য ব্যবস্থার আশা রেখেছিলেন৷
অভ্যুত্থান
সম্পাদনারাজা শঙ্কর প্রতাপ ছিলো আরো উৎপীড়নকারী, ফলে রাজ্য জুড়ে শুরু হয় প্রজাবিদ্রোহ৷ ঢেঙ্কানালের বেদবর্ত জগন্নাথ পট্টনায়ক এবং দেওয়ান দামোদর পট্টনায়ক এর বংশধর হরমোহন পট্টনায়ক এই প্রজাবিদ্রোহকে সুসংহত এবং সঠিক পথে পরিচালিত করতে সাহায্য করেছিলেন। তিনি ঢেঙ্কানাল প্রজামন্ডল গঠন করেন এবং তার সভাপতি পদে আসীন হন। ওই একই সময়ে হিন্দোল দেশীয় রাজ্যের সেনাধ্যক্ষ সেনাপতি নকুল সামন্ত সিংহরা এবং জমিদার সরবরাকার ফকির চরণ গড়নায়ক একত্রে হিন্দোল প্রজামন্ডল গঠন করেন এবং নকুল সামন্ত সিংহরা তার সভাপতি নির্বাচিত হন।ঢেঙ্কানাল রাজ্য থেকে হরমোহন পট্টনায়ক এবং হিন্দোল রাজ্য থেকে নকুল সামন্ত সিংহরা আস্তে আস্তে ভারতের অন্য সমস্ত দেশীয় রাজ্যগুলি তে জনপ্রিয় হওয়া শুরু করেন। ব্রিটিশ শাসনকালে এটি ছিল ভারতের প্রথম প্রজা মন্ডল[৪] যা ভারতের বিভিন্ন দেশীয় রাজ্যের রাজা এবং মহারাজাদের অত্যাচারের বিরুদ্ধে ধারণ করে স্থানীয় প্রজাদের আওয়াজ তুলে ধরতো।
রাজাসাহেব এরকমই একটি প্রজাবিদ্রোহ দমন করতে ব্রিটিশ সেনার সাহায্য প্রার্থী হয়েছিলেন বলে উল্লেখ রয়েছে। বাজি রাউত নামে এক কিশোর ব্রিটিশ বাহিনীর নৌ-চলাচলের বাধা দান করে।[৫] বাধা পেয়ে ব্রিটিশ অফিসার তাকে সহ আরো পাঁচ গ্রামবাসীকে গুলি করে হত্যা করে। এই ঘটনার ফলে প্রজা বিদ্রোহের আগুন সমগ্র ঢেঙ্কানাল রাজ্য জুড়ে ছড়িয়ে পড়ে।
প্রজা মন্ডল আন্দোলন মূলত ছিল স্থানীয় নিপীড়িতদের একত্রিত করার আন্দোলন। আন্দোলন চলাকালীন ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসও ঢেঙ্কানাল আন্দোলনের সঙ্গে জড়িয়ে পড়ে। রাজাসাহেব হরমোহন পট্টনায়ক কে আটক করলে রাজ্যবাসী তার রাজপ্রাসাদের চারদিকে ঘিরে ফেলে ফলে বাধ্য হয়ে রাজা, নিঃশর্তে হরমোহন পট্টনায়ককে ছেড়ে দেন।
ভারতের স্বাধীনতা
সম্পাদনা১৯৪৭ খ্রিস্টাব্দে ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি এবং ব্রিটিশ সরকারের থেকে ভারতের স্বাধীনতা প্রাপ্তির ঘটলে এই বিশৃঙ্খলার পরিসমাপ্তি ঘটে। রাজা শ্রী শঙ্করপ্রতাপ সিংহদেও মাহিন্দ্র বাহাদুর, হরমোহন পট্টনায়ককে তার প্রশাসনিক উপদেষ্টা হিসেবে মেনে নেন। এর পরপরই দেশীয় রাজ্য গুলো ভারতীয় অধিরাজ্যে সংযুক্ত হলে রাজা ও মহারাজা উভয় পদই অবলুপ্ত হয়। রাজা শ্রী শঙ্করপ্রতাপ নবগঠিত ওড়িশার বিধানসভা কেন্দ্র থেকে নির্বাচিত হন। রাণী শ্রীমতি রত্নপ্রভা দেবী পরপর দুটি নির্বাচনে এমএলএ নির্বাচিত হন। রাজা শ্রী শঙ্কর প্রতাপের পুত্র কামাখ্যাপ্রসাদ সিংহদেও ভারতীয় সাংসদ এবং ভারত সরকারের ক্যাবিনেট মন্ত্রী নিযুক্ত হন। তিনি উড়িষ্যা প্রদেশ কংগ্রেস কমিটির সভাপতিও ছিলেন।
শাসকবর্গ
সম্পাদনা১৮৬৯ খ্রিস্টাব্দের পর থেকে ঢেঙ্কানাল রাজ্যের শাসকগণ মহারাজা উপাধিতে ভূষিত হতেন।[৬]
রাজা
সম্পাদনা- ১৬৮২ - ১৭০৮ নৃসিংহ রায়সিংহ ভ্রমরবর রায়
- ১৭০৮ - ১৭২৮ কুঞ্জবিহারী রায়সিংহ ভ্রমরবর রায়
- ১৭২৮ - ১৭৪১ ব্রজবিহারী রায়সিংহ ভ্রমরবর
- ১৭৪১ - ১৭৪৩ দামোদর রায়সিংহ ভ্রমরবর
- ১৭৪৩ - ১৭৮৫ ত্রিলোচন সিংহ মাহিন্দ্র বাহাদুর
- ১৭৮৫ - ১৭৯৬ দয়ানিধি মাহিন্দ্র বাহাদুর
- ১৭৯৬ - ১৮০৭ রামচন্দ্র মাহিন্দ্র
- ১৮০৭ - ১৮২২ কৃষ্ণচন্দ্র মাহিন্দ্র
- ১৮২২ - ১৮৩২ শ্যামচন্দ্র মাহিন্দ্র
- ১৮৩২ - ১৮৬৯ ভগীরথ মাহিন্দ্র
- ১৮৩২ - ১৮৪৪ - রাজপ্রতিনিধি
মহারাজা
সম্পাদনা- ১৮৬৯ - ১৮৭৭ ভগীরথ মাহিন্দ্র
- ১৮৭৭ - ১৮৮৫ দিনবন্ধু মাহিন্দ্র
- ২৯ আগস্ট ১৮৮৫ – ১৬ অক্টোবর ১৯১৮ সুরপ্রতাপ সিংহদেও মাহিন্দ্র
- ২৯ আগস্ট ১৮৮৫ - ১৯০৬ - রাজপ্রতিনিধি
- ১৬ অক্টোবর ১৯১৮ – ১৫ আগস্ট ১৯৪৭ শঙ্করপ্রতাপ সিংহদেও মাহিন্দ্র
- ০৩ আগস্ট ১৯৬৫ - ব্রিগেডিয়ার রাজা কামাখ্যাপ্রসাদ সিংহদেও মাহিন্দ্র বাহাদুর
তথ্যসূত্র
সম্পাদনা- ↑ Malleson, G. B.: An historical sketch of the native states of India, London 1875, Reprint Delhi 1984
- ↑ "সংরক্ষণাগারভুক্ত অনুলিপি"। ১৭ অক্টোবর ২০২০ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ১১ অক্টোবর ২০২০।
- ↑ "Dhenkanal"। Orissagateway.com। ২০১২-০৪-১৫ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ২০১৩-১০-১৪।
- ↑ Orissa Review
- ↑ "Freedom Fighters"। Dhenkanal.nic.in। ১৩ আগস্ট ২০১৫ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ২০১৩-১০-১৪।
- ↑ Indian Princely States