ঢাকার ইতিহাস

বাংলাদেশের অন্যতম প্রাচীন একটি শহর এবং বর্তমানে বাংলাদেশের রাজধানী

ঢাকা নামের উৎপত্তি সম্পর্কে স্পষ্ট করে তেমন কিছু জানা যায় না। এ সম্পর্কে প্রচলিত রয়েছে নানা মত। যেমন কেউ বলেন একসময় এ অঞ্চলে প্রচুর ঢাক গাছ (বুটি ফুডোসা) ছিল। আবার রাজধানী উদ্বোধনের দিনে ইসলাম খানের নির্দেশে এখানে ঢাক অর্থাৎ ড্রাম বাজানো হয়েছিল। আবার কেউ বা প্রমাণ করতে চান ‘ঢাকাভাষা’ নামে একটি প্রাকৃত ভাষা এখানে প্রচলিত ছিল, সেখান থেকেই এই শহরের নামকরণ।

১৮৬১ সালে ফ্রেডেরিক উইলিয়াম আলেকজান্ডার ডি ফেবেক অঙ্কিত "বুড়িগঙ্গা নদীর পাড়ে ঢাকা"।

তবে বিতর্ক এখানেই থেকে নেই। আরো রয়েছে- রাজতরঙ্গিণী-তে ঢাক্কা শব্দটি ‘পর্যবেক্ষণ কেন্দ্র’ হিসেবে উল্লেখিত হয়েছে অথবা এলাহাবাদ শিলালিপিতে উল্লেখিত সমুদ্রগুপ্তের পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্য ডবাকই হলো ঢাকা।কথিত আছে যে, সেন বংশের রাজা বল্লাল সেন বুড়িগঙ্গা নদীর তীরবর্তী এলাকায় ভ্রমণকালে সন্নিহিত জঙ্গলে হিন্দু দেবী দুর্গার বিগ্রহ খুঁজে পান। দেবী দুর্গার প্রতি শ্রদ্ধাস্বরূপ রাজা বল্লাল সেন ঐ এলাকায় একটি মন্দির প্রতিষ্ঠা করেন।

যেহেতু দেবীর বিগ্রহ ঢাকা বা গুপ্ত অবস্থায় পাওয়া গিয়েছিল তাই রাজা মন্দিরের নাম ঢাকেশ্বরী মন্দির। মন্দিরের নাম থেকেই কালক্রমে স্থানটির নাম ঢাকা হিসেবে গড়ে ওঠে। আবার অনেক ঐতিহাসিকদের মতে, মোঘল সম্রাট জাহাঙ্গীর যখন ঢাকাকে সুবা বাংলার রাজধানী হিসেবে ঘোষণা করেন, তখন সুবাদার ইসলাম খান আনন্দের বহিঃপ্রকাশ স্বরূপ শহরে ‘ঢাক’ বাজানোর নির্দেশ দেন। এই ঢাক বাজানোর কাহিনী লোকমুখে কিংবদন্দির রূপ ধারণ করে এবং তা থেকেই এই শহরের নাম ঢাকা হয়ে যায়।

নামকরণ সম্পাদনা

রাজা বল্লাল সেন নির্মিত ঢাকেশ্বরী মন্দির নামের ঢাকা+ঈশ্বরী থেকে "ঢাকা" শব্দের উৎপত্তি। ঢাকা (ইংরেজি: Dhaka; ১৯৮২ সালের পূর্বে Dacca নামে লেখা হত) ১৬১০ সালে সুবেদার ইসলাম খান চিশতি ঢাকায় বাংলার রাজধানী স্থানান্তর করেন। প্রথমবারের মত ঢাকা রাজধানী হওয়ার মর্যাদা লাভ করে। তিনি মুঘল সম্রাট জাহাঙ্গীরের নামানুসারে ঢাকার নামকরণ করেন জাহাঙ্গীর নগর। ১৬১৩ সালে মৃত্যুর আগে সুবেদার দলুয়া বা ধোলাই নদীর (বর্তমান বুড়িগঙ্গা) তীরে একটি দুর্গ প্রতিষ্ঠা করেন যার নাম ছিল “কেল্লা-ই-জাহাঙ্গীর”। এই কেল্লাতেই পরবর্তীকালে ইংরেজরা নবাব সিরাজদৌলার স্ত্রী-সন্তানদের বন্দী করে রেখেছিলেন।

কামরূপ সাম্রাজ্য সম্পাদনা

কামরূপ রাজত্ব ৩৫০ থেকে ১১৪০ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত বিদ্যমান ছিল। 'যোগিনীতন্ত্র' ঘটনাপঞ্জী হতে জানা যায়, রাজত্ব এর দক্ষিণের সীমা ব্রহ্মপুত্র ও শীতলক্ষ্যা নদী পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল যা ঢাকা অঞ্চলকে ঘিরে রেখেছে। পাল বংশ ছিল শেষ রাজবংশ যা কামরূপ রাজত্ব শাসন করতো। ৮ থেকে ১১ শতকের সেই আমলে, ঢাকা থেকে ১২ মাইল দূরের বিক্রমপুর ছিল তাদের রাজধানী। পাল শাসকরা ছিল বৌদ্ধ ধর্ম অবলম্বী, কিন্তু তাদের বিষয়ের সংখ্যাগরিষ্ঠতা ছিল হিন্দু ধর্ম।

হিন্দু শাসন সম্পাদনা

দিল্লী সালতানাত শাসন সম্পাদনা

দিল্লীর প্রথম স্বাধীন সুলতান হলেন কুতুবউদ্দীন আইবেক এবং তার মাধ্যমে ১২০৬ সালে দিল্লি সালতানাতের শুরু হয়। ১৫২৬ সাল পর্যন্ত ৩২০ বছর দিল্লি সালতানাত স্হায়ী ছিল। কুতুবুদ্দিন আইবেক মুহম্মদ ঘুরির একজন কৃতদাস। তিনি মুহম্মদ ঘুরির অনুমতিক্রমে ভারত বিজয়ের পর দিল্লিতে মুসলিম শাসন শুরু করেন। দিল্লি সালতানাতে ৪ টি বংশ উল্লেখযোগ্য ছিল: দাস বংশ, খিলজী বংশ, তুঘলক বংশ, লোদী বংশ। দাসবংশের প্রতিষ্ঠাতা কুতুবউদ্দীন আইবেক তবে প্রকৃত প্রতিষ্ঠাতা বলা হয় সুলতান ইলতুতমিশকে।দিল্লির সিংহাসনে প্রথম মুসলিম নারী হলেন সুলতানা রাজিয়া। ভারতীয় উপমহাদেশে খিলজী বংশের সূচনা করেন ইখতিয়ার উদ্দীন মুহাম্মদ বিন বখতিয়ার খিলজী। তুঘলক বংশের প্রথম শাসকের নাম গিয়াস উদ্দীন। দিল্লী থেকে রাজধানী দেবগিরিতে স্থানান্তর করেন মুহাম্মদ বিন তুঘলক এবং তার আমলে মরক্কোর পরিব্রাজক ইবনে বতুতা ভারতবর্ষে আগমন করেন, তার বিখ্যাত গ্রন্থের নাম কিতাবুল রেহলা বা সফরনামা। লোদী বংশের প্রতিষ্ঠাতা খিজির খান এবং শেষ সুলতান ইব্রাহীম লোদী। দিল্লীর সালতানাতের পতন হয় পানিপথের প্রথম যুদ্ধে(১৫২৬ সালে)। এ যুদ্ধ সংগঠিত হয় ইব্রাহীম লোদী ও সম্রাট বাবরের মধ্যে এবং যুদ্ধে সম্রাট বাবর জয়লাভ করে।

মুঘল শাসন সম্পাদনা

মুঘল শাসনের পূর্বে বাংলা মুঘলবিরোধী বারো ভূঁইয়া কর্তৃক শাসন হত। বারো ভূইয়ার নিয়ন্ত্রণ থেকে বাংলাকে করতলগত করতে ১৫৭৬ থেকে ১৬০৫ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত বারবার চেষ্টা চালানো হয়। কিন্তু তারা সফল হয় না। মুঘল সম্রাট আকবরের সময় বাংলার রাজধানী ছিল বিহারের রাজমহল। ১৬০৮ খ্রিষ্টাব্দে ইসলাম খান চিশতীকে সম্রাট জাহাঙ্গীর রাজমহলের সুবেদার নিয়োগ করেন। তিনি ১৬১০ সালে ঢাকা বিজয় করেন। এখানে উল্লেখ্য যে, বারো ভূইয়ার শাসনের সময় বাংলার প্রধান প্রশাসনিক কেন্দ্র ছিল সোনারগাঁও। দায়িত্ব নেবার পাঁচ বছরের মধ্যে ইসলাম খান চিশতী মুসা খাঁকে হত্যা করার মাধ্যমে বারো ভূইয়ার জমিদারি শাসনের অবসান ঘটান। বর্তমান চট্টগ্রামের কিছু অংশ বাদে পুরো সুবে বাংলা মোগল সাম্রাজ্যের অধীনে আসে। তিনি ১৬১০ খ্রিষ্টাব্দে বাংলার ভৌগোলিক অবস্থান বিবেচনা করে রাজধানী রাজমহল থেকে সরিয়ে ঢাকায় স্থানান্তর করেন। অনেক ক্ষেত্রে জানা যায়, ঢাকা বিজয়ের ভবিষ্যৎ রাজধানীর সীমানা নির্ণয়ের উদ্দেশ্যে ঢাকিদের কয়েকজনকে নির্দেশ দেন সর্ব শক্তিতে ঢাক (বাদ্যযন্ত্র, ঢোল) বাজাতে আর তিনজন ঘোড়সওয়ার সৈন্যকে নির্দেশ দেন উত্তর, পূর্ব ও পশ্চিম দিকে ঘোড়া ছোটাতে। যে পর্যন্ত ঢাকের শব্দ শুনতে পাওয়া যায় সে পর্যন্ত গিয়ে নিশানা গেড়ে শহরের সীমানা নির্ধারণ করে তবেই তারা ফিরবে। ঢাকার নামকরণের ক্ষেত্রে অনেক গুলো মতবাদের মধ্যে এই মতবাদটিকেও ধরা হয়। যদিও এখন পর্যন্ত ঢাকার নামকরণের কোনো সুনির্দিষ্ট ইতিহাস নির্ণয় করা সম্ভব হয়নি। এখানে উল্লেখ্য, তৎকালীন মুঘল সম্রাট জাহাঙ্গীরকে সম্মান করে তার জীবতকাল পর্যন্ত ঢাকার নাম জাহাঙ্গীর নগর রাখা হয়েছিল।

১৬১০ সালে ঢাকা আনুষ্ঠানিক ভাবে যাত্রা শুরু করলেও এর মধ্যে অনেকবার সুবে বাংলার রাজধানী পরিবর্তন হয়। কয়েক বছর পরই ১৬৫০ খ্রিষ্টাব্দে বাংলার সুবেদার নিয়োগ হাওয়ার পর শাহ্‌ সুজা রাজধানী আবার রাজমহলে স্থানান্তর করেন। কিন্তু ১৬৬০ সালে শাহ্‌ সুজার পতন ঘটে, মীর জুমলা আবারও ঢাকাকে রাজধানীর মর্যাদা ফিরিয়ে দেন। এরপর অনেক কাল ঢাকা নির্বিঘ্নে গৌরবের সাথে রাজধানীর মর্যাদায় অধিষ্ঠিত ছিল। ১৭১৭ সালে মুর্শিদ কুলি খান বর্তমান পশ্চিমবঙ্গের মুর্শিদাবাদে স্থানান্তর করেন। এরপর ঢাকায় মোঘল শাসনামলে চলতো নায়েবে নাজিমদের শাসন। মীরজাফরের বিশ্বাসঘাতকতায় মুঘলদের পরাজয়ের পর আস্তে আস্তে ঢাকার গুরুত্ব কমতে থাকে।

ব্রিটিশ শাসন সম্পাদনা

বৃটিশ ভারতে ঢাকা বাংলার রাজধানী হয় ১৯০৫ সালে। বঙ্গভঙ্গের ফলে পূর্ব বাংলা এবং আসাম নিয়ে নতুন প্রদেশ সৃষ্টি হয়, যার রাজধানী হয় ঢাকা।

তথ্যসূত্র সম্পাদনা