ড্যানিয়েল ম্যাকিনন হ্যামিল্টন

ব্রিটিশ ব্যবসায়ী

স্যার ড্যানিয়েল ম্যাকিনন হ্যামিল্টন (৬ ডিসেম্বর ১৮৬০ ― ৬ ডিসেম্বর ১৯৩৯) ছিলেন একজন স্কটিশ ব্যবসায়ী। তিনি ভারতে এসে বাংলার গ্রামীণ ও সামাজিক উন্নয়নে সক্রিয় অংশগ্রহণ করেন। তিনি ছিলেন ভারতবর্ষে সমবায় আন্দোলনের পথিকৃৎ।[১]

ড্যানিয়েল ম্যাকিনন হ্যামিল্টন
জন্ম(১৮৬০-১২-০৬)৬ ডিসেম্বর ১৮৬০
আরান দ্বীপ, স্কটল্যান্ড
মৃত্যু৬ ডিসেম্বর ১৯৩৯(1939-12-06) (বয়স ৭৯)
পেশাব্যবসায়ী ও ভূস্বামী
দাম্পত্য সঙ্গীলেডি মার্গারেট এলিজাবেথ হ্যামিল্টন

জন্ম ও প্রারম্ভিক জীবন সম্পাদনা

ড্যানিয়েল ম্যাকিনন হ্যামিল্টন ১৮৬০ খ্রিস্টাব্দের ৬ ডিসেম্বর স্কটল্যান্ডের পশ্চিম উপকূলের অদূরে আরান দ্বীপে এক ব্যবসায়ী পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। লেখাপড়ার শেষে তিনি ১৮৮০ খ্রিস্টাব্দে তাদের বোম্বাইস্থিত বাণিজ্য সংস্থা ম্যাকিনন-ম্যাকেঞ্জির শাখা দেখাশোনার জন্য ভারতে আসেন। তিনি মার্গারেট এলিজাবেথকে বিবাহ করেন।

কর্মজীবন সম্পাদনা

 
গোসাবায় স্যার ড্যানিয়েল হ্যামিল্টনের বাংলো

বিংশ শতাব্দীর প্রথম দিকে তিনি ম্যাকিনন ম্যাকেঞ্জির কলকাতা শাখার প্রধান হয়ে আসেন। ১৯০৩ খ্রিস্টাব্দে কলকাতার কাছে তৎকালীন অবিভক্ত চব্বিশ পরগনা জেলার সুন্দরবনের গোসাবা ও রাঙাবেলিয়া দ্বীপে ১৪৩ ও ১৪৯ নম্বর লটে প্রায় নয় হাজার একর জমি চল্লিশ বৎসরের ইজারায় নেন।[২] কাঠ ইত্যাদির সাহায্যে নদীবাঁধ তৈরি করে জমি পুনরুদ্ধার করেন। [৩]: তিনি বাংলাকে ভালোবেসে নিজের জমিদারি প্রতিষ্ঠার পাশাপাশি গোসাবাতেই নিজের দ্বিতীয় আবাস বানান। ব্রিটিশ ভারতের স্থানীয়  দারিদ্র্যপীড়িত মানুষের জীবনযাত্রার উন্নয়নে প্রভূত কাজ করেন। তাদের নিয়ে গ্রামীণ ও সামাজিক উন্নয়নের নানা কর্মসূচির পরীক্ষা-নিরীক্ষা করেন। কৃষি ব্যবসায় ও শিল্পকাজ দ্বারা অর্থনৈতিক দুর্দশা দূরীকরণের জন্য স্বেচ্ছায় মিলিত হওয়ার চেষ্টায় উদ্যোগী করার আদর্শে তিনি দরিদ্র জনসাধারণকে উদ্বুদ্ধ করে তোলেন।তিনি নিজে ম্যাকিনন ম্যাকেঞ্জির অ্যান্ড কোম্পানির অন্যতম অংশীদার হয়ে গ্রামীণ পুনর্গঠন সম্ভব করে তুলতে তিনি গোসাবায় এবং  সুন্দরবনের বিভিন্ন স্থানে সমবায় ব্যবস্থা চালু করেন,  জনগণকে দায়িত্ব ভাগ করে নিতে শেখান।  তিনি গোসাবায় ১৫ জন সদস্য নিয়ে সমবায় ঋণদান সমিতিও প্রতিষ্ঠা করেন এবং তিনিই সমিতির জন্য প্রাথমিক মূলধন ৫০০ টাকা প্রদান করেন।  [৩]:১২ ১৯১৮ খ্রিস্টাব্দে  তিনি উপভোক্তা সমবায় সমিতিও শুরু করেন। ১৯১৯ খ্রিস্টাব্দে তিনি ধান, সব্জি, ফল ইত্যাদির জন্য পরীক্ষামূলক ভাবে কেন্দ্রীয় মডেল খামার গড়েন। ১৯২৩ খ্রিস্টাব্দে  সমবায় ধান বিক্রয় সমিতি প্রতিষ্ঠা করেন এবং ১৯২৪ খ্রিস্টাব্দে তিনি গোসাবা কেন্দ্রীয় সমবায় ব্যাংক প্রতিষ্ঠা করেন। সেসময় সমবায় সমিতির রেজিস্টার যামিনীভূষণ মিত্র তার এই সমবায় আন্দোলনে যথেষ্ট সহায়তা করেন। ১৯২৭ খ্রিস্টাব্দে হ্যামিল্টন তার নামেই প্রতিষ্ঠা করেন - যামিনী রাইস মিল[২]  ১৯৩২ খ্রিস্টাব্দের তিনি গোসাবায় গ্রামীণ পুনর্গঠন ইনস্টিটিউট শুরু করেন। এর ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন তার স্ত্রী লেডি মার্গারেট হ্যামিল্টন  [২]  এবং ওই বছর পরে তিনি গোসাবায় এক টাকার নোট ইস্যু শুরু করেন। এছাড়াও তিনি নৈশ বিদ্যালয়,  হাসপাতাল প্রভৃতি স্থাপন করে তার ওই অঞ্চলকে একটি আদর্শ সমবায় উপনিবেশে পরিণত করেন। হ্যামিল্টন সাহেব গোসাবার রূপকার হিসাবে পরিচিত হন। [২]

ড্যানিয়েল ম্যাকিনন হ্যামিল্টন নোবেল বিজয়ী কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সমসাময়িক এবং ঘনিষ্ঠ সহযোগী ছিলেন। তিনি তার কাছ থেকে গ্রাম পুনর্গঠন এবং সমবায় সমিতির প্রয়োজনীয়তার বিষয়ে পত্র আদান-প্রদান মারফত পরামর্শ লাভ করেন।[৪]

১৯৩০ এর  দশকে তাঁর গোসাবা প্রকল্প সমাপ্ত হওয়ার পর, ড্যানিয়েল হ্যামিল্টন রবীন্দ্রনাথ এবং মহাত্মা গান্ধী  উভয়কেই আমন্ত্রণ জানান।  রবীন্দ্রনাথ ১৯৩২ খ্রিস্টাব্দের ডিসেম্বরের শেষে গোসাবায় হ্যামিল্টনের কর্মযজ্ঞ দেখতে এসেছিলেন। [৪] সাহেবের আতিথেয়তায় তিনি দু-দিন বেকন বাংলোয় ছিলেন। [২]  কিন্তু মহাত্মা গান্ধী নিজে না এলেও তিনি ১৯৩৫ খ্রিস্টাব্দে ফেব্রুয়ারি মাসে তার ব্যক্তিগত সচিব মহাদেব দেশাইকে পাঠান। দেশাই গোসাবাতে হ্যামিল্টনের সঙ্গে এক সপ্তাহ কাটিয়েছিলেন। পরে দেশাইএর পরিদর্শন নিয়ে গান্ধীজি তার হরিজন পত্রিকায় চারটি পর্বে বিস্তারিত বিবরণ প্রকাশ করেন। দেশের দরিদ্র কৃষকগণকে মহাজনের অত্যাচার থেকে রক্ষার জন্য তিনি ১৯২৯ খ্রিস্টাব্দে কেন্দ্রীয়  ব্যাঙ্ক কমিটিতে কৃষিঋণদানের জন্য বিশেষ গুরুত্ব দেন এবং তার প্রস্তাব গৃহীত হয়। [১]

গান্ধী সাপ্তাহিক পত্রিকায় হরিজন -এ চার পর্বের সিরিজে এই সফর সম্পর্কে লিখেছেন। দেশাই হ্যামিল্টনের কাজের প্রশংসা করে তাকে প্রকৃত আদর্শবাদের  "একজন অসাধারণ মানুষ" হিসাবে উল্লেখ করেছেন।

মৃত্যু সম্পাদনা

স্যার ড্যানিয়েল ম্যাকিনন হ্যামিল্টন ১৯৩৯ খ্রিস্টাব্দের ৬ ডিসেম্বর তার ৭৯ তম জন্মদিনেই স্কটল্যান্ডে প্রয়াত হন।

তথ্যসূত্র সম্পাদনা

  1. সুবোধ সেনগুপ্ত ও অঞ্জলি বসু সম্পাদিত, সংসদ বাঙালি চরিতাভিধান, প্রথম খণ্ড, সাহিত্য সংসদ, কলকাতা, আগস্ট  ২০১৬, পৃষ্ঠা ৮৮৪, আইএসবিএন ৯৭৮-৮১-৭৯৫৫-১৩৫-৬
  2. "গোসাবাকে বদলে দেন স্কটল্যান্ডের হ্যামিল্টন"। সংগ্রহের তারিখ ২০২২-১১-০৩ 
  3. The Philosopher's Stone: Speeches and Writings of Sir Daniel Hamilton। গোসাবা এস্টেট ট্রাস্ট, কলকাতা। ২০০৩।  অজানা প্যারামিটার |সম্পাদনা= উপেক্ষা করা হয়েছে (সাহায্য)
  4. "A house in the Sundarbans « Amitav Ghosh"। amitavghosh.com