ডুরান্ড লাইন

দক্ষিণ এশিয়ায় আফগানিস্তান এবং পাকিস্তানের মধ্যে সীমান্ত রেখা
(ডুরান্ড সীমা থেকে পুনর্নির্দেশিত)

ডুরান্ড লাইন (পশতু: د ډیورنډ کرښه; উর্দু: ڈیورنڈ لائن‎‎; দারি: خط دیورند‎) হল আফগানিস্তান এবং পাকিস্তান সীমান্তে অবস্থিত একটি সীমান্ত রেখা বা লাইন।[১] এ রেখাটি পাকিস্তানআফগানিস্তান সীমান্তে প্রায় ২,৬৭০ কিলোমিটার জুড়ে অবস্থিত একটি আন্তর্জাতিক স্থল সীমান্ত।[১] এর পশ্চিম প্রান্তটি ইরানের সীমান্ত পর্যন্ত এবং পূর্ব প্রান্তটি চীনের সীমান্ত পর্যন্ত চলে গেছে। তৎকালীন ব্রিটিশ ভারতীয় সিভিল সার্ভিসের একজন ব্রিটিশ কূটনৈতিক মার্টিমার ডুরান্ড ও আফগান রাজা আমীর আবদুর রহমান খান তাদের নিজ নিজ দেশের সীমা নির্ধারণের জন্য ১৮৯৩ সালে ব্রিটিশ ভারতআফগানিস্তানের আমিরাতের মধ্যে আন্তর্জাতিক সীমানা হিসেবে ডুরান্ড লাইন প্রতিষ্ঠা করেন। তখন থেকে আফগানিস্তানব্রিটিশ ভারতের সীমানা ডুরাল্ড লাইন থেকে নির্ধারিত হয়।

পাকআফগান সীমান্তে ডুরাল্ড লাইন (লাল রেখা)। এই রেখার উভয় পাশে পশতু ভাষাভাষীরা বসবাস করে।

ব্রিটিশরা তখন আফগানিস্তানকে একটি স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে বিবেচনা করত। ১৮৯৩ সালের ১২ নভেম্বরে লিখিত একক পৃষ্ঠার একটি চুক্তিতে মোট সাতটি ছোট নিবন্ধ রয়েছে এবং এর মধ্যে ডুরান্ড লাইনের বাইরে হস্তক্ষেপ না করার প্রতিশ্রুতি রয়েছে।[২] এরপর ১৮৯৪ সালে একটি যৌথ ব্রিটিশ-আফগান সীমানা নির্ধারণ জরিপ শুরু হয়, যা প্রায় ১৩০০ কিলোমিটার সীমান্ত কভার করে। ১৯১৯ সালের অ্যাংলো-আফগান চুক্তির মাধ্যমে লাইনটি সামান্য পরিবর্তিত হয়। ১৯৪৭ সালে পাকিস্তান স্বাধীন হলে আফগানিস্তানপাকিস্তানের সীমানা নির্ধারণের ক্ষেত্রে ডুরাল্ড লাইনকেই নির্ধারিত করা হয়।

আফগানরা কখনো ডুরান্ড লাইনকে স্বীকার করেননি। কারণ এটি পশতুন উপজাতীয় এলাকা ও বেলুচিস্তান অঞ্চলের মধ্য দিয়ে হওয়ার কারণে রাজনৈতিকভাবে জাতিগত পশতুনদের পাশাপাশি বেলুচ এবং অন্যান্য জাতিগোষ্ঠীকে বিভক্ত করেছে, যারা এখন সীমান্তের উভয় পাশে বাস করে। এটি আফগানিস্তানের উত্তর-পূর্ব ও দক্ষিণ প্রদেশ থেকে উত্তর- পশ্চিম পাকিস্তানের খাইবার পাখতুনখোয়া, বেলুচিস্তান এবং গিলগিত- বালতিস্তানকে পৃথক করেছে। ভূ-রাজনৈতিক এবং ভূ-কৌশলগত দৃষ্টিকোণ থেকে এটিকে বিশ্বের সবচেয়ে বিপজ্জনক সীমানা হিসেবে বর্ণনা করা হয়।[৩]

ডুরান্ড লাইন আন্তর্জাতিকভাবে পাকিস্তানের পশ্চিম সীমান্ত হিসেবে স্বীকৃত হলেও আফগানিস্তানে এটি অনেকাংশে অস্বীকৃত রয়ে গেছে। আফগানিস্তানের প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী এবং রাষ্ট্রপতি মুহাম্মদ দাউদ খান জোরালোভাবে এই সীমান্ত লাইনের বিরোধিতা করেন এবং এর বিপক্ষে একটি প্রচার যুদ্ধ শুরু করেছিলেন। ২০১৭ সালে আন্তঃসীমান্ত উত্তেজনার সময় প্রাক্তন আফগান রাষ্ট্রপতি কারজাই বলেন যে, আফগানিস্তান দুই দেশের মাঝে সীমানা হিসেবে ডুরান্ড লাইনকে কখনোই স্বীকৃতি দেবে না। ২০২১ সালে আফগানিস্তান দখল করা তালেবানও ডুরাল্ড লাইনকে উভয় দেশের সীমানা হিসেবে মান্য করে না বলে জানা যায়। এ নিয়ে উভয় দেশের সীমান্তরক্ষী বাহিনী কয়েকবার সংঘর্ষেও জড়িয়েছে।[৪][৫]

অ্যারাকোসিয়া ও প্যাক্টিয়ানসের সময় ১ম সহস্রাব্দের বিসি
১৯৯৩ সালে ডুরাল্ড লাইন চুক্তির আগে আফগানিস্তান
১৯৮৩ সালে হোয়াইট হাউসে আফগান মুজাহিদিন প্রতিনিধিদের সঙ্গে প্রেসিডেন্ট রোনাল্ড রেগান
১৯৮৫ সালে সিআইও এবং আইএসআই প্রশিক্ষিত মুজাহিদিন যোদ্ধাদের ডুরাল্ড লাইন উত্তরণ।
ওয়েশ-চমন সীমান্তে মার্কিন সেনাবাহিনীর জেনারেল স্ট্যানলি ম্যাকক্রিস্টালের সঙ্গে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর লে. জেনারেল খালেদ।
নানগারহার প্রদেশের তোরখাম গেটে আফগান কাস্টমস কর্মকর্তারা ভ্রমণকারীদের পাসপোর্ট পরীক্ষা করছে।

ঐতিহাসিক পটভূমি সম্পাদনা

যে অঞ্চল দিয়ে ডুরান্ড লাইন বয়ে গেছে,সেখানে আদিবাসী পশতুনরা অন্তত ৫০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দ থেকে বসবাস করে আসছে। গ্রীক ঐতিহাসিক হেরোডোটাস খ্রিস্টপূর্ব ১ম সহস্রাব্দের প্রথম দিকে অ্যারাকোসিয়া এবং এর আশেপাশে বসবাসকারী প্যাক্টিয়ান নামক একটি জনগোষ্ঠীর কথা উল্লেখ করেছেন। বালুচরা লাইনের দক্ষিণ প্রান্তে বাস করে, যা বেলুচিস্তানে বাস করা জাতিগত বেলুচ জনগণকে আলাদা করেছে।

আরব মুসলমানরা ৭ম শতাব্দীতে এলাকাটি জয় করে এবং পশতুনদের কাছে ইসলামের পরিচয় তুলে ধরে। এ কথাও বিশ্বাস করা হয় যে, কিছু আরবও সুলাইমান পর্বতমালায় পশতুনদের মধ্যে বসতি স্থাপন করেছিল। এটি লক্ষ করা গুরুত্বপূর্ণ যে, পশতুনরা সাধারণত ঐতিহাসিকভাবে আফগান নামে পরিচিত ছিল এবং ১০ শতকের প্রথম দিকে আরবি ইতিহাসে তাদের এই নামেই উল্লেখ করা হয় বলে বিশ্বাস করা হয়। পশতুন এলাকা ১০ শতকে গজনভি সাম্রাজ্যের অধীনে আসে এবং তারপর যথাক্রমে ঘুরি, তৈমুরি, মুঘল, হোতাকি, দুররানিশিখদের অধীনে কিছুদিন থাকে।[৬]

১৮৩৯ সালে প্রথম প্রথম ইঙ্গ-আফগান যুদ্ধের সময় ব্রিটিশ নেতৃত্বাধীন ভারতীয় বাহিনী আফগানিস্তানে আক্রমণ করে এবং আফগান শাসকদের সাথে যুদ্ধ শুরু করে। দুই বছর পর ১৮৪২ সালে ব্রিটিশরা যুদ্ধে পরাজিত হয় এবং যুদ্ধ শেষ হয়। ১৮৭৮ সালে দ্বিতীয় ইঙ্গ-আফগান যুদ্ধে ব্রিটিশরা পুনরায় আফগানিস্তান আক্রমণ করে। তখন ব্রিটিশরা আফগানিস্তান দখল করতে না পারলেও ক্ষমতায় আমির আব্দুর রহমান খানকে বসাতে সফল হয় এবং ১৮৮০ সালে গন্ডামাক চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। এর ফলে আফগানিস্তান বিভিন্ন সীমান্ত এলাকার নিয়ন্ত্রণ ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের হাতে তুলে দেয়। তখন নিজেদের সমস্ত ভূ-রাজনৈতিক উদ্দেশ্য অর্জিত হলে ব্রিটিশরা সৈন্য প্রত্যাহার করে নেয়।[৬]

১৮৯৩ সালে মর্টিমার ডুরান্ডকে ব্রিটিশ ভারত সরকার কাবুলে প্রেরণ করে। এতে তাদের উদ্দেশ্য ছিল আমির আবদুর রহমান খানের সাথে তাদের সীমা নির্ধারণের পাশাপাশি কূটনৈতিক সম্পর্ক ও বাণিজ্যের উন্নতির জন্য একটি চুক্তি স্বাক্ষর করা। এরপর ১৮৯৩ সালের ১২ নভেম্বর ডুরান্ড লাইন চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়।

 
ঔপনিবেশিক ব্রিটিশ ভারতের কূটনীতিক ও সিভিল সার্ভেন্ট স্যার মর্টিমার ডুরান্ডের নামে এই লাইনের নাম ডুরান্ড লাইন করা হয়।

ব্রিটিশের পক্ষ থেকে উপস্থিত ছিলেন মর্টিমার ডুরান্ড ও সাহেবজাদা আব্দুল কাইয়ুম। আফগানিস্তানের পক্ষ থেকে সরদার শিরেন্দিল খান আমির আবদুর রহমান খানের প্রতিনিধিত্ব করেন। ১৮৯৩ সালের ডুরান্ড লাইন চুক্তিটি ইংরেজিতে লেখা হয় এবং দারিতে তা অনুদিত হয়। ফলস্বরূপ চুক্তি বা চুক্তির ফলে ব্রিটিশ ভারতের উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশ নামে একটি নতুন প্রদেশ তৈরি করা হয়, যা এখন খাইবার পাখতুনখওয়া নামে পরিচিত।

তথ্যসূত্র সম্পাদনা

  1. "Pakistan"The World Factbook (ইংরেজি ভাষায়)। Central Intelligence Agency। ২০২২-১২-১৩। 
  2. "A Selection of Historical Maps of Afghanistan (G&M Reading Room, Library of Congress)"www.loc.gov। সংগ্রহের তারিখ ২০২২-১২-১৫ 
  3. "The World's Most Dangerous Borders - By Philip Walker | Foreign Policy"web.archive.org। ২০১১-১২-৩১। Archived from the original on ২০১১-১২-৩১। সংগ্রহের তারিখ ২০২২-১২-১৫ 
  4. Siddiqui, Dawn com | Naveed (২০১৭-০৩-০৫)। "Afghanistan will never recognise the Durand Line: Hamid Karzai"DAWN.COM (ইংরেজি ভাষায়)। সংগ্রহের তারিখ ২০২২-১২-১৫ 
  5. "পাকিস্তানে আফগান বাহিনীর গোলাবর্ষণ, নিহত ১"দৈনিক ইত্তেফাক। সংগ্রহের তারিখ ২০২২-১২-১৫ 
  6. Kessler, P. L.। "Kingdoms of South Asia - Arachosia / Afghanistan"The History Files (ইংরেজি ভাষায়)। সংগ্রহের তারিখ ২০২২-১২-১৬