বিধানচন্দ্র রায়
বিধানচন্দ্র রায় (১ জুলাই ১৮৮২ – ১ জুলাই ১৯৬২) ছিলেন পশ্চিমবঙ্গের দ্বিতীয় মুখ্যমন্ত্রী। ১৯৪৮ খ্রিস্টাব্দ থেকে আমৃত্যু তিনি ওই পদে অধিষ্ঠিত ছিলেন। চিকিৎসক হিসেবেও তার বিশেষ খ্যাতি ছিল। ১৯১১ খ্রিস্টাব্দে তিনি ইংল্যাণ্ড থেকে এমআরসিপি এবং এফআরসিএস উপাধি অর্জন করার পর কলকাতার ক্যাম্পবেল মেডিক্যাল স্কুলে (বর্তমানে নীলরতন সরকার মেডিক্যাল কলেজ) শিক্ষকতা ও চিকিৎসা পেশা শুরু করেন। পরে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের সেনেট সদস্য, রয়্যাল সোসাইটি অফ ট্রপিক্যাল মেডিসিন অ্যান্ড হাইজিন এবং আমেরিকান সোসাইটি অফ চেস্ট ফিজিশিয়ানের ফেলো নির্বাচিত হন। ১৯৩১ খ্রিস্টাব্দে মহাত্মা গান্ধির ডাকে আইন অমান্য আন্দোলনে যোগ দিয়ে কারাবরণ করেন। ১৯৪২ খ্রিস্টাব্দে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য মনোনীত হন। ১৯৪৭ খ্রিস্টাব্দে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় নির্বাচন কেন্দ্র থেকে কংগ্রেস প্রার্থীরূপে আইনসভায় নির্বাচিত হন। ১৯৪৮ খ্রিস্টাব্দে গ্রহণ করেন পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রীর দায়িত্ব। তিনি চারটি নতুন শহরের প্রতিষ্ঠা করেন: দূর্গাপুর, বিধাননগর, কল্যাণী ও অশোকনগর-কল্যাণগড়। তার চোদ্দ বছরের মুখ্যমন্ত্রীত্বকালে নবগঠিত পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের প্রভূত উন্নতি সম্ভব হয়েছিল যে কারণেই তাকে পশ্চিমবঙ্গের রূপকার নামে অভিহিত করা হয়। ১৯৬১ খ্রিস্টাব্দে তিনি ভারতের সর্বোচ্চ অসামরিক সম্মান ভারতরত্নে ভূষিত হন। মৃত্যুর পর তার সম্মানে কলকাতার উপনগরী সল্টলেকের নামকরণ করা হয় বিধাননগর। তার জন্ম ও মৃত্যুদিন ১ জুলাই দিনটি সারা ভারতে "চিকিৎসক দিবস" রূপে পালিত হয়।
বিধানচন্দ্র রায় এমআরসিপি, এফআরসিএস | |
---|---|
দ্বিতীয় পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী | |
কাজের মেয়াদ ২৩ জানুয়ারি, ১৯৪৮ – ১ জুলাই, ১৯৬২ | |
পূর্বসূরী | প্রফুল্লচন্দ্র ঘোষ |
উত্তরসূরী | প্রফুল্লচন্দ্র সেন |
আইনসভার সদস্য | |
কাজের মেয়াদ ১৯৫২–১৯৬২ | |
পূর্বসূরী | নির্বাচনীক্ষেত্র প্রতিষ্ঠা |
উত্তরসূরী | বিজয় সিংহ নাহার |
নির্বাচনী এলাকা | বউবাজার |
কাজের মেয়াদ ১৯৬২–১৯৬২ | |
পূর্বসূরী | বিজয় সিংহ নাহার |
উত্তরসূরী | সিদ্ধার্থশঙ্কর রায় |
নির্বাচনী এলাকা | চৌরঙ্গী |
ষষ্ঠ কলকাতার মহানাগরিক | |
কাজের মেয়াদ ৫ এপ্রিল, ১৯৩১ – ৯ এপ্রিল, ১৯৩৩ | |
ব্যক্তিগত বিবরণ | |
জন্ম | পাটনা, বেঙ্গল প্রেসিডেন্সি, ব্রিটিশ ভারত | ১ জুলাই ১৮৮২
মৃত্যু | ১ জুলাই ১৯৬২ কলকাতা, পশ্চিমবঙ্গ, ভারত | (বয়স ৮০)
রাজনৈতিক দল | ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেস |
পিতামাতা | অঘোর কামিনী দেবী প্রকাশচন্দ্র রায় |
বাসস্থান | কলকাতা, পশ্চিমবঙ্গ, ভারত |
প্রাক্তন শিক্ষার্থী | পাটনা কলেজ কলকাতা মেডিকেল কলেজ |
জীবিকা | |
পুরস্কার | ভারতরত্ন (১৯৬১) |
স্বাক্ষর | |
তার জন্ম ও মৃত্যুদিন (১ জুলাই) সারা ভারতে চিকিৎসক দিবস হিসেবে পালিত হয় |
পারিবারিক ইতিহাস
সম্পাদনাবিধানচন্দ্র রায়ের ঠাকুরদা প্রাণকালী রায় অধুনা পশ্চিমবঙ্গের মুর্শিদাবাদ জেলার বহরমপুর কালেক্টরেটের একজন কর্মচারী ছিলেন৷ সেই সূত্রে বিধানচন্দ্র রায়ের পিতা প্রকাশচন্দ্র রায়ের জন্ম হয় বহরমপুরে (১৮৪৭ খ্রিস্টাব্দে) ৷ বিধানচন্দ্র রায়ের মাতা অঘোর কামিনী দেবী ছিলেন মুর্শিদাবাদ জেলার বহরমপুরেরই এক জমিদার বিপিনচন্দ্র বসুর কন্যা৷[১]
প্রারম্ভিক জীবন
সম্পাদনা১৮৮২ খ্রিস্টাব্দের ১ জুলাই বর্তমানে বিহার রাজ্যের অন্তর্গত পাটনার বাঁকিপুরে বিধানচন্দ্র রায়ের জন্ম। তিনি ছিলেন পিতা প্রকাশচন্দ্র রায় ও মা অঘোরকামিনী দেবীর ছয় সন্তানের মধ্যে সর্বকনিষ্ঠ। প্রকাশচন্দ্রের আদি নিবাস ছিল বর্তমান বাংলাদেশের খুলনা বিভাগের সাতক্ষীরা জেলার দেবহাটা উপজেলার শ্রীপুর গ্রামে। সরকারি চাকুরিজীবী প্রকাশচন্দ্র ব্রাহ্মধর্মে দীক্ষিত হয়েছিলেন। বিখ্যাত ব্রাহ্মনেতা ও 'নববিধান' ব্রাহ্ম সমাজের প্রতিষ্ঠাতা কেশবচন্দ্র সেন তার নামকরণ করেন 'বিধান'।[১]
শিক্ষা
সম্পাদনাডাঃ বিধানচন্দ্রের লেখাপড়ার সূচনা হয়েছিল এক গ্রাম্য পাঠশালায়। পরে পাটনার টি কে ঘোষ ইনস্টিটিউশন এবং তারপর পাটনা কলেজিয়েট স্কুলে পড়াশোনা করেন। ১৮৯৭ খ্রিস্টাব্দে মাতৃবিয়োগের এক বছর পর প্রবেশিকা পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে পাটনা কলেজে ভরতি হন। সেখান থেকে ১৮৯৭ খ্রিস্টাব্দে এফএ পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন তিনি। ১৯০১ খ্রিস্টাব্দে পাটনা কলেজ থেকে গণিতে সাম্মানিকসহ বিএ পাস করে তিনি কলকাতায় চলে আসেন। কলকাতা মেডিক্যাল কলেজ থেকে ১৯০৬ খ্রিস্টাব্দে এলএমএস এবং দু-বছর পর মাত্র ছাব্বিশ বছর বয়সে এমডি ডিগ্রি লাভ করেন। এরপর ১৯০৯ খ্রিস্টাব্দে ইংল্যান্ড গিয়ে লন্ডনের বার্থোলোমিউ হাসপাতালে উচ্চশিক্ষার আবেদন করেন। প্রথমে এশীয় বলে তার আবেদন অগ্রাহ্য হয়। কথিত আছে নাছোড়বান্দা বিধানচন্দ্র ত্রিশ বার আবেদন করে সাফল্য পেয়েছিলেন। অথচ কেবল দু-বছর তিন মাস সময়কালে তিনি একসঙ্গে এমআরসিপি (লন্ডন)ও এফআরসিএস (ইংল্যান্ড) পরীক্ষায় সসম্মানে উত্তীর্ণ হয়েছিলেন।[২]
কর্মজীবন
সম্পাদনাতিনি ১৯১১ খ্রিস্টাব্দে কলকাতায় ফিরে প্রথমে কলকাতা মেডিক্যাল কলেজ ও পরে কারমাইকেল তথা আরজি কর এবং ক্যাম্পবেল তথা নীলরতন সরকার মেডিক্যাল কলেজে শিক্ষকতা করেছিলন। এছাড়া তিনি কলকাতার চিত্তরঞ্জন সেবা সদন, চিত্তরঞ্জন ক্যান্সার হাসপাতাল, ভিক্টোরিয়া ইনস্টিটিউশন এবং কমলা নেহরু হাসপাতাল এর সাথে যুক্ত ছিলেন।[২]
রাজনৈতিক জীবন
সম্পাদনাবিধানচন্দ্র রায় ১৯২৩ খ্রিস্টাব্দে দেশবন্ধুর কাছে রাজনৈতিক দীক্ষা লাভ করেন। ১৯২৩ খ্রিস্টাব্দে দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশের প্রভাবে রাজনীতিতে যোগ দিয়ে বঙ্গীয় ব্যবস্থাপক সভার নির্বাচনে সুরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়কে পরাজিত করেন। পরে কলকাতা কংগ্রেসের সাধারণ সম্পাদক ও কলকাতা পৌরসংস্থার মেয়র নির্বাচিত হন। কিছুদিনের মধ্যে আইন সভার সদস্য নির্বাচিত হন। মহাত্মা গান্ধির ডাকে কংগ্রেসে যোগদান করেন। ১৯৩১ খ্রিস্টাব্দে কারাবরণ করেন। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর উত্তরপ্রদেশের রাজ্যপাল হওয়ার জন্য তদানীন্তন প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরুর লোভনীয় প্রস্তাব সবিনয় ফিরিয়ে দেন। পশ্চিমবঙ্গ আইন সভার সদস্যগণ একবাক্যে তাকে দলনেতা নির্বাচন করলে সমস্যাকণ্টকিত পশ্চিমবঙ্গের নব রূপায়ণকল্পে দায়িত্বপূর্ণ মুখ্যমন্ত্রীর পদ অলংকৃত করেন (পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের দ্বিতীয় মুখ্যমন্ত্রী)। ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেস দলের প্রতিনিধিত্বে ১৯৪৮ খ্রিস্টাব্দের জানুয়ারি ১৪ থেকে মৃত্যুকাল অবধি ১৪ বছর তিনি পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী ছিলেন।
পশ্চিমবঙ্গের নবরূপকার
সম্পাদনাসময়টা ১৯৪৮ খ্রিস্টাব্দ। সদ্যখন্ডিত পূর্ব পাকিস্তান থেকে ছিন্নমূল লক্ষ লক্ষ নরনারী শিশু নিঃসম্বল অবস্থায় শুধু প্রাণটুকু বাঁচাবার তাগিদে পশ্চিমবঙ্গে আছড়ে পড়ছে সাতপুরুষের পদধূলিরঞ্জিত বাস্তুভূমি ছেড়ে। এই অক্লিষ্টকর্মা কর্মবীর তাদের দিয়েছিলেন মাথাগোঁজার ঠাঁই, একমুঠো খাবারের প্রতিশ্রুতি। উদ্বাস্তুর আগমনে রাজ্যে তখন খাদ্য ও বাসস্থানের সমস্যা ভয়াবহ আকার নিয়েছে। তাছাড়া পূর্ব পাকিস্তান থেকে কাঁচামাল পাটের যোগান বন্ধ । তিনি বহু পতিত জমি উদ্ধার করে এবং কিছু ধানের জমিতে পাটচাষের ব্যবস্থা করে লক্ষাধিক চটকলকর্মীর সম্ভাব্য বেকারি রুখলেন। শিল্পসমৃদ্ধ বাংলা গড়তে তার ত্রুটিহীন পরিকল্পনায় স্থাপিত হল দুর্গাপুর ইস্পাতনগরী, চিত্তরঞ্জন রেল ইঞ্জিন কারখানা। বাসস্থানের জন্য তৈরি হল কল্যাণী উপনগরী, লেক টাউন, লবণহ্রদ নগর। দুগ্ধ সরবরাহের জন্যে গড়ে তুললেন হরিণঘাটা দুগ্ধ প্রকল্প। শিক্ষিত বেকারদের বিপুল পরিমাণে কর্মনিয়োগের জন্য সৃষ্টি করলেন কলকাতা রাষ্ট্রীয় পরিবহন সংস্থা।
শিক্ষাব্রতী
সম্পাদনাতিনি ১৯৪৩-৪৪ খ্রিস্টাব্দে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাধ্যক্ষ ছিলেন। তার ঐকান্তিক ইচ্ছায় গড়ে উঠল রবীন্দ্র ভারতী বিশ্ববিদ্যালয়, বর্ধমান বিশ্ববিদ্যালয়, বাঁকুড়া সম্মিলনী মেডিক্যাল কলেজ, পুরুলিয়া, রহড়া, নরেন্দ্রপুরে প্রাচীন ভারতীয় আদর্শে আশ্রমিক পরিবেশে রামকৃষ্ণ মিশন বিদ্যালয়।
সংস্কৃতি মনস্কতা
সম্পাদনাসত্যজিৎ রায়ের পথের পাঁচালির মতো আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন চলচ্চিত্র প্রযোজনা করেছিল তার নেতৃত্বে পশ্চিমবঙ্গ সরকার। বিশ্ববরেণ্য নৃত্যশিল্পী উদয়শংকরকে তিনি সরকারি তহবিল থেকে অনুদান দেন। কবিগুরুর জন্মশতবার্ষিকীতে রবীন্দ্র রচনাবলি প্রকাশের উদ্যোগ নেন।
মৃত্যু
সম্পাদনা১৯৬২ খ্রিস্টাব্দের ১ জুলাই বিধানচন্দ্র রায় মৃত্যুবরণ করেন। তার জন্ম ও মৃত্যু দিন ১ জুলাই ভারতে চিকিৎসক দিবস হিসেবে পালন করা হয়।
তথ্যসূত্র
সম্পাদনা- ↑ ক খ নন্দলাল ভট্টাচার্য (২০০৪)। কর্মযোগী বিধানচন্দ্র। গ্রন্থতীর্থ। পৃষ্ঠা ১৫ ও ১৬।
- ↑ ক খ "Dr. Bidhan Chandra Roy Biography For Students"। Kids Portal For Parents (ইংরেজি ভাষায়)। ২৮ জুন ২০২০। সংগ্রহের তারিখ ২২ জুলাই ২০২০।
আরো দেখুন
সম্পাদনাপূর্বসূরী প্রফুল্লচন্দ্র ঘোষ |
পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী জানুয়ারি ১৪,১৯৪৮–জুলাই ১, ১৯৬২ |
উত্তরসূরী প্রফুল্লচন্দ্র সেন |