টঙ্ক আন্দোলন

বাংলার কৃষকদের অধিকার আদায়ের একটি অন্যতম আন্দোলন

টঙ্ক আন্দোলন বাংলার কৃষকদের অধিকার আদায়ের একটি অন্যতম আন্দোলন। উত্তর ময়মনসিংহ অঞ্চলে এই আন্দোলন ব্যাপক আকার ধারণ করে এবং ১৯৫০ সালে টঙ্ক প্রথা ও জমিদারী প্রথা উচ্ছেদের মাধ্যমে এই আন্দোলনের সমাপ্তি হয়। তেভাগা, নানকার, নাচোল কৃষক আন্দোলনের মতো এটিও ছিলো কৃষকদের অধিকার আদায়ের আন্দোলন।[১]

টঙ্ক সম্পাদনা

বৃহত্তর ময়মনসিংহ তথা নেত্রকোণা, ময়মনসিংহ এবং শেরপুর জেলার বিভিন্ন স্থানে টঙ্ক প্রথা চলে আসছিলো। টঙ্ক বলতে খাজনা বুঝানো হতো। কৃষকদেরকে উৎপাদিত শস্যের উপর এই টঙ্ক দিতে হতো। কিন্তু এর পরিমাণ ছিলো প্রচলিত খাজনার কয়েক গুনেরও বেশি। যা দরিদ্র কৃষকদের পক্ষে সম্ভব ছিলো না।[২]

পটভূমি সম্পাদনা

শোষিত কৃষকেরা এই প্রথার বিরুদ্ধে কমরেড মণি সিংহের নেতৃত্বে একত্রিত হয়। ১৯৩৭ সালের নভেম্বর মাসে একটি বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। এখান থেকেই মূলতঃ আন্দোলনের শুরু। এরপর কমরেড মণি সিংহ ছয় দফা[৩] দাবিনামা প্রস্তুত করেন। ছয়দফা ছিলো।

  • টঙ্ক প্রথার সম্পূর্ণ বিলুপ্তি
  • টঙ্ক কৃষকদের ভূমির অধিকারের স্বীকৃতি
  • পরগনায় নগদ টাকায় দেয় হারের নিরিখে খাজনা নির্ধারণ
  • টঙ্ক খাজনার বকেয়া দাবি না করা
  • জমিদারি প্রথার বিলুপ্তি এবং
  • সাম্রাজ্যবাদের উচ্ছেদ

কিন্তু ব্রিটিশ সরকার আন্দোলনকারীদের উপর চড়াও হয়। যার ফলশ্রুতিতে আন্দোলন আরও তীব্র হতে থাকে।

টঙ্ক আন্দোলন সম্পাদনা

 
হাজং মাতা রশিমনি স্মৃতিসৌধ

১৯৪৬ সালের দিকে টঙ্ক প্রথা বিলোপের আন্দোলনের সংগে সংগে জমিদারী প্রথা বিলোপ আন্দোলনও শুরু হয়ে যায়। তখন আন্দোলন ব্যাপক রূপ ধারণ করে। আন্দোলনকারীদের প্রতিহত করতে পুলিশ স্থানে স্থানে ক্যাম্প বসায়। এই আন্দোলনের আরেক নেতা ললিত সরকারের বাড়িতে আগুন দেয়। ঐ বছরেরই ৩১শে ডিসেম্বর দুর্গাপুরের বহেরাদলী গ্রামে পুলিশ ব্যাপক তল্লাশি চালায়। এরপর বিখ্যাত হাজং নেত্রী কুমুদিনী হাজং কে আটক করে পুলিশ। তাকে ধরে নিয়ে যাওয়ার সময় রশিমনি হাজং তাকে ছাড়াতে গেলে পুলিশ গুলি করে। শহীদ হন হাজং মাতা রশিমনি হাজং। তার এই মহান আত্মত্যাগকে স্মরণীয় করে রাখতে ২০০৪ সালে নির্মিত হয় হাজং মাতা রশিমনি স্মৃতিসৌধ।[৪] পুলিশের গুলিতে হাজং মাতা, সুরেন্দ্র হাজংসহ আরও অনেক আন্দোলনকর্মী নিহত হন। ক্ষিপ্ত কৃষক জনতা তখন পুলিশ বাহিনীর দিকে বল্লম ছুড়তে থাকে। এতে দুইজন পুলিশ নিহত হয়।

১৯৪৯ সালে আন্দোলন বিশাল আকার ধারণ করে।

‘ টংক প্রথার উচ্ছেদ চাই, জান দিব তবু ধান দিব না, জমিদারী প্রথার উচ্ছেদ চাই, জমি যার,লঙ্গল তার’ 

ইত্যাদি স্লোগান ছড়িয়ে পড়ে সর্বত্র। টঙ্ক দেওয়া বন্ধ করে দেন সকল কৃষক। ১৯৪৯ সালের ১৫ জানুয়ারি কলমাকান্দা থানার বটতলায় ২০ মণ টংক ধান আটক করে কৃষকেরা। ২৬ ফেব্রুয়ারি চৈতন্যনগরে জমিদারের কাছারি দখল করে উত্তেজিত কৃষকেরা। পুড়িয়ে দেয় জমিদারের প্রয়োজনীয় সব কাগজপত্র। অত্যাচারের খড়গ নেমে আসে তাদের উপর। বিপ্লবী মঙ্গল সরকারের নেতৃত্বে একটি মিছিলে পুলিশ গুলি করলে ১৯ জন বিদ্রোহী নিহত হন। গ্রেপ্তার হন অনেকে। এর মধ্যে অশ্বমণি ও ভদ্রমণি হাজং এর ১২ বছর করে জেল হয়। ২৮ ফেব্রুয়ারি দু’জন বন্ধুকধারী সিপাইকে বিপ্লবী কৃষকেরা ভালুকা পাড়া গির্জার সামনে হত্যা করে।

আন্দোলনের সমাপ্তি সম্পাদনা

১৯৫০ সনে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের মুখ্যমন্ত্রী নুরুল আমীন সুসং দুর্গাপুর এলাকায় আসেন ভয়াবহ পরিস্থিতি সামাল দেওয়ার জন্য। কিন্তু টঙ্ক প্রথা না তুলে নেওয়ায় এই আন্দোলন চলতে থাকে। অবশেষে পূর্ববঙ্গ জমিদারি অধিগ্রহণ ও প্রজাস্বত্ব আইন ১৯৫০ পাস হলে এই নির্মম প্রথা বিলোপ সাধিত হয়।

এই আন্দোলনে বহু নেতা প্রাণ হারান। এবং কৃষকেরা তাদের অধিকার ছিনিয়ে নিয়ে আসেন। টঙ্ক আন্দোলনে নারীদের ভূমিকা ছিলো সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। অনেক নারী আন্দোলনকর্মী পরবর্তীতে রাজনীতি এবং অন্য জাতীয় আন্দোলনে সক্রিয় ছিলেন।

টঙ্ক আন্দোলন প্রথম বাংলা উপন্যাসে উপস্থাপিত হয়েছে অমর মিত্র রচিত মোমেনশাহী উপাখ্যান উপন্যাসে। ইতিহাস এবং গারো পাহাড়ের দেশের জনজীবনের এই গণআন্দোলন উপন্যাসটিতে বিধৃত। কলকাতার দে'জ প্রকাশনী প্রকাশ করেছে বইটি।

টঙ্ক আন্দোলনের বিপ্লবীরা সম্পাদনা

আরও দেখুন সম্পাদনা

তথ্যসূত্র সম্পাদনা

বহিঃসংযোগ সম্পাদনা