জাকির হোসাইন (গভর্নর)
জাকির হোসাইন (উর্দু: ذاکِر حسین) (২ নভেম্বর ১৮৯৮ - ২৪ মে ১৯৭১) ছিলেন পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নর এবং পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী।[১][২][৩]
জাকির হোসাইন | |
---|---|
![]() | |
পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী | |
কাজের মেয়াদ ১৪ জুন ১৯৬০ – ৮ জুন ১৯৬২ | |
রাষ্ট্রপতি | আইয়ুব খান |
পূর্বসূরী | খালিদ মাসুদ শেখ |
উত্তরসূরী | খান হাবিবউল্লাহ খান |
পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নর | |
কাজের মেয়াদ ১০ অক্টোবর ১৯৫৮ – ১৪ এপ্রিল ১৯৬০ | |
রাষ্ট্রপতি | আইয়ুব খান |
পূর্বসূরী | সুলতানউদ্দিন আহমদ |
উত্তরসূরী | আজম খান |
ব্যক্তিগত বিবরণ | |
জন্ম | নভেম্বর ২, ১৮৯৮ রাঙ্গুনিয়া, চট্টগ্রাম, বেঙ্গল প্রেসিডেন্সি |
মৃত্যু | ২৪ মে ১৯৭১ খুলশি, চট্টগ্রাম, পূর্ব পাকিস্তান | (বয়স ৭২)
সমাধিস্থল | গরিবুল্লাহ শাহ মাজার কবরস্থান |
নাগরিকত্ব | ![]() ![]() |
সন্তান | তিন পুত্র, তিন কন্যা |
প্রাক্তন শিক্ষার্থী | মোহামেডান অ্যাংলো ওরিয়েন্টাল কলেজ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় |
পেশা | সরকারি কর্মকর্তা |
জন্ম
সম্পাদনাজাকির হোসাইন ১৮৯৮ সালের ২ নভেম্বর চট্টগ্রামের রাঙ্গুনিয়ার ঘাটচেক গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন।[১]
শিক্ষাজীবন
সম্পাদনারাঙ্গুনিয়ায় প্রথমিক বিদ্যালয় পাশ করার পর ১৯১৫ সালে তিনি চট্টগ্রাম কলেজিয়েট স্কুল থেকে এনট্রান্স পাশ করেন। একই বছরে ফুলার পরীক্ষায় প্রথম স্থান লাভ করেন এবং প্রথম বিভাগে বৃত্তি পান। ১৯১৭ সালে চট্টগ্রাম কলেজ থেকে তিনি ইন্টারমিডিয়েট পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। ১৯২০ সালে মোহামেডান অ্যাংলো ওরিয়েন্টাল কলেজ (পরবর্তীতে আলিগড় বিশ্ববিদ্যালয়) থেকে স্নাতক হন। এরপর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে স্নাতকোত্তর পর্যায়ে ভর্তি হন।[১]
কর্মজীবন
সম্পাদনা১৯২০ সালে তিনি প্রথম মুসলিম হিসেবে ইন্ডিয়ান ইম্পেরিয়াল পুলিশে যোগদানের সক্ষমতা অর্জন করেন। ১৯২৩ সালের ২৬ সেপ্টেম্বর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রাবস্থায় তিনি ভারতীয় পুলিশ বিভাগে যোগ দেন। তিনি বাংলার বিভিন্ন জেলায় পুলিশ কর্মকর্তা হিসেবে কাজ করেছেন। তিনি ত্রিশের দশকের শুরুতে ময়মনসিংহ জেলার অতিরিক্ত পুলিশ সুপার হিসেবে কর্মরত ছিলেন এবং আলিগড় এ তিনি গোয়েন্দা বিভাগের পুলিশের বিশেষ সুপারিন্টেন্ডেট ছিলেন। তাঁরই ঐকান্তিক প্রচেষ্টায় ও সহযোগিতায় ময়মনসিংহ শহরের প্রাণকেন্দ্রে শ্যামাচরণ রায় রোডে ৪১ শতাংশ জমির উপর মুসলিম ইনস্টিটিউট নামে মুসলমানদের জন্য একটি সামাজিক প্রতিষ্ঠান গড়ে ওঠে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় ১৯৪৭ সালের ১ এপ্রিল তিনি কলকাতা বন্দরের শিপিং মাস্টার হিসেবে দায়িত্বপালন করেছেন। এরপর প্রেসিডেন্সি রেঞ্জে পুলিশের ডেপুটি ইন্সপেক্টর জেনারেল হিসেবে নিয়োগ লাভ করেন।[১][৪]
১৯৪৭ সালের দেশভাগের পর তিনি পূর্ব বাংলা চলে আসেন। এখানে ১৯৪৭ সালের আগস্টে তিনি পূর্ব বাংলার প্রথম পুলিশ ইন্সপেক্টর জেনারেল হন। ১৯৪৭ থেকে ১৯৫২ সাল পর্যন্ত তিনি এই পদে ছিলেন। ১৯৫২ সালে তিনি পুলিশ বিভাগ থেকে অবসর নেন।[১]
এরপর সেই বছর তিনি পাঁচ বছরের জন্যে ফেডারেল পাবলিক সার্ভিস কমিশনের চেয়ারম্যান নিযুক্ত হন এবং ১৯৫৭ সাল পর্যন্ত এই পদে ছিলেন। একই বছর তিনি সরকারি চাকরি থেকে অবসর গ্রহণ করেন।[১]
পরের বছর ১৯৫৮ সালের ১০ অক্টোবর তাকে পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নর হিসেবে নিয়োগ দেয়া হয়। ১১ অক্টোবর তিনি শপথ নেন।[৪][৪] তার আমলে দ্রব্যমূল্য হ্রাস পায় এবং চোরাচালানের উপর নজরদারি বৃদ্ধি করা হয়।[৫] তিনি মৌলিক গণতন্ত্রের পক্ষে কাজ করেছেন এবং ১৯৬০ সালের ১৪ ফেব্রুয়ারি অনুষ্ঠিত আস্থা ভোটে তিনি আইয়ুব খানের বিজয়ে ভূমিকা রাখেন। তবে, তিনি যেহেতু একটি সামরিক আইন শাসন ব্যবস্থার প্রতিনিধি ছিলেন, তাই শীঘ্রই অজনপ্রিয় হয়ে ওঠেন। ১৪ই এপ্রিল ১৯৬০ পর্যন্ত তিনি গভর্নর ছিলেন।
১৯৬০ থেকে ১৯৬২ পর্যন্ত তিনি পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ও কাশ্মীর বিষয়ক মন্ত্রী ছিলেন।[১] ১৯৬৪ সালে তিনি চট্টগ্রামে ফিরে আসেন এবং সক্রিয় রাজনীতি থেকে অবসর নেন।
তিনি তার কর্মজীবনে বহু গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠা করেন। ফৌজদারহাট ক্যাডেট কলেজ প্রতিষ্ঠা করেন, যার প্রথম অধ্যক্ষ হিসেবে নিয়োগ পান কর্নেল গিবসন, যিনি পরবর্তীতে পূর্ব পাকিস্তান রাইফেলসের মহাপরিচালক হিসেবে অবসর গ্রহণ করেন। এছাড়াও, তিনি ৫০০ শয্যাবিশিষ্ট চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়, চট্টগ্রাম মহিলা কলেজ, চট্টগ্রাম নিউ মার্কেট এবং রাঙ্গুনিয়া কলেজ (স্কুল থেকে উন্নীত) প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ নেন। তিনি বেগম ইকবাল জাকির হুসাইন স্কুল এবং বর্তমানে রাঙ্গুনিয়ার একটি মহিলা কলেজও প্রতিষ্ঠা করেন।
ব্যক্তিজীবন
সম্পাদনাজাকির হোসাইন সুশৃঙ্খল জীবনযাপন করতেন। তিনি কঠোর পরিশ্রমী ও নিয়মানুবর্তী ছিলেন। জাকির হুসাইন বকশালিয়া (লালদিঘী পূর্ব) এলাকার খান বাহাদুর আমান আলীর কন্যা ফিরোজার সাথে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন। তাদের তিন পুত্র—জাহিদ, আদিল এবং শাহিদ হুসাইন এবং তিন কন্যা—জেহরা (ফাতেহা), জীনাত এবং ফারিদা। তিনি বাগান ও খামারের প্রতি গভীর আগ্রহী ছিলেন এবং নিয়মিত টেনিস ও গুলটি খেলতেন।[৫]
মৃত্যু
সম্পাদনামুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন, ১৯৭১ সালের ৯ এপ্রিল পাকিস্তান সেনাবাহিনী চট্টগ্রামের পাহাড়ের চূড়ায় অবস্থিত তার বাসভবনে আক্রমণ চালায়, যার ফলে তার অধিকাংশ দেহরক্ষী ও গৃহপরিচারক নিহত হন। সে সময় তার সঙ্গে থাকা বড় ছেলে জাহিদ হুসাইনসহ তাকে গুলি করে হত্যা করে পাহাড় থেকে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দেওয়া জন্য সারিবদ্ধভাবে দাঁড় করানো হয় । তবে, তখনই কমান্ডিং অফিসার এসে তাদের হত্যা থামিয়ে দেন। মর্টার হামলায় তার বাড়ির প্রথম তলা ধ্বংস হয়ে গেলে, তিনি কয়েকদিনের জন্য ব্যবসায়ী এম.এম. ইস্পাহানির অতিথি হিসেবে আশ্রয় নেন। পরে কিছুদিন পর তিনি তার বাড়িতে ফিরে আসেন, যেখানে ইতোমধ্যে বসতি স্থাপন করা কিছু বিহারি পরিবারকে উচ্ছেদ করা হয়। তিনি ১৯৭১ সালের ২৪ মে মৃত্যুবরণ করেন। তার জানাজার জন্য চট্টগ্রামের লালদিঘী ময়দানে কয়েক ঘণ্টার জন্য কারফিউ শিথিল করা হয়। তাকে চট্টগ্রামে গরীবুল্লাহ শাহের মাজার ও মসজিদের পাশে, তার দ্বিতীয় স্ত্রীর কবরের পাশে সমাহিত করা হয়। জাকির হোসাইন ১৯৭১ সালের ২৪ মে মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন সময় চট্টগ্রামের খুলশিতে অবস্থিত নিজ বাসভবনে মৃত্যুবরণ করেন।[১] লালদীঘি ময়দানে[তথ্যসূত্র প্রয়োজন] তার জানাজা অনুষ্ঠিত হওয়ার জন্য এসময় চলমান কারফিউ তুলে নেয়া হয়। চট্টগ্রামের গরিবুল্লাহ শাহর মাজার সংলগ্ন কবরস্থানে তাকে দাফন করা হয়।
স্মরণ ও সম্মাননা
সম্পাদনাজাকির হোসাইন ১৯৪০ সালে ভারতীয় পুলিশ পদক এবং পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর কায়েদে আজম পুলিশ পদক লাভ করেছেন। তার নামে দুটি গুরুত্বপূর্ণ শহরের সড়ক নামকরণ করা হয়েছে— চট্টগ্রামের জাকির হোসেন রোড ও ঢাকায় একটি সড়ক।[১]
তথ্যসূত্র
সম্পাদনা- ↑ ক খ গ ঘ ঙ চ ছ জ ঝ হোসাইন, জাকির বাংলাপিডিয়া
- ↑ "BANGABHABAN - The President House of Bangladesh"। web.archive.org। ২০১৭-০৫-১০। Archived from the original on ২০১৬-০৪-১৪। সংগ্রহের তারিখ ২০২৫-০২-০৫।
- ↑ "Zakir Hussain installed as new governor"। Bangladesh Observer (তৎকালীন Pakistan Observer)। ১২ অক্টোবর ১৯৫৮।
- ↑ ক খ গ "পূর্ব পাকিস্তানের নয়া গভর্নর"। দৈনিক আজাদ। ১২ অক্টোবর ১৯৫৮। Archived from the original on ১৪ এপ্রিল ২০১৬। সংগ্রহের তারিখ ৫ ফেব্রুয়ারি ২০২৫।
- ↑ ক খ "Governors and Acting Governors of East Bengal/ East Pakistan 1947-1971, ২০ জুলাই ২০১৬ তারিখে সংগৃহিত"। ১৪ এপ্রিল ২০১৬ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ২০ জুলাই ২০১৬।
রাজনৈতিক দপ্তর | ||
---|---|---|
পূর্বসূরী সুলতানউদ্দিন আহমেদ |
পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নর ১৯৫৮-১৯৬০ |
উত্তরসূরী আজম খান |
পূর্বসূরী খালিদ মাসুদ শেখ |
পাকিস্তানের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ১৯৬০-১৯৬২ |
উত্তরসূরী খান হাবিবউল্লাহ খান |