জনপ্রিয়তার দোহাই দিয়ে যুক্তি

জনপ্রিয়তার দোহাই দিয়ে যুক্তি এক প্রকারের অনুপপত্তি বা কুযুক্তি বা হেত্বাভাস। যুক্তিপ্রদানের তত্ত্ব (argumentation theory) অনুসারে এই কুযুক্তি দিয়ে বুঝানো হয় বেশিরভাগ মানুষ বিশ্বাস করে এরকম যেকোনও প্রকার প্রতিজ্ঞা বা বিবৃতি অবশ্যই সত্য। একে সংক্ষেপে এভাবেও বলা যায়, "যা বেশিরভাগ মানুষ বিশ্বাস করে তাই সঠিক"। এই কুযুক্তি বিচার বিবেকের মাধ্যমে নির্ধারিত হয় না, বরং এই কুযুক্তি সংখ্যার প্রাচুর্যতাকে বিবেচনাধীন রেখে সিদ্ধান্ত নেয়। চীনা ভাষায় একটি প্রবাদ আছে। প্রবাদটি হলো "তিনজনেতে বাঘ বলিলে, বাঘ জন্মায় সে স্থানে"। এই প্রবাদের সাথে এই হেত্বাভাসের অর্থগত সাদৃশ্য আছে।

অন্য ভাষায় সম্পাদনা

লাতিন ভাষায় একে "আর্গুমেন্তুম আদ পোপুলুম" (argumentum ad populum) বলে; একে ইংরেজিতে "আর্গুমেন্টাম অ্যাড পপুলাম" উচ্চারণ করা হয়। এই কুযুক্তি ইংরেজি ভাষায় আরও বিভিন্ন নামে পরিচিত।(ইংরেজি:appeal to the masses, appeal to belief, appeal to the majority, appeal to democracy, appeal to popularity, argument by consensus, consensus fallacy, authority of the many, bandwagon fallacy, vox populi)।[১]

উদাহরণ সম্পাদনা

কোনো মানুষকে প্রভাবিত করতে গিয়ে এই হেত্বাভাষের ব্যবহারের প্রবণতা অনেক বেশি দেখা যায়। বলা হয়, এটা বিশ্বাস করতেই হবে বা এটাই যৌক্তিক কারণ সংখ্যাধিক্য মানুষ এটাই মনে করে। এরকম কিছু উদাহরণ হলো

  • সংখ্যাধিক্য মানুষ মনে করে, ভূমিকম্পের কারণ হলো অনৈতিক কাজ, তার মানে ভুমিকম্প এ কারণেই হয়।
  • "বেদের মেয়ে জ্যোৎস্না" একটি ব্যাবসাসফল চলচ্চিত্র, অর্থাৎ এই চলচ্চিত্রটি মানসম্পন্ন চলচ্চিত্র।
  • সবাই এটা করছে, তার মানে এটাই সঠিক।
  • আদালতে নির্ণায়কসভার সদস্যরা গণতান্ত্রিকভাবে সিদ্ধান্ত নেন, অর্থাৎ তারা সঠিক সিদ্ধান্ত নেন।
  • বেশিরভাগ লোক নির্ভরপত্রের (ওয়ারেন্টি) মেয়াদ বেশি এরকম জিনিসপত্র ক্রয় করে, তার মানে, যেসব দ্রব্যের নির্ভরপত্রের মেয়াদ বেশি সেগুলো ক্রয় করাই বুদ্ধিমানের কাজ।
  • লক্ষাধিক মানুষ আমার দৃষ্টিভঙ্গির সাথে একমত, অর্থাৎ আমিই সঠিক।
  • দেশটার বেশিরভাগ মানুষ এই প্রধানমন্ত্রীকে ভোট দিয়েছে, তার মানে এই প্রধানমন্ত্রী ভালো প্রধানমন্ত্রী।
  • আমার পরিবার বা সম্প্রদায় এটাকে সত্য মানে, অতএব যারা যারা এর সাথে দ্বিমত পোষন করছে তারা সবাই নিশ্চিতভাবে ভুল।
  • কেউ এই বিষয়ে এখন পর্যন্ত অভিযোগ করে নি, তার মানে, এই বিষয়ে অভিযোগ কেউ করতে পারবেও না (অর্থাৎ জিনিসটা ভালো)

ব্যাখ্যা সম্পাদনা

ধরা যাক কোনো একটা বিষয়ের উপর ভোট গণনা করা হচ্ছে। ক এবং খ-এর মধ্যে যে কোনও একটি বাছাইয়ের সুযোগ আছে। ধরা যাক ৭৫ শতাংশ মানুষ এক্ষেত্রে "ক" পছন্দটি বাছাই করে নিল। এক্ষেত্রে গণতন্ত্র হিসাব করে খ পছন্দকে বাতিল করে দেওয়া হবে। আপাতদৃষ্টিতে এটা সর্বশ্রেষ্ঠ মনে হলেও এটা সঠিক নয়। এক্ষেত্রে যে ২৫ শতাংশ খ সুযোগটিকে বাছাই করেছে, তাদের বক্তব্য শোনা প্রয়োজন এবং বিবেচনা করা প্রয়োজন যে কেন তারা ক পছন্দটিকে বেছে নিলো না। কিন্তু সমাজ বা রাষ্ট্রপরিচালনায় এরকম সংখ্যালঘুদের মতামত বেশিরভাগ সময়েই উপেক্ষিত হয়। ফলশ্রুতিতে ঐতিহাসিকভাবে রাষ্ট্র এবং সভ্যতাকে অনেক সময় সে ভুলের প্রতিদান দিতে হয়।

প্রমাণ সম্পাদনা

  • কেউ দাবী করতে পারে ধূমপান স্বাস্থ্যের জন্য ভালো। এই দাবী হিসাবে সে বলতে পারে কোটি কোটি মানুষ এই ধূমপান করে। কিন্তু তা সত্ত্বেও এই কোটি মানুষের মতামত অগ্রহণযোগ্য এবং সত্যটা হলো ধূমপান স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর।
  • প্রাচীন সমাজে অসংখ্য মানুষ বিশ্বাস করত কিছু মানুষ জাদুচর্চা করে, সেই অপবাদে কিছু মানুষকে অপজাদুর চর্চার অপবাদ দিয়ে পুড়িয়ে মারা হয়েছিল। যদি সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের মতামত উপেক্ষা করে, যাদের বিরুদ্ধে অপবাদ দেওয়া হয়েছিল, তাদের বক্তব্য শোনা হত, তবে এরকম অনৈতিক আচরণ তাদের সাথে করা হত না।
  • গালিলেও গালিলেই বৈজ্ঞানিক উপাত্ত সহকারে সৌরকেন্দ্রিক বিশ্বকে প্রমাণে সক্ষম হলেও তাকে নির্যাতিত হতে হয়েছিল। সেসময়ের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ ভূকেন্দ্রিক ধারণাকে বিশ্বাস করতো, তাই তারা গালিলেওর বক্তব্যকে প্রত্যাখান করে। অথচ আজ এটা প্রতিষ্ঠিত গালিলেওই সঠিক ছিলেন। এখানে সংখ্যাগরিষ্ঠের মতামত নয়, বরং সংখ্যালঘুর মতামতই জয়লাভ করেছে।

তথ্যসূত্র সম্পাদনা

বহিঃসংযোগ সম্পাদনা