জগদীশ ভট্টাচার্য

ভারতীয় কবি

জগদীশ ভট্টাচার্য বা জগদীশচন্দ্র ভট্টাচার্য (২৪ জানুয়ারি ১৯১২ – ৩০ জুন ২০০৭) ছিলেন একজন ভারতীয় বাঙালি কবি, প্রাবন্ধিক ও সমালোচক। [১][২] রবীন্দ্র গবেষক ও বিশেষজ্ঞ হিসাবেও তার পরিচিতি ছিল। [৩]

জগদীশ ভট্টাচার্য
জন্ম(১৯১২-০১-২৪)২৪ জানুয়ারি ১৯১২
লামুয়া গ্রাম শ্রীহট্ট, বেঙ্গল প্রেসিডেন্সি (বর্তমানে বাংলাদেশ)
মৃত্যু৩০ জুন ২০০৭(2007-06-30) (বয়স ৯৫)
কলকাতা পশ্চিমবঙ্গ
ছদ্মনামকলেজ-বয়
পেশাঅধ্যাপনা
ভাষাবাংলা
জাতীয়তাভারতীয়
শিক্ষা প্রতিষ্ঠানসিটি কলেজ, কলকাতা
কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়
উল্লেখযোগ্য পুরস্কারসরোজিনী বসু পদক (১৯৭৮)
শিশিরকুমার ঘোষ পুরস্কার (১৯৮৩)
বিদ্যাসাগর পুরস্কার (২০০০)
দাম্পত্যসঙ্গীমাধুরী মিত্র (বি.১৯৩৪, মৃ. ১৯৯০)
সন্তানরঞ্জন ভট্টাচার্য

জন্ম ও শিক্ষাজীবন সম্পাদনা

জগদীশচন্দ্র ভট্টাচার্যের জন্ম অবিভক্ত বাংলার অধুনা বাংলাদেশের শ্রীহট্টের অধুনা শ্রীমঙ্গল উপজেলার লামুয়া গ্রামে। পিতা যামিনীকান্ত ভট্টাচার্য ও মাতা বরদাসুন্দরী দেবী। জগদীশচন্দ্রের বিদ্যালয়ের পাঠ শুরু হয় শ্রীহট্টের মৌলভীবাজারের সরকারি উচ্চ-ইংরাজী বিদ্যালয়ে। কিশোর বয়সে তিনি রামকৃষ্ণ মিশনের জনসেবা ও দেশহিতকর কাজের ভক্ত হয়ে উঠেছিলেন। দেশসেবার জন্য শরীর শিক্ষায় আগ্রহী হয়ে স্কাউটিংএর জন্য তরুণ সঙ্ঘে যোগ দেন। ১৯৩০ খ্রিস্টাব্দে তিনি চারটি বিষয়ে লেটার মার্কস নিয়ে ম্যাট্রিক পাশ করেন; কিন্তু তাকে সন্ত্রাসবাদী দলের সক্রিয় সদস্য অজুহাতে শিক্ষাবৃত্তি থেকে বঞ্চিত করা হয়। পরবর্তীতে সহায় সম্বলহীন অবস্থায় কলকাতায় এসে, বঙ্গবাসী কলেজের প্রতিষ্ঠাতা কৃষিবিজ্ঞানী আচার্য গিরিশচন্দ্র বসুর অনুগ্রহে বঙ্গবাসী কলেজে ভর্তি হন এবং ছাত্রাবাসে আশ্রয় পান। ১৯৩২ খ্রিস্টাব্দে আই.এসসি এবং ১৯৩৪ খ্রিস্টাব্দে সিটি কলেজ থেকে দর্শনে অনার্সসহ বি.এ পাশ করেন। ১৯৩৬ খ্রিস্টাব্দে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় হতে আধুনিক ভারতীয় ভাষা বিভাগে বাংলায় এম.এ পাশ করেন। [২]

কর্মজীবন সম্পাদনা

১৯৩৭ খ্রিস্টাব্দে তিনি কলকাতার উইমেন্স কলেজে শিক্ষকতার মধ্য দিয়ে কর্মজীবন শুরু করেন। এরপর ১৯৩৮ খ্রিস্টাব্দে একবছর সিটি কলেজে অধ্যাপনা করে বঙ্গবাসী কলেজে যোগ দেন। ১৯৭০ খ্রিস্টাব্দে তিনি বঙ্গবাসী কলেজ অফ কমার্সের অধ্যক্ষ হন এবং ১৯৭৮ খ্রিস্টাব্দে অবসর গ্রহণ করেন। [২]

সাহিত্য ও সংস্কৃতি চর্চা সম্পাদনা

জগদীশচন্দ্র ১৯৪০-এর দশকের প্রথম দিকে রঙ্গ-ব্যঙ্গের কবিতা রচনার মধ্য দিয়ে বাংলা সাহিত্যের জগতে প্রবেশ করেন। অবশ্য তখন তিনি কলেজ-বয় ছদ্মনামটি ব্যবহার করতেন এবং ছদ্মনামেই তার প্রথম কাব্যগ্রন্থ ব্লাকবোর্ড প্রকাশিত হয় ১৯৪১ খ্রিস্টাব্দে। তবে প্রথমদিকে তিনি "বৈজয়ন্তী" নামের একটি মাসিক পত্রিকা সম্পাদনা করতেন। কিন্তু ছয়টি সংখ্যা প্রকাশের পর ১৩৪৬ বঙ্গাব্দের কার্তিক মাসে পত্রিকাটি বন্ধ হয়ে যায়। ১৯৪৬ খ্রিস্টাব্দ হতে বঙ্গবাসী কলেজের ছাত্রাবাসের সহাধ্যক্ষ ও পরে অধ্যক্ষ থাকাকালীন সময়ে তিনি ছাত্রাবাসের তার ঘরটিকে সাহিত্যচর্চার কেন্দ্র করে তুলেছিলেন। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সান্নিধ্য লাভের সঙ্গে তিনি সাহিত্য সাধনা শুরু করেন। তবে রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে তার ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ ঘটে অন্য রকমে। সত্যেন্দ্রনাথ ঠাকুর সম্পাদিত নবরত্নমালা গ্রন্থে কিছু সংস্কৃত শ্লোকের অনুবাদকের নাম ছিল না। অধ্যাপক জগদীশ ভট্টাচার্য অনুবাদের ভাষা বিশ্লেষণ করে তিনি এসম্পর্কে নবরত্নমালায় রবীন্দ্রনাথের কবিতা শিরোনামে একটি গবেষণামূলক নিবন্ধ রচনা করেন, সেখানে তিনি উল্লেখ করেন যে, সেগুলি রবীন্দ্রনাথকৃত অনুবাদ। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বিস্মিত হয়েছিলেন জগদীশচন্দ্রের অসাধারণ বিশ্লেষণের ক্ষমতায়। কবি তার সঙ্গে সাক্ষাৎকার দিয়েছিলেন এক সময় প্রশান্তচন্দ্র মহলানবিশের বাড়িতে। ক্রমে কবির সঙ্গে জগদীশচন্দ্রের ঘনিষ্ঠতা দৃঢ় হয়। আর সেই পরিচয়ের সূত্রে জগদীশচন্দ্র তার বৈজয়ন্তী পত্রিকার জন্য রবীন্দ্রনাথের কিছু লেখা কয়েকটি সংখ্যায় প্রকাশ করতে পেরেছিলেন। কবি জগদীশকে শান্তিনিকেতন পড়াতে প্রস্তাবও দিয়েছিলেন, কিন্তু আর্থিক কারণে সে প্রস্তাব না নেওয়ায় কবির জীবদ্দশায় আর শান্তিনিকেতনে যেতে পারেননি। সেজন্য তিনি পরে আক্ষেপ করেছেন। জগদীশচন্দ্রের রচিত অন্যান্য কাব্যগ্রন্থগুলি হল—

  • অষ্টাদশী (১৯৩৩)
  • প্রেমকে মৃত্যুকে (১৯৬৮)
  • ক্ষণশাশ্বতী (১৯৭১)
  • একটি আলোর পাখি (১৯৭২)
  • লোকায়ত (১৯৭৪)
  • জগদীশচন্দ্রের শ্রেষ্ঠ কবিতা (১৯৯১) প্রভৃতি।

কবি জগদীশচন্দ্র কবি ও কবিতা নামের ত্রৈমাসিক পত্রিকার সম্পাদক ছিলেন। ১৯৬৬ খ্রিস্টাব্দে (১৩৮২ বঙ্গাব্দের মাঘ-চৈত্র, প্রথম সংখ্যা) প্রথম প্রকাশের পর আঠারো বৎসর চলেছিল সেই পত্রিকাটি। কবিতা রচনার পাশাপাশি তিনি বহু প্রবন্ধ, সমালোচনা গ্রন্থ ও কিছুগ্রন্থের সম্পাদনা করেছেন। সেগুলি হল—

  • সনেটের আলোকে মধুসূদন ও রবীন্দ্রনাথ (১৯৬০)
  • কবি মানসী ১ম খণ্ড, ১৯৬২, ২য় খণ্ড ১৯৭১)
  • রবীন্দ্রচিত্তে জনচেতনা
  • বন্দে মাতরম্ (১৯৭৮)
  • চৈতন্য প্রসঙ্গ
  • তারাশঙ্করের গল্পগুচ্ছ
  • বিভূতিভূষণ মুখোপাধ্যায়ের রচনাবলী

বঙ্গবাসী কলেজে অধ্যাপনাকালে ১৯৫৩ খ্রিস্টাব্দে আর্তজনের সেবার উদ্দেশ্যে তিনি কলেজে শরণার্থী সেবাদল নামে একটি সেবাকেন্দ্র স্থাপন করেছিলেন। ওই বছরেই কলেজে স্নাতকোত্তর স্তরের পঠনপাঠন ও গবেষণার জন্য 'আচার্য গিরিশচন্দ্র সংস্কৃতি ভবন' প্রতিষ্ঠিত হয়। জগদীশ ভট্টাচার্য ছিলেন প্রতিষ্ঠানটির প্রাণপুরুষ। বঙ্গবাসী কলেজে স্নাতকোত্তর স্তরের পঠনপাঠনের সূচনা ছিল তার অক্ষয় কীর্তি। সংস্কৃতি ভবনের অধ্যাপকের নিয়ে তিনি 'রবীন্দ্র-নাট্য পরিষদ' নামে একটি নাট্যগোষ্ঠী গড়েন। জগদীশচন্দ্র দীর্ঘ দিন (১৯৮৩-৮৮) বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদের সভাপতি ছিলেন। ১৯৫৪ এবং ১৯৫৮ খ্রিস্টাব্দে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের সেনেট ও অ্যাকাডেমিক কাউন্সিলের নির্বাচিত সদস্য ছিলেন। একজন ভালো বক্তা হিসাবে পরিচিতি ছিল অধ্যাপক ভট্টাচার্যের। [২]

সম্মাননা সম্পাদনা

কবি অধ্যাপক জগদীশ ভট্টাচার্য সাহিত্যকীর্তির জন্য বহু সম্মান, পদক ও পুরস্কারে সম্মানিত হয়েছেন—

জীবনাবসান সম্পাদনা

রবীন্দ্র গবেষক অধ্যাপক জগদীশ ভট্টাচার্য ২০০৭ খ্রিস্টাব্দের ৩০ জুন প্রয়াত হন।[২]


তথ্যসূত্র সম্পাদনা

  1. শিশিরকুমার দাশ (২০১৯)। সংসদ বাংলা সাহিত্যসঙ্গী। সাহিত্য সংসদ, কলকাতা। পৃষ্ঠা ৮১৩। আইএসবিএন 978-81-7955-007-9 
  2. অঞ্জলি বসু সম্পাদিত, সংসদ বাঙালি চরিতাভিধান, দ্বিতীয় খণ্ড, সাহিত্য সংসদ, কলকাতা, জানুয়ারি ২০১৯ পৃষ্ঠা ১৩৫, আইএসবিএন ৯৭৮-৮১-৭৯৫৫-২৯২-৬
  3. "নিল না কলকাতা, শিলচরে দুই অধ্যাপকের গ্রন্থসংগ্রহ"। সংগ্রহের তারিখ ২০২২-১১-০৯