ছোট সোনা মসজিদ
ছোট সোনা মসজিদ বাংলাদেশের অন্যতম প্রাচীন মসজিদ। প্রাচীন বাংলার রাজধানী গৌড় নগরীর উপকণ্ঠে পিরোজপুর গ্রামে এ স্থাপনাটি নির্মিত হয়েছিল, যা বর্তমানে বাংলাদেশের রাজশাহী বিভাগের চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলার শিবগঞ্জ থানার অধীনে পড়েছে। সুলতান আলাউদ্দিন হুসেন শাহ এর শাসনামলে (১৪৯৪-১৫১৯ খ্রিষ্টাব্দে) ওয়ালি মোহাম্মদ আলি নামে এক ব্যক্তি এই মসজিদ নির্মাণ করেছিলেন।[১] মসজিদের মাঝের দরজার উপর প্রাপ্ত এক শিলালিপি থেকে এ তথ্য জানা যায়। তবে শিলালিপিতে নির্মানের সঠিক তারিখ সম্বলিত অক্ষরগুলি মুছে যাওয়ায় নির্মাণকাল জানা যায় নি। এটি কোতোয়ালী দরজা থেকে মাত্র ৩ কি.মি. দক্ষিণে। মসজিদটি মুসলিম স্থাপত্যের অন্যতম নিদর্শন। এটি হোসেন-শাহ স্থাপত্য রীতিতে তৈরি।
ছোট সোনা মসজিদ | |
---|---|
![]() ছোট সোনা মসজিদের সম্মুখ প্রান্ত | |
ধর্ম | |
অন্তর্ভুক্তি | ইসলাম |
জেলা | চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলা |
পবিত্রীকৃত বছর | ১৪৯৩ এবং ১৫১৯ এর মধ্যে |
অবস্থা | সক্রিয় |
অবস্থান | |
অবস্থান | চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলা, বাংলাদেশ |
দেশ | ![]() |
স্থানাঙ্ক | ২৪°৪৮′৪৯″ উত্তর ৮৮°০৮′৩৬″ পূর্ব / ২৪.৮১৩৭° উত্তর ৮৮.১৪৩২° পূর্ব |
স্থাপত্য | |
স্থাপত্য শৈলী | হোসেন-শাহ স্থাপত্য রীতি |
প্রতিষ্ঠাতা | ওয়ালী মোহাম্মদ |
নির্দিষ্টকরণ | |
দৈর্ঘ্য | ৮২ ফুট |
প্রস্থ | ৫২.৫ ফুট |
গম্বুজসমূহ | ১৫ |
উপাদানসমূহ | পাথর, ইট, টেরাকোটা ও টাইল |
স্থাপত্য |
তালিকা |
স্থাপত্য শৈলী |
মসজিদের তালিকা |
অন্যান্য |
তালিকা |
নামকরণসম্পাদনা
ছোট সোনামসজিদ ‘সুলতানি স্থাপত্যের রত্ন’ বলে আখ্যাত।[২] এর বাইরের দিকে সোনালি রং এর আস্তরণ ছিল, সূর্যের আলো পড়লে এ রং সোনার মতো ঝলমল করত। প্রাচীন গৌড়ে আরেকটি মসজিদ ছিল যা বড় সোনা মসজিদ নামে পরিচিত। এটি তৈরি করেছিলেন সুলতান নুসরত শাহ। সেটি ছিল আরও বড়। তাই স্থানীয় লোকজন এটিকে ছোট সোনা মসজিদ বলে অবহিত করতো, আর গৌড় নগরীর মসজিদটিকে বলতো বড় সোনা মসজিদ।[৩]
বহির্ভাগসম্পাদনা
মসজিদটি উত্তর-দক্ষিণে ৮২ ফুট লম্বা ও পূর্ব-পশ্চিমে ৫২.৫ ফুট চওড়া। উচ্চতা ২০ ফুট। এর দেয়ালগুলো প্রায় ৬ ফুট পুরু। দেয়ালগুলো ইটের কিন্তু মসজিদের ভেতরে ও বাইরে এরা পাথর দিয়ে ঢাকা। তবে ভেতরের দেয়ালে যেখানে খিলানের কাজ শুরু হয়েছে, সেখানে পাথরের কাজ শেষ হয়েছে। মসজিদের খিলান ও গম্বুজগুলো ইটের তৈরি।
মসজিদের চারকোণে চারটি বুরুজ আছে। এগুলোর ভূমি নকশা অষ্টকোণাকার। বুরুজগুলোতে ধাপে ধাপে বলয়ের কাজ আছে। বুরুজগুলোর উচ্চতা ছাদের কার্নিশ পর্যন্ত।
মসজিদের পুব দেয়ালে পাঁচটি খিলানযুক্ত দরজা আছে। খিলানগুলো বহুভাগে বিভক্ত। এগুলো অলংকরণে সমৃদ্ধ। উত্তর ও দক্ষিণ দেয়ালে আছে তিনটি করে দরজা। তবে উত্তর দেয়ালের সর্ব-পশ্চিমের দরজাটির জায়গায় রয়েছে সিঁড়ি। এই সিঁড়িটি উঠে গেছে মসজিদের অভ্যন্তরে উত্তর-পশ্চিম দিকে দোতলায় অবস্থিত একটি বিশেষ কামরায়। কামরাটি পাথরের স্তম্ভের উপর অবস্থিত। মসজিদের গঠন অনুসারে এটিকে জেনানা-মহল বলেই ধারণা করা হয়। তবে অনেকের মতে এটি জেনানা-মহল ছিল না, এটি ছিল সুলতান বা শাসনকর্তার নিরাপদে নামাজ আদায়ের জন্য আলাদা করে তৈরি একটি কক্ষ, অর্থাৎ বাদশাহ্-কা-তাখত্।
অন্তর্ভাগসম্পাদনা
মসজিদটির অভ্যন্তরভাগ কালো ব্যাসাল্টের ৮টি স্তম্ভ দ্বারা উত্তর দক্ষিণে তিনটি আইল ও পূর্ব-পশ্চিমে পাঁচটি সারিতে বিভক্ত। এই পাঁচটি সারির মাঝের সারিটি ১৪'৫" চওড়া, বাকি সারিগুলো ১১'৪" চওড়া। পুব দেয়ালের পাঁচটি দরজা বরাবর মসজিদের অভ্যন্তরে রয়েছে পাঁচটি মিহরাব। এদের মধ্যে মাঝেরটি আকারে বড়। প্রতিটির নকশাই অর্ধ-বৃত্তাকার। মিহরাবগুলোতে পাথরের উপর অলংকরণ রয়েছে। সর্ব উত্তরের মিহরাবটির উপরে দোতলার কামরাটিতেও একটি মিহরাব রয়েছে।
মসজিদের অভ্যন্তরের ৮টি স্তম্ভ ও চারপাশের দেয়ালের উপর তৈরি হয়েছে মসজিদের ১৫টি গম্বুজ। মাঝের মিহরাব ও পূর্ব দেয়ালের মাঝের দরজার মধ্যবর্তী অংশে ছাদের উপর যে গম্বুজগুলো রয়েছে সেগুলো বাংলা চৌচালা গম্বুজ। এদের দুপাশে দুসারিতে তিনটি করে মোট ১২টি গম্বুজ রয়েছে। এরা অর্ধ-বৃত্তাকার গম্বুজ। এ মসজিদের অন্যতম বৈশিষ্ট্য হল, বাইরের যে কোনো পাশ থেকে তাকালে কেবল পাঁচটি গম্বুজ দেখা যায়, পেছনের গম্বুজগুলো দৃষ্টিগোচর হয় না।
অলংকরণসম্পাদনা
পুরো মসজিদের অলংকরণে মূলত পাথর, ইট, টেরাকোটা ও টাইল ব্যবহার করা হয়েছে। এদের মাঝে পাথর খোদাই এর কাজই বেশি। মসজিদের সম্মুখভাগ, বুরুজসমূহ, দরজা প্রভৃতি অংশে পাথরের উপর অত্যন্ত মিহি কাজ রয়েছে, যেখানে লতাপাতা, গোলাপ ফুল, ঝুলন্ত শিকল, ঘণ্টা ইত্যাদি খোদাই করা আছে। ফ্যাসাদগুলোতে দুই সারিতে প্যানেলের কাজ রয়েছে, নিচেরগুলো উপরের প্যানেলগুলোর চাইতে আকারে বড়। দরজাগুলোর মাঝের অংশে এই প্যানেলগুলো অবস্থিত। দরজাগুলো অলংকরণযুক্ত চতুষ্কোণ ফ্রেমে আবদ্ধ। খিলানগুলো পাথর খোদাই এর অলংকরণযুক্ত। দুটি খিলানের মধ্যভাগেও পাথরের অলংকরণ রয়েছে। মাঝের দরজাটির উপরে একটি শিলালিপি পাওয়া যায়। ক্রেইটন ও কানিংহামের বর্ণনা থেকে জানা যায়, একসময় বাইরের দিকে পুরো মসজিদটির উপর সোনালি রঙের আস্তরণ ছিল, মতান্তরে কেবল গম্বুজগুলোর ওপর। গম্বুজগুলোর অভ্যন্তরভাগ টেরাকোটা সমৃদ্ধ।
অপরাপর স্থাপনা সমূহসম্পাদনা
- মূল মসজিদের আঙিনায় ঢোকার পথে একটি তোরণ আছে। এর বাইরের দিকটি পাথর দিয়ে ঢাকা ছিল। এটি ২.৪ মিটার চওড়া। উচ্চতা ৭.৬ মিটার। তোরণটি মসজিদের মাঝের দরজা বরাবর অবস্থিত।
- তোরণের সামান্য পুবে বাঁধানো মঞ্চের ওপর উত্তর-দক্ষিণ বরাবর দুটো কবর রয়েছে। দুটি কবরই কালো পাথরের উপরে উঠে যাওয়া সিঁড়িসদৃশ স্তরযুক্ত, সবচেয়ে উঁচুতে যে স্তরটি রয়েছে তা ব্যারেল আকৃতির। এতে পবিত্র কুরআন শরিফের কিছু আয়াত ও আল্লাহর নাম লেখা রয়েছে। কবর দুটো কার তা জানা যায় না, তবে ধারণা করা হয় নির্মাতা ওয়ালি মোহাম্মদ ও তাঁর স্ত্রীর। আবার কানিংহ্যামের অনুমান অনুসারে এ দুটি ছিল ওয়ালি মোহাম্মদ ও তাঁর পিতা আলির। মঞ্চটি পূর্ব-পশ্চিমে ৬.২ মিটার ও উত্তর-দক্ষিণে ৪.২ মিটার চওড়া। উচ্চতা ১ মিটার। এর চার কোণে পাথরের চারটি কলাম রয়েছে।[তথ্যসূত্র প্রয়োজন]
- মূল মসজিদের উত্তর দিকে একটি দিঘি রয়েছে, এককালে এতে বাঁধানো ঘাট ছিল।
- বর্তমানে স্থাপনাটির দক্ষিণ-পূর্ব দিকে দুটো কবর রয়েছে, ১.৩ মিটার উঁচু একটি পাচিল দিয়ে ঘেরা। এ কবর দুটো ক্যাপ্টেন মহিউদ্দীন জাহাঙ্গীর ও মেজর নাজমুল হক টুলুর। এঁরা দুজনেই ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে মৃত্যুবরণ করেন।[৪]
আরও দেখুনসম্পাদনা
তথ্যসূত্রসম্পাদনা
- ↑ "Chhota Sona Masjid. Gaur"। Bangladesh.com (ইংরেজি ভাষায়)। সংগ্রহের তারিখ ২০২২-০৩-০৯।
- ↑ চক্রবর্তী, রজনীকান্ত (জানুয়ারি ১৯৯৯)। গৌড়ের ইতিহাস (PDF) (1 & 2 সংস্করণ)। বঙ্কিম চ্যাটার্জি স্ট্রীট, কলকাতা ৭০০ ০৭৩: দেব'স পাবলিশিং।[স্থায়ীভাবে অকার্যকর সংযোগ]
- ↑ সালাউদ্দিন, মোহাম্মদ (২৬ মার্চ ২০১০)। "ছোট সোনা মসজিদ"। গৌড়বঙ্গ ও চাঁপাইনবাবগঞ্জ এর প্রাচীন নিদর্শন (২য় সংস্করণ)। ঢাকা: জাতীয় সাহিত্য পরিষদ। পৃষ্ঠা ১০১।
- ↑ "শিবগঞ্জ উপজেলা, বীরশ্রেষ্ঠ শহীদ ক্যাপ্টেন মহিউদ্দিন জাহাঙ্গীরের সমাধি, বাংলাদেশ জাতীয় তথ্য বাতায়ন"। ২২ আগস্ট ২০২১ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ২২ আগস্ট ২০২১।
আরো পড়ুনসম্পাদনা
- Husain, A. B. M (২০০৭)। Architecture: a history through the ages (ইংরেজী ভাষায়)। Dhaka: Asiatic Society of Bangladesh। এলসিসিএন 2008419298। ওসিএলসি 298612818।
- Ahmed, Abu Sayeed M. (২০০৬)। Mosque architecture in Bangladesh। Syed Zakir Hossain। Dhaka: UNESCO Dhaka। পৃষ্ঠা ১০২। আইএসবিএন 984-32-3469-3। ওসিএলসি 232358372।
- The Islamic heritage of Bengal। George Michell, Unesco। Paris: Unesco। ১৯৮৪। আইএসবিএন 92-3-102174-5। ওসিএলসি 11631329।
- মোহাম্মদ যাকারিয়া, আবুল কালাম (২০১২)। বাংলাদেশের প্রাচীন কীর্তি: মুসলিম যুগ (২য় খণ্ড)। ঢাকা: দিব্য প্রকাশ। আইএসবিএন 9789848830734।