ছিন্নমূল

নিমাই ঘোষ পরিচালিত বাংলা চলচ্চিত্র

ছিন্নমূল ১৯৫০ খ্রিস্টাব্দে মুক্তিপ্রাপ্ত বিমল দে প্রযোজিত ও নিমাই ঘোষ পরিচালিত বাংলা চলচ্চিত্র[১][২] দেসা পিকচার্সের এই চলচ্চিত্র পূর্ববঙ্গের বাস্তুহারা মানুষের দুঃখ-দুর্দশাকে জলজ্যান্ত ভাবে ফুটিয়ে তুলেছে।[৩] এটিই প্রথম ভারতীয় চলচ্চিত্র যা ভারত বিভাজনকে ভিত্তি করে নির্মিত হয়েছিল। ছিন্নমূল চলচ্চিত্রকে ভারতের প্রথম নব্য বাস্তববাদী চলচ্চিত্র হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়।[৪] বিখ্যাত রাশিয়ান চলচ্চিত্র পরিচালক ভেসেভলড পুডোভকিন সেই সময় কলকাতায় এই চলচ্চিত্রটি দেখেছিলেন। ছবিটি দেখে তিনি এতটাই মুগ্ধ হন যে ভারত সরকারের অনুমুতি নিয়ে চলচ্চিত্রটি রাশিয়ায় প্রকাশের জন্য এই ছবির প্রিন্ট কিনেছিলেন। সেইসময়ে চলচ্চিত্রটি রাশিয়ার ১৮১টি প্রেক্ষাগৃহে প্রদর্শিত হয়[৫] এবং সেখানকার দর্শক-সমালোচকমন্ডলী দ্বারা বিশেষ প্রশংসা লাভ করে।[৬] যদিও পশ্চিমবঙ্গের আপামর জনসাধারণের কাছে চলচ্চিত্রটি সমাদৃত না হওয়ায় এটি বাণিজ্যিকভাবে সফল হয়নি।[৭]

ছিন্নমূল
ছিন্নমূল চলচ্চিত্রের পোস্টার
পরিচালকনিমাই ঘোষ
প্রযোজকবিমল দে
চিত্রনাট্যকারনিমাই ঘোষ
কাহিনিকারস্বর্ণকমল ভট্টাচার্য
শ্রেষ্ঠাংশে
সুরকারকলাবরণ দাস
নৃপেন পাল
চিত্রগ্রাহকনিমাই ঘোষ (পরিকল্পনায়)
বিশ্বনাথ গাঙ্গুলী
সম্পাদকগোবর্দ্ধন অধিকারী
প্রযোজনা
কোম্পানি
দেসা পিকচার্স
পরিবেশকইউনিয়ন ডিস্ট্রিবিউটরস
মুক্তি১৯৫০ খ্রিস্টাব্দ (ভারত)
স্থিতিকাল১১৭ মিনিট
দেশভারত
ভাষাবাংলা

শ্রেষ্ঠাংশে সম্পাদনা

কাহিনী সংক্ষেপ সম্পাদনা

পূর্ববঙ্গের একটি ছোট্ট গ্রাম নলডাঙ্গা। গ্রামবাসীদের বেশিরভাগই কামার, কুমোর, ছুতোর, গোয়ালা প্রভৃতি জাত-বৃত্তিজীবী মানুষ। যুদ্ধ, মন্বন্তর, মহামারী বিভিন্ন বিপর্যয়ে তারা কাবু হলেও হার মানেনি। সেখানকারই যুবক ছেলে শ্রীকান্ত তার স্বভাব-গুণে গ্রামের মোড়ল হয়েছে। সবরকম বিপদেই মানুষ তার পরামর্শ নেয়। নববিবাহিত শ্রীকান্ত তার পত্নী বাতাসীকে নিয়ে আর্থিক সঙ্কটের মধ্যে দিয়ে দিন কাটালেও মনে মনে এক সুখের সংসার গড়ার অস্ফুট আনন্দে বিভোর হয়ে থাকে।

এরই মধ্যে কূটনৈতিক প্রভাব ও রাজনৈতিক ঝরে বাংলা দ্বিখন্ডিত হয়। দাঙ্গা, গুজব ও আতঙ্কে পার্শ্ববর্তী হিন্দু প্রধান পলাশডাঙ্গা ও তালপুকুরের অধিকাংশ মানুষই সাতপুরুষের ভিটে ছেড়ে চলে যেতে শুরু করে। কাছেপিঠের আরো কিছু গ্রামে ভাঙ্গন ধরলে শেষে সেই হিড়িক নলডাঙ্গায় আসে। গ্রামের দুই দুষ্ট-মতলবি মধু গাঙ্গুলি ও মোজাফফর‍্ খাঁ নিঃস্ব চাষীদের জমিজমা কুক্ষিগত করে এবং মিথ্যা মামলায় গাঁয়ের প্রিয়পাত্র শ্রীকান্তকে জেলে পাঠায়। তারা গ্রামের মানুষকে ভিটে ছেড়ে কলকাতায় চলে যাওয়ার জন্য উস্কানি দিতে থাকলে গ্রামের বয়োজ্যেষ্ঠ বিশু ঠাকুর প্রথমে সবাইকে অভয়দান করলেও পরে তিনিও বিচলিত হয়ে পড়েন। বাস্তুত্যাগের প্রস্তুতি শুরু হলে সকলে মোজাফফর‍্ খাঁয়েদের কাছে জলের দামে ঘরদোর বিক্রি করে দিতে থাকে। কিন্তু বাতাসী তার স্বামীর অনুপস্থিতিতে কিছুতেই শ্বশুরের ভিটে বিক্রি করতে রাজি হয়না। বিষণ্ণমনে একদিন বিশু ঠাকুর, বাতাসী, প্রসন্ন, মঙ্গলা সহ কুড়ি-বাইশ জনের এক দল কলকাতার উদ্দেশ্যে যাত্রার প্রস্তুতি নেয়। দৃশ্যে দেখা যায় গ্রামের এক বৃদ্ধার ঘরের খুঁটি আঁকড়ে ধরে মর্মস্পর্শী নিষ্ফলা কান্না। সকলে মিলে অনেক করে বোঝালে, গঙ্গাস্নানের লোভ দেখালেও বৃদ্ধা ভিটে ছেড়ে যেতে চায় না। বৃদ্ধার একই কথা- ‘তরা যা, আমি যামু না’[৮] শেষে অদৃষ্টের দিকে চেয়ে বৃদ্ধাকে নিয়ে সকলে কলকাতার অভিমুখে গমন করে।

ট্রেনের অসম্ভব ভিড়ে দুর্ভোগ সহ্য করতে করতে শিয়ালদহ স্টেশনে আসার পর অস্থায়ী আশ্রয়-শিবির দেখেই তারা অন্ধকার ভবিষ্যতের কথা আঁচ করতে পারে। কোনো রকমে মাথা গোঁজার স্থান যোগাড় করে পুরুষেরা কাজের খোঁজ করতে থাকে। চার মাস হতে চলেছে, তারা কোনো কাজই জোগাড় করতে পারে না। এদিকে আসন্নপ্রসবা বাতাসীকে নিয়ে তাদের চিন্তার শেষ নেই। অবশেষে একটি ফাঁকা বাড়ির সন্ধান পেলে তারা সেখানে গিয়ে ওঠে। ওদিকে শ্রীকান্ত জেল থেকে ছাড়া পেয়ে দেখে বাস্তুভিটার শূন্য অবস্থা। রওনা দেয় কলকাতায়। বিভিন্ন আশ্রয় শিবিরে সন্ধান করতে করতে একদিন নলডাঙ্গার দলের খোঁজ মেলে। জানতে পারে যে বাতাসী এক পুত্র সন্তানের জন্ম দিয়েছে, তবে তার শরীরের অবস্থা ভালো নয়। শ্রীকান্তকে দেখা মাত্র বাতাসী উল্লাসে উদ্বেল হয়ে পরে। এই সময় বাড়ির মালিক ফিরে এলে নলডাঙ্গাবাসীদের সঙ্গে তাদের বচসা শুরু হয়। শ্রীকান্ত নীচে আসে। বাড়িওয়ালাদের সঙ্গে কথা বলতে বলতেই দোতলা থেকে মঙ্গলার বুকফাটা কান্না ভেসে আসে। বাতাসী মারা গেছে। শ্রীকান্ত, প্রসন্ন, বিশু ঠাকুর ঘরে ঢুকে নিশ্চল পাষানের মতো দাঁড়িয়ে থাকে। মর্মান্তিক নিঃশব্দতা ভেঙে নবজাত শিশু কেঁদে উঠলে শ্রীকান্ত অদৃষ্টের দিকে তাকিয়ে ছেলেকে কোলে তুলে নেয়।[৯]

পর্যালোচনা সম্পাদনা

ভি. আই. পুডোভকিন চলচ্চিত্রটি সম্পর্কে লিখেছেন- ‘‘বাস্তব জীবনের সংস্পর্শে শিল্প কীভাবে তৎক্ষণাৎ এক নতুন আঙ্গিকের জন্ম দেয় তা দেখে সত্যিই অবাক হতে হয়। যদিও সমস্ত ভারতীয় চলচ্চিত্রের মতো এই ছবিটিও দীর্ঘ কথোপকথন দ্বারা পরিপূর্ণ, তবুও এটি অন্যান্য চলচ্চিত্রের চেয়ে অনেক বেশি মনোমুগ্ধকর গতিশীলতা পেয়েছে।’’[১০] দ্য নিউইয়র্ক টাইমস পত্রিকায় জনাথন ক্রো এই চলচ্চিত্রটিকে ‘‘ইতালিও নব্য বাস্তববাদী চলচ্চিত্রের চেয়ে ভিন্ন স্বাদের এক নতুন আঙ্গিকের চলচ্চিত্র’’ বলে অভিহিত করেছেন।[১১] চলচ্চিত্রটি বিদেশ থেকে প্রচুর প্রশংসা পেলেও বাংলায় ছবিটি বাণিজ্যিকভাবে সফল না হওয়ার কারণ ব্যাখ্যা করতে গিয়ে মৃণাল সেন পরিচয় পত্রিকায় চলচ্চিত্রটির অসঙ্গতিপূর্ণ বিবরণ ও উপস্থাপনাকে সমালোচনা করেন।[১২]

তথ্যসূত্র সম্পাদনা

  1. Britannica। Student Britannica India 7 Vols (ইংরেজি ভাষায়)। Popular Prakashan। পৃষ্ঠা 101। আইএসবিএন 978-0-85229-762-9 
  2. Ruberto, Laura E.; Ruberto, Laura E.; Wilson, Kristi M.; Wilson, Kristi M. (২০০৭)। Italian Neorealism and Global Cinema (ইংরেজি ভাষায়)। Wayne State University Press। পৃষ্ঠা 81। আইএসবিএন 978-0-8143-3324-2 
  3. Jonathan Crow (২০১৩)। "The Uprooted (1950)"। Movies & TV Dept.। The New York TimesBaseline & All Movie Guide। ১০ মে ২০১৩ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ৩ আগস্ট ২০১২ 
  4. Roy, Anjali Gera; Bhatia, Nandi (২০০৮)। Partitioned Lives: Narratives of Home, Displacement, and Resettlement (ইংরেজি ভাষায়)। Pearson Education India। পৃষ্ঠা 68। আইএসবিএন 978-81-317-1416-4 
  5. imagineindia (২০২০-০৪-২৪)। "Chinnamul: The first indian attempt at neo-realism" (ইংরেজি ভাষায়)। সংগ্রহের তারিখ ২০২১-০৪-২২ 
  6. Rajagopalan, Sudha। "'In our grey lives, we happened into a fantasy world': Why the Soviet Union fell for Indian cinema"Scroll.in (ইংরেজি ভাষায়)। সংগ্রহের তারিখ ২০২১-০৪-২২ 
  7. Menon, Jisha (২০১৩)। The Performance of Nationalism: India, Pakistan, and the Memory of Partition (ইংরেজি ভাষায়)। Cambridge University Press। পৃষ্ঠা 58। আইএসবিএন 978-1-107-00010-0 
  8. সেন, মৃণাল (১৯৮৪)। মুখোপাধ্যায়, মলয়রঞ্জন; মিত্র, নন্দন, সম্পাদকগণ। "বাংলা সিনেমার দর্শক ও ছিন্নমূল"চিত্রাভাষ। কলকাতা: নর্থ ক্যালকাটা ফিল্ম সোসাইটি: ২১। 
  9. "দেসা পিকচার্সের চিত্র ছিন্নমূল: বাস্তুহারা জীবনের আলেখ্য - প্রচার পুস্তিকা (১৯৫১)" (পিডিএফ)bn.wikisource.org। সংগ্রহের তারিখ ২০২১-০৪-২৪ 
  10. Pudovkin, Vsevolod Illarionovich (১৯৭৪)। Sobranie sochineniĭv trekh tomakh (রুশ ভাষায়)। Iskusstvo। পৃষ্ঠা ৩১৮–৩১৯। 
  11. "The-Uprooted - Trailer - Cast - Showtimes - NYTimes.com"movies.nytimes.com। ২০১৩-০৫-১০ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ২০২১-০৪-৩০ 
  12. Rajadhyaksha, Ashish; Willemen, Paul (২০১৪-০৭-১০)। Encyclopedia of Indian Cinema (ইংরেজি ভাষায়)। Routledge। পৃষ্ঠা ৩১৭। আইএসবিএন 978-1-135-94318-9 

বহিঃসংযোগ সম্পাদনা