চৈতন্যভাগবত প্রসিদ্ধ বৈষ্ণব সন্তকবি বৃন্দাবন দাস ঠাকুর (১৫০৭–১৫৮৯ খ্রিষ্টাব্দ) রচিত চৈতন্য মহাপ্রভুর একটি জীবনীগ্রন্থ। এটি বাংলা ভাষায় রচিত চৈতন্য মহাপ্রভুর প্রথম পূর্ণাঙ্গ জীবনী। এই গ্রন্থে চৈতন্যদেবের প্রথম জীবন এবং গৌড়ীয় বৈষ্ণবধর্মের প্রবর্তকরূপে তার ভূমিকার বিস্তারিত বিবরণ রয়েছে। গ্রন্থে রাধাকৃষ্ণের যুগ্ম অবতাররূপে গৌড়ীয় বৈষ্ণব ভক্তসমাজে প্রচলিত চৈতন্যদেবের অবতারতত্ত্বেরও ধর্মীয় ব্যাখ্যা প্রদান করা হয়েছে। বৃন্দাবন দাস ঠাকুরের গুরু তথা চৈতন্যদেবের প্রধান পার্ষদ নিত্যানন্দ চৈতন্যজীবনীরূপে চৈতন্যভাগবত গ্রন্থটিকে অনুমোদন করেন।

নামকরণ সম্পাদনা

চৈতন্যভাগবত গ্রন্থের আদি নাম ছিল চৈতন্যমঙ্গল। কিন্তু পরে জানা যায় যে কবি লোচন দাসও এই নামের একটি চৈতন্যজীবনী রচনা করেছেন। তখন বৈষ্ণব সমাজের গণ্যমান্য পণ্ডিতগণ বৃন্দাবনে একত্রিত হয়ে সিদ্ধান্ত নেন যে বৃন্দাবন দাস ঠাকুরের গ্রন্থটির নাম হবে চৈতন্যভাগবত এবং লোচন দাসের গ্রন্থটিই চৈতন্যমঙ্গল নামে পরিচিত হবে।

খণ্ড সম্পাদনা

 
চৈতন্য মহাপ্রভু (১৪৮৬-১৫৩৪ খ্রিস্টাব্দ)

চৈতন্যভাগবত তিনটি খণ্ডে বিভক্ত: আদিখণ্ড, মধ্যখণ্ডঅন্ত্যখণ্ড:

আদিখণ্ড

আদিখণ্ডে পনেরোটি অধ্যায় রয়েছে। এই খণ্ডের উপজীব্য বিষয় হল: চৈতন্য মহাপ্রভুর আবির্ভাবের পূর্বে বাংলার সামাজিক ও ধর্মীয় অবস্থা, চৈতন্যদেবের জন্ম, শিক্ষা, ও লক্ষ্মীপ্রিয়ার সহিত বিবাহ; তার তর্কযুদ্ধে পণ্ডিতদের পরাস্তকরণ, পূর্ববঙ্গ ভ্রমণ, লক্ষ্মীপ্রিয়ার মৃত্যু, গয়া ভ্রমণ এবং ঈশ্বর পুরীর নিকট দীক্ষাগ্রহণ

মধ্যখণ্ড

মধ্যখণ্ডে ছাব্বিশ টি অধ্যায় রয়েছে। এই খণ্ডের উপজীব্য বিষয় হল: চৈতন্য মহাপ্রভুর হৃদয়ে ভক্তির উদয়, ভক্তিধর্ম প্রচারের উদ্দেশ্যে তার সঙ্গে তার অনুগামীদের যোগদান, দুষ্ট জগাই ও মাধাইয়ের সঙ্গে কথোপকথন, স্থানীয় শাসক চাঁদ কাজী কৃষ্ণনাম প্রচার নিষিদ্ধ করলে চৈতন্যদেবের আইন অমান্য আন্দোলন (কাজীদলন)।

অন্ত্যখণ্ড

অন্ত্যখণ্ডে রয়েছে দশটি অধ্যায়। এই খণ্ডের মূল উপজীব্য: চৈতন্যদেবের সন্ন্যাসগ্রহণ, শচীমাতার বিলাপ, পুরী ভ্রমণ, ন্যায়শাস্ত্রবিদ সার্বভৌম ভট্টাচার্যের সহিত আলাপ এবং নানা ভক্তের সঙ্গে তার সম্পর্ক ও আলাপআলোচনা।

চৈতন্যভাগবত গ্রন্থের দুটি পুথিতে অন্ত্যখণ্ড-এর শেষে আরও তিনটি অতিরিক্ত অধ্যায় পাওয়া যায়। আধুনিক গবেষকগণ এই অধ্যায়গুলিকে মূল গ্রন্থের অন্তর্ভুক্ত মনে করেন না।[১]

গুরুত্ব সম্পাদনা

চৈতন্যচরিতামৃত গ্রন্থের মতো চৈতন্যভাগবত গ্রন্থেও চৈতন্য মহাপ্রভুকে কেবলমাত্র এক সাধারণ অবতার রূপে না দর্শিয়ে ভগবানরূপী কৃষ্ণের প্রত্যক্ষ অবতার রূপে দর্শানো হয়েছে। গ্রন্থকারের মতে, চৈতন্য অবতারের উদ্দেশ্য ছিল বর্তমান কলিযুগের যুগ-ধর্ম (হরিনাম-সংকীর্তন) প্রবর্তনের মাধ্যমে মানবজাতির কল্যাণ। নিজ নাম প্রচার সম্পর্কে চৈতন্যদেব বলেছেন, পৃথিবী-পর্যন্ত যত আছে দেশ-গ্রাম / সর্বত্র সঞ্চার হইবেক মোর নাম। [২] চৈতন্যদেবের সত্যরূপ ও অবতারগ্রহণের উদ্দেশ্য ব্যাখ্যার জন্য গৌড়ীয় বৈষ্ণব সমাজে বৃন্দাবন দাস চৈতন্য-সমকালের ব্যাসদেব নামে পরিচিত।

কৃষ্ণদাস কবিরাজের চৈতন্যচরিতামৃত ধর্মীয় তত্ত্বব্যাখ্যায় ভারাক্রান্ত। সেই তুলনায় চৈতন্যভাগবত অনেক সহজবোধ্য। চরিতামৃতে কৃষ্ণদাস চৈতন্যজীবনীর যে বর্ণনা দিয়েছেন তা পাণ্ডিত্যপূর্ণ ও ধর্মতাত্ত্বিক। উক্ত গ্রন্থে চৈতন্যদেবের পুরীবাসের বছরগুলির উপর অধিক গুরুত্ব আরোপিত হয়। এই জন্য চৈতন্যচরিতামৃতচৈতন্যভাগবত গ্রন্থদুটি একযোগে চৈতন্য মহাপ্রভুর জীবন ও শিক্ষার এক পূর্ণাঙ্গ বিবরণী। যদিও পরবর্তীকালে আরও অনেকেই চৈতন্যজীবনী রচনায় প্রবৃত্ত হয়েছিলেন।[৩]

গবেষকদের মতে ১৫৪০-এর দশকের মধ্যভাগে বৃন্দাবন দাস চৈতন্যভাগবত গ্রন্থটি রচনা করেছিলেন।

পাদটীকা সম্পাদনা

  1. সুকুমার সেন (২০০৭). বাঙ্গালা সাহিত্যের ইতিহাস, প্রথম খণ্ড, কলকাতা: আনন্দ পাবলিশার্স, আইএসবিএন ৮১-৭০৬৬-৯৬৬-৯, p.269
  2. চৈতন্যভাগবত, অন্ত্যখণ্ড ৪।১২৬
  3. "Vedic Encyclopedia, Library"। ১৭ জুন ২০১০ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ১০ ডিসেম্বর ২০০৯ 

তথ্যসূত্র সম্পাদনা