চাকমা সার্কেল (চাকমা: 𑄌𑄇𑄴𑄟𑄳𑄦 𑄥𑄢𑄴𑄇𑄬𑄣𑄴), যা চাকমা রাজ নামেও পরিচিত, বাংলাদেশের পার্বত্য চট্টগ্রামের তিনটি বংশগত রাজতান্ত্রিক ব্যবস্থার (বা "সার্কেলের") একটি।[] চাকমা সার্কেল রাঙামাটি জেলা এবং খাগড়াছড়ি জেলার দীঘিনালাবান্দরবান জেলার রাজস্থলী উপজেলার অংশ জুড়ে বিস্তৃত। এই রাজতান্ত্রিক ব্যবস্থার সদস্যরা চাকমা বংশোদ্ভূত

চাকমা সার্কেল
চাকমা সার্কেল লোগো
পূর্বসূরীরাজা ত্রিদিব রায়
সদরদপ্তররাঙ্গামাটি পার্বত্য জেলা
অবস্থান
  • বাংলাদেশ
যে অঞ্চলে
পার্বত্য চট্টগ্রাম
রাজা
রাজা দেবাশীষ রায়

নেতৃত্ব

সম্পাদনা

চাকমা সার্কেল একজন বংশগত প্রধান যাকে রাজা নামে অভিহিত করা হয় তার নেতৃত্বে পরিচালিত হয়, যার ভূমিকা বিচারিক, প্রশাসনিক, আনুষ্ঠানিক, আইনগত এবং সামাজিক দায়িত্বে বিস্তৃত। রাজনৈতিক ক্ষমতা পিতার কাছ থেকে বড় ছেলের কাছে উত্তরাধিকারসূত্রে হস্তান্তর হয়।[]

বর্তমান প্রধান (রাজা) হলেন দেবাশীষ রায় (জন্ম: ১০ এপ্রিল ১৯৫৯), যিনি চাকমা বিজক অনুযায়ী এই পদে রয়েছেন। চাকমা বিজক হল ১৮৭৬-১৯৩৪ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত চাকমা ইতিহাসের একটি সংকলন। চাকমা প্রধান পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা পরিষদ এবং রাঙামাটি পার্বত্য জেলা পরিষদের সদস্য হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেন।[] চাকমা প্রধান রাজপুণ্যাহ উৎসবেরও নেতৃত্ব দেন।[]

ইতিহাস

সম্পাদনা

ঔপনিবেশিক যুগের পূর্ববর্তী সময়

সম্পাদনা

চাকমা প্রধানদের বংশধারা ১১শ শতক বা ১৬শ শতকের মধ্যভাগে শুরু হয়েছে বলে ধারণা করা হয়।[] চাকমা লোককাহিনী এবং ঐতিহ্য অনুযায়ী, চাকমাদের উৎপত্তি ভারতের আধুনিক ভাগলপুর এলাকার যোদ্ধা বর্ণ থেকে।[] বিশ্বাস করা হয় যে, কিংবদন্তিতুল্য রাজা বিজয় গিরি (প্রায় ১৬৩০) চাকমা জনগণের পূর্বপুরুষদের নাফ নদীর উত্তরে নিয়ে আসেন।[] রাখাইন জনগণের সাথে আন্তর্বিবাহের মাধ্যমে চাকমারা শেষ পর্যন্ত বৌদ্ধধর্মে ধর্মান্তরিত হয়।[] বিদ্যমান ঐতিহাসিক রেকর্ডগুলি ১৭০০ সালের দিকের। মোগল সাম্রাজ্যের চাকমা অঞ্চলে সম্প্রসারণের পর, চাকমা প্রধানরা বিনিময়ে খাজনা প্রদানের শর্তে মোগল নাম এবং উপাধি (যেমন: খান) গ্রহণ করেন।[][]

ব্রিটিশ শাসন এবং আধুনিক যুগ

সম্পাদনা

ব্রিটিশ শাসনামলে, ১৮৮৪ সালে পার্বত্য চট্টগ্রাম প্রশাসনিকভাবে তিনটি সার্কেলে বিভক্ত করা হয়: চাকমা সার্কেল, বোমাং সার্কেল এবং মং সার্কেল, প্রতিটি সার্কেল চাকমা এবং মারমা জনগণের বংশগত প্রধানদের নেতৃত্বে পরিচালিত হতো।[][] ১৯০০ সালের পার্বত্য চট্টগ্রাম বিধিমালা দ্বারা এই সার্কেলগুলো আইনগতভাবে প্রণীত হয়, যা কর সংগ্রহ, ভূমি প্রশাসন পরিচালনা এবং সামাজিক মধ্যস্থতার দায়িত্ব প্রধানদের নিকট অর্পণ করে ব্রিটিশ প্রশাসনের উপর থেকে রাজস্ব সংগ্রহ এবং প্রশাসনিক বোঝা হ্রাস করে।[][১০] ১৯০১ সালে, বোমাং সার্কেলের আয়তন ছিল ২,৪২১ বর্গমাইল (৬,২৭০ বর্গকিমি)।[১১] এই প্রশাসনিক কাঠামো ১৯৬৪ সাল পর্যন্ত বহাল ছিল, যখন স্থানীয় স্বশাসন প্রবর্তনের মাধ্যমে এই সার্কেলগুলোর বিশেষ মর্যাদা বিলুপ্ত করা হয় এবং স্থানীয় প্রশাসন কেন্দ্রীয় সরকারের নিয়ন্ত্রণে আনা হয়।[১২]

রাজাগণের তালিকা

সম্পাদনা
ক্র. নং ছবি নাম রাজত্বকাল জীবনকাল
সুধান্য
মরু দেব
চম্পা কালী
লাঙ্গল ধন
ক্ষুদ্রজিৎ
সমুদ্রজিৎ
শ্যামল
চম্পক কালী
সন্ধ্যা সুর
১০ চন্দ্র চুগ
১১ সাদেং গিরি
১২ ধর্ম চুগ
১৩ সুধান্য-২
১৪ চম্পাসুর
১৫ বিম্বসুর
১৬ সেঙবুদ্ধ
১৭ উদয়গিরি
১৮ বিজয়গিরি
১৯ চিরত্তমা চেগ
২০ সরন্নামা
২১ উলত নামা
২২ জমু
২৩ কমলা জনু
২৪ উনসা গিরি
২৫ মছ্যাগিরি
২৬ কমলা যুগ
২৭ মদন যুগ
২৮ জীবন যুগ
২৯ রত্নগিরি
৩০ ধনগিরি
৩১ স্বর্ণগিরি
৩২ বুদ্ধং গিরি
৩৩ ধর্মগিরি ১০৭৫ খ্রিঃ
৩৪ মনোরথ
৩৫ অরিজিৎ
৩৬ মৈমাংসা
৩৭ কেওয়ালা
৩৮ বৈরিন্দম
৩৯ জ্ঞানানু
৪০ স্বেইতারাতোর চোতুংজা
৪১ সাকালিয়া
৪২ ওয়ানগালি শেরধর
৪৩ মান্যেগিরি
৪৪ মাধলিয়া
৪৫ রামতোংজা
৪৬ কমলা চেগে
৪৭ রত্ন গিরি
৪৮ হালা তোংজা
৪৯ চক্র ধন
৫০ ফেলা ধাবেঙ
৫১ শেরমুত্ত ধাবেঙ ১৩০০ খ্রিঃ
৫২ ইয়োংজা ১৩৩০ খ্রিঃ
৫৩ সূর্যজিৎ ১৪শ শতক
৫৪ শত্রুজিৎ ১৫শ শতকের শুরু
৫৫ রামতোংজা ১৫শ শতকের মাঝামাঝি
৫৬ মানিকগিরি ১৫শ শতকের শেষ
৫৭ তৈন সুরেশ্বরী ১৬শ শতকের শুরু
৫৮ জনু ১৫১৬ খ্রিঃ (রাজ্যাভিষেক)
৫৯ সত্ত্বা ১৬শ শতকের শেষ
৬০ কাত্ত্ব রাণী ১৭শ শতকের শুরু
৬১ ধবনা ১৭শ শতকের মাঝামাঝি
৬২ ধরম্যা ১৬৬১ খ্রিঃ (রাজ্যাভিষেক)
৬৩ মোগল্যা ১৭শ শতকের শেষ
৬৪ যুবল খাঁ বা সুবল খাঁ ১৭শ শতকের শেষ
৬৫ জল্লাল খাঁ ১৭১৫ (মৃত্যু)
৬৬ ফতেহ খাঁ ১৮শ শতকের মাঝামাঝি
৬৭ শেরজ্জা খাঁ ১৮শ শতকের মাঝামাঝি
৬৮ শেরমুস্ত খাঁ ১৭৩০ খ্রিঃ
৬৯ রাজা শুকদেব রায় ১৮শ শতকের মাঝামাঝি
৭০ শের দৌলত খাঁ ১৭৭৬ - ১৭৮২ খ্রিঃ
৭১ জানবক্স খাঁ ১৭৮২ - ১৭৮৯ খ্রিঃ
৭২ তব্বর খাঁ ১৮০১ - ১৮১১ খ্রিঃ
৭৩ জব্বর খাঁ ১৮১১ - ১৮১৪ খ্রিঃ
৭৪ ধরম বক্স খাঁ ১৮১৪ - ১৮৩২ খ্রিঃ
৭৫ রাণী কালিন্দী ১৮৩২ - ১৮৭৩ খ্রিঃ
৭৬ রাজা হরিশ্চন্দ্র রায় বাহাদুর ১৮৭৩ - ১৮৮৫ খ্রিঃ
৭৭ কোর্ট অফ ওয়ার্ডস (নীল চন্দ্র দেওয়ান এবং ত্রিলোচন দেওয়ান) ১৮৮৫ - ১৮৯৭ খ্রিঃ
৭৮   রাজা ভুবনমোহন রায় ৭ মে ১৮৯৭ - ১৭ সেপ্টেম্বর ১৯৩৩
৭৯   রাজা নলিনাক্ষ রায় ৭ মার্চ ১৯৩৫ - ৭ অক্টোবর ১৯৫১
৮০   রাজা ত্রিদিব রায় ২ মার্চ ১৯৫৩ - ১৯৭১
৮১ সমিত রায় ১৯৭১ - ১৯৭৭
৮২   রাজা দেবাশীষ রায় ওয়াংজা ২৫ ডিসেম্বর ১৯৭৭ - বর্তমান

আরো দেখুন

সম্পাদনা

তথ্যসূত্র

সম্পাদনা
  1. Deakin, Liz; Kshatriya, Mrigesh; Sunderland, Terry (২০১৬)। Agrarian change in tropical landscapes (ইংরেজি ভাষায়)। CIFOR। পৃষ্ঠা 194। আইএসবিএন 9786023870226 
  2. Ahmed, Kawser (২০১০)। "Defining 'Indigenous' in Bangladesh: International Law in Domestic Context"। International Journal on Minority and Group Rights17 (1): 47–73। জেস্টোর 24675834ডিওআই:10.1163/157181110X12595859744169 
  3. "Chittagong Hill Tracts Peace Accord" (পিডিএফ)। ১৯৯৭-১২-০২। ২০১৮-১১-২১ তারিখে মূল (পিডিএফ) থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ২০১৮-০৯-১৯ 
  4. "Rajpunnah in Bandarban today"দ্য ডেইলি স্টার। ২০০৯-০২-০৪। সংগ্রহের তারিখ ২০১৮-০৯-১৯ 
  5. Dowlah, Caf (অক্টোবর ২০১৩)। "Jumma insurgency in Chittagong Hills Tracts: how serious is the threat to Bangladesh's national integration and what can be done?"। Small Wars & Insurgencies24 (5): 773–794। আইএসএসএন 0959-2318ডিওআই:10.1080/09592318.2013.866419 
  6. Serajuddin, A. M.; Buller, John (১৯৮৪)। "The Chakma Tribe of the Chittagong Hill Tracts in the 18th Century"। Journal of the Royal Asiatic Society of Great Britain and Ireland116 (1): 90–98। জেস্টোর 25211628ডিওআই:10.1017/S0035869X00166146 
  7. Hutchinson, Robert Henry Sneyd (১৯০৬)। An Account of the Chittagong Hill Tracts (ইংরেজি ভাষায়)। Bengal Secretariat Book Depot। পৃষ্ঠা xvii। 
  8. Jhala, Angma D. (জানুয়ারি ২০১৩)। "Daughters of the Hills: legacies of colonialism, nationalism and religious communalism in the Chakma Raj family, Chittagong Hill Tracts, Bengal c. 1900–1972"। South Asian History and Culture4 (1): 107–125। আইএসএসএন 1947-2498ডিওআই:10.1080/19472498.2012.750460 
  9. Kundu, Debasish; Samadder, Mrinmoy; Khan, Ashrafuzzaman; Shajahan Naomi, Sharin (জানুয়ারি ২০১১)। State of Justice in Chittagong Hill Tracts: Exploring the Formal and Informal Justice Institutions of Indigenous Communities (প্রতিবেদন)। BRAC। 
  10. "Bandarban wears festive look as Rajpunyah starts"দ্য ডেইলি স্টার। ২০১০-০১-১৫। সংগ্রহের তারিখ ২০১৮-০৯-১৯ 
  11. Hutchinson, Robert Henry Sneyd (১৯০৬)। An Account of the Chittagong Hill Tracts (ইংরেজি ভাষায়)। Bengal Secretariat Book Depot। পৃষ্ঠা 122 
  12. Zaman, M. Q. (১৬ জানুয়ারি ১৯৮২)। "Crisis in Chittagong Hill Tracts: Ethnicity and Integration"। Economic and Political Weekly17 (3): 75–80। জেস্টোর 4370578