চন্দ্রকেতুগড়
চন্দ্রকেতুগড় বাংলার গুরুত্বপূর্ণ একটি প্রত্নস্থল। পশ্চিমবঙ্গের উত্তর চব্বিশ পরগনা জেলায় এবং কলকাতা শহর থেকে ৩৫ কিলোমিটার উত্তর-পূর্ব দিকে একদা ভাগীরথী নদীর অন্যতম প্রবাহ পদ্মা নদী (বর্তমানে অবলুপ্ত) ও বিদ্যাধরী নদীর কূল ঘেঁষে এর অবস্থান। এখানকার দেগঙ্গা (এটি দেবগঙ্গা, দ্বীপগঙ্গা বা দীর্ঘগঙ্গা নামের অপভ্রংশ) গ্রামের রাজপথের সমান্তরালে এক প্রবাহিত নদীর (পদ্মা) শুষ্কখাত এখনো দেখা যায়। এই প্রত্নস্থলটি আনুমানিক ৪০০ থেকে ৮০০ খ্রিস্টপূর্বে গড়ে উঠেছিল।
অবস্থান | বেড়াচাঁপা,পশ্চিমবঙ্গ,ভারত |
---|---|
স্থানাঙ্ক | ২২°২৫′ উত্তর ৮৮°২৫′ পূর্ব / ২২.৪১° উত্তর ৮৮.৪১° পূর্ব |
ধরন | নগর-বসতি |
ইতিহাস | |
প্রতিষ্ঠিত | আনুমানিক ৪০০ - ৮০০ খ্রিষ্টপূর্বে |
পরিত্যক্ত | ১২০৪ সাল |
স্থান নোটসমূহ | |
মালিকানা | সরকারি |
ব্যবস্থাপনা | আর্কিওলজিক্যাল সার্ভে অব ইন্ডিয়া |
প্রত্নস্থলটিতে বিভিন্ন সময়ে একাধিকবার উৎখনন পরিচালিত হয়েছে। উৎখননে প্রাপ্ত প্রত্নসামগ্রী চন্দ্রকেতুগড়ের প্রাচীনত্ব ও প্রত্নতাত্ত্বিক গুরুত্ব প্রমাণ করে। এখানকার নিদর্শনাবলির প্রধান অংশ কলকাতার আশুতোষ সংগ্রহশালা ও প্রত্নতাত্ত্বিক জাদুঘরে সংরক্ষিত রয়েছে। এছাড়া বেশ কিছু নিদর্শন শহর এবং শহরের বাইরে ব্যক্তিগত সংগ্রহেও রয়েছে। চন্দ্রকেতুগড়ে প্রাপ্ত পঞ্চচূড় অপ্সরা, নগরশ্রেষ্ঠীর ও গজদন্ত শিল্প ইউরোপ ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নামি সংগ্রহালয়ে রয়েছে।
প্রত্নস্থলটিতে বর্তমানে দেবালয়, হাদীপুর, বেড়াচাঁপা, শানপুকুর, ঝিক্রা ও ইটাখোলা গ্রামের বিস্তৃত এলাকা জুড়ে প্রাচীন নগর-বসতির চিহ্ন পাওয়া যায়। মাটির তৈরি বিশাল দুর্গপ্রাচীর প্রত্নস্থলটির মূল কেন্দ্র ঘিরে আছে; যা আকৃতিতে আয়তাকার এবং মোটামুটিভাবে এক বর্গমাইল এলাকা জুড়ে বিস্তৃত। মাটির তৈরি এই দুর্গপ্রাচীরের অভ্যন্তরেই চন্দ্রকেতুগড়, খনা-মিহিরের ঢিবি, ইটাখোলা এবং নুনগোলা ইত্যাদি স্থানে খননের মাধ্যমে প্রাচীন ভারতের নগর-সভ্যতার পাঁচটি পৃথক সাংস্কৃতিক স্তর বা পর্বের সন্ধান পাওয়া গেছে।
স্থানটির "খনা-মিহিরের ঢিবি" অংশের সঙ্গে প্রাচীন ভারতীয় রাজা বিক্রমাদিত্যের সভারত্ন বিখ্যাত জ্যোতির্বিদ বরাহমিহির এবং তার পুত্রবধূ খনার নাম যুক্ত; লোকপ্রবাদ যে, এখানেই খনা ও বরাহমিহিরের বাসস্থান ছিল। এছাড়া, এখানে "দেবালয়"-এর রাজা চন্দ্রকেতুর নামে একাধিক কিংবদন্তি প্রচলিত আছে (দ্রষ্টব্য: পীর গোরাচাঁদ)।
বিভিন্ন ঐতিহাসিকদের মতে, চন্দ্রকেতুগড়ই ছিল সম্ভবত ‘পেরিপ্লাস’ এবং টলেমি সূত্রে উল্লিখিত বিখ্যাত প্রাচীন সমুদ্র-বন্দর 'গঙ্গারিডাই'-এর রাজধানী বা 'গাঙ্গে' বন্দর। এই প্রত্নস্থলটির সঙ্গে জলপথে প্রাচীন ভূমধ্যসাগরীয় অঞ্চল বিশেষত রোমের বাণিজ্যিক যোগসূত্র রয়েছে বলে ধারণা করা হয় ।[১]
ভূগোল
সম্পাদনাপদ্মা নদীর তীরে নির্মিত প্রাচীন শহরটিতে সমুদ্রগামী বাণিজ্যিক জাহাজের জন্য একটি বন্দর[২] ছিল। শহরের অবশেষসমূহ বর্তমানের কলকাতা থেকে প্রায় ৩৫–৩৭ কিলোমিটার (২২–২৩ মা)[৩][৪] উত্তর-পূর্বে উত্তর চব্বিশ পরগনা জেলায় ৪৫ বর্গকিলোমিটার (১৭ মা২)[৫] জুড়ে ছড়িয়ে আছে, যেখানে ধ্বংসপ্রাপ্ত মন্দির ও ধ্বংসাবশেষ রয়েছে। চন্দ্রকেতুগড়ের স্থানটি পদ্মা নদীর দক্ষিণ তীরে বেশ কয়েকটি টিলা নিয়ে গঠিত। মূলত, নদীটি শহরটির উত্তর প্রান্ত বরাবর প্রবাহিত হত, কিন্তু নদী গর্ভে পলি জমার কারণে বর্তমানে নদীর গতিপথ প্রায় অবরুদ্ধ হয়ে পড়েছে। প্রাচীন শহরের স্বল্প অংশই (মন্দির চত্বর ও দেয়াল) খনন করা হয়েছে। গঙ্গা নদীর সঙ্গে যুক্ত বিদ্যাধরী নদীই ছিল সংশ্লিষ্ট এলাকার যোগাযোগের প্রধান জলপথ। তবে পরবর্তী সময়ে নদীর গতিপথের পরিবর্তনর ও গঙ্গার থেকে বিচ্ছিন্ন হওয়ার ফলে শহরের যোগাযোগ ও অর্থনীতি প্রভাবিত হয়েছিল।
নিকটবর্তী প্রাচীন জনবসতি হল মোগলমারি, ধোসা ও তিলপি। চন্দ্রকেতুগড় থেকে স্থানগুলি গড়ে ৩০-৩৫ কিলোমিটার দূরত্বের মধ্যে অবস্থিত ছিল।
ইতিহাস
সম্পাদনাপ্রাথমিক স্তর
সম্পাদনাপ্রথম পর্বটি প্রাক্-‘উত্তর ভারতীয় কালো মসৃণ মৃৎপাত্র’ (Pre-NBPW) পর্যায়ের স্তরকে নির্দেশ করে।
দ্বিতীয় স্তর
সম্পাদনা৪০০ থেকে ১০০ খ্রিষ্টপূর্বাব্দ পর্যন্ত সময়কাল ঘোষণা করে দ্বিতীয় স্তর। এই স্তরের বৈশিষ্ট্যমণ্ডিত নিদর্শনাবলির মধ্যে লম্বা গলার লাল মৃৎপাত্র; কানাবিহীন বড় গোলাকার পেয়ালা ও বাটিকা; কালো, সোনালি এবং বেগুনী রং-এর উত্তর ভারতীয় কালো মসৃণ মৃৎপাত্র; ধূসর রং-এর সাধারণ মৃৎপাত্রের টুকরা; তামার তৈরি চোখে সুরমা লাগাবার দণ্ড (Antimony rod); ও হাতির দাঁতের সামগ্রীর খণ্ড; ছাপাঙ্কিত তাম্র মুদ্রা; লিপিবিহীন ছাঁচে ঢালা ও বিরল বিলন তাম্র মুদ্রা; এবং বেশ কিছু পোড়ামাটির সামগ্রী যার মধ্যে প্রচুর পরিমাণে পুঁতি, নামাঙ্কিত সীল ও সীলমোহর রয়েছে। অস্থি ও গজদন্ত শিল্প, সোনা ও রুপোর গয়না, দামী ও কমদামী রত্নপাথরের অজস্র পুঁতির নিদর্শন মিলেছে।
প্রাপ্ত একটি রৌপ্যমুদ্রায় উৎকীর্ণ পাশাপাশি সারি বেঁধে দুজন পুরুষ, ১জন নারী, উপরে বাঁধানো চত্বরের মধ্যে বৃক্ষ ও বাঁদিকে মাকড়সা। মুদ্রার অন্যদিকে, ত্রিশৃঙ্গ পর্বতের উপরে বিস্তৃতকলাপ ময়ূর - যা মৌর্যযুগের স্মারক। আরেকটি দুষ্প্রাপ্য রৌপ্যমুদ্রার উৎকীর্ণ একটি একতল সমুদ্রগামী জলযান, এর অন্যদিক শুশুকের (ডলফিন) আকারে নির্মিত।
তৃতীয় স্তর
সম্পাদনাতৃতীয় স্তরটি কুষাণ যুগের সমসাময়িক এবং স্তরটি আপাতদৃষ্টিতে সর্বাপেক্ষা সমৃদ্ধ। এ স্তর হতে রোমক ‘রুলেটেড’ (নকশা করা) পাত্রের অংশ বিশেষ; কালো অথবা অনুজ্জল লাল (mat-red) রং-এর ‘অ্যামফোরা’ (amphorae) বা গ্রিস দেশীয় মৃৎপাত্রের বেশ কিছু ভাঙ্গা অংশ; ছাপাঙ্কিত নকশাযুক্ত মনোরম লোহিত মৃন্ময়; ধূসর মৃৎপাত্র; অ্যাম্বারের অলঙ্কার ও পুঁতি, রুলেটেড মৃৎপাত্র এবং নিখুঁতভাবে ছাঁচে তৈরি পোড়ামাটির ক্ষুদ্র মূর্তি পাওয়া গেছে। এছাড়া, খরোষ্ঠী লেখযুক্ত ও 'শস্যবাহী জাহাজ'-এর চিত্র-সংবলিত সিলমোহর মিলেছে। এ পর্বকে খ্রিষ্টীয় প্রথম তিন শতাব্দীর মধ্যে ধরা হয়।
কুষাণ সম্রাট হুবিষ্কের ছবি (মাথায় মুকুট, হাতে অঙ্গুরীয়; পাশে গ্রিক হরফে প্রাচীন ফার্সীতে লেখা "সাও-নানো সাও ওইসি কোষানো" অর্থাৎ, "শাহানশাহ হুবিষ্ক কুষাণ") ও ব্যবিলনীয় দেবী 'নানা'র ছবি সংবলিত স্বর্ণ মুদ্রা মিলেছে। এসময়ের তাম্রমুদ্রাগুলি চতুষ্কোণ বা গোলাকার; ত্রিচূড় পর্বত, চৈত্য, বৃক্ষ ও হাতির প্রতীকযুক্ত। নৌকা উৎকীর্ণ মুদ্রাগুলি এযুগের বাণিজ্যের স্মারক।[১]
চতুর্থ স্তর
সম্পাদনাচতুর্থ স্তরটিকে গুপ্ত এবং গুপ্তোত্তর যুগের বলে চিহ্নিত করা হয়। এ স্তরের বৈশিষ্ট্যপূর্ণ নিদর্শনের মধ্যে রয়েছে সীল ও সীলমোহর; পোড়ামাটির সামগ্রী; ছাপাঙ্কিত নকশাযুক্ত ও ছাঁচে নির্মিত মৃৎপাত্র। ১৯৬৯ সালে 'সিংহের আটি' গ্রাম থেকে দ্বিতীয় চন্দ্রগুপ্তের ধনুর্ধর মূর্তি ও লক্ষ্মীদেবীর মূর্তি সংবলিত স্বর্ণ মুদ্রা পাওয়া গেছে। হাদিপুরে পুকুর সংস্কারকালে প্রাপ্ত কয়েকটি স্বর্ণমুদ্রার একটিতে গুপ্তরাজ প্রথম চন্দ্রগুপ্ত ও লিচ্ছবি রাজকন্যা কুমারদেবীর বিবাহদৃশ্য উৎকীর্ণ।
গৃহনির্মাণের জন্য এযুগের রোদে-পোড়ানো মাটির তাল দিয়ে তৈরি বড়-বড় অসদৃশ ইট পাওয়া গেছে। এ স্তরের সবচাইতে গুরুত্বপূর্ণ নিদর্শন হচ্ছে ১৪ ফুটের বেশি উচুঁ ‘সর্বত-ভদ্র’ রীতির ইট নির্মিত বিশাল একটি মন্দিরের ধ্বংসাবশেষ। কোন বিশেষ দেব-দেবীর সঙ্গে সম্পর্কিত করা যায় ধর্মীয় এমন কোন নমুনা মন্দিরের ধ্বংসাবশেষ থেকে পাওয়া যায়নি। তবে, গুপ্ত স্তর থেকে সূর্য্য দেবতার প্রতিকৃতি একটি বেলে পাথর ফলকের নিম্নাংশে পাওয়া গেছে। পঞ্চম স্তরের প্রত্নতাত্ত্বিক সাক্ষ্যপ্রমাণ খুবই কম, এগুলি সম্ভবত পাল পর্যায়ের বলে ধরে নেওয়া হয়। প্রত্নস্থল থেকে সর্বমোট ২৭২ টি রৌপ্য মুদ্রা পাওয়া গেছে।[১]
আধুনিক যুগ
সম্পাদনাপ্রত্নতাত্ত্বিক উৎখনন
সম্পাদনাপ্রবীন মানুষজনের মধ্যে সঞ্চিত দীর্ঘকালীন কিংবদন্তি এবং দুর্ভেদ্য জঙ্গলাবৃত প্রত্নস্থলটির আশপাশ থেকে প্রাপ্ত প্রত্নবস্তুর উপর নির্ভর করে ১৯০৬ সালে স্থানীয় অধিবাসীরা এবং চিকিৎসক তারকনাথ ঘোষ "আর্কিওলজিক্যাল সার্ভে অব ইন্ডিয়া"র কাছে প্রত্নতাত্ত্বিক পরিদর্শনের আবেদনপত্র পেশ করেন। তাঁর আবেদনে সাড়া দিয়ে ভারতীয় পুরাতত্ত্ব সর্বেক্ষণের পূর্বাঞ্চল শাখার সুপারিটেন্ডেন্ট মিস্টার লঙহার্স্ট পরিদর্শনে এলেও তিনি এখানকার গুরুত্ব আবিষ্কার করতে অসমর্থ হন। এরপর, ১৯০৭ সালে বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদের প্রথম সম্পাদক ও পুরাবিদ নৃপেন্দ্রনাথ বসু এবং ১৯০৯ সালে খ্যাতনামা প্রত্নতত্ত্ববিদ রাখালদাস বন্দ্যোপাধ্যায় স্থানটি পরিদর্শন করেন। রাখালদাসই সর্বপ্রথম চন্দ্রকেতুগড়ের প্রাচীনত্ব ও গুরুত্ব সম্যকভাবে উপলব্ধি করে এই প্রত্নস্থল সম্বন্ধে বিজ্ঞানসম্মত বিশ্লেষণ ও ব্যাখ্যা দেন। কিন্তু, সেসময় কিছু মূল্যবান প্রত্নবস্তু পাওয়া গেলেও কোনো উৎখনন সংঘটিত হয়নি৷ ১৯২২-২৩ সালের ভারতীয় পুরাতত্ত্ব সর্বেক্ষণের বার্ষিক প্রতিবেদনে কাশীনাথ দীক্ষিত লেখেন, "চন্দ্রকেতুগড় বাংলার প্রাচীনতম জনবসতিগুলির অন্যতম।"
১৯৩৭ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে প্রত্নতত্ত্ব-বিষয়ক "আশুতোষ সংগ্রহশালা"র প্রতিষ্ঠা হয়। ভারতের স্বাধীনতা লাভের পর, ১৯৫৭ সালে আশুতোষ সংগ্রহশালার উদ্যোগে জয়নগর মজিলপুর-এর তৎকালীন জমিদার ও পুরাতাত্ত্বিক কালিদাস দত্তের প্রেরণায় এখানে প্রথম প্রত্নতাত্ত্বিক উৎখনন শুরু হয়। ১৯৬৭-৬৮ সাল পর্যন্ত এর নিরবচ্ছিন্ন খননে নেতৃত্ব দেন কুঞ্জবিহারী গোস্বামী ও তাঁর সহযোগীরা। প্রত্নস্থলটিতে বৈজ্ঞানিক 'উলম্ব খনন' (কৌশল: হুইলার খুপরি পদ্ধতি) সাধিত হয়েছিল।
প্রথম বছরে উৎখননে দুর্গ-নগরীর ধ্বংসাবশেষ উদ্ঘাটিত হয় এবং প্রাচীন ভারতের দ্বিতীয় নগরায়নের সমসাময়িক প্রাক-মৌর্য (খ্রিস্টপূর্ব ৬০০-৩০০ অব্দ) থেকে গুপ্তযুগের পাঁচটি অধিবসতি স্তর আবিষ্কৃত হয়। উৎখননের দ্বিতীয় বছরে 'খনা-মিহিরের ঢিবি' থেকে প্রাক-গুপ্তযুগ থেকে পাল-পরবর্তী যুগ পর্যন্ত প্রত্নদ্রব্য আবিষ্কৃত হয়। এখান থেকেই গুপ্তযুগের উত্তরমুখী মন্দির ও মন্দিরগুচ্ছের বিভিন্ন অংশ এবং সাতটি অধিবসতি স্তরের সন্ধান মেলে (প্রাক-NBP, NBP সংস্কৃতি, NBP পরবর্তী (শুঙ্গ যুগ), শুঙ্গ-কুষাণ যুগ, গুপ্তযুগ, গুপ্তযুগের শেষ ও গুপ্ত-পরবর্তী যুগ)। চতুর্থ বছরে ইটাখোলা ঢিবি খনন করা হয় (এখানে প্রাক-NBP ও শুঙ্গ-কুষাণ যুগের অধিবসতি স্তরের হদিশ মেলে; এর NBP স্তরেই উদ্ঘাটিত হয় ভূগর্ভস্থ পোড়ামাটির নলের পয়ঃপ্রণালী)। ১৯৬৫-৬৬তে নুনগোলায় উৎখনন হয়। ১৯৬৭-৬৮ সালে আনুমানিক ৭ম-৮ম শতকের মন্দিরসহ মৌর্য ও কুষাণ যুগের প্রত্নবস্তুও পাওয়া গিয়েছিল। [১]
নিদর্শন
সম্পাদনাপোড়ামাটি ও অন্যান্য শিল্প-নিদর্শন
সম্পাদনাপ্রাপ্ত শিল্প নিদর্শনের ভিত্তিতে সুস্পষ্ট যে, মৌর্য থেকে গুপ্ত যুগ পর্যন্ত নদীবিধৌত এই প্রত্নস্থলের প্রধান শিল্প মাধ্যম ছিল ছাঁচ নির্মিত পোড়ামাটির সামগ্রী। সার্বিক বিবেচনায় এ শিল্পটি শিল্পরীতিতে ৩৫০ খ্রিষ্টপূর্বাব্দ থেকে ৫০০ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত সময়কালে গাঙ্গেয় ভারতের শিল্পকলার নিদর্শনাবলির সঙ্গে সম্পৃক্ত বলে মনে হয়। এগুলির বিস্ময়কর বিষয় বৈচিত্র্য অত্র অঞ্চলের শিল্পরীতির বিশেষ বৈশিষ্ট্যকে প্রকাশ করেছে। শুঙ্গ যুগে ছাঁচের ব্যবহার শুরু হয়; কুষাণ যুগে 'ডবল ছাঁচের' প্রচলন ঘটে।
এখানে ধর্মীয় ও আচার সংক্রান্ত নিদর্শনাবলি যা পাওয়া গেছে তার মধ্যে আদিম ধরিত্রি-দেবী, যক্ষ, যক্ষিণী, নাগ, রথারূঢ় সূর্যদেব, মেষারূঢ়া স্বাহার মূর্তি, হাতির দাঁতের কুষাণ যুগীয় চিরুণী, উন্মেষ-উন্মুখ মন্দিরের নমুনার ভিতরে ব্যাঘ্রারূঢ় দেবদম্পতির উৎকীর্ণ মূর্তি (সম্ভবত সুন্দরবনের লৌকিক ব্যাঘ্রদেবতা "দক্ষিণরায়ের" আদিরূপ), প্রহরী সমন্বিত রাজদম্পতির এবং কিন্নরদম্পতির টেরাকোটার ভাঙা মূর্তি, বিভিন্ন টেরাকোটার মৃচ্ছকটিক, হেলেনীয় প্রভাবযুক্ত কুষাণ যুগের ভগ্ন পুরুষের টেরাকোটা মূর্তি, রাবণরাজা কর্তৃক সীতাহরণের বা পঞ্চতন্ত্র-এর বিভিন্ন নীতিকাহিনীর কিংবা যশোদা-কৃষ্ণ-ব্রজবাসীগণের দৃশ্যসংবলিত মৃৎ ভাস্কর্য, অর্ধচন্দ্রাকার কাস্তে হাতে ধান কর্তনরত কৃষক, খেজুর গাছের কাণ্ড ও খেজুর গাছ থেকে চেঁছে রস সংগ্রহ করার দৃশ্য উৎকীর্ণ মৃৎফলক, পাথরের পাটা, নৃত্যরত পুরুষ ও নারী মূর্তি, কোমরে মেখলা ও গলায় হার পরিহিতা রোমীয় শৈলীর প্রভাবে নির্মিত রমণীমূর্তি (হেলেনীয় 'কিটোন' আচ্ছাদন, পোশাক মুখ ও দেহ ব্যঞ্জনায় গ্রিক প্রভাব, গ্রেকো-রোমান শিরো বন্ধনী, বর্ম ও পাদুকা পরিহিতা), ঘোড়ায় আসীন জনৈক ব্যক্তি, আসনে উপবিষ্ট ভোজনরতা নারীর মূর্তি, বুদ্ধমূর্তির ফলক, দেবী মনসার নাগমূর্তি, শিকার-কুস্তি-রথচালনা-মাহুতের বুনো হাতি পোষ মানানোর দৃশ্যসংবলিত মাটির ফলক, প্রস্তরবলয় (মৌর্যযুগে নির্মিত; এর ভিতরের দিকে বৃত্তাকারে উৎকীর্ণ নগ্নিকা মাতৃকামূর্তি, বৃক্ষ ও জীবজন্তুর চিত্র), ব্রোঞ্জের ক্ষুদ্র পার্বতী মূর্তি, কখনও পশুচালিত যানে দণ্ডায়মান এবং পাখাযুক্ত দেব-দেবী রয়েছে। আবার ধর্মের সঙ্গে কোন সম্পর্ক নেই এমন বস্তু: খেলনা, শৌখিন জিনিস, পশুপাখিও পাওয়া গেছে। পোড়ামাটির সামগ্রীতে বিশেষ করে পোশাক অথবা শারীরিক সাধারণ বৈশিষ্ট্য খ্রিষ্টীয় প্রথম তিন শতাব্দীর গ্রেকো-রোমান যোগাযোগের গভীর প্রভাব দেখা যায়। প্রেমবিলাসী কামার্ত যুগলের কিংবা ‘মৈথুন’ ভঙ্গিতে চন্দ্রকেতুগড় প্রত্নস্থল থেকে অগণিত পোড়া মাটির মূর্তি পাওয়া গেছে (নারীসঙ্গ বঞ্চিত নাবিক ও বণিকদের মধ্যে এর চাহিদা ছিল)। অলঙ্কারযুক্ত পুরুষ ও নারী মূর্তিসমূহ থেকে ইঙ্গিত পাওয়া যায় যে, স্বর্ণকারের শিল্পের অনুকরণ করা হতো। বাঁশ, বেতের ঝুড়ি কিংবা হরিণের শিং, কচ্ছপের খোলা, হাতির দাঁত দিয়ে তৈরি জিনিসের মৃৎফলক মিলেছে।
মৃত্তিকাফলকগুলিতে নারীগণ নাগরিকা, সম্রাজ্ঞী, বিলাসিনী, নর্তকী, প্রেমিকা, কৃষক-ঘরণী, পূজারিণী (আম, কাঁঠাল, কলা, তাল, পদ্মফুল প্রভৃতি পূজা-উপাচারের থালা বাহিকা) জননী, পশুচারণরতা বালিকা, ফুল ও ফলওয়ালী, রন্ধনপটিয়সি, লাগাম হাতে অশ্ব ও হস্তী আরোহিণী, রথচালিকা, উৎসব পরিচালিকা - বিচিত্র বেশ, অলঙ্কার, আয়ুধে সুসজ্জিতা হয়ে নানা ভূমিকায় অবতীর্ণ।
একটি ফলকে রমণী পুরুষকে পদাঘাত করছে, ভীতু পুরুষ জোড়হাতে ক্ষমা চাইছে। আরেকটি ফলকে পুরুষ বড়শি দিয়ে মাছ ধরছে, দূরে মহিলা রন্ধনের আয়োজনে ব্যস্ত। একটি ফলকে দেখা যাচ্ছে, অলঙ্কারভূষিতা উপবিষ্টা এক মহিলা ধান তুষমুক্ত করে বেতের তৈরি ধামায় রাখছেন। এক ফলকের চিত্রে, বাঁদিকে হাতির পিঠে অলঙ্কারভূষিতা অঙ্কুশধারিণী এক নারী; হাতির ডানদিকে আঁটিবাঁধা ধানের গোছা কাঁধে দুই পুরুষ মূর্তি, তার পরে একজন বীণাবাদক। শোভাযাত্রার পুরোভাগে ঢোলবাদনরত তিনজন পুরুষ। এটি রাজপথের শস্য উৎসবের (নবান্ন) আনন্দযাত্রার একটি দৃশ্য। এছাড়া, বিভিন্ন মৃৎফলকে কলসী কাঁখে গ্রাম্যবধূ, শুক-সারি পাখির সাথে তরুণী, স্নানরতা কিংবা প্রসাধনরতা যুবতী, প্রোষিতভর্তৃকার আত্মরতি প্রভৃতি দৃশ্য বিদ্যমান। একটি ফলকে, জোড়া মাছ হাতে দাঁড়ানো মৎস্যদেবী বা বসুধা; পাশে কলসীর কানা থেকে উদ্গত একসারি মাছ। একটি মৃত্তিকাফলকে উৎকীর্ণ রয়েছে - দণ্ডায়মান সালংকারা এক দেবী (লক্ষ্মী বা যক্ষিণী) কলসী উপুড় করে মুদ্রা ঢেলে দিচ্ছেন, ভক্ত সেই মুদ্রা থালা ভর্তি করে নিচ্ছেন।
মনে করা হয়, নৌকা, জলযান নির্মাণ, দারুশিল্প, NBP মৃৎপাত্রের 'নির্মাণশালা' ছিল হাদিপুর। গাজীতলা গ্রামে পোড়ামাটির মূর্তি, ফলক, পুঁতি তৈরি হত। এখানে 'গজদন্ত ও কারু শিল্পের' কর্মশালাও ছিল।
বাংলার প্রাচীনতম বৌদ্ধমূর্তি (পাথরের বোধিসত্ত্ব মূর্তি) এবং জিনমূর্তি এখান থেকেই পাওয়া গেছে।[১]
১৯১১ সালে এখান থেকে প্রত্নতত্ত্ববিদরা একটি কালো ক্লেরাইট পাথরের স্তম্ভের ধ্বংসাবশেষ উদ্ধার করেন; এতে অশোকস্তম্ভের মতো সুন্দর পালিশ ছিল। এসময় একটি রুপোর ও একটি তামার পাত্রের টুকরো এবং একটি ছোট হলুদ বর্ণের পাথরে নির্মিত শীলমোহর (খ্রিস্টপূর্ব ২য় বা ৩য় শতকের উত্তরভারতীয় লিপিতে 'মা' বর্ণটি খোদিত ছিল) পাওয়া যায়। এছাড়া একটি টেরাকোটা মৃৎখণ্ডে একত্রবদ্ধ শস্যগুচ্ছ এবং আরেকটি মৃৎখণ্ডে নারীর নূপুরযুক্ত পায়ের নকশা ছিল। এছাড়াও মাটির দুটি শঙ্কু (স্পিন্ডল হোর্ল) আবিষ্কৃত হয়েছিল। স্থানীয় লোকেরা পুকুরখনন গৃহনির্মাণ ইত্যাদির সময় লাঞ্ছনমুদ্রা পোড়ামাটির মূর্তি, ভাঁড় ও নানারকম পুরাবস্তু বিভিন্ন সময় পেয়েছেন।[৬]
উন্নত নাগরিক সভ্যতার নিদর্শন
সম্পাদনা১৯৫৬-৫৯ সালে প্রত্নতাত্ত্বিক উৎখননে "খনামিহিরের ঢিবি" নামক স্থানে প্রায় ৬৩ ফুট×৬৩ ফুট একটি বিশাল উত্তরমুখী (বৌদ্ধধর্মের যোগসূত্র) মন্দিরের সন্ধান পাওয়া যায়। এর পূর্ব, দক্ষিণ ও পশ্চিম - এই তিনদিকে ১৪ ফুট চওড়া বারান্দা; মন্দির-সংলগ্ন উত্তরদিকে ৪৫ ফুট×৪৫ ফুট একটি মণ্ডপ (এর প্রাচীর ৪ ফুট পুরু) এবং কাছে আরেকটি ছোট মন্দিরও পাওয়া গিয়েছে। মন্দিরের বাইরের দেওয়াল টেরাকোটা চিত্রফলকে সুসজ্জিত ছিল (দেওয়ালের বর্তমান শূণ্যস্থানগুলি এর সাক্ষী)। উত্তরমুখী মন্দিরের মধ্যস্থলে দৈর্ঘ্যে ৮ ফুট, প্রস্থে ৮ ফুট ও গভীরতায় ২৩ ফুট গর্ভগৃহ আবিষ্কৃত হয়; এর তলদেশে দৈর্ঘ্যে ও প্রস্থে ২ ফুট ১৩ ইঞ্চি মাপের ক্ষুদ্র ইটের চতুষ্কোণ ক্ষেত্র। কেউ কেউ মনে করেন, এই মন্দির সম্ভবত পশ্চিমবঙ্গের প্রাচীনতম মন্দিরের নিদর্শন। মন্দিরটি তিনবার নির্মিত হয়েছিল বলে মনে করা হয় (একবার গুপ্তযুগে, তারপর গুপ্ত-পরবর্তী যুগে)।[১]
নগরীর ধ্বংসাবশেষ থেকে আবিষ্কৃত হয়েছে বেশকিছু ভগ্ন ও অভগ্ন টেরাকোটা নির্মিত রাশিচক্র; ধারণা করা হয়, কৃষির প্রয়োজনে এখানে জ্যোতির্বিদ্যার চর্চা হত (জ্যোতির্বিদ্যার হিসাব কষে বীজবপন থেকে ফসল তোলার সময় নিরূপণ করা হত; দ্রষ্টব্য: খনার বচন)৷ "খনা-মিহিরের ঢিবি"র উপর্যুক্ত মন্দির ছিল জ্যোতির্বিদ পুরোহিত শ্রেণীর কর্মকেন্দ্র। অনুমিত হয়, প্রাচীরবেষ্টিত দুর্গে বাস করতেন শাসক ও অভিজাত মানুষরা; প্রাচীরবিহীন অংশে বাস করতেন সাধারণ কৃষক, ব্যবসায়ী, কারিগর ও অন্যান্য জীবিকার মানুষ। প্রথম স্তরের মানুষ বাস করতেন কাদামাটি, বাঁশ ও কাঠের তৈরি বাড়িঘরে।
মাটির গভীরে একটি ডাস্টবিন (জীবজন্তুর হাড়গোড়, মৃৎপাত্রের ভগ্নাংশ, কাঠের টুকরো সহ) এবং মাটির বেড় সাজিয়ে পরিশোধিত পানীয় জলের জন্য তৈরি কুয়োর (মাটির ১০-১২ হাত তলায়) সন্ধান মিলেছে।
বেড়াচাঁপা থেকে আধমাইল দূরে হাড়োয়া যাওয়ার পথে একটি ধানক্ষেত খুঁড়ে ৫-৮ ইঞ্চি ব্যাসের এবং ২ ফুট ৭ ইঞ্চি দৈর্ঘ্যের পোড়ামাটির যুক্তনলবিশিষ্ট ভূগর্ভস্থ পয়ঃপ্রণালী পাওয়া গিয়েছে। মাটির উপর থেকে ১৩ ফুট নিচে এবং জলস্তর থেকে প্রায় ১ ফুট নিচে এই নালার চিহ্ন পাওয়া গেছে।[৬]
এছাড়া, মাটির ৮/৯ ফুট তলায় ইটের তৈরি মজবুত বাঁধ আবিষ্কৃত হয়েছে। এগুলি পূর্ব থেকে পশ্চিমে ঢালু। ২০০৪ সালে গাজীতলা গ্রাম থেকে ৭টি পুকুর উৎখননের পর পুকুরের মাঝখানে বিশাল বাঁধ দেখা গেছে। এগুলি মূলত মৌর্যযুগ বা তার আগে থেকেই তৈরি করা শুরু হলেও প্রধানত শুঙ্গযুগ থেকে বিদেশী হানা প্রতিরোধের জন্য বিশেষত্ব লাভ করে। ১৯২২-২৩ সালের ভারতীয় পুরাতত্ত্ব সর্বেক্ষণের প্রতিবেদন অনুযায়ী, এই স্থানের বেষ্টনী প্রাচীরগুলি তখনও ১ মাইল পর্যন্ত বিস্তৃত ও ২৫/৩৩ ফুট উচ্চ ছিল।
এর দক্ষিণ-পশ্চিম কোণে একটি ফাঁকা জায়গা 'সিংহদ্বার' বা 'সিং-দরজা' নামে পরিচিত। নগর প্রাচীরের বাইরে ছিল এখনকার সিংহের আটি, হাদিপুর।[১]
প্রাচীন সভ্যতার সাথে যোগাযোগ
সম্পাদনাদেবগঙ্গা-দেগঙ্গা, দেবালয় ও অন্যান্য স্থানীয় নাম এবং এই অঞ্চলের জাতিবিন্যাস (প্রধানত প্রাগার্য নিষাদ-জাতিভুক্ত) লক্ষ্য করলে এমন বিশ্বাস করার যথেষ্ট কারণ রয়েছে যে, চন্দ্রকেতুগড়ই সম্ভবত ‘পেরিপ্লাস’ এবং টলেমি সূত্রে উল্লিখিত প্রাচীন ‘গাঙ্গে’ বা গঙ্গারিডাই। মনে করা হয়, দক্ষিণের সাগরদ্বীপ সুন্দরবন থেকে উত্তরের সমগ্র চব্বিশ পরগনা এলাকা জুড়ে গঙ্গার প্রবাহপথে এই প্রাচীন গঙ্গারিডিরাজ্য বিস্তৃত ছিল এবং চন্দ্রকেতুগড় ছিল এই রাজ্যের রাজধানী।[৬]
সতীশচন্দ্র মিত্র, ব্রজদুলাল চট্টোপাধ্যায়, পরেশচন্দ্র দাশগুপ্ত, দিলীপকুমার চক্রবর্তী, ব্রতীন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায় প্রভৃতি প্রত্নতাত্ত্বিক বিশেষজ্ঞগণ চন্দ্রকেতুগড়কেই 'গাঙ্গে' বন্দর হিসাবে উল্লেখ করেছেন। শত্রুর আক্রমণ, ঝড়-ঝঞ্ঝার প্রকোপ থেকে জলযান, পোতাশ্রয় ও পণ্যদ্রব্য বাঁচাতে প্রাচীন ভারতের বন্দরগুলির অবস্থান ছিল নদীর মোহনায় বা ব-দ্বীপ অঞ্চলে; যা ছিল নদীপথে সমুদ্রের সঙ্গে যুক্ত। এক্ষেত্রে, পদ্মা-বিদ্যাধরী নদী হয়ে রায়মঙ্গল নদীর মাধ্যমে বঙ্গোপসাগর-এর সাথে সংযুক্ত চন্দ্রকেতুগড় ছিল আদর্শ সংস্থান।
এই সভ্যতাকেন্দ্রের সঙ্গে ভূমধ্যসাগরীয় অঞ্চল বিশেষত রোমের প্রত্যক্ষ বাণিজ্যিক যোগাযোগ ছিল। নিকটবর্তী প্রত্নস্থল তমলুক থেকে প্রাপ্ত অভগ্ন গ্রিক অ্যাম্ফোরা ও রোমান দেবতা জানুসের মূর্তি এবং বিহারের সিংভূম জেলার বামনঘাটি থেকে আবিষ্কৃত রোমান স্বর্ণমুদ্রার ভাণ্ডার (এর মধ্যে বেশকিছু মুদ্রা ২৪৪ খ্রীষ্টাব্দের রোম-সম্রাট গার্ডিয়ানের আমলের) এর প্রমাণ। বস্তুত, চন্দ্রকেতুগড় ছিল তাম্রলিপ্ত- কৌশাম্বী-মথুরার সঙ্গে রোমের বাণিজ্যপথের প্রধান মুখ।
পশ্চিমী মৃৎপাত্র যথা: অরেটাইন ওয়্যার, রুলেটেড (ঘূর্ণায়মান রেখা-সংবলিত) ওয়্যার এবং ধূসরবর্ণের অ্যাম্ফোরা ছিল এখানকার সাথে রোমের বাণিজ্যের প্রধান নিদর্শন। ভূমধ্যসাগরীয় অধিবাসীরা পানীয় ও সহজে পচনশীল বিশেষত তরল দ্রব্য (সসে ভেজানো মাছ, ফল, বাদাম, ভিনিগার, মধু, জলপাই তেল) প্রক্রিয়াকরণের পর এই উচ্চগ্রীবা যুক্ত, দুই হাতল বিশিষ্ট অ্যাম্ফোরার মাধ্যমে স্থানান্তর করতো। চন্দ্রকেতুগড় থেকে রোমান 'রুলেটেড' মৃৎপাত্রের অংশ, একজন রোমান রমণীর আবক্ষ মূর্তি (নিরাভরণ ও নগ্ন, যা খাঁটি ইউরোপীয় ঘরানার ভাস্কর্য); এছাড়া অ্যাম্বার বা তৈলস্ফটিক, ৩/৪ টি অ্যাম্বার-নির্মিত পুঁতি (একটির গায়ে আঁকা কাঁকড়া বিছে), কাঁচ, পান্না, কার্নেলিয়ান পাথর প্রভৃতি বাণিজ্যিক প্রত্নসামগ্রী পাওয়া গেছে।[১]
তথ্যসূত্র
সম্পাদনা- ↑ ক খ গ ঘ ঙ চ ছ জ Dr. Gaurishankar de & Prof. Subhradip de, Prasanga: Pratna-Prantar Chandraketugarh, First Edition: 2013, আইএসবিএন ৯৭৮-৯৩-৮২৪৩৫-০০-৬
- ↑ দাস ২০২১, পৃ. ৯১।
- ↑ সেন ২০১৯, পৃ. ১।
- ↑ রাজিব ২০০৬, পৃ. ১৬০।
- ↑ সেন ২০১৯, পৃ. ১৯।
- ↑ ক খ গ ঘোষ, বিনয়, "পশ্চিমবঙ্গের সংস্কৃতি", তৃতীয় খন্ড, প্রথম সংস্করণ, প্রকাশ ভবন, পৃষ্ঠা: ১৫৯-১৬০
গ্রন্থপঞ্জি
সম্পাদনা- এসভি, রাজেশ; জিএস, অভয়ন; নায়ার, প্রীতা, সম্পাদকগণ (২০১৭)। "Heritage: Journal of Multidisciplinary Studies in Archaeology"। হেরিটেজ: জার্নাল অব মাল্টিডিসিপ্লিনারি স্টাডিজ ইন আর্কিওলজি (ইংরেজি ভাষায়)। তিরুবনন্তপুরম। ৫। আইএসএসএন 2347-5463। সংগ্রহের তারিখ ২৩ জানুয়ারি ২০২৪।
- রাজিব, সি. বাবু, সম্পাদক (২০০৬)। "Indian Archaeology 2000-2001-A Review" (পিডিএফ) (ইংরেজি ভাষায়)। Archaeological Survey of India। সংগ্রহের তারিখ ২৩ জানুয়ারি ২০২৪।
- সেন, জয়; বসু, অরিন্দম (২০১৯)। Chandraketugarh – rediscovering a missing link in Indian history। কলকাতা: Indian Institute of Technology, Kharagpur। আইএসবিএন 978-93-80813-37-0।
- দাস, বলাই চন্দ্র; ঘোষ, সন্দীপন; ইসলাম, আজনারুল; রায়, শুভেন্দু (২০২১)। Anthropogeomorphology of Bhagirathi-Hooghly River System in India (ইংরেজি ভাষায়)। সিআরসি প্রেস। আইএসবিএন 978-0-367-86102-5।
- Chandraketugarh : A Treasure House of Bengal Terracottas - Enamul Haque. Dhaka, The International Centre for Study of Bengal Art, 2001, 416 p., 678 illustrations including 400 in colour, figures, plates, maps, আইএসবিএন ৯৮৪-৮১৪০-০২-৬. [১]
- Chandraketugarh : A Lost Civilization - Gourishankar De and Shubhradip De. Kolkata, Sagnik Books, 2004, 109 p., 34 photos, [২]