চট্টগ্রামে ১০ ট্রাক অস্ত্র আটক মামলা

(চট্টগ্রামে ১০ ট্রাক অস্ত্র আটক থেকে পুনর্নির্দেশিত)

চট্টগ্রামে ১০ ট্রাক অস্ত্র আটক মামলা বাংলাদেশের বড় আকারের জাহজে আনীত চোরাচালানের মামলা। ২০০৪ সালের ১লা এপ্রিল তারিখে মধ্যরাতে চট্টগ্রাম ইউরিয়া সার কারখানা বা সিইউএফএল জেটিঘাটে খালাসের সময় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা বিপুল পরিমাণে অস্ত্রশস্ত্র আটক করে যা পরিবহনের জন্য ১০টি ট্রাক প্রয়োজন হয়েছিল। এই অস্ত্রশস্ত্রের চোরাচালান জাহাজের মাধ্যমে বঙ্গোপসাগরে দিয়ে এনে কর্ণফুলী নদীতে আনা হয়েছিল। সরকারের উচ্চপদস্থ ব্যক্তিবর্গ ও সরকারী গোয়েন্দাগণ এই চোরাচালানের বিষয়ে অবহিত বা জড়িত ছিলেন বলে অভিযোগ করা হয়। ২০০৫ সালের ৬ জুলাই এ মামলার বিচার প্রক্রিয়া শুরু করা হয়। ২০১৪ সালের ১৪ ফ্রেব্রুয়ারী তারিখে আদালত এ মামলার রায় প্রকাশ করে। আদালত সাবেক শিল্পমন্ত্রী ও জামায়াতে ইসলামীর আমির মতিউর রহমান নিজামী, সাবেক স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী লুত্ফুজ্জামান বাবরসহ ১৪ জনকে মৃত্যুদণ্ডের আদেশ প্রদান করে।

আটকের ঘটনা সম্পাদনা

১লা এপ্রিল ২০০৪ বাংলাদেশের বন্দর নগরীতে চট্টগ্রাম ইউরিয়া ফার্টিলাইজার লিমিটেড এর জেটিতে ১০ ট্রাক বিভিন্ন ধরনের অস্ত্র ও গোলাবারুদ আটকের ঘটনা ঘটে। বাংলাদেশের ইতিহাসে ধরা পড়া অস্ত্র চোরাচালানের মধ্যে এটি সর্বোচ্চ পরিমাণ। এ মামলার পাবলিক প্রসিকউটর কামাল উদ্দিন আহমেদের মতে আসামি ছাড়াও এই মামলার কয়েকজন সাক্ষী আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দিতে ভারতের বিচ্ছিন্নতাবাদী সংগঠন উলফার জন্য আটককৃত অস্ত্রশস্ত্র বাংলাদেশের জলসীমা ব্যবহার করে আনয়ন করা হয়েছিল। আটককালে চোরাচালনের মোট ৪৬৩টি বাক্স অশস্ত্রসশ্ত্র উদ্ধার করা হয় যেগুলির মধ্যে ছিল এমটিটি, এসএমজি, টমিগান ৭৯০টি, গ্রেনেড ২৭ হাজার, রকেট লঞ্চার ১৫০, ম্যাগজিন ৬২০ এবং ১১ লাখ ৪৩ হাজার ৫২০টি গুলি। এগুলির আনুমানিক মূল্য ২৭ হাজার কোটি টাকা। পত্রিকার সংবাদে বলা হয়েছে যে উলফা চীন থেকে ক্রয় করে কিউসি নামীয় জাহাজে করে বাংলাদেশের জলসীমায় নিয়ে আসে এবং দুটি ‘কনটেইনার বোট’-এ করে বাংলাদেশের ভূমিসীমায় অবতরণ করায়। চট্টগ্রাম থেকে স্থলপথে ভারতে উলফার কাছে এ অস্ত্র প্রেরণের পরিকল্পনা ছিল।[১][২]

মামলা সম্পাদনা

২০০৪ সালের ১লা এপ্রিল তারিখে মধ্যরাতে চট্টগ্রাম ইউরিয়া সার কারখানা বা সিইউএফএল জেটিঘাটে খালাসের সময় সদস্যরা আটক করে ১০ ট্রাক সমপরিমাণ অস্ত্র। ঘটনাস্থল থেকে আটক করা হয় পাঁচ ব্যক্তিকে। পর দিন ২ এপ্রিল ২০০৪ ভোরে পুলিশ প্রহরায় আটক অস্ত্র চট্টগ্রাম নগরীর দামপাড়া পুলিশ লাইন্সে নিয়ে যাওয়া হয়। তৎকালীন স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী লুৎফুজ্জামান বাবর সেদিনই আটককৃত অস্ত্র পরিদর্শন করেন। পর দিন ৩রা এপ্রিল ২০০৪ তারিখে কর্ণফুলী থানার তৎকালীন ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) আহাদুর রহমান বাদী হয়ে ১৯৭৪ সালের বিশেষ ক্ষমতা আইনের ২৫(বি) ধারায় এবং ১৮৭৮ সালের ১৯(এ) ধারায় অস্ত্র আইনে দুটি মামলা দায়ের করেছিলেন। তবে তিনি এর এজাহারে কোনো আসামির নাম উল্লেখ করেন নি। পরবর্তী কালে মামলার তদন্তের দায়িত্ব দেয়া হয় সিআইডি পুলিশকে। ২০০৭ সাল হতে প্রসিকিউশন অবৈধ অস্ত্র চোরাচালান মামলার চার্জ গঠনে জোর তৎপরতা শুরু করে।

অস্ত্র আটক ও চোরাচালান আটকের ঘটনায় ১০ ট্রাক অস্ত্র আটকের ঘটনায় দায়ের করা দুটি মামলা দায়ের করা হয়। মামলায় ২০০৪ সালের ১১ জুন প্রথম দফা ৪১ জনের বিরুদ্ধে অভিযোগপত্র দাখিল করে সিআইডি। এরপর রাষ্ট্রপক্ষের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে একই বছর ২০০৭ এর ২৫ আগস্ট সম্পূরক অভিযোগপত্র দাখিল করা হয়। ২০০৭ সালের ১৯ নভেম্বর সেনাসমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে এ মামলা দুটির অধিকতর তদন্ত শুরু হয়। তদন্ত শেষে ২০১১ সালের ২৬ জুন নতুন করে বাবর, নিজামীসহ ১১ জনকে জড়িত করে সম্পূরক অভিযোগপত্র দাখিল করা হয়। অস্ত্র আটক মামলায় ৫০ জন এবং চোরাচালান আইনে ৫২ জনকে আসামি করা হয়। ২০১১ সালের ২৯ নভেম্বর থেকে সাক্ষ্য গ্রহণ শুরু হয়। অস্ত্র আটক মামলায় ৫৬ এবং চোরাচালান আইনে ৫৩ জন সাক্ষী সাক্ষ্য দেন।[৩]

আসামীদের নাম সম্পাদনা

এই মামলার অভিযুক্তদের মধ্যে তৎকালীন বিএনপি সরকারের বিভিন্ন উচ্চপদস্থ রাজনীতিবিদ ও সামরিক বাহীনীর পদস্থ কর্মকর্তাদের জড়িত করা হয়। এদের বেশিরভাগ কর্মকর্তা সরকারের মেয়াদকালের শেষে অর্থাৎ অক্টোবর, ২০০৬ এর মধ্যে দায়িত্ব থেকে অবসর গ্রহণ করেন। এরা হলেনঃ বাবর, নিজামী ও পরেশ বড়ুয়া ছাড়া ফাঁসির দণ্ডাদেশপ্রাপ্ত অন্য আসামিরা হলেন ডিজিএফআইয়ের সাবেক পরিচালক মেজর জেনারেল (অব.) রেজ্জাকুল হায়দার চৌধুরী, এনএসআইয়ের সাবেক মহাপরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) মো. আবদুর রহিম, পরিচালক উইং কমান্ডার (অব.) সাহাব উদ্দিন আহাম্মদ, উপপরিচালক মেজর (অব.) লিয়াকত হোসেন, এনএসআইয়ের মাঠ কর্মকর্তা আকবর হোসেন খান, সিইউএফএলের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মহসিন উদ্দিন তালুকদার, মহাব্যবস্থাপক (প্রশাসন) কে এম এনামুল হক, শিল্প মন্ত্রণালয়ের সাবেক ভারপ্রাপ্ত সচিব নুরুল আমিন, অস্ত্র বহনকারী ট্রলারের মালিক হাজি সোবহান, চোরাকারবারি হাফিজুর রহমান এবং অস্ত্র খালাসের জন্য শ্রমিক সরবরাহকারী দ্বীন মোহাম্মদ। এঁদের মধ্যে পরেশ বড়ুয়া ও নুরুল আমিন পলাতক।

  • মেজর জেনারেল রেজ্জাকুল হায়দার চৌধুরি, সাবেক ডিরেক্টর জেনারেল, ডিরেক্টরেট জেনারেল অফ ফোর্সেস ইন্টেলিজেন্স;[৪]
  • বিগ্রেডিয়ার জেনারেল আব্দুর রহিম, সাবেক ডিরেক্টর জেনারেল, জাতীয় নিরাপত্তা গোয়েন্দা;[৪]
  • উইং কমান্ডার শাহাবুদ্দিন আহমেদ, সাবেক পরিচালক, জাতীয় নিরাপত্তা গোয়েন্দা;
  • নুরুল আমিন, সাবেক অতিরিক্ত সচিব, শিল্প মণত্রণালয়;
  • মেজর লিয়াকত হোসেন
  • ফিল্ড অফিসার আকবর হোসাইন
  • চট্টগ্রাম এই অস্ত্র মামলা ও বেশ কয়েকটি হত্যামূলক ঘটনার সত্যতা যাচাই করে মতিউর রহমান নিজামীকে ১১ মে ২০১৬ এর ০০:১০ মিনিটে ফাঁসির মাধ্যমে মৃত্যুদন্ড প্রদান করা হয়।

বিচার প্রক্রিয়া সম্পাদনা

২০০৫ সালের ৬ জুলাই এ মামলায় বাদি আহাদুর রহমানের সাক্ষ্য দেয়ার মধ্য দিয়ে বিচার শুরু হয়। ২০০৭ সালের ১৪ আগস্ট পর্যন্ত সাক্ষ্যগ্রহণ চলে। অস্ত্র আটক মামলায় ৫৬ এবং চোরাচালান আইনে ৫৩ জন সাক্ষী সাক্ষ্য প্রদান করে। বিচারপতি ভবানী প্রসাদ সিংহ ও বিচারপতি মো. কামরুল হোসেন মোল্লাহের সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্ট বেঞ্চ মামলার শুনানীতে অপারগতা প্রকাশ করেন।[৫]

আদালতের রায় সম্পাদনা

২০১৪ সালের ৩০ জানুয়ারি চট্টগ্রাম মহানগর দায়রা জজ আদালত এবং বিশেষ ট্রাইব্যুনাল-১ এর বিচারক এস. এম. মজিবুর রহমান মামলার রায় ঘোষণা করেন। ২০১৪ সালের ১৪ ফ্রেবুয়ারী তারিখে আদালত এ মামলার রায় প্রকাশ করে। রায়ের দৈর্ঘ ৫১৪ পৃষ্ঠা। চট্টগ্রাম মহানগর দায়রা জজ আদালতের রায়ে ২৬০ পৃষ্ঠা চোরাচালান মামলার রায় এবং ২৫৪ পৃষ্ঠা অস্ত্র মামলার রায়। আদালত সাবেক শিল্পমন্ত্রী ও জামায়াতে ইসলামীর আমির মতিউর রহমান নিজামী, সাবেক স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী লুত্ফুজ্জামান বাবরসহ ১৪ জনকে মৃত্যুদণ্ডের আদেশ দেন। রায়ে সাবেক স্বরাষ্ট্রপ্রতিমন্ত্রী লুত্‍ফুজ্জামান বাবর এবং জামায়াতের আমীর সাবেক শিল্পমন্ত্রী মতিউর রহমান নিজামীসহ ১৪ জনের ফাঁসির আদেশ দেয়া হয়৷ অন্যরা হলেন ভারতের বিচ্ছিন্নতাবাদী সংগঠন উলাফার সামরিক কমান্ডার পরেশ বড়ুয়া, সাবেক শিল্পসচিব নুরল আমিন, ডিজিএফআই-র সাবেক মহাপরিচালক মেজর জেনারেল (অব.) রেজ্জাকুল হায়দার চৌধুরী, এনএসআই-র সাবেক মহাপরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) আব্দুর রহিম, পরিচালক উইং কমান্ডার (অব.) সাহাব উদ্দিন আহাম্মদ, উপপরিচালক মেজর (অব.) লিয়াকত হোসেন, এনএসআই-র মাঠ কর্মকর্তা আকবর হোসেন খান, সিইউএফএল-র ব্যবস্থাপনা পরিচালক মহসিন উদ্দিন তালুকদার, মহাব্যবস্থাপক(প্রশাসন) কে এম এনামুল হক, হাফিজুর রহমান, দীন মোহাম্মদ এবং হাজি আব্দুস সোবাহান৷ এঁদের মধ্যে পরেশ বড়ুয়া এবং নুরুল আমিন পলাতক৷ পাশাপাশি প্রত্যেককে পাঁচ লাখ টাকা করে জরিমানা করে।

এ ছাড়া অস্ত্র আটক মামলার দুটি ধারায় তাদের যাবজ্জীবন ও সাত বছর কারাদণ্ড দেয়া হয়েছিল। অস্ত্র চোরাচালান মামলার মোট আসামি ছিলেন ৫২ জন। এদের মধ্যে ৩৮ জনকে আদালত মুক্তি দেন। মৃত্যুদণ্ড পাওয়া বাকি আসামিরা হলেন— উলফার সামরিক কমান্ডার পরেশ বড়ুয়া, সাবেক শিল্পসচিব নুরুল আমিন, প্রতিরক্ষা গোয়েন্দা মহাপরিদপ্তরের (ডিজিএফআই) সাবেক মহাপরিচালক মেজর জেনারেল (অব.) রেজ্জাকুল হায়দার চৌধুরী, জাতীয় নিরাপত্তা গোয়েন্দা সংস্থার (এনএসআই) সাবেক মহাপরিচালক ব্রিগেডিয়ার (অব.) আবদুর রহিম, পরিচালক উইং কমান্ডার (অব.) সাহাব উদ্দিন আহাম্মদ, উপপরিচালক মেজর (অব.) লিয়াকত হোসেন, এনএসআইয়ের মাঠ কর্মকর্তা আকবর হোসেন খান, সিইউএফএলের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মহসিন উদ্দিন তালুকদার, মহাব্যবস্থাপক (প্রশাসন) কে এম এনামুল হক, হাফিজুর রহমান, দীন মোহাম্মদ ও হাজি আবদুস সোবহান।[৬]

তথ্যসূত্র সম্পাদনা