গোলাপের খেলা

ইংল্যান্ডের ইয়র্কশায়ার ও ল্যাঙ্কাশায়ারের মধ্যকার যে-কোন ধরনের ক্রিকেট প্রতিযোগিতা

গোলাপের খেলা (ইংরেজি: Roses Match) পরিভাষাবিশেষ। ইয়র্কশায়ার ও ল্যাঙ্কাশায়ারের মধ্যকার যে-কোন ধরনের ক্রিকেট খেলাকে বোঝানো হয়ে থাকে। ইয়র্কশায়ারের প্রতীক হিসেবে সাদা গোলাপ ও ল্যাঙ্কাশায়ারের প্রতীক হিসেবে রয়েছে লাল গোলাপ। পঞ্চদশ শতাব্দীতে গোলাপের যুদ্ধকে ঘিরে এ সংস্থাগুলো জড়িত হয়ে পড়ে। খেলাগুলোয় দীর্ঘ ও গর্বিত ইতিহাস রয়েছে এবং ঐতিহ্যগতভাবে ইংরেজ প্রথম-শ্রেণীর খেলাগুলোয় সর্বাপেক্ষা তীব্র উত্তেজনাপূর্ণ খেলায় পরিণত হয়েছে। পরাজয়বরণের চেয়ে কঠোর অবস্থানে থেকে অনেকগুলো ড্র হবার রেকর্ড রয়েছে।

ল্যাঙ্কাশায়ারের হোয়ালি এলাকায় অবস্থিত স্টেশন রোড গ্রাউন্ডে প্রথমবারের মতো গোলাপের খেলা আয়োজন করা হয়েছিল।

এ পরিভাষাটি ল্যাঙ্কাশায়ারের সাথে ইয়র্কশায়ারের অন্যান্য ক্রীড়া যেমন: রাগবি ইউনিয়ন[১] ও রাগবি লীগে মাঝে-মধ্যে ব্যবহার করা হয়ে থাকে।

ইতিহাস সম্পাদনা

১৮৪৯ সালে ইয়র্কশায়ার ও ল্যাঙ্কাশায়ারের মধ্যকার প্রথম-শ্রেণীর ক্রিকেট খেলাটি প্রথমবারের মতো অনুষ্ঠিত হয়েছিল। শেফিল্ডের হাইড পার্ক গ্রাউন্ড অনুষ্ঠিত ঐ খেলায় ইয়র্কশায়ার দল ৫ উইকেটে জয়লাভ করে। সর্বপ্রথম গোলাপের খেলাটি ১৮৬৭ সালে ব্ল্যাকবার্নের কাছাকাছি হোয়ালির স্টেশন রোড ক্রিকেট গ্রাউন্ডে আয়োজন করা হয়। এতে ইয়র্কশায়ার দল ৫ উইকেটে জয় পায়। নবপ্রবর্তিত কাউন্টি চ্যাম্পিয়নশীপে প্রথম খেলাটি ১৮৯০ সালে অনুষ্ঠিত হয়েছিল। খেলাটি অবধারিতভাবে ড্রয়ে পরিণত হয়। প্রথম খেলার পর থেকে দেড়শত বছরে ছয় শতাধিক প্রথম-শ্রেণীর, দ্বিতীয় শ্রেণীর, একদিনের ও অন্যান্য প্রতিনিধিত্বমূলক গোলাপের খেলা হয়েছে।

জুন, ১৯২৪ সালের ব্যাংকের ছুটিরদিনে হুইটসানটাইডে ল্যাঙ্কাশায়ার দল দ্বিতীয় ইনিংসে মাত্র ৭৪ রান গুটিয়ে যায়। এরফলে, পরদিন ইয়র্কশায়ার দল মাত্র ৫৮ রানের জয়ের লক্ষ্যমাত্রায় অগ্রসর হয়। পার্সি হোমসহার্বার্ট সাটক্লিফ ইয়র্কশায়ারের ব্যাটিং উদ্বোধনে নামেন। তবে, সেসিল পার্কিনডিক টিল্ডসলে’র বোলিং তোপে পড়ে ইয়র্কশায়ার দল মাত্র ৩৩ রানে অল-আউট হয়ে যায়। এরফলে, ল্যাঙ্কাশায়ার দল ২৫ বছরের মধ্যে প্রথম জয়ের সন্ধান পায়।[২]

১৯২৬ সালে ওল্ড ট্রাফোর্ডে অনুষ্ঠিত গোলাপের খেলায় রেকর্ডসংখ্যক ৭৮,৬১৭ জন দর্শকের উপস্থিতি ছিল। তবে, ঊর্ধ্বমূখী রানের ঐ খেলাটি ড্রয়ে পরিণত হয়েছিল। ল্যাঙ্কাশায়ারের পক্ষে হ্যারি মেকপিস ১২৬, আর্নেস্ট টিল্ডসলে ১৩৯ ও ফ্রাঙ্ক ওয়াটসন ৯২ রান সংগ্রহ করেন। এ সংগ্রহের বিপরীতে ইয়র্কশায়ারের কিংবদন্তি পার্সি হোমস ১৪৩ ও হার্বার্ট সাটক্লিফ ৮৯ রান করতে সক্ষম হন। তন্মধ্যে, হার্বার্ট সাটক্লিফ দুই বছর পূর্বে ১৯৯ রানের ইনিংস খেলেছিলেন। দলের সংগ্রহ ৪৯৯ থাকা অবস্থায় ল্যাঙ্কাশায়ারের অধিনায়ক লিওনার্ড গ্রীন ব্যাটিংয়ে নামেন। বিখ্যাত ইংরেজ লেখক নেভিল কারদাস এ সম্পর্কে গ্রীনের কাছ থেকে জানতে পারেন যে, ‘ল্যাঙ্কাশায়ার যে ইয়র্কশায়ারের বিপক্ষে ৫০০ রান তুলতে পারবে কেউ তা ভাবতে পারেনি। আমি একটি রান সংগ্রহ করতে চেয়েছিলাম, মরে যদি যাই, তাও। উইলফ্রেড রোডসের বল থেকে অফ সাইডে ঠেলে দেই ও বাতাসের গতিবেগে যেতে থাকি।' তবে, ইয়র্কশায়ারের শীর্ষস্থানীয় তারকা এমট রবিনসন বলটি রোডসের কাছে দিলে গ্রীন লাফিয়ে মাটিতে স্পর্শ করলেও আউট হন। প্যাভিলিয়নে ফেরার পথে তিনি রোডসের কাছ থেকে শুনতে পান যে,

উইকেটে কিন্তু কেউ একজন আছেন। আহ! জানি না তিনি কে হতে পারেন! কিন্তু কেউ একজন আছেন। 'আহ! জানি না তিনি কে হতে পারেন!' বাক্যটি জনপ্রিয়তা লাভ করে।[২]

অর্জনসমূহ সম্পাদনা

অবশেষে, ১৯২৬ সালে ল্যাঙ্কাশায়ার দল তাদের পূর্ববর্তী সর্বোচ্চ রানকে পিছনে ফেলে ৫০৯/৯ তুলে ইনিংস ঘোষণা করে। পরবর্তীতে, ২০০৫ সালে অধিনায়ক মার্ক চিল্টন ও ইয়ান সাটক্লিফের উদ্বোধনী জুটিতে ২২৩ রান তোলার সুবাদে ৫৩৭ তুলতে সক্ষম হয়। এ পর্যায়ে দলটি ইয়র্কশায়ারের বিপক্ষে প্রথম উইকেট জুটিতে সর্বোচ্চ রান তুলে ১৯১২ সালে ওল্ড ট্রাফোর্ডে রেজি স্পুনার ও হ্যারি মেকপিসের গড়া ১৮১ রানের রেকর্ডকে ম্লান করে দেয়।

ব্যাটসম্যানদের উপযোগী পিচে একচ্ছত্র আধিপত্য বিস্তারের চিত্র বোলিংয়ের মাধ্যমে ভেঙ্গে ফেলার প্রয়াস চালানো হয়। কুখ্যাত বডিলাইন সিরিজের পূর্বে ১৯২৭ সালের পর অস্ট্রেলীয় ফাস্ট বোলার টেড ম্যাকডোনাল্ড গোলাপের খেলায় লেগ তত্ত্ব প্রয়োগ করেছিলেন। তিনি স্লিপে কোন ফিল্ডার না রেখে চারজন খেলোয়াড়কে লেগের দিকে ফাঁদ পেতে বোলিং কর্মে অগ্রসর হয়েছিলেন।

বেশ কয়েকজন বোলার গোলাপের খেলায় অসাধারণ বোলিংশৈলী প্রদর্শন করেছেন। ১৯৩৭ সালে ল্যাঙ্কাশায়ারের পক্ষে জ্যাক ইডন ৯/৫২ পান। পরবর্তীকালে ১৯৫৪ সালে ওল্ড ট্রাফোর্ডে ইয়র্কশায়ারের প্রতিভাবান বামহাতি স্পিনার জনি ওয়ারডল বৃষ্টিবিঘ্নিত পিচে ৯/২৫ বোলিং পরিসংখ্যান দাঁড় করান।

১৯৪৯ সালে ফ্রেড ট্রুম্যান এ খেলায় অংশগ্রহণের মাধ্যমে প্রথম-শ্রেণীর ক্রিকেটে অভিষিক্ত হন। অন্যদিকে ইংল্যান্ডে তার দীর্ঘদিনে সঙ্গী ল্যাঙ্কাশায়ারীয় কিংবদন্তি ব্রায়ান স্ট্যাদাম আগস্ট, ১৯৫০ সালে মাত্র ২০ বছর বয়সে প্রথম গোলাপের খেলায় অংশ নিয়ে বড় ধরনের অঘটন ঘটান। তবে, ওল্ড ট্রাফোর্ডে তার উদ্বোধনী বোলিং কর্মের পর দর্শকেরা তার মুখে ধুলো ছিটায়। তিনি নিজেকে সামলে নেন। এরপর তিনি ফ্রাঙ্ক লসনের মাঝের স্ট্যাম্পে আঘাত করেন। এরপর টেড লেস্টার ও উইলি ওয়াটসনকে শূন্য রানে বিদেয় করেন। উইজডেনে তার এ বোলিংকে অত্যন্ত আশাপ্রদ ও চিত্তাকর্ষকের সীমাকে অতিক্রম করার সামিল হিসেবে উল্লেখ করে।

সাম্প্রতিক সময়কাল সম্পাদনা

গ্রানাডা টেলিভিশনের মাধ্যমে আইটিভিতে, ল্যাঙ্কাশায়ার ও ইয়র্কশায়ার টেলিভিশনে ১৯৭০-এর দশক থেকে ১৯৮০-এর দশকের শেষদিক পর্যন্ত খেলা সম্প্রচার করা হতো। এ সকল এলাকাসহ যুক্তরাজ্যের অন্যান্য আইটিভি অঞ্চলে তা দেখা যেতো।

কাউন্টি চ্যাম্পিয়নশীপের একটি মৌসুমে দুইটি গোলাপের খেলা হোম এন্ড অ্যাওয়ে পদ্ধতিতে অনুষ্ঠিত হয়েছে। ১৯৯৩ সালে চ্যাম্পিয়নশীপে দলের সংখ্যা ১৮ হওয়ায় প্রত্যেক দল একে-অপরের বিপক্ষে একবার করে অংশ নেয়। কয়েক মৌসুমে হোম এন্ড অ্যাওয়ে পদ্ধতির ধারা বজায় রাখতে মৌসুমের শুরুতে অতিরিক্ত খেলা আয়োজন করে ধারাবাহিকতা রক্ষা করা হয়েছিল। ২০০০ সাল থেকে কাউন্টি চ্যাম্পিয়নশীপে দুইটি বিভাগের প্রবর্তনের ফলে হোম এন্ড অ্যাওয়ের মাধ্যমে দুইটি গোলাপের খেলা আয়োজন করা হয়। কিন্তু, ২০০২ সালে ইয়র্কশায়ারের অবনমন ঘটলে তিন বছর এ খেলায় ছেদ ঘটে। প্রথম বিভাগে উত্তরণের পর পুনরায় এ ধারা বহমান হয়।

অস্ট্রেলীয় ব্যাটসম্যান ড্যারেন লেহম্যান মাত্র ২৮৮ বলে ২৫২ রান তুলেছিলেন। ২০০১ সালে হেডিংলিতে অনুষ্ঠিত গোলাপের খেলায় এ কীর্তি গড়েন তিনি। ঐ বছরই ৩০ বছরের অধিক সময় পর ইয়র্কশায়ার দল কাউন্টি চ্যাম্পিয়নশীপের শিরোপা করায়ত্ত্ব করতে সমর্থ হয়েছিল। সতীর্থ অস্ট্রেলীয় স্টুয়ার্ট লঅ্যান্ড্রু সাইমন্ডস দ্রুতগতিতে সেঞ্চুরি করেছেন। সাম্প্রতিক বছরগুলোয় গোলাপের খেলায় অ্যান্ড্রু ফ্লিনটফ তার ব্যক্তিগত সেরা ১৬০ রান তুলেন। তন্মধ্যে, খেলা শুরু থেকে মধ্যাহ্নভোজনের সময়কালে ১১১ রান তুলেছিলেন।

সেপ্টেম্বর, ২০১৪ সালে ইয়র্কশায়ারের অ্যাডাম লিথ তার খেলোয়াড়ী জীবনের সেরা ২৫১ রান করেন। এ পর্যায়ে আদিল রশিদের সাথে ৬ষ্ঠ উইকেটে রেকর্ডসংখ্যক ২৯৬ রান তুলেছিলেন।[৩]

২০০৩ সালে টুয়েন্টি২০ কাপের প্রচলন শুরু হয়। এ সকল খেলাগুলোয় ‘ইয়র্কশায়ার কার্নেগি’ ‘ল্যাঙ্কাশায়ার লাইটনিংয়ের’ মুখোমুখি হয়। স্বল্প সময়ের এ ধরনের খেলায় মাঠে বিশালসংখ্যক দর্শক উপস্থিত হচ্ছেন। জুন, ২০০৬ সালে হেডিংলিতে ১৪২১৫ জন দর্শক আসেন। ২০০৮ সালে এ সংখ্যা বৃদ্ধি পেয়ে ১৭,০০০ জন হয়। জুলাই, ২০১৩ সালে হেডিংলিতে সবগুলো টিকিট বিক্রয় হয়ে যায় ও ১৭,৫০০ জন দর্শক উপস্থিত ছিলেন। তারা টুয়েন্টি২০ খেলায় উভয় দলের মধ্যকার প্রথমবারের মতো টাই পর্যবেক্ষণ করেন। ২০১৩ সাল শেষে ইয়র্কশায়ার ৯টি ও ল্যাঙ্কাশায়ার ৮টি খেলায় জয় পায়। একটি খেলা টাইয়ে পরিণত হয় ও কোন খেলাই পরিত্যক্ত ঘোষিত হয়নি।

২০১২ সালে ইয়র্কশায়ার দল অবনমনের কবলে পড়লে কোন গোলাপের খেলা কাউন্টি চ্যাম্পিয়নশীপ চলাকালে হয়নি। ২০১১ সালের কাউন্টি চ্যাম্পিয়নশীপের উভয় খেলায় ল্যাঙ্কাশায়ার দল বিজয়ী হয়।[৪]

জুন, ২০১৫ সালে ল্যাঙ্কাশায়ার লাইটনিংয়ের পক্ষে জস বাটলার শেষ বলে ইয়র্কশায়ার ভাইকিংসের বিপক্ষে জয় পেতে সহায়তা করেন। হেডিংলিতে অনুষ্ঠিত ঐ খেলায় শেষ বলে জয় পায়। অদ্যাবধি এ খেলাটিই টুয়েন্টি২০ গোলাপের খেলায় সর্বাপেক্ষা নাটকীয় খেলারূপে চিত্রিত হয়।[৫][৬]

ফলাফল বিবরণী (১৮৪৯ - ২০০৮) সম্পাদনা

খেলার ধরন সর্বমোট খেলা ইয়র্কশায়ার ল্যাঙ্কাশায়ার ড্র ফলাফল হয়নি
এফসি (৩/৪-দিনের খেলা) ২৬৪ ৮৩ ৫৩ ১২৭
একদিনের ৬২ ২১ ৩৪ -
টুয়েন্টি২০ ১৭

তথ্যসূত্র সম্পাদনা

  1. "Rugby Football Union – Community Rugby Detail"। ৩০ সেপ্টেম্বর ২০০৭ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ৯ এপ্রিল ২০২০ 
  2. Neville Cardus (১৯৬৮)। "Beside the Roses the Ashes paled into insignificance – Neville Cardus on the importance of the annual battle between Yorkshire and Lancashire"ESPNCricinfoThe Cricketer / Features। সংগ্রহের তারিখ ১৫ ফেব্রুয়ারি ২০১৩ 
  3. http://www.espncricinfo.com/county-cricket-2014/engine/match/692839.html
  4. http://news.bbc.co.uk/sport1/hi/cricket/14885148.stm
  5. Joe Root and Gary Ballance help Yorkshire Vikings to 185 for eight
  6. Jos Buttler blasts unbeaten 71 as Lancashire Lightning win off last ball

বহিঃসংযোগ সম্পাদনা