গোয়ালপাড়িয়া লোকগীতি
গোয়ালপাড়িয়া লোকগীতি (আসাম: গোৱালপৰীয়া লোকগীত) আসামের গোয়ালপাড়া অঞ্চলে বহুল প্রচলিত এক লোকসঙ্গীত যা এতদঞ্চলের মানুষের কথ্য গোয়ালপাড়িয়া উপভাষায় প্রাচীনকাল থেকে চর্চিত ও গীত হয়ে আসতেছে। সঙ্গীতের এই ধারাটি বাংলা বা আসাম যে অঞ্চলেরই হোক না কেন এর পরিচয় ও রূপ বৈচিত্র্য জাতীয় পর্যায়ে তুলে ধরার মূল কারিগর ছিলেন বিখ্যাত গোয়ালপাড়িয়া লোকগীতি শিল্পী প্রতিমা বড়ুয়া পাণ্ডে। গোয়ালপাড়িয়া লোকগীতি তার কথ্য রীতি, সুর, জনজীবনের দৃশ্যাবলী ও বাদ্যযন্ত্রের জন্য বিখ্যাত। বর্তমানে বাণিজ্যিকভাবে গোয়ালপাড়িয়া লোকগীতির অ্যালবাম বের হচ্ছে; এবং এই সঙ্গীতের মোটিফ ও বাদ্যযান্ত্র ভারতের জনপ্রিয় গানগুলোতে ক্রমবর্ধমান ব্যবহার করা হচ্ছে। নজরুল হক, আলাউদ্দিন সরকার, হামিদা সরকার, আব্দুল জব্বার, কল্পনা পাটোয়ারী ও রহিমা বেগম কালিতা এই লোকসঙ্গীতের কয়েকজন বিখ্যাত শিল্পী। তদুপরি জনপ্রিয় গায়ক যেমন— ড. ভূপেন হাজারিকা, জুবিন গার্গ ও অংগরাগ মহন্ত পাপনসহ প্রমুখ শিল্পী গোয়ালপাড়িয়া লোকগীতি গেয়েছেন। সূক্ষ্ম পার্থক্য থাকলেও গোয়ালপাড়িয়া নামে আসামে প্রচলিত লোকগীতির এই ধারাটি বাংলাদেশের রংপুর এবং পশ্চিম বঙ্গের জলপাইগুড়ি, কোচবিহার, আলিপুরদুয়ারে ভাওয়াইয়া নামে স্বীকৃত।
বিষয়বস্তু ও রূপভেদ
সম্পাদনাগোয়ালপাড়িয়া লোকগীতি ধর্মীয় বা ধর্মানুষ্ঠান সংশ্লিষ্ট কোন সঙ্গীত নয়। আবার প্রেম এসব রচনার মূল থিম হলেও তা একচেটিয়া নয়। জনজীবনের দৃশ্য, কৃষি, ঈশ্বর বন্দনা, দর্শন, হাতি প্রভৃতি এর বিষয়বস্তুরূপে ঠাই পেয়েছে। ভাওয়াইয়া ও গোয়ালপাড়িয়া লোকগীতির মধ্যে কোনটি কার ধারা বা উপধারা, এগুলো পরস্পরের কতটুকু অভিন্ন কিংবা এগুলোর মধ্যে পার্থক্য কতটুকু সেসব নিয়ে আলোচনার যথেষ্ট অবকাশ রয়েছে। মৈষালী, মাউত ও চটকাকে গোয়ালপাড়িয়া লোকগীতির অন্যতম কয়েকটি শাখা হিসেবে ধরা যেতে পারে যেগুলোর মেজাজ ও বিষয়বস্তুর মধ্যে বিস্তর বৈচিত্র্য বিদ্যমান। যাইহোক, এই গানগুলো সাধারণত সমবেত কণ্ঠে গাওয়া হলেও এগুলো দোতারার একক সঙ্গতেও মানানসই ও শ্রুতিমধুর। দোতারা ও সারিন্দা[১] গোয়ালপাড়িয়া লোকগীতির প্রধান বাদ্যযন্ত্র হলেও তাল, বাঁশি, একতারা, বিশেষ ধরনের নাগরাও এতে ব্যবহার করা হয়।
গ্রামীণ শ্রমজীবী পেশার নারীর ইচ্ছা, আকাঙ্ক্ষা, কামনা বাসনা ও আবেগের সাথে জড়িত সঙ্গীতের এই ধারাটি মূলত নারীরাই গেয়ে থাকেন ও চর্চা করেন। ১৯৫০ সাল থেকে, বিশেষকরে প্রতিমা বড়ুয়া পাণ্ডের আগমণের পর গোয়ালপাড়িয়া লোকগীতির পরিবেশন-রীতিতে ব্যাপক রূপান্তর ঘটতে থাকে। বর্তমানে এটি তার মূল জাগতিক সুরবিন্যাস থেকে সরে গিয়ে আন্তর্জাতিক সঙ্গীত পরিবেশণ রীতিতে প্রবেশ করেছে এবং নানা সামাজিক, অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক চাপে পড়ে ‘সাধারণ লোকসঙ্গীত’ থেকে একটি ‘সম্ভ্রান্ত মঞ্চে’ উন্নীত হয়েছে।[১]
ভাওয়াইয়া
সম্পাদনাভাওয়াইয়া প্রেম ও আকাঙ্ক্ষা বিষয়ক সঙ্গীত। সংস্কৃত ভাব শব্দ হতে ভাওয়াইয়া শব্দটি এসেছে। ভাওয়াইয়াতে গাম্ভীর্যের প্লাবন ঘটে যার সুর গুঞ্জরিত হয় হতাশার করুণ আবহে। ভাওয়াইতে বর্ণিত প্রেম স্নেহপূর্ণ ও রোমাঞ্চকর নয়; এই প্রেম একক প্রেম এবং তা বিরহ বিচ্ছেদের আগুনে জ্বলমান, এই প্রেম স্বামী বা প্রেমিককে কাছে পাওয়া তীব্র আকাঙ্ক্ষার বহিঃপ্রকাশ।[২]
চটকা
সম্পাদনাচটকা হল ভাওয়াইয়ার অধঃপতিত বা অপভ্রংশ রূপ[৩] যেখানে দুঃখ হতাশার কোন গাম্ভীর্য নেই। চটকার প্রেম একতরফা প্রেম নয় বরং তা মুখরোচক কৌতূহল উদ্দীপক ও কৌতুকময় এবং অবশ্যই সে প্রেম দ্বৈত প্রেম যার প্রস্ফুটন ঘটে নৈমিত্তিক চটুলতার মাধ্যমে। ব্যাঙ্গাত্মক রস ও প্যারোডির চরমভাব সমৃদ্ধ চটকা গানের কথা সংক্ষিপ্ত ও মুচমুচে।[৪] দেবর-ভাবীর সম্পর্ক, শ্যালিকা বোন-জামাইের সম্পর্ক, বিবাহ বহির্ভূত সম্পর্ক, বেহাই-বেহাইনের আথিয়েতার ন্যায় বিষয়গুলির রসাত্মক প্রকাশ ঘটে চটকা গানে। স্থানীয় ভাষায় চট শব্দের অর্থ তাড়াতাড়ি। এই চট শব্দটির স্ত্রীলিঙ্গান্তর করে চটকা শব্দের উৎপত্তি হয়েছে। হালকা তাল ও ছন্দে রচিত এ গানে লঘু তাল এবং জলদ লয় ব্যবহার করা হয়। ফলে দরিয়া গানের মতো প্রলম্বিত সুর বিন্যাসের ধীরস্থির ভাব এখানে অনুপস্থিত। চটকার বৈশিষ্ট্যগত কারণে সাধারণত উত্তর বাংলার শিল্পী ছাড়া এ গানের সুরসংযোজনা সম্ভব হয় না।[৫]
তথ্যসূত্র
সম্পাদনা- ↑ ক খ Contemporary ‘Folk’ Dynamics: Shifting Visions and Meanings in the Goalpariya Folk Music of Assam, Research article by Simona Sarma & Anjali Monteiro: Folklore 130 (December 2019): page 331–351
- ↑ Bhāwāiyā: ethnomusicological study; Sukhbilas Barma; ISBN 9788182200708
- ↑ আশুতোষ ভট্টাচার্য (১৯৫৪); বাংলার লোক সাহিত্য - তৃতীয় খণ্ড, পৃষ্ঠা ২৮১; ক্যালকাটা বুক হাউস
- ↑ Dutta, Birendranath. ‘Folklore’.In Assam: Land & People, edited by H. Deka, 217–27. New Delhi: Thomson Press (India), 2009
- ↑ ভাওয়াইয়া, বাংলাপিডিয়া
গ্রন্থপঞ্জি
সম্পাদনা- বঙ্গীয় লোকসংস্কৃতি কোষ, সম্পাদনা ড. বরুণকুমার চক্রবর্তী; অপর্ণা বুক ডিস্ট্রিবিউটর
- বাংলা লোকসংগীত কোষ, সম্পাদনা ড. কাকলী ধারা মণ্ডল; অমর ভারতী, ২০১৩
- বাংলার পল্লীগীতি, চিত্তরঞ্জন দেব; ন্যাশনাল বুক এজেন্সি প্রা: লি: প্রথম মুদ্রণ, ১৯৬৬
- উত্তরবঙ্গের লোকসঙ্গীত ভাওয়াইয়া ও চটকা, বিমলচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
- “Songs of a Lyrical Nature: Bhawaiya and Chatka— A Study of the Folk Culture of the Goalpara Region of Assam”, Birendranath Dutta; University Publication Department, Gauhati University, 1995
বহিঃসংযোগ
সম্পাদনা- ইউটিউব চ্যানেলে গোয়ালপাড়িয়া লোকগীতি
- গোয়ালপাড়িয়া লোকসঙ্গীত ও পাঞ্জাবী লোকসঙ্গীতের ফিউশন। এখানে ড্রাম, ইলেক্ট্রনিক গিটার ও সিন্থেসাইজারকে খুবই ভিন্ন উপায়ে ব্যবহার করা হলেও গোয়ালপাড়িয়া লোকগীতির মূল বাদ্যযন্ত্র দোতারার অক্ষুণ্ণ প্রয়োগ করা হয়েছে।