গাভী বিত্তান্ত

আহমদ ছফা রচিত উপন্যাস

গাভী বিত্তান্ত বাংলাদেশের প্রখ্যাত চিন্তাবিদ ও লেখক আহমদ ছফা রচিত একটি বাস্তবিক গভীর পর্যবেক্ষণে রচিত উপন্যাস। উপন্যাসটি ১৯৯৫ খ্রিস্টাব্দে ঢাকা থেকে প্রকাশিত হয়। গাভী বিত্তান্ত উপন্যাসে চিত্রায়িত হয়েছে একজন উপাচার্যের গোলামি আর বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকদের লেজুড়বৃত্তিক রাজনীতির নোংরা কদর্য রূপ।[১][২][৩]

গাভী বিত্তান্ত
গাভী বিত্তান্ত প্রথম সংস্করণের ধ্রুব এষকৃত প্রচ্ছদ
লেখকআহমদ ছফা
দেশবাংলাদেশ
ভাষাবাংলা
বিষয়বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক রাজনীতি ও দলাদলি
ধরনউপন্যাস
প্রকাশকসন্দেশ (প্রথম প্রকাশক)
প্রকাশনার তারিখ
১৯৯৫

পটভূমি সম্পাদনা

১৯৮৬ থেকে ১৯৯০ পর্যন্ত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ছিলেন জৈবরসায়নের অধ্যাপক আবদুল মান্নান[৪] ছাত্রদের গোলাগুলির মাঝখানে পড়লে ‘বিশেষ যোগ্যতায়’ নিয়োগ পাওয়া বিশ্ববিদ্যালয় উপাচার্যের গর্ভবতী গাভিটি নিহত হয়।[৪] সত্য এ ঘটনাকে উপজীব্য ধরে রচিত গাভী বিত্তান্ত উপন্যাসের প্রকাশ হয় ১৯৯৫ সালে। উপন্যাসের অনেক চরিত্রই পাঠকদের তাই চেনা-পরিচিত মনে হবে।[৪] কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ের নাম উল্লেখ না করেই এ উপন্যাসে ছফা বলেন,

‘‘আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়টির ছিল গৌরবময় অতীত। অনেকে এই বিশ্ববিদ্যালয়টিকে গোটা দেশের আত্মার সঙ্গে তুলনা করে গর্ববোধ করতেন। ...অতীতের গরিমার ভার বইবার ক্ষমতা বর্তমানে বিশ্ববিদ্যালয়ের নেই।’’[৪]

কাহিনীসংক্ষেপ সম্পাদনা

সকলের দৃষ্টির অজান্তে [বিশ্ববিদ্যালয়টিতে] একের অধিক হনন কারখানা বসেছে, কারা এন্তেজাম করে বসিয়েছেন সকলে বিশদ জানে। কিন্তু কেউ প্রকাশ করে না। ফুটন্ত গোলাপের মত তাজা টগবগে তরুণেরা শিক্ষক হিসেবে বিশ্ববিদ্যালয়ে ঢোকার পর হনন কারখানার ধারে কাছে বাস করতে করতে নিজেরাই বুঝতে পারেন না কখন যে তারা হনন কারখানার কারিগরদের ইয়ার দোস্তে পরিণত হয়েছেন।

গাভী বিত্তান্ত (১৯৯৫)

রসায়নের অধ্যাপক মিয়া মোহাম্মদ আবু জুনায়েদ দেশের সেরা ও প্রাচীনতম বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য নির্বাচিত হয়েছেন। রসায়ন বিভাগের সুন্দরী শিক্ষিকা দিলরুবা খানমের আকর্ষণে জুনায়েদ ডোরাকাটা দলের শিক্ষক রাজনীতিতে সক্রিয় হয়েছিলেন। পূর্ববর্তী উপাচার্যের উপর ক্ষোভবশত দিলরুবা খানম তাঁর নারীপ্রভাবকে কাজে লাগিয়ে জুনায়েদকে উপাচার্য প্যানেলে ঢুকিয়ে দেন। স্বৈরাচারী সরকারের অবাধ্য হবে না বলে রাষ্ট্রপতি (যিনি পদাধিকারবলে সকল বিশ্ববিদ্যালয়ের আচার্যও) জুনায়েককেই উপাচার্য নিয়োগ দেন। এই উপাচার্যের পদে আসীন হওয়ার পর জুনায়েদের চরিত্রের বিবর্তনকে ঘিরে আবর্তিত হয় উপন্যাসের কাহিনী।

ঠিকাদার শেখ তবারক আলী উপাচার্যকে হাতে রাখতে জুনায়েদের মনোবাসনা পূর্ণ করতে একটি দুর্লভজাতের গাভী কিনে দেন এবং ভিসির বাংলোতে শেখ তবারক আলী নিজ জামাতা বুয়েটপাস সিভিল ইঞ্জিনিয়ার আবেদ হোসেনকে দিয়ে গোয়ালঘর বানিয়ে দেন। পরবর্তীতে উপাচার্য আবু জুনায়েদের জীবন এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের ভবিষ্যৎ সবটাই হয়ে পড়ে গোয়ালঘরকেন্দ্রিক। এই গোয়ালঘরকে রঙ্গমঞ্চ বানিয়ে আহমদ ছফা বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর দৈন্যদশা এবং শিক্ষকরাজনীতির নোংরা বিভিন্ন দিক তুলে ধরেছেন।[৪]

উল্লেখযোগ্য চরিত্র সম্পাদনা

  • মিয়া মোহাম্মদ আবু জুনায়েদ – রসায়ন বিভাগের অধ্যাপক ও বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য
  • বেগম নুরুন্নাহার বানু – আবু জুনায়েদের স্ত্রী
  • দিলরুবা খানম – ডোরাকাটা দলের শিক্ষক রাজনীতিতে অতিসক্রিয় রসায়ন বিভাগের সুন্দরী শিক্ষিকা। আবু জুনায়েদের উপাচার্য হওয়ার পিছনে তার গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে।
  • শেখ তবারক আলী – বিশ্ববিদ্যালয়ের মহিলা ছাত্রীনিবাস নির্মাণের দায়িত্বপ্রাপ্ত ঝানু ঠিকাদার
  • আবেদ হোসেন – তবারক আলীর জামাতা, বুয়েটপাস সিভিল ইঞ্জিনিয়ার
  • জনার্দন চক্রবর্তী – সংস্কৃত বিভাগের প্রবীণ শিক্ষক। একদা আবু জুনায়েদকে বাংলা পড়িয়েছিলেন।
  • মাওলানা আবু তাহের
  • ড. সাইফুল আলম

পর্যালোচনা ও প্রভাব সম্পাদনা

 
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ২০১৮ খ্রিস্টাব্দের ১২ অক্টোবরে গৃহীত 'ঘ' ইউনিটের ভর্তিপরীক্ষার ফলাফল (পরবর্তীতে বাতিলকৃত ও পরীক্ষা পুনরায় গৃহীত) প্রশ্ন ফাঁসের অভিযোগে বাতিল করে পুনরায় নেওয়ার দাবিতে আমরণ অনশনকারী আহমদ ছফার গাভী বিত্তান্ত বইটি পড়ছেন।

বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রেক্ষাপটে, বিশেষত বাংলাদেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর শিক্ষক রাজনীতির প্রেক্ষাপটে রচিত বাংলা ভাষার সবচেয়ে শক্তিশালী উপন্যাস হিসেবে গণ্য গাভী বিত্তান্ত[৫] বিশ্ববিদ্যালয়ের নোংরা শিক্ষক রাজনীতির প্রসঙ্গ উঠলে গাভী বিত্তান্তকে রেফারেন্স হিসেবে ব্যবহার করা হয়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ২০১৮ খ্রিস্টাব্দের ১২ অক্টোবর গৃহীত 'ঘ' ইউনিটের ভর্তি পরীক্ষার ফলাফল প্রশ্ন ফাঁসের অভিযোগে বাতিল করে পুনরায় নেওয়ার দাবিতে আমরণ অনশনকারী প্রতিবাদ জানাতে আহমদ ছফার গাভী বিত্তান্ত বইটি পড়েছিলেন।[৬] পরবর্তীতে ফলাফল বাতিলকৃত এবং ১৬ই নভেম্বর ভর্তিপরীক্ষা পুনরায় গৃহীত হয়।[৭]

তথ্যসূত্র সম্পাদনা

  1. "Gabhi Bittranto: Timely Review of a Satire" [গাভী বিত্তান্ত: একটি বিদ্রূপের সময়গত পর্যালোচনা]। epaper.newagebd.net (ইংরেজি ভাষায়)। সংগ্রহের তারিখ ২০১৮-১০-১৯ 
  2. হাননান, ড. সুদীপ্ত (২০১৭)। আহমদ ছফার উপন্যাস : বাংলাদেশের উদ্ভব এবং বিকাশের ব্যাকরণ। ঢাকা: পুথিনিলয় প্রকাশনী। পৃষ্ঠা ৯৩–৯৮। আইএসবিএন 9789849212430 
  3. "Ahmed Sofa's 'Gabhi Bittanto' : A Timeless Political Allegory" [আহমদ ছফার 'গাভী বিত্তান্ত': একটি সময়হীন রাজনৈতিক রূপক]। ডেইলি সান (ইংরেজি ভাষায়)। সংগ্রহের তারিখ ২০১৮-১০-১৯ 
  4. "উপাচার্যদের আমলনামা-১"দৈনিক প্রথম আলো। ঢাকা: ট্রান্সকম গ্রুপ। সংগ্রহের তারিখ ২০১৮-১০-১৯ 
  5. "'গাভী বিত্তান্ত'"বাংলা ট্রিবিউন। ২২ অক্টোবর ২০১৮ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ১৯ অক্টোবর ২০১৮ 
  6. "ঘ ইউনিটের পরীক্ষা বাতিলের দাবিতে আমরণ অনশনে ঢাবি শিক্ষার্থী"Jugantor। সংগ্রহের তারিখ ২০১৮-১০-২২ 
  7. "ঢাবির ঘ ইউনিট: সন্দেহভাজন ১৪ জন পরীক্ষাই দেননি, ৮ জন অনুত্তীর্ণ"। ২০১৮-১১-২৮ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ২০১৮-১১-২৮