খার্চী পূজা

ত্রিপুরিদের প্রধান ধর্মীয় উৎসব

খার্চী পূজা ত্রিপুরা অঞ্চলের প্রধান ধর্মীয় উৎসব৷

বিবরণ সম্পাদনা

১৪ জন দেবদেবীকে এক বেদীতে প্রতিস্থাপন করে যে পূজা অনুষ্ঠান হয় সেটি ‘খার্চী পূজা’ নামে পুরো ভারতবর্ষে প্রসিদ্ধ লাভ করেছে৷ চতুর্দশ দেবদেবী প্রতিস্থাপিত মন্দিরকে অভিহিত করা হয় ‘চতুর্দশ দেব মন্দির’৷ ত্রিপুরা জাতির নিজস্ব বর্ষপঞ্জিকা ‘ত্রিপুরাব্দ’ অনুসারে প্রতি বছর আষাঢ় মাসের শুক্লা অষ্টমী তিথি থেকে আগরতলার চতুর্দশ দেব মন্দিরে খার্চী পূজা শুরু হয় এবং সাত দিনব্যাপী চলে পূজা অনুষ্ঠান৷ ত্রিপুরা রাজ্যের অধিবাসী ত্রিপুরিরা রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থাপনায় আড়ম্বর সহকারে ‘খার্চী পূজ্যোত্‍সব’ উদ্‌যাপন করে থাকে৷ ত্রিপুরা রাজ্যে এ সময় সরকারি ছুটি ঘোষিত হয়৷ খার্চী পূজোতে মোষ, পাঁঠা, বরাহ, অনুপৰী ইত্যাদি বলি দেয়ার প্রথা প্রচলিত আছে৷ শৈব, শাক্ত ও বৈষ্ণব এই সমন্বিত সাধন প্রণালী অনুযায়ী তান্দ্রিকাচারে খার্চী পূজো অনুষ্ঠিত হয়৷ বাংলাদেশে ত্রিপুরিদের জনজীবনে চতুর্দশ দেব উপবাস, কেউবা সংযমীব্রত পালন করে ধর্মীয় কার্যাদি সম্পাদন করে থাকে৷ আগরতলায় প্রতিষ্ঠিত চতুর্দশ দেব মন্দিরে স্থাপিত দেবদেবীরা হচ্ছেন : ১. সিবরাই (মহাদেব), ২. সংগ্রাংমা (কালী), ৩. হাচুকমা (বসুন্ধরা), ৪. সুকুন্দ্রাই (কার্তিক (দেবতা)), ৫. মুকুন্দ্রাই (গণেশ), ৬. তোয়বুকমা (জলদেবী বা বারুণী), ৭. মাইলুকমা (লক্ষ্মী দেবী), ৮. ইরিত্রা (অগ্নি দেব), ৯. বিরিত্রা (পবনদেব), ১০. কালাকতর (মহাকাল), ১১. কালারী (যম (হিন্দুধর্ম)), ১২ রন্দকা (কুবের), ১৩. দন্দকা (কামদেব) ও ১৪. বণিরক (অশ্বিনীকুমারদ্বয়)৷

দেব বিগ্রহ সম্পাদনা

চতুর্দশ দেবদেবীর বিশেষত হলো, প্রত্যেকের শিরোপরে অর্ধচন্দ্র বাণ খচিত৷ মহাদেব ছাড়া বাকি ১৩ জন দেবদেবীর মুকুট স্বর্ণে নির্মিত৷ চতুর্দশ দেব-দেবীদের প্রধান মহাদেবের মুকুট রোপ্য দ্বারা নির্মিত এবং মহাদেবের বিগ্রহটি সবার বড়৷ ত্রিপুরী জাতি চন্দ্র বংশীয় ক্ষত্রিয় কূলজাত বলেই কুলীয় চিহ্ন হিসেবে দেব-দেবী মুকুটেও চন্দ্রধ্বজ খচিত হয়৷ চতুর্দশ দেব মন্দিরের প্রধান পুরোহিতকে বলা হয় ‘রাজ চোনত্মাই’৷ সহকারী পূজকদের বলা হয় ‘দেওড়াই ও গালিম’৷ পুরোহিতরা সরকারি বিধিমতে নিযুক্ত হন৷ খার্চী পূজা অনুষ্ঠানে বিশেষ গোপনীয়তা অবলম্বন করার রীতি প্রচলিত আছে৷ পূজা চলাকালীন যেদিন গভীর রাতে ‘হজাগিরি’ নৃত্য অনুষ্ঠিত হয় সেদিন রাজ পুরোহিত ছাড়া সাধারণের ঘরের বাইরে চলাফেরা করা বা বিচরণ করা নিষিদ্ধ৷ ত্রিপুরা রাজ্যে আজও এ রীতি প্রচলিত রয়েছে৷ সে দেশে এই আইন অমান্যকারীদের সরকারি আইনে দণ্ডনীয় অপরাধ হিসেবে গণ্য করা হয়৷ ‘হজাগিরি’ শব্দের বাংলা অর্থ হয় ‘ভয়ঙ্কর রাত্রি’৷ তান্ত্রিক পদ্ধতিতে এ নৃত্য অনুষ্ঠিত হয় এবং এ নৃত্যের মুদ্রা ১৪টি৷

ইতিহাস সম্পাদনা

ভারতের স্বাধীনতার সময় ত্রিপুরা ছিল রাজন্য শাসিত স্বাধীন দেশীয় রাজ্য। ভারত স্বাধীন হওয়ার পর ত্রিপুরা ভারতের অঙ্গরাজ্য হিসেবে যোগ দেয়। রাজতন্ত্রের অবসান ও গণতন্ত্রের সূচনায় রাজ্যের মানুষের দায়িত্ব চলে যায় ভারত সরকারের ওপর। তখন একটি প্রশ্ন সামনে আসে জনগণের দায়িত্ব তো নিয়ে নিলো দেশের সরকার কিন্তু রাজকোষ থেকে যে সব মন্দির ও ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান পরিচালিত হয়ে আসছে তার দায়িত্ব কে নেবে?

তখন সিদ্ধান্ত হয় যে রাজকোষ থেকে পরিচালিত সব ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানের দায়িত্ব নেবে ত্রিপুরা সরকার। সেই থেকে এখনও এই রীতি চলে আসছে। মন্দিরের নিত্য পূজা থেকে উৎসবের যাবতীয় খরচ বহন করে রাজ্য সরকার।

পুজোর বিবরণ সম্পাদনা

ত্রিপুরা রাজ্যের সবচেয়ে প্রাচীন পুজো হল খার্চি পুজো। ১৪ জন দেবতার পুজোর মধ্যে দিয়ে এই উৎসবের শুভ সূচনা হয়ে থাকে। খার্চি শব্দের আক্ষরিক অর্থ হল, খার ও চি। খার কথার অর্থ হল পাপ এবং চি কথার অর্থ হল পরিষ্কার বা মোচন করা। এই উৎসবের মধ্যে দিয়ে এক কথায় পাপ মোচন করা হয়। আগরতলার চতুর্দশ দেবতাবাড়িতে ৭ই জুলাই থেকে শুরু হয় খার্চি পূজা, চলে টানা সাত দিন। প্রতি বছর আষাঢ় মাসের শুক্লঅষ্টমী তিথিতে এই পুজো শুরু হয়।

এই পুজোতে যে চতুর্দশ দেবতাকে পুজো করা হয় তাঁরা হলেন— হর বা শিব প্রধান দেবতা, উমা বা দুর্গা, হরি, লক্ষ্মী, সরস্বতী, কুমার বা কার্তিক, গণেশ, ব্রহ্মা, পৃথিবী, সমুদ্র, গঙ্গা, অগ্নি, কামদেব, হিমাদ্রি। সকলেই ত্রিপুরা রাজাদের কুলদেবতা। ৭ দিন ধরে হাজারো ভক্তের সমাগম হয় মন্দির প্রাঙ্গণে। এই পুজোর একটি বৈশিষ্ট্য হল দেবতাদের পূর্ণাবয়ব মূর্তিতে পুজো না হয়ে শুধুমাত্র দেবতাদের মাথা গুলিকে পুজো করা হয়।

স্নানের বিবরণ সম্পাদনা

পুরোহিতদের সঙ্গে পুলিশ বাহিনী ব্যান্ড বাজিয়ে চৌদ্দ দেবতার স্নানে অংশ নেয়। কয়েক শত বছর ধরে এভাবে প্রতিবছর শ্রাবণ মাসে পুরাতন আগরতলার চৌদ্দ দেবতার মন্দিরে বাৎসরিক খার্চি পূজা অনুষ্ঠিত হয়ে আসছে। রাজন্য আমলে ত্রিপুরার রাজবাড়ী যখন পুরাতন আগরতলায় ছিল তখন থেকে এই খার্চি পূজা প্রচলন শুরু হয়। পরবর্তী সময় রাজবাড়ী বর্তমান আগরতলায় চলে এলেও রাজাদের কুলদেবতার মন্দির রয়ে যায় পুরাতন আগরতলায় এবং প্রতি বছর খার্চি পূজা উপলক্ষে উৎসব ও মেলা আয়োজন করা হয়ে থাকে।

রাজপরিবারের পুরোহিতকে বলা হয় চন্তাই। রাজন্য আমলে রাজা সৈন্যরা খার্চি পূজার সময় চতুর্দশ দেবতাকে গার্ড অফ অনার জানাতেন। এই প্রথা এখনও প্রচলিত রয়েছে। ত্রিপুরা রাজ্য ভারত ভুক্তির পর ত্রিপুরা পুলিশ এই মন্দিরের উৎসবের সময় ১৪ জন দেবতাদেরকে গার্ড অফ অনার জানান। প্রতিদিন এখানে সরকারের তরফে একটি পাঠা বলি দেওয়া হয়ে থাকে।

তথ্যসূত্র সম্পাদনা

নিউ বাংলা লেটেস্ট লি

বহিঃসংযোগ সম্পাদনা