খাদ্যজাল

খাদ্যশৃঙ্খলসমূহের প্রাকৃতিক আন্তঃসংযোগ

খাদ্যজাল বা খাদ্যচক্র বহু খাদ্যশৃঙ্খলের সংযোগে তৈরী হওয়া একটি ছক যা প্রাকৃতিক ব্যবস্থায় 'কে কি(বা কাকে) খায়' তা সাধারণত চিত্রের আকারে তুলে ধরে। বাস্তুবিদ ও পরিবেশবিদরা সমস্ত জীবিত শরীরকে দুই 'ট্রাফিক' পর্যায়ে ভাগ করেছেন: ১)স্বয়ংসম্পূর্ণ জৈব শরীর বা autotroph- যারা নিজেদের খাদ্য স্বয়ং তৈরী করতে সক্ষম, ২)পর-নির্ভর জৈব শরীর বা heterotroph- যারা নিজেদের খাদ্য তৈরিতে অক্ষম ও পুষ্টি সংগ্রহের হেতু পর শরীরের ওপর নির্ভরশীল। এরা সরাসরি বা পরোক্ষভাবে হলেও অটোট্রফদের ওপর নির্ভরশীল। সমস্ত প্রাণীর মতোই নিজেদের শরীরের স্বাভাবিক জৈবিক কার্য বজায় রাখতে, নিজেদের বৃদ্ধি, বিকাশে ও পুনরুৎপাদনের হেতু অটোট্রফরা অজৈবিক পদার্থসমূহ থেকে জৈবিক পদার্থ তৈরী করে। এইসব রাসায়নিক বিক্রিয়ার জন্য যা এনার্জি প্রয়োজন হয় তা প্রধানত সার্বজনীন প্রাণ ও শক্তিদাতা অর্থাৎ সূর্যের থেকেই আসে, যদিও জলাভূমিতে তার কিছুটা অংশ বায়োইলেট্রোজেনেসিস-এর ফলে ও হটস্প্রিং বা হাইড্রোথার্মাল ভেন্ট গুলিতে খনিজ ইলেকট্রন দানের ফলে তৈরির হয়।[১] সম্পূর্ণ অটোট্রফদের(অর্থাৎ যারা খাদ্যনির্মান প্রক্রিয়ায় স্বয়ংসম্পূর্ণ) ও সম্পূর্ণ হেটেরোট্রফিদের(যারা পর শরীর_ গাছ বা অন্য প্রাণীর ওপর খাদ্যের জন্য নির্ভরশীল) মাঝখানের ভাগে মিক্সট্রপ(mixotroph) বলে একটি জাতির উদ্ভিদ প্রজাতি বিদ্যমান যারা সৌরশক্তির সাহায্যেও কিছু খাদ্য নির্মাণ করে ও কিছু অংশে পরশরীরের ওপর নির্ভরশীল, যেমন মাংসাশী গাছ বা "কার্নিভোরাস প্লান্ট"। একটি খাদ্যজালের বিভিন্ন খাদ্যশৃঙ্খলের সংযোগ বিভিন্ন খাদ্যপথ চিত্রায়িত করে, যেমন তৃণভোজী ও মাংশাসী হেটেরোট্রোফরা যথাক্রমে অটোট্রফ বা অন্য হেটেরোট্রোফদের ভক্ষণ করে জৈবিক পুষ্টি লাভ করে। একটি খাদ্যজাল অতি সহজভাবে বিভিন্ন খাদ্য পদ্ধতির সহজাত চিত্রায়ণ যা বাস্তুতন্ত্রকে একটি ঐক্যবদ্ধ বিনিময় ব্যবস্থার ছবি প্রদান করে।আমাদের প্রকৃতিতে নানা প্রক্টরের খাদ্যাভ্যাস লক্ষ্য করা যায় যাদের ভেষজজীবী, মাংসাশী, মৃত শরীর থেকে পুষ্টি গ্রহণ বা স্ক্যাভেঞ্জারী,পরজীবীতা প্রমুখ বৃহৎ শ্রেণীতে ভাগ করা যায়। অটোট্রফ ও হেটেরোট্রোফরা বহু আকার ও রূপে পৃথিবীতে বিরাজমান_আণুবীক্ষণিক সায়ানোব্যাকটেরিয়া থেকে বিশালাকায় জায়ান্ট রেডউড ও ভাইরাস থেকে নিয়ে দৈত্যাকার ব্লু হোয়েল।

চার্লস এলটন তাঁর ১৯২৭ সালে রচিত গ্রন্থ "Animal Ecology"-তে খাদ্যচক্র, খাদ্যশৃঙ্খল ও খাদ্যাকারের ধারণা নিয়ে এসেছিলেন। কিন্তু পরবর্তীকালে এলটন-এর খাদ্যচক্রের ধারণা খাদ্যজালের ধারণায় রূপান্তরিত হয়।এলটন তাঁর গবেষণায় সমস্ত প্রজাতিকে বহু কার্যকরী গোষ্ঠীতে ভাগ করেছিলেন যা ১৯৪২ সালে রেমন্ড লিন্ডেমান-এর ট্রফিক পর্যায়ের গতিশীলতা বিষয়ক যুগান্তকারী গবেষণা পত্রের মূল ভিত্তিরূপে ফুটে উঠেছিল। লিন্ডেমান তাঁর গবেষণায় ট্রফিক পর্যায়ের গতিশীলতাই পচনকারী জীবদের ভূমিকায় বিশেষভাবে গুরুত্ব দিয়েছেন। খাদ্যজালের ধারণার একটি আভাস বিশ্ববিখ্যাত জীববিজ্ঞানী চার্লস ডারউইন-এর লেখার মধ্যেও ভেসে উঠেছে; "entangled bank", "প্রাণের জাল"("web of life"), "জটিল সম্পর্কের জাল"("web of complex relations") ও কেঁচো কর্তৃক পচনকারী কার্যক্রিয়াকে বোঝাতে বলেছিলেন "the continued movement of the particles of earth"। তারও পূর্বে জন ব্রাকনার প্রকৃতিকে প্রাণের চক্র বলে চিহ্নিত করেছেন। খাদ্যজাল বৃহৎ প্রকৃতির ও বাস্তুতন্ত্রের একটি ক্ষুদ্র নিদর্শন মাত্র যা পরিবেশের জটিল খাদ্যসম্পর্কের বাস্তবরূপ আংশিকভাবে হলেও সম্পূর্ণরূপে তুলে ধরতে পারেনা।

খাদ্যশৃঙ্খল দৈর্ঘ্য ও খাদ্যজাল সম্পাদনা

খাদ্যজালের ট্রফিক কাঠামো বুঝতে একটি সাধারণ মেট্রিক ধারণা ব্যবহৃত হয় হকে বলে খাদ্যশৃঙ্খল দৈর্ঘ্য। এক কথায়, খাদ্যশৃঙ্খল দৈর্ঘ্য উদ্ভিদের থেকে উচ্চশ্রেণীর শিকারী পর্যন্ত এনার্জির যাত্রার সময় প্রজাতির সংখ্যা হিসেবেরূপে করার একটি উপাদানস্বরূপ। বিভিন্ন প্যারামিটার বিচার করে খাদ্যশৃঙ্খল দৈর্ঘ্য হিসাব করার বহু প্রচলিত পদ্ধিতিটি রয়েছে, যেমন সংযোগকারী, এনার্জি নির্ভর বা মিথষ্ক্রীয়। খুব সাধারণ কথায়, খাদ্যশৃঙ্খল দৈর্ঘ্য হল ট্রফিক কনসিউমার ও খাদ্যজালের base-এর মধ্যে অবস্থিত লিংক সংখ্যা। খাদ্যশৃঙ্খলের দৈর্ঘ্যের মধ্যক হল সেই খাদ্যজালে অবস্থিত সমস্ত খাদ্যশৃঙ্খলের দৈর্ঘ্যের গড়।


তথ্যসূ্ত্র সম্পাদনা

  1. Nowak, M. E.; Beulig, F.; von Fischer, J.; Muhr, J.; Küsel, K.; Trumbore, S. E. (২০১৫)। "Autotrophic fixation of geogenic CO2 by microorganisms contributes to soil organic matter formation and alters isotope signatures in a wetland mofette" (পিডিএফ)Biogeosciences। Copernicus Publications (প্রকাশিত হয় ২০১৫-১২-০৮)। 12 (23): 7169–7183। ডিওআই:10.5194/bg-12-7169-2015 বিবকোড:2015BGeo...12.7169N। সংগ্রহের তারিখ ২০১৯-১০-০১