খাজা নিজাম উদ্দিন ভূঁইয়া

বীর উত্তম খেতাবপ্রাপ্ত বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের মুক্তিযোদ্ধা

শহীদ খাজা নিজামউদ্দিন ভূঁইয়া (জন্ম: ১৯ ফেব্রুয়ারি, ১৯৪৯ - মৃত্যু: ৪ সেপ্টেম্বর, ১৯৭১) বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের একজন বীর মুক্তিযোদ্ধা। স্বাধীনতা যুদ্ধে তার সাহসিকতার জন্য বাংলাদেশ সরকার তাকে বীর উত্তম খেতাব প্রদান করে।[১] ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের সময় তিনি কর্মরত ছিলেন হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালে কন্ট্রোলার অব অ্যাকাউন্টস পদে।[২] বাংলাদেশ সরকার ১৯৭৩ সালের ১৫ ডিসেম্বর প্রণীত এক গেজেটে খাজা নিজামউদ্দিন ভূঁইয়াকে বীর উত্তম উপাধি দেয়। সেই তালিকায় তার স্মারক নম্বর ১৪। এই হিসেবে তিনিই মুক্তিযুদ্ধের সর্বোচ্চ বেসামরিক ব্যক্তিত্ব। এছাড়া তিনিই একমাত্র বেসামরিক শহীদ মুক্তিযোদ্ধা, যিনি ‘মরণোত্তর বীর উত্তম’ উপাধি পান। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ এক অনুষ্ঠানের মাধ্যমে তার ভাইদের কাছে তার স্নাতক ও স্নাতকোত্তর পরীক্ষার সনদ হস্তান্তর করেছে। [৩] স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধে অবদানের জন্য তিনি ২০২৩ সালে স্বাধীনতা পুরস্কারে ভূষিত হন।[৪]

খাজা নিজামউদ্দিন ভূঁইয়া
জন্ম১৯ ফেব্রুয়ারি ১৯৪৯
মৃত্যু৪ সেপ্টেম্বর ১৯৭১
নিজাম নগর, কানাইঘাট, সিলেট
জাতীয়তাবাংলাদেশি
নাগরিকত্ব পাকিস্তান (১৯৭১ সালের পূর্বে)
 বাংলাদেশ
পরিচিতির কারণমুক্তিযোদ্ধা, গণবাহিনীর সর্বাধিনায়ক, সাব-সেক্টর কমান্ডার
উপাধিবীর উত্তম

জন্ম ও শিক্ষাজীবন সম্পাদনা

খাজা নিজামউদ্দিন ভূঁইয়ার জন্ম ১৯৪৯ সালের ১৯ ফেব্রুয়ারি কুমিল্লা জেলার ব্রাহ্মণপাড়ার মালাপাড়া গ্রামে। তার বাবার নাম আব্দুল লতিফ ভূঁইয়া এবং মায়ের নাম তাবেন্দা আক্তার। ছয় ভাই এবং তিন বোনের মধ্যে নিজাম ছিলেন দ্বিতীয়। তিনি অবিবাহিত ছিলেন। তিনি কবি হিসেবে পরিচিত ছিলেন।তার বাবা সরকারি কর্মকর্তা হওয়ায় নিজামউদ্দিন ভূঁইয়ার প্রাথমিক ও মাধ্যমিক শিক্ষা পর্ব দেশের বিভিন্ন জেলায় সম্পন্ন হয়। পড়াশোনার পাশাপাশি তিনি ভালো কবিতা লিখতেন, ভালো গানও করতেন। সেই সঙ্গে গিটার বাদনেও তিনি ছিলেন সিদ্ধহস্ত। রবীন্দ্রসঙ্গীত বিশুদ্ধভাবে গাইতে পারার কারণে তার বেশ পরিচিতি ছিল। সুস্বাস্থ্যের অধিকারী নিজামউদ্দিন খেলাধুলায়ও ছিলেন সমান পারদর্শী।[৫] ১৯৬৪ সালে নিজামউদ্দিন চট্টগ্রামের জেএম সেনস ইনস্টিটিউট থেকে এসএসসি, ১৯৬৬ সালে এইচএসসি, ১৯৬৯ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্যবস্থাপনা বিভাগ থেকে স্নাতক পাস এবং ১৯৭০ সালে স্নাতকোত্তর পরীক্ষা দেন। এরপর ১৯৭১ সালে পড়াশুনা করছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইন্সটিটিউট অব বিজনেস অ্যাডমিনিস্ট্রেশন (আইবিএ)-তে। মাস্টার অব বিজনেস অ্যাডমিনিস্ট্রেশনে (এমবিএ) পড়ার সময় তিনি মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েন।[৩]

কর্মজীবন সম্পাদনা

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ১৯৭১ সালে পড়াশোনা শেষ করে ঢাকার হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালে কন্ট্রোলার অব অ্যাকাউন্টস পদে কর্মরত ছিলেন। মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে ১৯ এপ্রিল ঢাকা থেকে পালিয়ে নিজ এলাকা হয়ে ভারত যান।[৬]

মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ সম্পাদনা

ভারতে অস্ত্র বিষয়ক প্রশিক্ষণ নিয়ে খাজা নিজামউদ্দিন ভূঁইয়া সিলেটের কানাইঘাট, মস্তানগঞ্জ, ভরামইদ, নক্তিপাড়া ও মণিপুর বাজারে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেন। ১৯৭১ সালের এপ্রিল-মে মাসের প্রথম ১০ দিন প্রশিক্ষণ নেন বিএসএফের কাছে এবং পরের এক মাস ভারতীয় সেনাবাহিনীর কাছে। প্রশিক্ষণ শেষে তিনি সিলেট অঞ্চলের ৪ নম্বর সেক্টরের সাব-সেক্টর জালালপুরের যুদ্ধ পরিচালনার জন্য ‘সাব-সেক্টর সেকেন্ড-ইন-কমান্ড’ হিসেবে দায়িত্বপ্রাপ্ত হন।[৩] পরবর্তিতে তিনি সাব-সেক্টর কমান্ডার হিসেবেও দায়িত্ব পান।[৭] তার নেতৃত্বে ছিলেন ৪৮৮ জন মুক্তিযোদ্ধা। রণাঙ্গনে তিনি এতই চৌকস ছিলেন যে লোকজন তাকে সামরিক বাহিনীর কোন অফিসার মনে করত। তাকে সবাই ক্যাপ্টেন নিজাম হিসেবে চিনত।

অন্যান্য কর্মকাণ্ড সম্পাদনা

সাহিত্যের সাথে যোগাযোগ তার আগে থেকেই ছিল। সাহিত্যের প্রতি দুর্বার আকর্ষণের কারণে ‘কালচক্র’ নামে একটি সাহিত্য পত্রিকাও সম্পাদনা করতেন ছাত্র জীবনে।[৫] সারা দিনের প্রচন্ড ক্লান্তিতে অল্প কিছু পাহারাদার বাদে সব সহযোদ্ধারা যখন শুয়ে পড়তেন তিনি দিনলিপি লিখতেন। শত্রুর মধ্যে ঢুকে পড়ে আহত সহযোদ্ধাদের নিয়ে এসেছেন।

মৃত্যু সম্পাদনা

নিজামউদ্দিন ভূঁইয়া তার দল নিয়ে সিলেট জেলার কানাইঘাটের আটগ্রাম সড়কের বাজারের কাছে একটি সেতু বিস্ফোরক দিয়ে ধ্বংস করেন। সে সময় একদল পাকিস্তানি সেনা সেতুর খুব কাছাকাছি অবস্থান করছিল। তারা নিজামউদ্দীনের দলকে আক্রমণ করে। তখন পাকিস্তানি সেনাদের সঙ্গে তাদের সম্মুখ যুদ্ধ শুরু হয়। এই যুদ্ধে তিনি ও তার দলের মুক্তিযোদ্ধারা যথেষ্ট সাহসিকতার সঙ্গে পাকিস্তানি বাহিনীকে মোকাবিলা করতে থাকেন। একপর্যায়ে পাকিস্তানি সেনাদের নিক্ষিপ্ত গোলার আঘাতে খাজা নিজামউদ্দীন শহীদ এবং কয়েকজন মুক্তিযোদ্ধা আহত হন। এই যুদ্ধে পাকিস্তানি বাহিনীরও অনেক ক্ষয়ক্ষতি হয়। যুদ্ধ শেষে দলের অন্য মুক্তিযোদ্ধারা খাজা নিজামউদ্দীনের মৃতদেহ ও আহত মুক্তিযোদ্ধাদের উদ্ধার করতে সক্ষম হন। পরে মুক্তিযোদ্ধারা শহীদ খাজা নিজামউদ্দীন ভূঁইয়াকে সিলেটের মুকামটিলায় সমাহিত করেন।[২] পুরো যুদ্ধটি একটানা ছয় ঘণ্টা যাবত চলে। পুরো সময়টাই সামনে থেকে নেতৃত্ব দিয়েছেন নিজামউদ্দিন। এক দিকে যেমন অস্ত্র পরিচালনা করছিলেন অন্য দিকে অন্যান্য সহযোদ্ধাদের বিভিন্ন নির্দেশনাও দিচ্ছিলেন।

সমাধি সম্পাদনা

নিজামউদ্দিন সমাহিত আছেন মোমটিলায় লাল শাহ, পাতা শাহ ও গুলু শাহ—এই তিন আউলিয়ার মাজারের পাশেই। তার নেতৃত্বে মমতাজগঞ্জ, নক্তিপাড়া, ভয়ামহিদ, মণিপুর প্রভৃতি অঞ্চল দীর্ঘকাল হানাদারমুক্ত ছিল। দেশবাসী এ বিরাট অঞ্চলের নাম দিয়েছে নিজামনগর। এলাকাবাসী তাকে ‘ক্যাপ্টেন নিজাম’ নামে সম্বোধন করতেন।[৩]

সম্মাননা সম্পাদনা

পাদটীকা সম্পাদনা

তথ্যসূত্র সম্পাদনা

  1. "জাতীয় সংহতি ও জাতীয় চরিত্র"prothom-alo.com [স্থায়ীভাবে অকার্যকর সংযোগ]
  2. "তোমাদের এ ঋণ শোধ হবে না"prothom-alo.com [স্থায়ীভাবে অকার্যকর সংযোগ]
  3. "একজন শহীদ মুক্তিযোদ্ধার প্রতি শ্রদ্ধাঞ্জলি"prothom-alo.com [স্থায়ীভাবে অকার্যকর সংযোগ]
  4. প্রতিবেদক, বিশেষ। "স্বাধীনতা পুরস্কার পাচ্ছেন নয় ব্যক্তি ও এক প্রতিষ্ঠান"Prothomalo। সংগ্রহের তারিখ ২০২৩-০৩-১১ 
  5. " কিশোর মুক্তিযোদ্ধার গল্প"amardeshonline.com। ২৩ জুন ২০১২ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ২০ জুন ২০১২  line feed character in |শিরোনাম= at position 2 (সাহায্য)
  6. একাত্তরের বীরযোদ্ধা (খেতাবপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধাদের বীরত্বগাথা)। প্রথমা প্রকাশন। ২০১২। পৃষ্ঠা ২৪। আইএসবিএন 9789843338884 
  7. "Nizam Uddin Bhuiyan"thedailystar.net