কাশ্মীরের ইতিহাস

দক্ষিণ এশিয়ার বৃহত্তর কাশ্মীর অঞ্চলের ইতিহাস

কাশ্মীরের ইতিহাস বৃহত্তর ভারতীয় উপমহাদেশ ও এর পার্শ্ববর্তী অঞ্চলসমূহের (মধ্য এশিয়া, দক্ষিণ এশিয়াপূর্ব এশিয়া) ইতিহাসের সঙ্গে অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত। ঐতিহাসিকভাবে কাশ্মীরকে 'কাশ্মীর উপত্যকা' নামে অভিহিত করা হয়েছে। বর্তমানে কাশ্মীর বলতে একটি তুলনামূলক বৃহৎ অঞ্চলকে বোঝায়। বর্তমান ভারত-নিয়ন্ত্রিত জম্মু ও কাশ্মীর রাজ্য (যেটি জম্মু, কাশ্মীর উপত্যকালাদাখের সমন্বয়ে গঠিত), পাকিস্তান-নিয়ন্ত্রিত আজাদ কাশ্মীরগিলগিত-বালতিস্তান অঞ্চলদ্বয় এবং চীন-নিয়ন্ত্রিত আকসাই চিনট্রান্স-কারাকোরাম ট্র্যাক্ট অঞ্চলদ্বয় বৃহত্তর কাশ্মীরের অন্তর্ভুক্ত।[তথ্যসূত্র প্রয়োজন]

পঞ্চম শতাব্দীর পূর্ববর্তী সময়ে কাশ্মীর প্রথমে হিন্দুধর্ম এবং পরে বৌদ্ধধর্মের একটি গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্রে পরিণত হয়। পরবর্তীতে নবম শতাব্দীতে কাশ্মীরে শৈব মতবাদের উত্থান ঘটে। ত্রয়োদশ থেকে পঞ্চদশ শতাব্দীতে কাশ্মীরে ইসলামের বিস্তার ঘটে এবং শৈব মতবাদের প্রভাব হ্রাস পায়। কিন্তু তাতে পূর্ববর্তী সভ্যতাগুলোর অর্জনসমূহ হারিয়ে যায় নি, বরং নবাগত ইসলামি রাজনীতি ও সংস্কৃতি এগুলোকে বহুলাংশে অঙ্গীভূত করে নেয়, যার ফলে জন্ম হয় কাশ্মিরি সুফিবাদের।

১৩৩৯ সালে শাহ মীর কাশ্মীরের প্রথম মুসলিম শাসক হিসেবে অধিষ্ঠিত হন এবং শাহ মীর রাজবংশের গোড়াপত্তন করেন। পরবর্তী পাঁচ শতাব্দীব্যাপী কাশ্মীরে মুসলিম শাসন বজায় ছিল। এর মধ্যে মুঘল সম্রাটরা ১৫৮৬ সাল থেকে ১৭৫১ সাল পর্যন্ত এবং আফগান দুররানী সম্রাটরা ১৭৪৭ সাল থেকে ১৮১৯ সাল পর্যন্ত কাশ্মীর শাসন করেন। ১৮১৯ সালে রঞ্জিত সিংহের নেতৃত্বে শিখরা কাশ্মীর দখল করে। ১৮৪৬ সালে প্রথম ইঙ্গ—শিখ যুদ্ধে ইংরেজদের নিকট শিখরা পরাজিত হয়। এরপর অমৃতসর চুক্তি অনুসারে জম্মুর রাজা গুলাব সিংহ অঞ্চলটি ব্রিটিশদের কাছে থেকে ক্রয় করেন এবং কাশ্মীরের নতুন শাসক হন। ১৯৪৭ সাল পর্যন্ত তার বংশধরগণ ব্রিটিশ রাজমুকুটের অনুগত শাসক হিসেবে কাশ্মীর শাসন করেন। ১৯৪৭ সালের ভারত বিভাগের সময় অঞ্চলটি একটি বিবদমান অঞ্চলে পরিণত হয়। বর্তমানে অঞ্চলটি ভারত, পাকিস্তানচিনের মধ্যে বিভক্ত।

আজাদ জম্মু কাশ্মীর এর ইতিহাস ... ভারতীয় উপমহাদেশের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দ্বিপাক্ষিক দ্বন্দ্ব হচ্ছে ভারত–পাকিস্তান দ্বন্দ্ব এবং এই দ্বন্দ্বের অন‍্যতম প্রধান কারণ হলো কাশ্মির সমস্যা। কাশ্মির অঞ্চলটি বর্তমানে ভারত, পাকিস্তান ও চীনের মধ‍্যে বিভক্ত। ভারত পাকিস্তান–নিয়ন্ত্রিত কাশ্মির এবং চীন নিয়ন্ত্রিত কাশ্মিরকে নিজস্ব ভূমি হিসেবে দাবি করে। পাকিস্তান ভারত–নিয়ন্ত্রিত কাশ্মিরকে নিজস্ব ভূমি হিসেবে দাবি করে। চীন ভারত–নিয়ন্ত্রিত কাশ্মিরের লাদাখ অঞ্চলটি নিজস্ব ভূমি হিসেবে দাবি করে।


ভারত–নিয়ন্ত্রিত কাশ্মির নিয়ে আন্তর্জাতিক (এবং বাংলাদেশি) গণমাধ্যমে যতটা আলোচনা হয়, পাকিস্তান–নিয়ন্ত্রিত কাশ্মির নিয়ে সেরকম আলোচনা প্রায় হয় না বললেই চলে। পাকিস্তান–নিয়ন্ত্রিত কাশ্মির বর্তমানে দুটি অংশে বিভক্ত- 'আজাদ জম্মু ও কাশ্মির' (সংক্ষেপে 'আজাদ কাশ্মির') এবং 'গিলগিট–বালতিস্তান'। এই নিবন্ধের আলোচ‍্য বিষয় হচ্ছে 'আজাদ জম্মু ও কাশ্মির'।

আজাদ জম্মু ও কাশ্মিরের উত্তরে গিলগিট–বালতিস্তান, পশ্চিমে পাকিস্তানের খাইবার পাখতুনখোয়া প্রদেশ, দক্ষিণে পাকিস্তানের পাঞ্জাব প্রদেশ এবং পূর্বে ভারতের 'জম্মু ও কাশ্মির' কেন্দ্রশাসিত অঞ্চল অবস্থিত। আজাদ জম্মু ও কাশ্মিরের আয়তন ১৩,২৯৭ বর্গ কি.মি. এবং ২০১৭ সালের আদমশুমারি অনুযায়ী জনসংখ্যা প্রায় ৪৪ লক্ষ ৫০ হাজার। মুজাফফরাবাদ আজাদ জম্মু ও কাশ্মিরের রাজধানী ও বৃহত্তম শহর। শহরটিতে প্রায় দেড় লক্ষ মানুষের বসবাস।


আজাদ জম্মু ও কাশ্মিরের রাষ্ট্রীয় পতাকা; Source: Wikimedia Commons আজাদ জম্মু ও কাশ্মিরের জনসংখ‍্যার ৯৯ ভাগের বেশিই মুসলিম, যদিও প্রায় ২০,০০০ থেকে ২৫,০০০ আহমদিয়া এবং প্রায় ৪,৫০০ খ্রিস্টান অঞ্চলটিতে বসবাস করে। নৃতাত্ত্বিক দৃষ্টিকোণ থেকে আজাদ জম্মু ও কাশ্মিরের অধিকাংশ অধিবাসী কাশ্মির উপত‍্যকার জাতিগত কাশ্মিরীদের সঙ্গে সম্পৃক্ত নয়, বরং তারা জম্মু ও পাঞ্জাবের অধিবাসীদের সঙ্গে সম্পৃক্ত। আজাদ জম্মু ও কাশ্মিরে গুজ্জার (বা গুর্জর), সুধান, জাঠ, রাজপুত, মুঘল, আওয়ান, আব্বাসি এবং অন্যান্য সম্প্রদায়ের মানুষ বসবাস করে। আজাদ জম্মু ও কাশ্মিরে জাতিগত কাশ্মিরীরা সংখ্যালঘু এবং তারা প্রধান নীলাম ও লীপা উপত‍্যকায় বসবাস করে।

আজাদ জম্মু ও কাশ্মিরের সরকারি ভাষা উর্দু এবং সরকারি কাজে ও উচ্চশিক্ষায় ইংরেজি ভাষা ব‍্যবহৃত হয়। কিন্তু উর্দু ছাড়াও অঞ্চলটিতে কমপক্ষে আধ-ডজন ভাষা প্রচলিত, যেগুলোর মধ‍্যে রয়েছে পাহাড়ি, গোজরি, পাঞ্জাবি, কোহিস্তানি, পশতু এবং কাশ্মিরী।

আজাদ জম্মু ও কাশ্মিরের অর্থনীতি মূলত কৃষিপ্রধান এবং অঞ্চলটিতে শিল্পায়নের হার খুবই সীমিত। কৃষি ছাড়া সেবা খাত, পর্যটন এবং প্রবাসীদের প্রেরিত রেমিট্যান্স অঞ্চলটির আয়ের মূল উৎস। আজাদ জম্মু ও কাশ্মিরের পার্বত‍্য উত্তরাঞ্চল ও সমভূমির দক্ষিণাঞ্চল মনোরম প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে পরিপূর্ণ এবং এটি পর্যটকদেরকে বিশেষভাবে আকৃষ্ট করে।


আজাদ জম্মু ও কাশ্মিরের নীলাম উপত‍্যকায় অবস্থিত হালমাত গ্রামটি সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে প্রায় ৭,৪০০ ফুট উচ্চতায় অবস্থিত; Source: Getty Images প্রশাসনিকভাবে, আজাদ জম্মু ও কাশ্মির ৩টি বিভাগে বিভক্ত- মুজাফফরাবাদ, মিরপুর এবং পুন্চ। এই বিভাগগুলো আবার ১০টি জেলায় বিভক্ত। মিরপুর ও পুন্চ বিভাগদ্বয় 'জম্মু ও কাশ্মির' দেশীয় রাজ‍্যের জম্মু প্রদেশের অংশ ছিল এবং মুজাফফরাবাদ বিভাগটি ছিল কাশ্মির প্রদেশের অংশ। অর্থাৎ, বৃহত্তর জম্মু ও বৃহত্তর কাশ্মির উভয় প্রদেশের অংশবিশেষ আজাদ জম্মু ও কাশ্মিরে রয়েছে।

আনুষ্ঠানিকভাবে, 'আজাদ জম্মু ও কাশ্মির' বা 'মুক্ত জম্মু ও কাশ্মির' একটি 'স্বাধীন' এবং 'স্বশাসিত' রাষ্ট্র, যেটির নিরাপত্তার দায়িত্ব পাকিস্তানের ওপর ন‍্যস্ত এবং যেটি প্রশাসনিক ও অর্থনৈতিকভাবে পাকিস্তানের সঙ্গে সংযুক্ত। অঞ্চলটির নিজস্ব জাতীয় পতাকা, রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী, আইনসভা, হাই কোর্ট ও সুপ্রিম কোর্ট রয়েছে। আজাদ জম্মু ও কাশ্মিরের বর্তমান রাষ্ট্রপতি মাসুদ খান এবং প্রধানমন্ত্রী পাকিস্তান মুসলিম লীগ (নওয়াজ) বা 'পিএমএল (এন)' দলভুক্ত রাজা ফারুক হায়দার খান।

'আজাদ জম্মু ও কাশ্মির আইনসভা' (Legislative Assembly of Azad Jammu and Kashmir) একটি এক কক্ষবিশিষ্ট আইনসভা যাতে ৪৯টি আসন রয়েছে। আইনসভার সদস‍্যদের মধ‍্যে ৪১ জন জনগণের সরাসরি ভোটে নির্বাচিত হন এবং বাকি ৮ জনের মধ‍্যে ৫ জন নারী সম্প্রদায়ের, ১ জন উলেমাদের, ১ জন পেশাজীবীদের এবং ১ জন প্রবাসীদের প্রতিনিধিত্ব করেন। বর্তমানে 'পিএমএল(এন)' এবং জামাত–এ–ইসলামি সম্মিলিতভাবে আজাদ জম্মু ও কাশ্মিরের সরকার গঠন করেছে। বর্তমানে আজাদ জম্মু ও কাশ্মির আইনসভায় দল দুটির যথাক্রমে ৩৫ জন ও ২ জন প্রতিনিধি রয়েছেন। উল্লেখ্য, পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় আইনসভায় আজাদ জম্মু ও কাশ্মির থেকে কোনো সদস্য নির্বাচিত হয় না।


রাজধানী মুজাফফরাবাদে অবস্থিত আজাদ জম্মু ও কাশ্মির আইনসভা ভবন; Source: Kashmir Sunshine পাকিস্তানি কেন্দ্রীয় সরকার আজাদ জম্মু ও কাশ্মিরকে 'স্বশাসিত' হিসেবে আখ‍্যা দিলেও বস্তুত অঞ্চলটি প্রকৃত অর্থে স্বায়ত্তশাসিত নয়। আজাদ জম্মু ও কাশ্মির পাকিস্তানি কেন্দ্রীয় সরকারের 'কাশ্মির বিষয়ক ও গিলগিট–বালতিস্তান মন্ত্রণালয়'–এর অধীন। পাকিস্তানের বর্তমান কাশ্মির বিষয়ক মন্ত্রী 'পাকিস্তান তেহরিক–ই–ইনসাফ' (পিটিআই) দলভুক্ত আলী আমিন খান গান্দাপুর।

'আজাদ জম্মু ও কাশ্মির পরিষদে'র মাধ‍্যমে পাকিস্তানি সরকার আজাদ জম্মু ও কাশ্মিরকে নিয়ন্ত্রণ করে। আজাদ জম্মু ও কাশ্মিরের রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী ও ৬ জন আইনসভা সদস‍্য এবং পাকিস্তানি প্রধানমন্ত্রীসহ পাকিস্তানি সরকারের ৬ জন সদস‍্যকে নিয়ে এই পরিষদ গঠিত। নিয়ম অনুযায়ী, পাকিস্তানি প্রধানমন্ত্রী এই পরিষদের সভাপতি এবং এই পরিষদটিই আজাদ জম্মু ও কাশ্মিরের অর্থব‍্যবস্থাকে নিয়ন্ত্রণ করে।

বর্তমানে আজাদ জম্মু ও কাশ্মিরের নিজস্ব কোনো সামরিক বা আধা–সামরিক বাহিনী নেই। ১৯৪৭ সাল থেকে ১৯৭২ সাল পর্যন্ত 'আজাদ কাশ্মির নিয়মিত বাহিনী' (Azad Kashmir Regular Forces) নামে অঞ্চলটিতে একটি আধা–সামরিক বাহিনী ছিল, কিন্তু ১৯৭২ সালে বাহিনীটিকে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীতে একটি পদাতিক রেজিমেন্ট হিসেবে আত্তীকৃত করে নেয়া হয় এবং 'আজাদ কাশ্মির রেজিমেন্ট' নামকরণ করা হয়।


পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর আজাদ কাশ্মির রেজিমেন্টের সৈন‍্যরা; Source: GlobalSecurity.org আজাদ জম্মু ও কাশ্মিরকে 'স্বশাসিত' হিসেবে দাবি করা হলেও অঞ্চলটির ওপর পাকিস্তানের সুস্পষ্ট নিয়ন্ত্রণ রয়েছে। অঞ্চলটির প্রত‍্যেক রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রীকে কাশ্মিরকে পাকিস্তানের অন্তর্ভুক্ত রাখার প্রতিশ্রুতি দিতে হয় এবং পাকিস্তান–বিরোধী বা বিচ্ছিন্নতাবাদী কোনো দলকে নির্বাচনে অংশ নিতে দেয়া হয় না। ভারত–নিয়ন্ত্রিত কাশ্মিরের বিচ্ছিন্নতাবাদী দল 'জম্মু কাশ্মির লিবারেশন ফ্রন্টে'র (জেকেএলএফ) পাকিস্তান–নিয়ন্ত্রিত কাশ্মিরেও শাখা রয়েছে, কিন্তু দলটি কাশ্মিরকে একটি স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে প্রতিষ্ঠা করতে চায়, পাকিস্তানের অন্তর্ভুক্ত করতে চায় না। এজন‍্য দলটিকে আজাদ জম্মু ও কাশ্মিরে নির্বাচনে অংশ নিতে দেয়া হয় না।

অর্থাৎ, রাষ্ট্র গঠনের তিনটি উপাদান 'ভূখণ্ড', 'জনসংখ‍্যা' ও 'সরকার' থাকলেও আজাদ জম্মু ও কাশ্মিরের 'সার্বভৌমত্ব' নেই, সুতরাং এটি কোনো স্বাধীন রাষ্ট্র নয়। আজাদ জম্মু ও কাশ্মিরের রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সামরিক ও বৈদেশিক সকল বিষয়াবলি পাকিস্তানি কেন্দ্রীয় সরকার নিয়ন্ত্রণ করে, সুতরাং এটি কোনো 'স্বশাসিত' অঞ্চলও নয়। কিন্তু পাকিস্তানি সংবিধান অনুযায়ী আজাদ জম্মু ও কাশ্মির পাকিস্তানি ফেডারেশনের অংশ নয় এবং অঞ্চলটি পাকিস্তানের আইনসভায়ও সদস‍্য প্রেরণ করে না, এজন্য এটি আইনগতভাবে পাকিস্তানের প্রদেশও নয়।

তাহলে এটি কী? সবদিক বিবেচনা করে বলা যায়, আজাদ জম্মু ও কাশ্মির আইনগত দৃষ্টিকোণ ছাড়া বাকি সকল দৃষ্টিকোণ থেকে পাকিস্তানের একটি অংশ। ভারতীয় এবং অন‍্যান‍্য পাকিস্তানবিরোধী গণমাধ্যমে দাবি করা হয় যে, পাকিস্তান আজাদ জম্মু ও কাশ্মিরকে জোরপূর্বক দখল করে রেখেছে এবং সেখানে গণতন্ত্র ও মানবাধিকারের ঘাটতি রয়েছে। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে, পাকিস্তানের অন‍্যান‍্য প্রদেশের সঙ্গে আজাদ জম্মু ও কাশ্মিরের গণতন্ত্র ও মানবাধিকারের মাত্রার তেমন কোনো পার্থক্য নেই, এবং অঞ্চলটির জনসাধারণের অধিকাংশ পাকিস্তানের সঙ্গে থাকতে আগ্রহী।


আজাদ জম্মু ও কাশ্মিরের বর্তমান রাষ্ট্রপতি মাসুদ খান ইতোপূর্বে একজন পাকিস্তানি কূটনীতিক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন; Source: The Nation 'জম্মু ও কাশ্মির' নামক দেশীয় রাজ‍্যটি ১৮৪৬ থেকে ১৯৪৭ সালের আগস্ট পর্যন্ত ব্রিটিশ–শাসিত ভারতের অন্তর্ভুক্ত ছিল। উল্লেখ্য, দেশীয় রাজ‍্য (princely state) বলতে ব্রিটিশ–শাসিত ভারতের সেই রাজ‍্যগুলোকে বোঝায়, যে রাজ‍্যগুলো অভ‍্যন্তরীণ প্রশাসনের ক্ষেত্রে বহুলাংশে স্বাধীন ছিল, কিন্তু ব্রিটিশ সাম্রাজ‍্যের আনুগত‍্য স্বীকার করত এবং ব্রিটিশদের নির্ধারিত নীতিতে চলত।

জম্মু ও কাশ্মির রাজ‍্যটির সংখ‍্যাগরিষ্ঠ অধিবাসী ছিলেন মুসলিম, কিন্তু হিন্দু, বৌদ্ধ, শিখ ও অন‍্যান‍্য ধর্মের অধিবাসীরাও রাজ‍্যটিতে বসবাস করত। রাজ‍্যটি শাসন করত একটি হিন্দু রাজবংশ এবং রাজ‍্যটির সমস্ত রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক ক্ষমতা হিন্দু অভিজাতদের হাতে কেন্দ্রীভূত ছিল। সংখ‍্যাগরিষ্ঠ মুসলিম সম্প্রদায়ের অধিকাংশই ছিল অত‍্যন্ত দরিদ্র।

১৯৪৭ সালে ভারতবর্ষের স্বাধীনতা লাভের প্রাক্কালে ভারতে এরকম মোট ৫৬৫টি দেশীয় রাজ‍্য ছিল এবং এই রাজ‍্যগুলোতে ছিল ব্রিটিশ–শাসিত ভারতের মোট ৪০% ভূমি ও ২৩% জনসংখ্যা। ভারত ছেড়ে যাওয়ার আগে ব্রিটিশরা এই রাজ‍্যগুলোকে তাদের জনসাধারণের ধর্মের ভিত্তিতে এবং ভৌগোলিক অবস্থান অনুযায়ী ভারত অথবা পাকিস্তান যেকোনো একটির সঙ্গে সংযুক্ত হওয়ার পরামর্শ প্রদান করে।

১৯৪৭ সালের ১৪ আগস্ট পাকিস্তান এবং ১৫ আগস্ট ভারত ব্রিটেনের কাছ থেকে স্বাধীনতা লাভ করে। অধিকাংশ দেশীয় রাজ‍্যই ব্রিটিশদের নির্দেশনা মোতাবেক ভারত অথবা পাকিস্তানের সঙ্গে যোগদান করে। কিন্তু কয়েকটি রাজ‍্য এর ব‍্যতিক্রম ছিল।


মানচিত্রে আজাদ জম্মু ও কাশ্মির; Source: Shutterstock ১৯৪৭ সালের ১৫ সেপ্টেম্বর আরব সাগরের তীরে অবস্থিত এবং ভারতের গুজরাত রাজ‍্য দ্বারা পরিবেষ্টিত হিন্দু–অধ‍্যুষিত জুনাগড় রাজ‍্যের মুসলিম নবাব পাকিস্তানের সঙ্গে 'অন্তর্ভুক্তি চুক্তি'তে (Instrument of Accession) স্বাক্ষর করেন এবং ১৬ সেপ্টেম্বর পাকিস্তান সেটি অনুমোদন করে। ভারত রাজ‍্যটির ওপর অবরোধ আরোপ করে এবং রাজ‍্যটির অভ‍্যন্তরে গোলযোগ সৃষ্টি করে, ফলে নবাব পালিয়ে যেতে বাধ‍্য হন এবং রাজ‍্যটি ভারতের হস্তগত হয়।

অন‍্যদিকে, মুসলিম–অধ‍্যুষিত জম্মু ও কাশ্মিরের হিন্দু রাজা ভারত বা পাকিস্তান কোনোটির সঙ্গেই যোগদান না করে ব্রিটিশ কমনওয়েলথের অধীনে একটি স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে থাকার ইচ্ছে প্রকাশ করেন। কিন্তু স্বাধীন থাকা সম্ভব না হলে তিনি পাকিস্তানের পরিবর্তে ভারতে যোগ দিতে আগ্রহী ছিলেন। এজন্য ১১ আগস্ট তিনি জম্মু ও কাশ্মিরের পাকিস্তানপন্থী প্রধানমন্ত্রী রামচন্দ্র কাককে বরখাস্ত করেন এবং তার স্থলে ২৫ আগস্ট ভারতপন্থী মেহের চান্দ মহাজনকে প্রধানমন্ত্রী নিযুক্ত করেন। ইতোমধ্যে রাজ‍্যটিতে মারাত্মক গোলযোগ দেখা দেয়।

বর্তমান আজাদ জম্মু ও কাশ্মিরের পুন্চ বিভাগটি তখন জম্মু ও কাশ্মির রাজ‍্যের জম্মু প্রদেশের অন্তর্ভুক্ত ছিল। পুন্চ প্রকৃতপক্ষে ছিল জম্মু ও কাশ্মিরের অধীনস্থ একটি স্বায়ত্তশাসিত 'জায়গির', কিন্তু ১৯৪০–এর দশকের প্রথম দিকে জম্মু ও কাশ্মিরের রাজা হরি সিং অঞ্চলটির স্বায়ত্তশাসন কেড়ে নিয়ে অঞ্চলটিকে জম্মু প্রদেশের অন্তর্ভুক্ত করে নেন। পুন্চ অঞ্চলটিতে প্রচুর মুসলিম বসবাস করত এবং দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলাকালে অঞ্চলটি থেকে প্রায় ৬০,০০০ মুসলিম ব্রিটিশ ভারতীয় সেনাবাহিনীতে যোগ দিয়েছিল।

যুদ্ধ শেষে এদেরকে সেনাবাহিনী থেকে ছাটাই করা হয় এবং রাজা হরি সিং যুদ্ধফেরত সৈন‍্যদেরকে ব্রিটিশ সরকারের কাছ থেকে প্রাপ‍্য অর্থ দিতে বা এদেরকে তার নিজস্ব সেনাবাহিনীতে আত্তীকৃত করে নিতে অস্বীকৃতি জানান। ফলে এরা অসন্তুষ্ট অবস্থায় পুন্চে ফিরে যায়।


আজাদ জম্মু ও কাশ্মির মনোমুগ্ধকর প্রাকৃতিক দৃশ‍্যাবলির জন‍্য প্রসিদ্ধ; Source: Natural Scenery of Pakistan ১৯৪৭ সালের প্রথমদিকে হরি সিং পুন্চ অঞ্চলে খাজনা বৃদ্ধি করেন এবং হরি সিং–এর সৈন‍্যরা রসদপত্র সরবরাহ না পাওয়ায় স্থানীয় জনসাধারণের কাছ থেকে খাদ‍্যদ্রব‍্য ও অন‍্যান‍্য সামগ্রী বাজেয়াপ্ত করতে শুরু করে। এর ফলে ঐ অঞ্চলের জনসাধারণের মধ‍্যে তীব্র ক্ষোভের সৃষ্টি হয়। এছাড়া, 'নিখিল জম্মু ও কাশ্মির মুসলিম কনফারেন্স' দলটি এসময় জম্মু প্রদেশের পুন্চ ও মিরপুর অঞ্চলে বিপুল জনপ্রিয় ছিল এবং এই দলটি পাকিস্তানের সঙ্গে যোগ দেয়ার জন্য জনসাধারণকে আহ্বান জানায়।

ইতোমধ্যে খাজনা আদায়কে কেন্দ্র করে অক্টোবরে পুন্চে বিদ্রোহ দেখা দেয় এবং রাজা হরি সিং–এর হিন্দু ও শিখ সৈন‍্যরা কঠোর হাতে বিদ্রোহ দমনের চেষ্টা করে। এতে ক্ষিপ্ত হয়ে বহুসংখ্যক যুদ্ধফেরত মুসলিম সৈন‍্য বিদ্রোহে যোগ দেয়। পুন্চ অঞ্চলের প্রায় পুরোটাই রাজার নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যায়।

১৯৪৭ সালের ৩ অক্টোবর পাকিস্তানের রাওয়ালপিন্ডিতে পুন্চ, মুজাফফরাবাদ ও মিরপুরে মুসলিম গোত্রপ্রধানরা মিলিত হয়ে 'আজাদ জম্মু ও কাশ্মির সরকার' গঠন করেন। খাজা গুলাম নবী গিলকার এই সরকারের রাষ্ট্রপতি এবং সর্দার মুহাম্মদ ইব্রাহিম খান প্রধানমন্ত্রী নিযুক্ত হন। কিন্তু গিলকার কয়েকদিনের মধ্যে শ্রীনগরে গ্রেপ্তার হন এবং পাকিস্তানের সঙ্গে বিরোধের কারণে এই সরকারটি বিলুপ্ত হয়ে যায়।

২৪ অক্টোবর পাল্লান্দ্রিতে আরেকটি 'আজাদ জম্মু ও কাশ্মির' সরকার গঠিত হয় এবং সর্দার ইব্রাহিম খান এই সরকারের রাষ্ট্রপতি নিযুক্ত হন। এই দিনটিকে বর্তমানে 'আজাদ কাশ্মির দিবস' হিসেবে পালন করা হয়।

এদিকে জম্মু ও কাশ্মির জুড়ে ব‍্যাপক সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা–হাঙ্গামা শুরু হয়। ১৯৪৭ সালের অক্টোবর ও নভেম্বরে জম্মু প্রদেশে উগ্রপন্থী হিন্দু ও শিখরা 'রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সঙ্ঘে'র (আরএসএস) পরিচালনায় এবং জম্মু ও কাশ্মিরের সরকার ও রাজকীয় সৈন‍্যবাহিনীর প্রত‍্যক্ষ সহায়তায় প্রায় ৫০,০০০ থেকে ১,০০,০০০ মুসলিমকে হত্যা করে। এই গণহত‍্যার মূল উদ্দেশ্য ছিল জম্মু প্রদেশের জনসংখ‍্যায় মুসলিমদের অনুপাত হ্রাস করা।


আজাদ জম্মু ও কাশ্মিরের প্রতিষ্ঠাতা ও প্রথম রাষ্ট্রপতি সর্দার মুহাম্মদ ইব্রাহিম খান; Source: Presidency of Azad Jammu & Kashmir জুনাগড়ে ভারতীয় সামরিক হস্তক্ষেপ, জম্মু ও কাশ্মিরের অভ‍্যন্তরে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা, পুন্চ বিদ্রোহ এবং আজাদ জম্মু ও কাশ্মির সরকার গঠন পাকিস্তানকে সরাসরি হস্তক্ষেপ করতে উৎসাহিত করে। ২২ অক্টোবর পাকিস্তানের তৎকালীন উত্তর–পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশ (বর্তমান খাইবার পাখতুনখোয়া) থেকে সশস্ত্র পশতুন অনিয়মিত যোদ্ধারা পাকিস্তানি সেনা কর্মকর্তাদের পরিচালনায় জম্মু ও কাশ্মির আক্রমণ করে এবং জম্মু ও কাশ্মিরের রাজকীয় সৈন‍্যবাহিনী তাদের গতিরোধ করতে ব‍্যর্থ হয়। পশতুন যোদ্ধারা বারামুল্লা দখল করে নেয়, যেটি রাজধানী শ্রীনগর থেকে মাত্র ৩২ কি.মি. দক্ষিণ–পশ্চিমে অবস্থিত ছিল। এখানে পৌঁছে তারা শ্রীনগরের দিকে অগ্রসর না হয়ে নিরর্থক হত‍্যাকাণ্ড ও লুটতরাজে লিপ্ত হয় এবং তাদের অগ্রযাত্রা থেমে যায়।

রাজা হরি সিং নিরুপায় হয়ে ২৬ অক্টোবর ভারতের সঙ্গে 'অন্তর্ভুক্তি চুক্তি'তে স্বাক্ষর করেন এবং ভারতীয় সৈন‍্যরা বিমানে করে শ্রীনগরে পৌঁছে। তাদের আক্রমণের মুখে পশতুন যোদ্ধারা পশ্চাৎপসরণে বাধ‍্য হয় এবং পাকিস্তানও জম্মু ও কাশ্মিরে সৈন‍্য প্রেরণ করে। নভেম্বরে পশতুন যোদ্ধা ও স্থানীয় উগ্রপন্থী মুসলিমরা মিরপুর অঞ্চলে গণহত‍্যা চালিয়ে প্রায় ২০,০০০ হিন্দু ও শিখকে হত‍্যা করে। এর ফলে এই অঞ্চলের হিন্দু ও শিখদের সংখ‍্যা একেবারেই হ্রাস পায়।

বেশ কয়েকটি আক্রমণ ও প্রতি–আক্রমণের পর জম্মু ও কাশ্মিরে ভারতীয় ও পাকিস্তানি সৈন‍্যদের অবস্থান স্থিতিশীল হয় এবং ১৯৪৯ সালের ৫ জানুয়ারি যুদ্ধবিরতি হয়। এসময় জম্মু ও কাশ্মিরের উত্তর ও পশ্চিমাংশ পাকিস্তানি নিয়ন্ত্রণে ছিল। জম্মু ও কাশ্মিরে দুই পক্ষের যে সীমানা ছিল, সেই 'নিয়ন্ত্রণ–রেখা'ই (Line of Control) এখন পাকিস্তানের আজাদ জম্মু ও কাশ্মির এবং ভারতের জম্মু ও কাশ্মির কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলের সীমারেখা। উল্লেখ্য, সেসময় গিলগিট–বালতিস্তান আজাদ জম্মু ও কাশ্মিরের অন্তর্ভুক্ত ছিল।

এসময় ভারতীয় জাতিসংঘের মধ‍্যস্থতায় কাশ্মির সমস‍্যা সমাধানের চেষ্টা চালায়। জাতিসংঘ জম্মু ও কাশ্মিরের ভাগ‍্য গণভোটের মাধ্যমে নির্ধারণ করার প্রস্তাব দেয়, এবং এর পূর্বশর্ত হিসেবে প্রথমে জম্মু ও কাশ্মির থেকে পাকিস্তানি সৈন‍্য সম্পূর্ণরূপে প্রত‍্যাহার এবং পরবর্তীতে ভারতীয় সৈন‍্য আংশিক রূপে প্রত্যাহার করতে বলে। ভারতের ওপর বিশ্বাস না থাকার কারণে পাকিস্তান আজাদ জম্মু ও কাশ্মির থেকে সৈন‍্য প্রত‍্যাহার করেনি, ফলে গণভোটও আর অনুষ্ঠিত হয়নি।

তথ্যসূত্র

সম্পাদনা